অসুস্থ রাজনীতি থেকে ছাত্রদের বাঁচান
ছাত্র
রাজনীতির নামে এ কি হচ্ছে? ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারে নির্বিঘ্নে চলছে
অস্ত্রের মহড়া। পাশাপাশি টেন্ডারবাজি, ভর্তি-নিয়োগ-বাণিজ্য, হলদখল এবং
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতর-বাইরে চাঁদাবাজি করাটা যেন ছাত্র সংগঠনের
নেতাকর্মীদের‘ রুটিনওয়ার্ক’। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ
নিরীহ শিক্ষার্থীরা। দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অকালে ঝরে গেছে অসংখ্য
শিক্ষার্থীর প্রাণ। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব জীবনযাপন করছে অনেকে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রায় সময়ই বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল
কলেজসহ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অথচ শহর বা গ্রামের মধ্যবিত্ত,
নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র বাবা-মা কত না রঙিন স্বপ্ন নিয়ে তাদের সন্তানদের
পাঠান এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সন্তানের পড়ালেখার খরচ জোগাতে কোনো কোনো সময়
গ্রামের দরিদ্র কৃষক পিতা বিক্রি করে দেন ফসলি জমি, বন্ধক রাখেন ভিটেমাটি।
আর শহরের চাকরিজীবী বাবার পেনশন ফান্ডের টাকা ফুরিয়ে এলে, হাত পড়ে মায়ের
স্বর্ণ-অলঙ্কারেও। অসুস্থ ছাত্র রাজনীতির সর্বশেষ শিকার সুমন চন্দ্র দাস।
বৃহস্পতিবার শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্র“পের সংঘর্ষে অকালে
মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সিলেটের হাওরপারের কৃষক পরিবারের একমাত্র ছেলে সুমন।
পিতা-মাতার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন মুহূর্তেই কেড়ে নিয়েছে সুমনের
রাজনৈতিক সহকর্মীদের অস্ত্র। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের
পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ছয় বছরে সুমনের মতো হত্যার শিকার হয়েছে ১৬৭ জন ও আহত
হয়েছে ১৩,৩৪৫ জন। আর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১০৮০টি।
গত প্রায় দুই যুগ ধরে অসুস্থ রাজনীতির অন্ধগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ নিয়েই নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী। এখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আছে বলে তাণ্ডব চালাচ্ছে ছাত্রলীগ। যখন বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারে ছিল, তখনও একই স্টাইলে তাণ্ডব চালিছে ছাত্রদল। অপকর্মের মঞ্চ ও স্ক্রিপ্ট থাকে অপরিবর্তিত, শুধু বদল হয় অভিনেতা-অভিনেত্রী।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতির সব অতীত গৌরব আজ ধূলিসাৎ হওয়ার উপক্রম। অথচ কী ঝকঝকে ছিল ছাত্র রাজনীতির চেহারা! বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এ দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল ছাত্ররা। এমনকি কোনো কোনো ঐতিহাসিক আন্দোলনে তারা জাতীয় রাজনীতিকেও পথ দেখিয়েছে। ভাষা আন্দোলন- মাকে মায়ের ভাষায় মা ডাকার অধিকারের আন্দোলনটি শুরু করেছিল ছাত্রলীগ। জিন্নাহ সাহেব উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা (তৎকালীন পাকিস্তানের) ঘোষণা দেয়ার প্রাক্কালে যে ‘না’ শব্দটি, উচ্চারিত হয়েছিল সেটিও ছিল নাঈমউদ্দিনের মুখে। তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তখন ছাত্রলীগ ছাড়া সাংগঠনিক অবকাঠামোয় অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়নি। ’৫৪-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে একত্রিত করার গৌরবদীপ্ত দায়িত্বটিও পালন করেছিল ছাত্রসমাজ। এর অগ্রণী ভূমিকায় ছিল ছাত্রলীগ। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের নামে যে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনটি তৈরি হয়েছিল, সেটিতেও ছাত্র সমাজের কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়। ’৬৯-এর অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানে ১১ দফার মধ্যে ৬ দফাকে সন্নিবেশিত করার গৌরবও ছাত্রলীগের। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ছাত্র সমাজের এসব অবিস্মরণীয় ভূমিকা।
কিন্তু এখন কি হচ্ছে? রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা ভাবে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য দেশটি তাদের ‘দখলে’ এসে গেল। তখন চলে ছাত্রাবাস এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিরোধী ছাত্র সংগঠনকে হটানো। প্রশাসনের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে তারা চালিয়ে যায় লঙ্কাকাণ্ড। সিট-বাণিজ্য থেকে শুরু করে এখন ভর্তি-বাণিজ্য পর্যন্ত তাদের (কালো) হাত প্রসারিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই পাঁচ বছরে যা কিছু উন্নয়ন প্রকল্প থাকবে, তার প্রতিটি থেকে তাদের বখরা চাই। তাতে নির্মাণ কাজ নিুমান হোক কিংবা পুরনো লক্কড়ঝক্কড় মার্কা পরিবহন কেনা হোক অথবা ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করা হোক- তাদের কিছুই যায় আসে না। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন নয়, তারা মশগুল ‘আত্মোন্নয়নে’, এখানে ব্যবহার করা হয় দলীয় পরিচয়। আর নিজেদের মসনদ অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এসব ছাত্রনামধারী মাস্তানের উপদ্রব, আবদার এমনকি বেয়াদবি পর্যন্ত সহ্য করেন। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি-বাণিজ্যে ছাত্রনেতাদের উপদ্রব। এক্ষেত্রে শিক্ষার মান বজায় রাখা অসম্ভব। সিট দখল ও পরে অনুগতদের মধ্যে তা বণ্টনের মাধ্যমে দলে ভেড়ানোর যে খেলা চলে, তা এখন ছাত্র রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত কৌশল। মফস্বল থেকে আসা, শহরে অভিভাবকহীন একজন ছাত্রের টিকে থাকার জন্যই প্রয়োজন হয় আবাসিক হলে একটি ‘সিট’। সে তা পায় তার রাজনৈতিক সত্তা বিক্রি করে দিয়ে। সিনিয়রদেও চোখ ভয়ে এবং সিট টিকিয়ে রাখতে কিংবা কৃতজ্ঞতার কারণে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যোগ দিতে হয় দলের মিটিং-মিছিলে। তখন প্রতিপক্ষ অথবা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয় মিছিলে যাওয়া নিরীহ ছাত্ররা।
এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও পড়েছে অসুস্থ রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব। সংসদ সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন মাঠপর্যায়ের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ), জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ, জেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে হয় সংসদ সদস্যদের অলিখিত নির্দেশ ও পরামর্শে। জেলা পর্যায়ে এসব কাজের নিয়ন্ত্রণ থাকে সদর আসনের সংসদ সদস্যদের হাতে। তারাই দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কাজ ভাগবাটোয়ারা করে দেন। একই অবস্থা উপজেলা পর্যায়েও। উন্নয়ন কাজের এসব ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আবার ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত আট মাসে টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। সংসদ সদস্যরা দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কাজ ভাগবাটোয়ারা করে দেয়ার ফলে সরকারের উন্নয়ন কাজগুলোর বেশির ভাগই যেমন নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হয় না, তেমনি গুণগত মানও থাকে না। এমনও অভিযোগ আছে, অনেক সময় কাজ শুরু না করেই বিল তুলে নিচ্ছেন দলীয় ঠিকাদাররা। এসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ে দায়িত্বরত নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপজেলা প্রকৌশলীরা তাদের উচ্চপর্যায়ে অভিযোগ করলেও কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় না।
ছাত্র রাজনীতির পথভ্রষ্ট হওয়া এবং নীতিহীনতার দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজ ছাত্রফ্রন্টের কর্মী ও নেতাদের ব্যাপারে একচোখা হাতি, তাদের সাতখুন মাফ হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল হলে তো কথাই নেই, তারা প্রশাসন ও পুলিশের পৃষ্ঠপোষকতা পায়। প্রতিপক্ষের মাথা ফাটানো, ছাদ থেকে ফেলে দেয়া, ছাত্রী লাঞ্ছনা, ভিসিকে হুমকি, শিক্ষকদের অপমান করাসহ নানা শিষ্টাচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে চালিয়ে যায়। হত্যাসহ বড় কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয় সংশ্লিষ্টদের। সন্ত্রাসী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নজির খুবই সামান্য। ফলে কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর আবার পুরোদমে সক্রিয় হয়ে ওঠে ওইসব নেতাকর্মী। ফলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে তারা। অসুস্থ ছাত্র রাজনীতি শিকার এসব সন্ত্রাসী ছাত্রদের ব্যাপারে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একই পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে। ছাত্রদলে অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০২ সালে কিছুদিনের জন্য ছাত্রদলে কার্যক্রম স্থগিত করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর ২০০৯ সালে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রলীগের সাংগাঠনিক নেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগও করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিল ওইসব সন্ত্রাসী নেতাকর্মী।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বই-খাতার বদলে কেন তুলে নেয় চাপাতি, রামদাসহ অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র? রাজনীতিবিদরা কী একটিবারও ভাবেন না কেন আমরা মেধাবীদের এভাবে অসুস্থ রাজনীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি? শিক্ষকরা কি ভাবছেন না, ছাত্ররা কেন বহিরাগত রাজনীতির শিকারে পরিণত হচ্ছে? শিক্ষক হিসেবে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ক্লাসে কোন ছাত্রটি ভালো ফল করতে পারছে না, কোন ছাত্রটি অনিয়মিত তা কোনোভাবেই শিক্ষকের অগোচরে থাকে না। তাহলে শিক্ষকদের ভূমিকা নেই কেন? অসুস্থ ছাত্র রাজনীতি সুস্থ করার কোনো উদ্যোগ নেই কেন? কারণ পরিষ্কার। আজকের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি শিক্ষকই জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে নিজ নিজ দলের ছাত্রদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মদদ দিয়ে থাকেন শিক্ষকরা। বেশি লক্ষ্য করা যায় ক্ষমতাসীনদেও ক্ষেত্রে। পুলিশ ও ‘প্রশাসক শিক্ষকদের’ সামনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রদের অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষকে তাড়া করার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। শিক্ষকদের কখনও রাজনৈতিক কর্মী হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। সব ছাত্রকে সমানভাবে পরিচর্যা করা যেমন তার দায়িত্ব, তেমনি পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের একাডেমিক ও মানসিকভাবে সাহায্য করা জরুরি। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ছাত্রদের হাতে বন্দুক নয়, নিতে হবে বই। এটি যেন সত্যি হয় এবং তা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব বর্তায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর।
পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও এ ব্যাপারে রাখতে হবে বিশেষ ভূমিকা। এছাড়া শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবকসহ সবাইকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে যে শিক্ষা গ্রহণ করাটাই মুখ্য, অন্য সবকিছুই গৌণ- তা উপলব্ধি করতে হবে দলমত নির্বিশেষ আপামর জনগোষ্ঠীর। তবেই ছাত্র রাজনীতি অমাবস্যার গহিন থেকে পূর্ণিমার চাঁদের মতো আপন মহিমায় উজ্জীবিত হবে। অসুস্থ রাজনীতির ছোবল থেকে বাঁচবে ছাত্ররা।
গত প্রায় দুই যুগ ধরে অসুস্থ রাজনীতির অন্ধগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ নিয়েই নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী। এখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আছে বলে তাণ্ডব চালাচ্ছে ছাত্রলীগ। যখন বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারে ছিল, তখনও একই স্টাইলে তাণ্ডব চালিছে ছাত্রদল। অপকর্মের মঞ্চ ও স্ক্রিপ্ট থাকে অপরিবর্তিত, শুধু বদল হয় অভিনেতা-অভিনেত্রী।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতির সব অতীত গৌরব আজ ধূলিসাৎ হওয়ার উপক্রম। অথচ কী ঝকঝকে ছিল ছাত্র রাজনীতির চেহারা! বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এ দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল ছাত্ররা। এমনকি কোনো কোনো ঐতিহাসিক আন্দোলনে তারা জাতীয় রাজনীতিকেও পথ দেখিয়েছে। ভাষা আন্দোলন- মাকে মায়ের ভাষায় মা ডাকার অধিকারের আন্দোলনটি শুরু করেছিল ছাত্রলীগ। জিন্নাহ সাহেব উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা (তৎকালীন পাকিস্তানের) ঘোষণা দেয়ার প্রাক্কালে যে ‘না’ শব্দটি, উচ্চারিত হয়েছিল সেটিও ছিল নাঈমউদ্দিনের মুখে। তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তখন ছাত্রলীগ ছাড়া সাংগঠনিক অবকাঠামোয় অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়নি। ’৫৪-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে একত্রিত করার গৌরবদীপ্ত দায়িত্বটিও পালন করেছিল ছাত্রসমাজ। এর অগ্রণী ভূমিকায় ছিল ছাত্রলীগ। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের নামে যে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনটি তৈরি হয়েছিল, সেটিতেও ছাত্র সমাজের কৃতিত্ব অবিস্মরণীয়। ’৬৯-এর অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানে ১১ দফার মধ্যে ৬ দফাকে সন্নিবেশিত করার গৌরবও ছাত্রলীগের। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ছাত্র সমাজের এসব অবিস্মরণীয় ভূমিকা।
কিন্তু এখন কি হচ্ছে? রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা ভাবে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য দেশটি তাদের ‘দখলে’ এসে গেল। তখন চলে ছাত্রাবাস এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিরোধী ছাত্র সংগঠনকে হটানো। প্রশাসনের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে তারা চালিয়ে যায় লঙ্কাকাণ্ড। সিট-বাণিজ্য থেকে শুরু করে এখন ভর্তি-বাণিজ্য পর্যন্ত তাদের (কালো) হাত প্রসারিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই পাঁচ বছরে যা কিছু উন্নয়ন প্রকল্প থাকবে, তার প্রতিটি থেকে তাদের বখরা চাই। তাতে নির্মাণ কাজ নিুমান হোক কিংবা পুরনো লক্কড়ঝক্কড় মার্কা পরিবহন কেনা হোক অথবা ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করা হোক- তাদের কিছুই যায় আসে না। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন নয়, তারা মশগুল ‘আত্মোন্নয়নে’, এখানে ব্যবহার করা হয় দলীয় পরিচয়। আর নিজেদের মসনদ অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এসব ছাত্রনামধারী মাস্তানের উপদ্রব, আবদার এমনকি বেয়াদবি পর্যন্ত সহ্য করেন। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি-বাণিজ্যে ছাত্রনেতাদের উপদ্রব। এক্ষেত্রে শিক্ষার মান বজায় রাখা অসম্ভব। সিট দখল ও পরে অনুগতদের মধ্যে তা বণ্টনের মাধ্যমে দলে ভেড়ানোর যে খেলা চলে, তা এখন ছাত্র রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত কৌশল। মফস্বল থেকে আসা, শহরে অভিভাবকহীন একজন ছাত্রের টিকে থাকার জন্যই প্রয়োজন হয় আবাসিক হলে একটি ‘সিট’। সে তা পায় তার রাজনৈতিক সত্তা বিক্রি করে দিয়ে। সিনিয়রদেও চোখ ভয়ে এবং সিট টিকিয়ে রাখতে কিংবা কৃতজ্ঞতার কারণে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যোগ দিতে হয় দলের মিটিং-মিছিলে। তখন প্রতিপক্ষ অথবা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয় মিছিলে যাওয়া নিরীহ ছাত্ররা।
এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও পড়েছে অসুস্থ রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব। সংসদ সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন মাঠপর্যায়ের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ), জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ, জেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে হয় সংসদ সদস্যদের অলিখিত নির্দেশ ও পরামর্শে। জেলা পর্যায়ে এসব কাজের নিয়ন্ত্রণ থাকে সদর আসনের সংসদ সদস্যদের হাতে। তারাই দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কাজ ভাগবাটোয়ারা করে দেন। একই অবস্থা উপজেলা পর্যায়েও। উন্নয়ন কাজের এসব ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আবার ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত আট মাসে টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। সংসদ সদস্যরা দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কাজ ভাগবাটোয়ারা করে দেয়ার ফলে সরকারের উন্নয়ন কাজগুলোর বেশির ভাগই যেমন নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হয় না, তেমনি গুণগত মানও থাকে না। এমনও অভিযোগ আছে, অনেক সময় কাজ শুরু না করেই বিল তুলে নিচ্ছেন দলীয় ঠিকাদাররা। এসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জেলা ও স্থানীয় পর্যায়ে দায়িত্বরত নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপজেলা প্রকৌশলীরা তাদের উচ্চপর্যায়ে অভিযোগ করলেও কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় না।
ছাত্র রাজনীতির পথভ্রষ্ট হওয়া এবং নীতিহীনতার দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজ ছাত্রফ্রন্টের কর্মী ও নেতাদের ব্যাপারে একচোখা হাতি, তাদের সাতখুন মাফ হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল হলে তো কথাই নেই, তারা প্রশাসন ও পুলিশের পৃষ্ঠপোষকতা পায়। প্রতিপক্ষের মাথা ফাটানো, ছাদ থেকে ফেলে দেয়া, ছাত্রী লাঞ্ছনা, ভিসিকে হুমকি, শিক্ষকদের অপমান করাসহ নানা শিষ্টাচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে চালিয়ে যায়। হত্যাসহ বড় কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয় সংশ্লিষ্টদের। সন্ত্রাসী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নজির খুবই সামান্য। ফলে কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর আবার পুরোদমে সক্রিয় হয়ে ওঠে ওইসব নেতাকর্মী। ফলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে তারা। অসুস্থ ছাত্র রাজনীতি শিকার এসব সন্ত্রাসী ছাত্রদের ব্যাপারে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একই পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে। ছাত্রদলে অপকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০২ সালে কিছুদিনের জন্য ছাত্রদলে কার্যক্রম স্থগিত করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর ২০০৯ সালে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রলীগের সাংগাঠনিক নেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগও করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিল ওইসব সন্ত্রাসী নেতাকর্মী।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বই-খাতার বদলে কেন তুলে নেয় চাপাতি, রামদাসহ অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র? রাজনীতিবিদরা কী একটিবারও ভাবেন না কেন আমরা মেধাবীদের এভাবে অসুস্থ রাজনীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি? শিক্ষকরা কি ভাবছেন না, ছাত্ররা কেন বহিরাগত রাজনীতির শিকারে পরিণত হচ্ছে? শিক্ষক হিসেবে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ক্লাসে কোন ছাত্রটি ভালো ফল করতে পারছে না, কোন ছাত্রটি অনিয়মিত তা কোনোভাবেই শিক্ষকের অগোচরে থাকে না। তাহলে শিক্ষকদের ভূমিকা নেই কেন? অসুস্থ ছাত্র রাজনীতি সুস্থ করার কোনো উদ্যোগ নেই কেন? কারণ পরিষ্কার। আজকের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি শিক্ষকই জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে নিজ নিজ দলের ছাত্রদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মদদ দিয়ে থাকেন শিক্ষকরা। বেশি লক্ষ্য করা যায় ক্ষমতাসীনদেও ক্ষেত্রে। পুলিশ ও ‘প্রশাসক শিক্ষকদের’ সামনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রদের অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষকে তাড়া করার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। শিক্ষকদের কখনও রাজনৈতিক কর্মী হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। সব ছাত্রকে সমানভাবে পরিচর্যা করা যেমন তার দায়িত্ব, তেমনি পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের একাডেমিক ও মানসিকভাবে সাহায্য করা জরুরি। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ছাত্রদের হাতে বন্দুক নয়, নিতে হবে বই। এটি যেন সত্যি হয় এবং তা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব বর্তায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর।
পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও এ ব্যাপারে রাখতে হবে বিশেষ ভূমিকা। এছাড়া শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবকসহ সবাইকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে যে শিক্ষা গ্রহণ করাটাই মুখ্য, অন্য সবকিছুই গৌণ- তা উপলব্ধি করতে হবে দলমত নির্বিশেষ আপামর জনগোষ্ঠীর। তবেই ছাত্র রাজনীতি অমাবস্যার গহিন থেকে পূর্ণিমার চাঁদের মতো আপন মহিমায় উজ্জীবিত হবে। অসুস্থ রাজনীতির ছোবল থেকে বাঁচবে ছাত্ররা।
No comments