সাগরপথে বিদেশযাত্রা- সিরাজগঞ্জের ৪০০ লোক নিখোঁজ
হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধ কারী মো. আবদুল আজিজ। বললেন, দিনমজুরের কাজ করে সংসার চলে তার। দিন আনা দিন খাওয়া সংসার। সঞ্চয় নেই একটা টাকাও। ছেলে আহম্মদ আলী তাকে দিনমজুরের কাজে সহযোগিতা করে। সেই ছেলেই আজ নিখোঁজ অনেক দিন ধরে। এর মধ্যে ছেলের সঙ্গে বৃদ্ধ আজিজের কথা হয়েছে মাত্র একবার। জানতে পেরেছেন দালাল চক্র তার ছেলেকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে জিম্মি করেছে। এখন তারা মুক্তিপণ চায়। ছেলেকে ফেরত পেতে তাই বৃদ্ধ পিতা উচ্চসুদে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ছেলের খোঁজ মেলেনি আজও। ছেলেটি তার বেঁচে আছে কিনা জানতেও পারেন নি। এ ধরনের কাহিনী সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় ৪০০০ পরিবারে। গতকাল বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে মানুষের জন্য-এর সহযোগিতায় রামরু আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দালালের খপ্পরে পড়া ভুক্তভোগীর স্বজনরা এভাবেই বর্ণনা করেন করুণ কাহিনী। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় সমুদ্র শান্ত থাকার কারণে অক্টোবর থেকে জানুয়ারির সময়টাতে দালাল চক্র মরিয়া হয়ে ওঠে লোক সংগ্রহে। রামরুর অনুসন্ধানে দেখা যায় এ জেলার ৭টি উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রাম থেকেই পাচারের শিকার হয়েছেন তরুণরা। তাদের মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পরিবারগুলোর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকা। ৭ উপজেলা থেকে প্রায় ৪০০০ তরুণ এ প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছে। এদের মধ্যে এখনও নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় ৪০০ জন। টিকরির চর গ্রামের আবদুল আজিজ জানান, তার ছেলে আহম্মদ আলী তার সঙ্গেই শহরে দিনমজুরের কাজ করতো। একদিন ছেলে তাকে বলে ‘তুমি কাজে যাও আমি পরে আসছি।’ পরে আর সে কাজে যোগ দেয়নি। পরে স্থানীয় শাহাদাত নামে এক ব্যক্তি তাকে ফোন করে জানায়, তার ছেলে মালয়েশিয়া যাচ্ছে। পরে বাড়ি ফিরে ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে সে অস্বীকার করে। অনেক জোরাজুরির পর সদরের কল্যাণপুর এলাকার দালাল ফয়সালের বাড়িতে নিয়ে যায়। দালাল তাদের জানায়, আহম্মদের সঙ্গে সবুজ, নজরুল ও মণি নামে আরও ৩ জন রয়েছে। তারা এখন কোথায় আছে জানতে চাইলে দালাল ফয়সাল তাদের বলে আমি তাদের খোঁজ করছি। তাদের ফেরত পেতে টাকা যোগাড় করেন। দিনমজুর আবদুল আজিজ বলেন, বহু কষ্ট করে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে ৪০ হাজার টাকা যোগাড় করেছি। কিন্তু ছেলের কোন খোঁজ পাইনি। এ জন্য টাকাও দেননি বলে জানান তিনি। বৃদ্ধ পিতা আরও জানান, তার সামনেই দু’জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে দালাল ফয়সাল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তার ছেলে বেঁচে আছে কিনা সে খবরও জানেন না তিনি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে এনায়েতপুর উপজেলার রাজু জানান, তার ভাই রমজান তাঁতের কাজ করতো। গত ৬ মাস আগে একদিন কাজে গিয়ে তার ভাই আর ফিরে আসেনি। অনেক দিন তার কোন খোঁজ ছিল না। প্রায় ২ মাস পর একটি মোবাইল নম্বর থেকে তাদের কাছে ফোন আসে। তাতে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। তার ভাই তাকে জানায়, ওই টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলবে। তিনি বলেন, ওই সময় তার ভাইয়ের ওপর নির্যাতন চলছিল। তারা ওই টাকা দিয়েছেন বলেও দাবি করেন। শাহজাদপুর উপজেলার সাতবাড়িয়ার জব্বার আলী জানান, তার ভাইও তাঁতের কাজ করতো। একদিন কাজে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। অন্যের মাধ্যমে টিফিন ক্যারিয়ার পাঠিয়ে দিয়ে বলে সে মালয়েশিয়া যাচ্ছে। এরপর খোঁজখবর নিলে আশপাশের লোকজনও স্বীকার করেনি সে কোথায় গেছে। এরপর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার ভাইয়ের। ৩৫-৪০ দিন পর একটি নম্বর থেকে তার ভাই ফোন করে। সে বলে টাকা দিলে তাকে মুক্তি দেবে দালালরা। পরে একজন ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করে। সে মোতাবেক ধারদেনা করে কয়েক দফায় ওই টাকা পাঠালেও তাকে ফেরত পায়নি। এরপর থেকে নম্বরটি বন্ধ। ভিকটিমের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই তাদের। মুসলিম পরামাণিক জানান, তার ছেলে নজরুল জানিয়েছে সে থাইল্যান্ডের জেলে বন্দি রয়েছে। তাকে দেশে ফিরিয়ে দিতে দালালদের দাবি মোতাবেক সুদে টাকা নিয়ে ২ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এরপর থেকে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। সানোয়ার হোসেনের ছেলে নবী হোসেন (২৭) তাঁতের কাজ করতো। সে-ও একজনকে দিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার পাঠিয়ে দেয়। সানোয়ার হোসেন বলেন, তিনি ওই খবর শোনার পর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। ১৭ দিন পর ছেলে ফোন করে তাকে বলে যদি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা না দেয়া হয় তবে ওরা তাকে মেরে ফেলবে। ছেলে তাকে আরও জানায়, তার সামনেই ৩ জনকে মেরে ফেলেছে। পরে তিন কিস্তিতে বিকাশের মাধ্যমে তিনি ওই টাকা দেন। কিন্তু এরপর থেকে ছেলের আর খোঁজ পাননি। ছোট্ট একটি সন্তান কোলে করে এসেছিলেন রহিমা বেগম। তিনি জানান, তার স্বামী শফিকুল একদিন বিকালে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। অনেক দিন তাকে না পাওয়ায় সবাই ধারণা করেন ট্রলারে করে মালয়েশিয়া গেছে। পরে হঠাৎ করে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন করে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। সুদে ওই টাকা নিয়ে পাঠানো হয়। কয়েক দিন পর তার স্বামী তাকে ফোন করে বলে সে এখন জেলে আছে। গণি মিয়া বলেন, তার ভাইপো শাহিনের মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ নেই। নিখোঁজ হওয়ার অনেক দিন পর সংবাদ আসে সে এখন ট্রলারে আছে। দালালরা ২ লাখ টাকা চেয়েছে। এলাকায় সাহায্য চেয়ে ওই টাকা দিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। এরপর থেকে তার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগও হয়নি। উপস্থিত ভিকটিম পরিবারের সদস্যদের বেশি ভাগের বাড়ি প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে। তাদের সংসার চলে দিন আনা দিন খাওয়াভাবে। সিরাজগঞ্জের স্থানীয় এনজিও ডেভেলপমেন্ট ফর ডিজঅ্যাবিলিটি পিপল (ডিডিপি)-এর নির্বাহী পরিচালক কাজী সোহেল রানা জানান, তিনি ৭ উপজেলার প্রতিটি গ্রামেই এ ধরনের ভয়াবহ চিত্র পেয়েছেন। তিনি বলেন, প্রশাসনের ওপর আস্থা নেই বলে তারা কেউ সেখানে যান না। এ ছাড়া দালালচক্রের ভয়ে অনেকেই মুখ খুলতে চান না। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বক্তারা বলেন, অবৈধ এ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় দালাল চক্র প্রতি বছর ৫০ হাজার বিলিয়ন টাকার ব্যবসা করে। দেশীয় দালালদের পাশাপাশি রয়েছে বিশাল আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। এর সঙ্গে যেই দায়ী হোক না কেন তাকেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। তারা বলেন, দালালরা বিভিন্ন সময় ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে আসছে। তারা হুঁশিয়ারি দেন এর মধ্যে সন্তোষজনক কোন ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে দেখা না গেলে আগামী ১৮ই ডিসেম্বর অভিবাসী দিবসে কালো ব্যাজ ধারণের মতো কর্মসূচিও তারা নেবেন। রামরুর চেয়ার অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকীর পরিচালনায় বক্তারা এ অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে বেশ কয়েকটি সুপারিশমালাও পেশ করা হয়।
No comments