ধর্ম, আইন ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে ঘুষ অবৈধ by ইকতেদার আহমেদ
সব ধর্মেই ঘুষ ও দুর্নীতিকে অবৈধ গণ্য করে একে পরিহার করতে বলা হয়েছে। যে সমাজে দুর্নীতিবাজরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সে সমাজ অসুস্থ এবং সেখানে সৎ ও ন্যায়পরায়ণদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা কঠিন। স্কুলে নবম ও দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে আমাদের পাঠ্যসূচিতে মানবিক বিভাগের ছাত্রদের জন্য ইসলামিক স্টাডিজ নামক ১০০ নম্বরের বিষয় ছিল। ইসলামিক স্টাডিজ বইয়ে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ৪০টি হাদিস অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে একটির প্রধান পাঠ্যাংশ ছিল র্আরাশি ওয়াল মুরতাশি কিলা হুমা ফিন্নার। এর বাংলা অর্থ হল- ঘুষ দাতা ও ঘুষখোর উভয়েই জাহান্নামি (তাবারানি)।
হাদিসটি ব্যাখ্যা করলে অতি সহজেই বোঝা যায়, ইসলাম ঘুষ গ্রহণ বা প্রদান কোনোটিই অনুমোদন করে না। ইসলামে ঘুষ গ্রহণ ও ঘুষ প্রদানকারী উভয়কেই একই মাপের অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং আরও বলা হয়েছে, উভয়ের স্থান হবে জাহান্নামে। ইসলামের মতো অন্যান্য ধর্মও ঘুষ গ্রহণ ও প্রদান অনুমোদন করে না। যারা ধর্ম বিশ্বাস করে না, তারা নীতিশাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পৃথিবীতে এমন কোনো নীতিশাস্ত্রও নেই, যেখানে ঘুষ গ্রহণ বা প্রদানকে অনুমোদন করা হয়েছে। দেশে এখনও অধিকাংশ মানুষের বদ্ধমূল ধারাণা হল, ঘুষ গ্রহণ অপরাধ কিন্তু ঘুষ প্রদান অপরাধ নয়। ধর্ম ও আইন বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান বা শিক্ষার অভাবেই তাদের মধ্যে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।
ঘুষ ও দুর্নীতি সমার্থক। ঘুষের আদান-প্রদান নগদ টাকা বা দ্রব্য-সামগ্রীর মাধ্যমে হয়ে থাকে। একটি কাজ তখনই ঘুষের পর্যায়ে পড়বে যখন কাজটি করার জন্য কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তিকে নগদ বা দ্রব্য-সামগ্রীর মাধ্যমে কোনো কিছু দেয়ার জন্য বাধ্য করা হয়। আমাদের দেশে অনেক সময় দেখা যায়, ঘুষ প্রদান ছাড়া কাজ আদায় হচ্ছে না এবং দ্রুত কাজ আদায়ের জন্য একজন ভুক্তভোগী বাধ্য হয়ে ঘুষ দিচ্ছেন। একজন ব্যক্তি কোনো কাজ হাসিলের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কোনো ধরনের উপহার বা উপঢৌকন দিয়ে থাকলে তাও ঘুষ হিসেবে গণ্য হবে, যদিও এ ধরনের উপহার বা উপঢৌকন দেয়ার কোনো উপলক্ষ ইতিপূর্বে ছিল না এবং ভবিষ্যতেও থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আমাদের মূল দণ্ড আইন দণ্ডবিধি ১৮৬০-এ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এ ঘুষ অথবা ইৎরনব-কে অপরাধ হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়নি। দণ্ডবিধিতে ঘুষ অথবা Bribe-কে Gratification হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অপরদিকে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এ ঘুষ বা Bribe-কে Criminal Misconduct হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে। Gratification অর্থ সন্তুষ্টকরণ, উৎকোচ, বকশিশ ইত্যাদি। পক্ষান্তরে Criminal Misconduct অর্থ অপরাধমূলক অসদাচরণ।
উভয় আইনের ভাষায় বকশিশ বা অপরাধমূলক অসদাচরণ বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী হিসেবে যদি নিজ অথবা অপর কোনো ব্যক্তির জন্য তার বৈধ বেতনবহির্ভূত কোনো ধরনের বকশিশ গ্রহণ করে বা গ্রহণে সম্মত হয়, তবে সে বকশিশ গ্রহণ বা অপরাধমূলক অসদাচরণ করেছে বলে গণ্য হবে।
দণ্ডবিধি একটি সাধারণ আইন। এ আইনটি ঔপনিবেশিক শাসনামলে ১৮৬০ সালে প্রণীত হয়। দণ্ডবিধিতে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক বকশিশ বা ঘুষ গ্রহণের সর্বোচ্চ সাজা তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার বছর পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৪৭ সালে প্রণীত দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক অপরাধমূলক অসদাচরণের সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড বা অপরাধমূলক অসদাচরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পদের রাষ্ট্রের বরাবরে বাজেয়াপ্তি।
দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ একটি বিশেষ আইন হওয়ায় এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ১৬১-১৬৫ ধারায় বর্ণিত সরকারি কর্মচারী কর্তৃক কৃত অপরাধগুলো দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর ৫ ধারায় বর্ণিত অপরাধগুলোর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এসব অপরাধ ফৌজদারি আইন সংশোধন আইন ১৯৫৮-এর ৩ ধারা অনুযায়ী দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ অথবা সহকারী দায়রা জজ সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ জজ আদালত দ্বারা বিচার্য। তাছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর কতিপয় অপরাধ ফৌজদারি আইন সংশোধন আইন ১৯৫৮-এর তফসিলভুক্ত হওয়ায় প্রথমোক্ত দুটি আইনে বর্ণিত অপরাধগুলো এবং শেষোক্ত আইনের কতিপয় অপরাধ বিশেষ জজ আদালত দ্বারা বিচার্য।
বাংলাদেশসহ সব দেশে সমাজ গতিশীল। গতিশীল সমাজে আইন স্থবির হলে সে আইন সময় ও যুগের চাহিদা মেটাতে পারে না। তাই সময় ও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে আইনকে যুগোপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ প্রয়োজনীয়তা পূরণকল্পে ক্ষেত্রবিশেষে প্রচলিত আইনে সংযোজন, বিয়োজন বা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সংশোধনী আনা হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়।
দুর্নীতি সংক্রান্ত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার জন্য স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভূত হলে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন প্রণয়নপূর্বক দুর্নীতি দমন আইন ১৯৫৭ এবং দুর্নীতি দমন (ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৬০ রহিত করা হয়। বাংলায় প্রণীত এ আইনটিতেও ঘুষকে সজ্ঞায়িত না করে দুর্নীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, দুর্নীতি অর্থ এ আইনের তফসিলে উল্লেখিত অপরাধগুলো। উল্লেখ্য, এ আইনের তফসিলে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর অধীন কতিপয় ধারার শাস্তিযোগ্য অপরাধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আইনের ভাষায় সরকারি কর্মচারীদের যেসব কার্যকলাপকে বকশিশ বা অপরাধমূলক অসদাচরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সাধারণ্যে তা ঘুষ হিসেবে সমধিক পরিচিত।
বলতে দ্বিধা নেই, ঘুষ বা দুর্নীতি আজ বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। সরকারের এমন কোনো বিভাগ নেই যেখানে ঘুষ বা দুর্নীতির চর্চা নেই। কিছু মন্ত্রী ও সচিব ঘুষ বা দুর্নীতি মুক্ত হলেও তারা কি হলফ করে বলতে পারবেন তাদের অধস্তনরা ঘুষ বা দুর্নীতি মুক্ত? উপরস্থ যারা অধস্তনদের ঘুষ বা দুর্নীতি দূর করতে অসমর্থ, তাদের বলা হয় নির্লিপ্ত সৎ। নিজে সৎ থেকে অধস্তনকে দুর্নীতিমুক্ত না রাখার মতো নির্লিপ্ত সততা কোনো বিভাগের মন্ত্রী বা সচিবের ক্ষেত্রে কাম্য নয়।
বিগত বছরগুলোয় দেশের শেয়ারবাজার এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এসবের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবারই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর এ কারণেই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। শেয়ারবাজার ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই দুর্নীতির মাধ্যমে লাখো কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আজকাল অনেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে ঋণের টাকার শতকরা ৫-১০ ভাগ ব্যাংক কর্মকর্তাদের উৎকোচ বা ঘুষ হিসেবে না দিলে ঋণ মঞ্জুর হয় না। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। বাংলাদেশ ব্যাংক আহূত একটি মতবিনিময় সভায় সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্ণধারকে বলতে শোনা গেছে ঘুষ অবৈধ নয়। তিনি এ কথা বলে ঘুষকে পাশ্চাত্যের Speed money-র সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি আশা করেন, আমাদের দেশের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে যদি স্পিড মানি দেয়া হয় সেক্ষেত্রে কাজটি দ্রুত সম্পন্ন হবে। পাশ্চাত্যে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে তাদের স্পিড মানি দিয়ে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করতে অথবা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত যেন পক্ষে হয় সে উদ্দেশ্যে লবিস্টদের স্পিড মানি দেয়া হয়। এটি পাশ্চাত্যে আইন দ্বারা স্বীকৃত এবং বৈধ হিসেবে বিবেচ্য। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের সরকার ও বিরোধী দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো যাতে তাদের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সে বিষয়ে মাঝে মাঝে লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। এ ধরনের লবিস্ট নিয়োগ সেসব দেশের আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে হয় এবং এটি ঠিক যে, পাশ্চাত্যে এটিকে ঘুষ বা দুর্নীতি বলা হয় না। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, পাশ্চাত্যের সমাজ ব্যবস্থা ও আইন-কানুন আমাদের সমরূপ নয়। পাশ্চাত্যে যেটি অপরাধ নয়, আমাদের দেশে সেটি অপরাধ। আমাদের কোনো আইনে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত কাজ আদায়ের জন্য স্পিড মানি দেয়ার বিধান নেই।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্ণধার ঘুষ অবৈধ নয় এমন উক্তি করার পর থেকে দেশে যারা ঘুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের অনেকেই উৎসাহিত হয়েছেন এবং এ ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, কর্ণধার উক্তিটি করার পরদিন কোনো বকেয়া টেলিফোন বিল না থাকা সত্ত্বেও বিল না দেয়ার মিথ্যা অজুহাতে অনেক টেলিফোন লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। ভুক্তভোগীদের অনেকে যখন সর্বশেষ বিল পরিশোধের দালিলিক প্রমাণ দাখিল করেন, তখন টেলিফোন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের বলতে শোনা গেছে, চা-নাস্তার টাকা দিয়ে যান, সন্ধ্যা নাগাদ টেলিফোন লাইন ঠিক হয়ে যাবে। কোনো মন্ত্রণালয়ের কর্ণধারেরই এমন কোনো উক্তি করা উচিত নয়, যা ধর্মীয় ও আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অনুমোদিত নয় এবং যা অধস্তনদের ঘুষ বা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করে। আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের যেসব ঊর্ধ্বতন পদধারী রয়েছেন, দেশ ও সমাজের প্রতি অধস্তনদের তুলনায় তাদের দায়িত্ব বেশি। আর সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের অবশ্যই ধর্মীয় অনুশাসন ও আইনের বিধিবিধানের প্রতি সম্মান রেখে কথা বলতে হবে। ধর্মীয় ও আইনের বিধিবিধানের লংঘন ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন কারও ক্ষেত্রেই কাম্য নয়।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
হাদিসটি ব্যাখ্যা করলে অতি সহজেই বোঝা যায়, ইসলাম ঘুষ গ্রহণ বা প্রদান কোনোটিই অনুমোদন করে না। ইসলামে ঘুষ গ্রহণ ও ঘুষ প্রদানকারী উভয়কেই একই মাপের অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং আরও বলা হয়েছে, উভয়ের স্থান হবে জাহান্নামে। ইসলামের মতো অন্যান্য ধর্মও ঘুষ গ্রহণ ও প্রদান অনুমোদন করে না। যারা ধর্ম বিশ্বাস করে না, তারা নীতিশাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পৃথিবীতে এমন কোনো নীতিশাস্ত্রও নেই, যেখানে ঘুষ গ্রহণ বা প্রদানকে অনুমোদন করা হয়েছে। দেশে এখনও অধিকাংশ মানুষের বদ্ধমূল ধারাণা হল, ঘুষ গ্রহণ অপরাধ কিন্তু ঘুষ প্রদান অপরাধ নয়। ধর্ম ও আইন বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান বা শিক্ষার অভাবেই তাদের মধ্যে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।
ঘুষ ও দুর্নীতি সমার্থক। ঘুষের আদান-প্রদান নগদ টাকা বা দ্রব্য-সামগ্রীর মাধ্যমে হয়ে থাকে। একটি কাজ তখনই ঘুষের পর্যায়ে পড়বে যখন কাজটি করার জন্য কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তিকে নগদ বা দ্রব্য-সামগ্রীর মাধ্যমে কোনো কিছু দেয়ার জন্য বাধ্য করা হয়। আমাদের দেশে অনেক সময় দেখা যায়, ঘুষ প্রদান ছাড়া কাজ আদায় হচ্ছে না এবং দ্রুত কাজ আদায়ের জন্য একজন ভুক্তভোগী বাধ্য হয়ে ঘুষ দিচ্ছেন। একজন ব্যক্তি কোনো কাজ হাসিলের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কোনো ধরনের উপহার বা উপঢৌকন দিয়ে থাকলে তাও ঘুষ হিসেবে গণ্য হবে, যদিও এ ধরনের উপহার বা উপঢৌকন দেয়ার কোনো উপলক্ষ ইতিপূর্বে ছিল না এবং ভবিষ্যতেও থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আমাদের মূল দণ্ড আইন দণ্ডবিধি ১৮৬০-এ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এ ঘুষ অথবা ইৎরনব-কে অপরাধ হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়নি। দণ্ডবিধিতে ঘুষ অথবা Bribe-কে Gratification হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অপরদিকে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এ ঘুষ বা Bribe-কে Criminal Misconduct হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে। Gratification অর্থ সন্তুষ্টকরণ, উৎকোচ, বকশিশ ইত্যাদি। পক্ষান্তরে Criminal Misconduct অর্থ অপরাধমূলক অসদাচরণ।
উভয় আইনের ভাষায় বকশিশ বা অপরাধমূলক অসদাচরণ বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী হিসেবে যদি নিজ অথবা অপর কোনো ব্যক্তির জন্য তার বৈধ বেতনবহির্ভূত কোনো ধরনের বকশিশ গ্রহণ করে বা গ্রহণে সম্মত হয়, তবে সে বকশিশ গ্রহণ বা অপরাধমূলক অসদাচরণ করেছে বলে গণ্য হবে।
দণ্ডবিধি একটি সাধারণ আইন। এ আইনটি ঔপনিবেশিক শাসনামলে ১৮৬০ সালে প্রণীত হয়। দণ্ডবিধিতে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক বকশিশ বা ঘুষ গ্রহণের সর্বোচ্চ সাজা তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার বছর পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৪৭ সালে প্রণীত দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক অপরাধমূলক অসদাচরণের সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড বা অপরাধমূলক অসদাচরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পদের রাষ্ট্রের বরাবরে বাজেয়াপ্তি।
দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ একটি বিশেষ আইন হওয়ায় এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ১৬১-১৬৫ ধারায় বর্ণিত সরকারি কর্মচারী কর্তৃক কৃত অপরাধগুলো দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর ৫ ধারায় বর্ণিত অপরাধগুলোর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এসব অপরাধ ফৌজদারি আইন সংশোধন আইন ১৯৫৮-এর ৩ ধারা অনুযায়ী দায়রা জজ অথবা অতিরিক্ত দায়রা জজ অথবা সহকারী দায়রা জজ সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ জজ আদালত দ্বারা বিচার্য। তাছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর কতিপয় অপরাধ ফৌজদারি আইন সংশোধন আইন ১৯৫৮-এর তফসিলভুক্ত হওয়ায় প্রথমোক্ত দুটি আইনে বর্ণিত অপরাধগুলো এবং শেষোক্ত আইনের কতিপয় অপরাধ বিশেষ জজ আদালত দ্বারা বিচার্য।
বাংলাদেশসহ সব দেশে সমাজ গতিশীল। গতিশীল সমাজে আইন স্থবির হলে সে আইন সময় ও যুগের চাহিদা মেটাতে পারে না। তাই সময় ও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে আইনকে যুগোপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ প্রয়োজনীয়তা পূরণকল্পে ক্ষেত্রবিশেষে প্রচলিত আইনে সংযোজন, বিয়োজন বা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সংশোধনী আনা হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়।
দুর্নীতি সংক্রান্ত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার জন্য স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভূত হলে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন প্রণয়নপূর্বক দুর্নীতি দমন আইন ১৯৫৭ এবং দুর্নীতি দমন (ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৬০ রহিত করা হয়। বাংলায় প্রণীত এ আইনটিতেও ঘুষকে সজ্ঞায়িত না করে দুর্নীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, দুর্নীতি অর্থ এ আইনের তফসিলে উল্লেখিত অপরাধগুলো। উল্লেখ্য, এ আইনের তফসিলে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর অধীন কতিপয় ধারার শাস্তিযোগ্য অপরাধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আইনের ভাষায় সরকারি কর্মচারীদের যেসব কার্যকলাপকে বকশিশ বা অপরাধমূলক অসদাচরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সাধারণ্যে তা ঘুষ হিসেবে সমধিক পরিচিত।
বলতে দ্বিধা নেই, ঘুষ বা দুর্নীতি আজ বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। সরকারের এমন কোনো বিভাগ নেই যেখানে ঘুষ বা দুর্নীতির চর্চা নেই। কিছু মন্ত্রী ও সচিব ঘুষ বা দুর্নীতি মুক্ত হলেও তারা কি হলফ করে বলতে পারবেন তাদের অধস্তনরা ঘুষ বা দুর্নীতি মুক্ত? উপরস্থ যারা অধস্তনদের ঘুষ বা দুর্নীতি দূর করতে অসমর্থ, তাদের বলা হয় নির্লিপ্ত সৎ। নিজে সৎ থেকে অধস্তনকে দুর্নীতিমুক্ত না রাখার মতো নির্লিপ্ত সততা কোনো বিভাগের মন্ত্রী বা সচিবের ক্ষেত্রে কাম্য নয়।
বিগত বছরগুলোয় দেশের শেয়ারবাজার এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এসবের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবারই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর এ কারণেই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। শেয়ারবাজার ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই দুর্নীতির মাধ্যমে লাখো কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আজকাল অনেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে ঋণের টাকার শতকরা ৫-১০ ভাগ ব্যাংক কর্মকর্তাদের উৎকোচ বা ঘুষ হিসেবে না দিলে ঋণ মঞ্জুর হয় না। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। বাংলাদেশ ব্যাংক আহূত একটি মতবিনিময় সভায় সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্ণধারকে বলতে শোনা গেছে ঘুষ অবৈধ নয়। তিনি এ কথা বলে ঘুষকে পাশ্চাত্যের Speed money-র সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি আশা করেন, আমাদের দেশের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে যদি স্পিড মানি দেয়া হয় সেক্ষেত্রে কাজটি দ্রুত সম্পন্ন হবে। পাশ্চাত্যে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে তাদের স্পিড মানি দিয়ে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করতে অথবা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত যেন পক্ষে হয় সে উদ্দেশ্যে লবিস্টদের স্পিড মানি দেয়া হয়। এটি পাশ্চাত্যে আইন দ্বারা স্বীকৃত এবং বৈধ হিসেবে বিবেচ্য। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের সরকার ও বিরোধী দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো যাতে তাদের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সে বিষয়ে মাঝে মাঝে লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। এ ধরনের লবিস্ট নিয়োগ সেসব দেশের আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে হয় এবং এটি ঠিক যে, পাশ্চাত্যে এটিকে ঘুষ বা দুর্নীতি বলা হয় না। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, পাশ্চাত্যের সমাজ ব্যবস্থা ও আইন-কানুন আমাদের সমরূপ নয়। পাশ্চাত্যে যেটি অপরাধ নয়, আমাদের দেশে সেটি অপরাধ। আমাদের কোনো আইনে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত কাজ আদায়ের জন্য স্পিড মানি দেয়ার বিধান নেই।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্ণধার ঘুষ অবৈধ নয় এমন উক্তি করার পর থেকে দেশে যারা ঘুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের অনেকেই উৎসাহিত হয়েছেন এবং এ ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, কর্ণধার উক্তিটি করার পরদিন কোনো বকেয়া টেলিফোন বিল না থাকা সত্ত্বেও বিল না দেয়ার মিথ্যা অজুহাতে অনেক টেলিফোন লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। ভুক্তভোগীদের অনেকে যখন সর্বশেষ বিল পরিশোধের দালিলিক প্রমাণ দাখিল করেন, তখন টেলিফোন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের বলতে শোনা গেছে, চা-নাস্তার টাকা দিয়ে যান, সন্ধ্যা নাগাদ টেলিফোন লাইন ঠিক হয়ে যাবে। কোনো মন্ত্রণালয়ের কর্ণধারেরই এমন কোনো উক্তি করা উচিত নয়, যা ধর্মীয় ও আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে অনুমোদিত নয় এবং যা অধস্তনদের ঘুষ বা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করে। আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের যেসব ঊর্ধ্বতন পদধারী রয়েছেন, দেশ ও সমাজের প্রতি অধস্তনদের তুলনায় তাদের দায়িত্ব বেশি। আর সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের অবশ্যই ধর্মীয় অনুশাসন ও আইনের বিধিবিধানের প্রতি সম্মান রেখে কথা বলতে হবে। ধর্মীয় ও আইনের বিধিবিধানের লংঘন ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন কারও ক্ষেত্রেই কাম্য নয়।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
No comments