কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল বিএনপি
আন্দোলন কর্মসূচিতে রাজপথে নামেন না বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। পুলিশের গুলির অজুহাত দেখিয়ে দায়সারা গোছের বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব সারেন। ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর নতুন সরকারের আমলে বিএনপির ডাকা একমাত্র হরতালেও রাজপথে দেখা যায়নি কোন কেন্দ্রীয় নেতাকে। এমনকি সর্বশেষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশের অনুমতি না দেয়ার প্রতিবাদে ডাকা বিক্ষোভ মিছিলেও দেখা যায়নি তাদের। কর্মসূচিগুলোতে গলির ভেতর ব্যানার শো’র মাধ্যমে ফটোসেশন করে গণমাধ্যমে প্রেস রিলিজ পাঠান ঢাকা মহানগরের নেতারা। অন্যদিকে ব্যতিক্রম জেলা বিএনপির নেতারা। পুলিশের গুলির ভয় উপেক্ষা করে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালন করছেন নিয়মিত। এমনকি গুলিবিদ্ধ হয়েও আহত অবস্থায় রাজপথের মিছিলে অংশ নেন তারা। ফলে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতারা। এখন প্রকাশ্যেই এ ক্ষোভ ঝাড়ছেন তারা। নাটোরের জনসভায় খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক ও নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, আগামীতে ঢাকার নেতারা যদি আন্দোলন করতে ব্যর্থ হন তাহলে আমাদের বলবেন, আমরা জেলার নেতারা গিয়ে ঢাকা ঘেরাও করবো, পাশাপাশি ঢাকার নেতাদের ঘেরাও করবো। শুধু তৃণমূল বিএনপি নয়, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন খোদ চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বৃহস্পতিবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কেন্দ্রীয় ভূমিকার সমালোচনা করেন তিনি। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, সারা দেশের মানুষ আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা সবাই প্রস্তুত। আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। আন্দোলন কর্মসূচি দিলে আপনারা কেউ মাঠে নামছেন না। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর রাজপথে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেননি। আগামীতে আপনারা নামেন আর না নামেন আমি দেশবাসীকে নিয়ে রাজপথে নামবো। নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে চেয়ারপারসনের এক উপদেষ্টা বলেন, আমাদের নিজেদের লজ্জা হয়। এলাকায় গেলে সাধারণ মানুষ আমাদের গালি দেয়। আমরা আন্দোলন করতে পারছি না। এছাড়া বিদেশীদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না। বিদেশীরা আমাদের বলছে, তোমরা তো আন্দোলন করতে পারছো না। কিন্তু দেশের মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। দলীয় ফোরামের আলোচনা সভায় নেতাকর্মীরা স্বীকার করেছেন, গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনেও সফল হয়েছিলেন জেলার নেতারা। প্রায় দুই মাস সারা দেশ থেকে রাজধানী ঢাকাকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন তারা। চূড়ান্ত কর্মসূচি হিসেবে রাজধানীতে ২৯শে ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু পুলিশের গুলির ভয়ে ঘর থেকে বের হননি ঢাকার নেতারা। ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণের জন্য ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ অঙ্গ সংগঠনগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। এ সময় খালেদা জিয়ার সামনে সব সারির নেতাই রাজপথে না নামার জন্য পুলিশের গুলির ভয়কে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করান। কিন্তু এই নতুন সরকারের আমলেও রাজপথে নামেননি ঢাকার নেতারা। গত ২১শে সেপ্টেম্বর বিচারপতিদের অভিশংসনের প্রতিবাদে হরতাল ডাকে বিএনপি। ওই হরতালের সমর্থনে গাজীপুরের জোড়পুকুর এলাকায় বিএনপি নেতা আবদুস সালাম শামীমের নেতৃত্বে মিছিল বের করেন দলের নেতাকর্মীরা। এ সময় পুলিশের কয়েকজন এসআই ও কনস্টেবল বিএনপি নেতাদের বলেন, কোন মিছিল করবেন না, করলে গুলি করে দেবো, নতুন এসপি স্যারের নির্দেশ আছে। এরপরও পুলিশি গুলির ভয় করেননি গাজীপুর জেলা বিএনপির নেতারা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে না দেয়ার প্রতিবাদে গত ১০ই নভেম্বর কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন গাজীপুর জেলা নেতারা। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ওই মিছিলে পুলিশ গুলিতে গাজীপুরের সিটি মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা প্রফেসর এমএ মান্নান, নারী কাউন্সিলর শিরিন চাকলাদার, বিএনপি নেতা ইউনুছ আলী, জাহাঙ্গীর আলম, বিজয় চক্রবর্তী ও রাশেদা বেগমসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। একই দিন পুলিশের গুলির ভয় উপেক্ষা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতারা। সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অমর কৃষ্ণ দাসের নেতৃত্বে ইবি রোডের দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পুলিশ বিনা উস্কানিতে ওই মিছিলেও রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছোড়ে। এতে ১০-১২ জন নেতাকর্মী আহত হন। একই দিন পুলিশি ব্যারিকেড উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন বরিশাল জেলা বিএনপির নেতারা। মহানগর বিএনপি’র সভাপতি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ারের নেতৃত্বে সহস্রাধিক নেতাকর্মী মিছিল বের করেন। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ওই মিছিলে বাধা দেয় পুলিশ। কিন্তু নেতাকর্মীরা পিছপা হননি। পুলিশের ব্যারিকেড ঠেলে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তিনি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। ১লা অক্টোবর লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে যশোরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। শান্তিপূর্ণ ওই বিক্ষোভ মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। এতে যুবদল কর্মী কামাল হোসেনসহ অন্তত ৫ জন আহত হন। গত বছরের ২৭শে অক্টোবর অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করেন রাজশাহী জেলা বিএনপির নেতারা। ওই দিনে পুলিশের রাবার বুলেটে আহত হন সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। টানা অবরোধের দ্বিতীয় দিন বিএনপির মিছিলে অংশ নেন আহত মেয়র বুলবুল। পরদিনের মিছিলেও গুলি চালায় পুলিশ। ওই দিন শটগানের গুলিতে ফের বিদ্ধ হন মেয়র বুলবুলসহ ২০ জন নেতাকর্মী । রাজশাহীর সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মানবজমিনকে বলেন, ঢাকায় আমাদের দলের সাংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী করা প্রয়োজন। ঢাকার নেতাদের জন্য আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতার রূপ পাচ্ছে না। আগামীতে আন্দোলন কর্মসূচিতে তাদের আরও জোরালোভাবে মাঠে নামতে হবে। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি এড. তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, আমরা পুলিশের গুলির ভয় করি না। পুলিশের গুলি ভয় উপেক্ষা করে কেন্দ্র ঘোষিত প্রতিটি কর্মসূচি পালন করছি। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা ভয় পান। তিনি বলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশির ভাগ সুবিধাবাদী। তারা দলের বড় বড় পদ দখল করে আছেন। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে নামেন না। যারা রাজপথে নামেন না তাদের দলের পদ থেকে সরিয়ে যারা তৃণমূলে আন্দোলন-সংগ্রাম করেন তাদেকে দায়িত্ব দেয়ার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে আহ্বান জানাবো। গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়্যেদুল আলম বাবুল বলেন, পুলিশের দমন-পীড়নের ভয়ে ঢাকার নেতারা রাজপথে নামছেন না। তবে আন্দোলন সফল করতে হলে তাদেরকে আরও ব্যাপকভাবে রাজপথে নামতে হবে। আশা করছি, শিগগিরই কৌশল নির্ধারণ করে আগামীর কর্মসূচিগুলোতে নামবেন তারা। নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল বলেন, আমরা জীবনকে তুচ্ছ করে রাজপথে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করি। আর কেন্দ্রীয় নেতারা স্বপ্নে ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাজনীতি করছেন। এভাবে অবৈধ সরকারের পতন হবে না। মাথায় সমস্যা রেখে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেললে সমস্যার সমাধান হবে না।
No comments