দশ বছরে প্রমাণ হয়নি কোনো মামলা!
প্রতিষ্ঠার এক দশকেও প্রত্যাশা পূরণ করতে
পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। দশ বছরে মামলা করেছে ৩ হাজার ৬৬২টি।
কিন্তু এর একটিও আপিল বিভাগে প্রমাণিত হয়নি। চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে
কারাগারে নেই কোনো দুর্নীতিবাজ। একমাত্র বনখেকো ওসমান গনি দণ্ডাদেশের
বিরুদ্ধে আপিল না করে স্বেচ্ছায় কারাভোগ করছেন। যদিও দুদকের দাবি, বিচারে
আসামির শাস্তি হওয়ার হার ৬৮ শতাংশ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পরিসংখ্যানে
রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। দুদকের প্রকৃত অর্জন বলতে তেমন কিছু নেই।
আইনগত দুর্বলতা, নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট না থাকা, ফিনির্ভর আইনজীবীদের প্রতি নির্ভরতা, দুর্বল অনুসন্ধান ও তদন্ত এবং আপসকামিতার কারণে দুদক দুর্নীতি মামলার চূড়ান্ত বিচারে হেরে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর কমিশন প্রতিষ্ঠার পর আড়াই বছর প্রতিষ্ঠানটি নিষ্ক্রিয় ছিল। বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের কমিশন নানা বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে চায়ের দাওয়াত পেয়ে মেয়াদ পূর্তির আগেই পদত্যাগ করেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান (চেয়ারম্যান), কমিশনার হাবিবুর রহমান ও আবুল হাসান মনযুর মান্নান। কমিশনবিহীন অবস্থায় একই বছর ১৬ ফেব্র“য়ারি আকস্মিকভাবেই কথিত ৫০ সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ-এর তালিকা প্রকাশ করেন তৎকালীন দুদক সচিব দেলোয়ার হোসেন। এ তালিকায় নাম ওঠে রাজনীতিক, প্রথিতযশা ব্যবসায়ী, শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, আমলা ও পেশাজীবীদের। সচিব স্বাক্ষরিত নোটিশে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে সম্পদ বিবরণী চাওয়া হয়। ২২ ফেব্র“য়ারি দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী।
পরে দুদক সচিব স্বাক্ষরিত নোটিশকে উচ্চ আদালত বেআইনি ঘোষণা করেন। সে সময় পরিচালিত প্রায় সব কর্মকাণ্ডই পরবর্তীকালে আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠান জন্মলগ্ন থেকেই ছিল আমলাদের করায়ত্তে। নানাভাবে এটিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। যখনই সক্রিয় হয়, তখন থেকেই এটি পরিণত হয়েছে সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ারে। আইনত স্বাধীন হলেও কার্যক্রমে সরকার ও দুদক ছিল একাট্টা। অতি সম্প্রতি দুদক পরিণত হয় দায়মুক্তি কমিশন-এ। পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার সব আসামিকে অব্যাহতি, হলমার্ক কেলেংকারিতে সরকার-ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতা-আমলাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়ার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে।
এছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দায়ের, পুরনো মামলার চার্জশিটে আসামি করায় প্রশ্নের মুখে পড়ে কমিশন। এক দশকে দুদককে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান, লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী, মো. গোলাম রহমান। বর্তমানে এর চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ।
দায়মুক্তি কমিশন : মামলা দায়েরের পর তদন্তে আসামিদের অব্যাহতি দেয়ার প্রবণতাই বেশি দুদকের দশ বছরের কার্যক্রমে। চার্জশিট দাখিলের অনুপাতও কম। ২০০৭ সালে দুদক আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে ৮০টি। ২০০৮ সালে ফাইনাল রিপোর্ট ১৯৭টি, ২০০৯ সালে ২৬২টি, ২০১০ সালে ২৮৫টি, ২০১১ সালে ২৯৯টি, ২০১২ সালে ৩৮২টি এবং ২০১৩ সালে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে ৪০৯টি। আর চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্তই দুদক ৪২৩টি মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাড়ে ৩ বছরে ৫ হাজার ৩৪৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের পর নথিভুক্তির মাধ্যমে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেয় দুদক। এছাড়া ব্যুরোর আমলে দায়েরকৃত ৪০০ মামলার বিচার থেমে আছে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশে। আর কমিশন আমলে দায়েরকৃত মামলার কার্যক্রম থেমে আছে ৪১৩টির।
পরিসংখ্যানে ফাঁকি : দুদক থেকে পরিসংখ্যান তুলে ধরে দাবি করা হয়, ৬৮ শতাংশ মামলায় আসামির শাস্তি হচ্ছে। দুদক প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পূর্তি উদযাপনকে সামনে রেখে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে এ দাবি করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন ব্যুরো আমলে সম্পন্ন হওয়া অনুসন্ধান ও তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সম্পন্ন হওয়া বিচারের হার যোগ করে দুদক এই দাবি করছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কমিশন দায়েরকৃত মামলার বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মাত্র ২০ শতাংশ অভিযুক্ত। ব্যুরো আমলে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা দিয়েই স্ফীত করা হয়েছে কমিশনের পরিসংখ্যান। ফলে দুদকের কৃতিত্ব দাবির এ পরিসংখ্যানকে শুভংকরের ফাঁকি বলেই বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা।
জেল খাটছেন শুধু ওসমান গনি : ২০০৭ সালে ১৫৩টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া ১২টি মামলাই উচ্চ আদালতে টেকেনি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নতুন-পুরনো মিলিয়ে ১৭টি মামলা থাকলেও আদালতের রায় মেলেনি একটি মামলাতেও। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর দুদকের মামলায় সাজার আদেশপ্রাপ্ত হলেও আপিল বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ বিবেচনাধীন রয়েছে। ওই সময় দায়েরকৃত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন মামলার দুটি ধারায় প্রধান বন সংরক্ষক ওসমান গনির ১০ বছর কারাদণ্ড হয়। হাইকোর্ট তার দণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। তিনি ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেননি। জানা গেছে, এ দেশে ওসমান গনির পরিবারের কেউ থাকেন না। স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা আমেরিকা-ইউরোপে স্থায়ী। পরিবারের প্রতি অভিমান করে তিনি স্বেচ্ছায় কারাভোগ করছেন।
এছাড়া ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময় দুদক আবুধাবিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নাজিম উল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করে। বিচারে বিশেষ আদালত তাকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে হাইকোর্ট শাস্তি ২ বছর কমিয়ে ৩ বছর করেন। নাজিম উল্লাহ চৌধুরী এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন সুপ্রিমকোর্টে। আপিলটি এখন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এ মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ফলে দুদকের মামলায় চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত হয়ে কোনো দুর্নীতিবাজ কারাভোগ করছেন তা এক বাক্যে দাবি করতে পারছেন না দুদকের আইনজীবীরাও। বিচার আদালতে দণ্ডিত হওয়ার হার কত- জানতে চাওয়া হলে দুদকের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, অনুপাত দিয়ে বিশ্লেষণ করা ঠিক হবে না। বহু মামলায় আসামি দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে। দুদকের আরেক কৌঁসুলি খুরশিদ আলম খান বলেন, আপিল বিভাগে বহু সাজা বহাল রয়েছে। অনেকেই এখন কারাভোগ করছেন। না দেখে আপনাকে পরিসংখ্যান দিতে পারব না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, যে প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা হয়েছিল সেটি পূরণে দুদক ব্যর্থ হয়েছে। দুদক আর সরকার একাকার হয়ে গেছে। সব সময়ই রাজনৈতিক ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় থেকেছে কমিশন। এক দশক পূর্তি উপলক্ষে দুদক এখন একটি কাজই করতে পারে। তা হল, দশ বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে পরবর্তী দশ বছরের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা।
দুদকের পথ চলার এক দশকের মূল্যায়ন করে আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক উল হক যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত। এ কারণে একটি দুর্নীতি মামলাও প্রমাণিত হয়নি।
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে নয়, রাজনীতি দমনে কাজ করছে দুদক। পলিটিক্যালি ভিক্টিমাইজ করছে। লক্ষ্য করুন, সরকার বলছে, রফিক উল হক দুর্নীতিবাজ, তাকে ধরো। দুদক ধরছে। আবার দেখুন, ইদানীং সরকারদলীয় লোকদের দায়মুক্তি দিচ্ছে। অর্থাৎ দুদকের উদ্দেশ্যের মাঝেই দুর্নীতি নিহিত। ফলে এক দশকে একটি মামলাও দুদক প্রমাণ করতে পারেনি। কেউ ফাইনালি কনভিক্ট হয়ে কারাগারে যায়নি। এতে প্রমাণিত হয় দুদক জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
কমিশনের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সমালোচনা থেকেই প্রমাণিত হয় দুদক গত এক দশকে অনেক কাজ করেছে। অনেক সাফল্য রয়েছে আমাদের। সমালোচনাকে তাই স্বাগত জানাই। তিনি দাবি করেন, দুদক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। কে ক্ষমতায় আছে, কে নেই- এ বিবেচনা কখনও আমাদের মধ্যে কাজ করে না। লক্ষ্য করবেন, সম্প্রতি সরকারদলীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে আমরা কুণ্ঠিত হইনি। ফলে দুদক প্রভাবশালীদের দায়মুক্তি দিচ্ছে- এ কথা সঠিক নয়। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, কমিশন প্রতিষ্ঠার পর আইন সংশোধন করা হয়েছে। দুদককে আরও গতিশীল করতে আমরা আইনের আরেকটি সংশোধনী প্রস্তাব করেছি। এছাড়া অর্থ পাচার রোধে জানুয়ারি থেকে দুদক নতুন একটি সেল চালুর চিন্তা করছে। তাই এক বাক্যে দুদককে ব্যর্থ বলা সমীচীন হবে না।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন আজ : এমন অবস্থার মধ্যেই দুদক দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে আজ। ২১ নভেম্বর ১০ বছর পূর্ণ হলেও ওইদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় দুদিন দেরিতে উদযাপন করা হচ্ছে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জানান, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুদক সদর দফতর, ৬ বিভাগীয় কার্যালয় ও ২২ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রধান কার্যালয়ে সকাল সোয়া ৯টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা ও দুদকের পতাকা উত্তোলন। সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা অডিটোরিয়ামে আয়োজন করা হয়েছে শপথ, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এছাড়া প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুদক জাতীয় দৈনিকে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে।
আইনগত দুর্বলতা, নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট না থাকা, ফিনির্ভর আইনজীবীদের প্রতি নির্ভরতা, দুর্বল অনুসন্ধান ও তদন্ত এবং আপসকামিতার কারণে দুদক দুর্নীতি মামলার চূড়ান্ত বিচারে হেরে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর কমিশন প্রতিষ্ঠার পর আড়াই বছর প্রতিষ্ঠানটি নিষ্ক্রিয় ছিল। বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের কমিশন নানা বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে চায়ের দাওয়াত পেয়ে মেয়াদ পূর্তির আগেই পদত্যাগ করেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান (চেয়ারম্যান), কমিশনার হাবিবুর রহমান ও আবুল হাসান মনযুর মান্নান। কমিশনবিহীন অবস্থায় একই বছর ১৬ ফেব্র“য়ারি আকস্মিকভাবেই কথিত ৫০ সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ-এর তালিকা প্রকাশ করেন তৎকালীন দুদক সচিব দেলোয়ার হোসেন। এ তালিকায় নাম ওঠে রাজনীতিক, প্রথিতযশা ব্যবসায়ী, শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, আমলা ও পেশাজীবীদের। সচিব স্বাক্ষরিত নোটিশে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে সম্পদ বিবরণী চাওয়া হয়। ২২ ফেব্র“য়ারি দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী।
পরে দুদক সচিব স্বাক্ষরিত নোটিশকে উচ্চ আদালত বেআইনি ঘোষণা করেন। সে সময় পরিচালিত প্রায় সব কর্মকাণ্ডই পরবর্তীকালে আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠান জন্মলগ্ন থেকেই ছিল আমলাদের করায়ত্তে। নানাভাবে এটিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। যখনই সক্রিয় হয়, তখন থেকেই এটি পরিণত হয়েছে সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ারে। আইনত স্বাধীন হলেও কার্যক্রমে সরকার ও দুদক ছিল একাট্টা। অতি সম্প্রতি দুদক পরিণত হয় দায়মুক্তি কমিশন-এ। পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার সব আসামিকে অব্যাহতি, হলমার্ক কেলেংকারিতে সরকার-ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতা-আমলাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়ার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে।
এছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দায়ের, পুরনো মামলার চার্জশিটে আসামি করায় প্রশ্নের মুখে পড়ে কমিশন। এক দশকে দুদককে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান, লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী, মো. গোলাম রহমান। বর্তমানে এর চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ।
দায়মুক্তি কমিশন : মামলা দায়েরের পর তদন্তে আসামিদের অব্যাহতি দেয়ার প্রবণতাই বেশি দুদকের দশ বছরের কার্যক্রমে। চার্জশিট দাখিলের অনুপাতও কম। ২০০৭ সালে দুদক আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে ৮০টি। ২০০৮ সালে ফাইনাল রিপোর্ট ১৯৭টি, ২০০৯ সালে ২৬২টি, ২০১০ সালে ২৮৫টি, ২০১১ সালে ২৯৯টি, ২০১২ সালে ৩৮২টি এবং ২০১৩ সালে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে ৪০৯টি। আর চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্তই দুদক ৪২৩টি মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাড়ে ৩ বছরে ৫ হাজার ৩৪৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের পর নথিভুক্তির মাধ্যমে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেয় দুদক। এছাড়া ব্যুরোর আমলে দায়েরকৃত ৪০০ মামলার বিচার থেমে আছে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশে। আর কমিশন আমলে দায়েরকৃত মামলার কার্যক্রম থেমে আছে ৪১৩টির।
পরিসংখ্যানে ফাঁকি : দুদক থেকে পরিসংখ্যান তুলে ধরে দাবি করা হয়, ৬৮ শতাংশ মামলায় আসামির শাস্তি হচ্ছে। দুদক প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পূর্তি উদযাপনকে সামনে রেখে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে এ দাবি করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন ব্যুরো আমলে সম্পন্ন হওয়া অনুসন্ধান ও তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সম্পন্ন হওয়া বিচারের হার যোগ করে দুদক এই দাবি করছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কমিশন দায়েরকৃত মামলার বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মাত্র ২০ শতাংশ অভিযুক্ত। ব্যুরো আমলে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা দিয়েই স্ফীত করা হয়েছে কমিশনের পরিসংখ্যান। ফলে দুদকের কৃতিত্ব দাবির এ পরিসংখ্যানকে শুভংকরের ফাঁকি বলেই বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা।
জেল খাটছেন শুধু ওসমান গনি : ২০০৭ সালে ১৫৩টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া ১২টি মামলাই উচ্চ আদালতে টেকেনি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নতুন-পুরনো মিলিয়ে ১৭টি মামলা থাকলেও আদালতের রায় মেলেনি একটি মামলাতেও। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর দুদকের মামলায় সাজার আদেশপ্রাপ্ত হলেও আপিল বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ বিবেচনাধীন রয়েছে। ওই সময় দায়েরকৃত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন মামলার দুটি ধারায় প্রধান বন সংরক্ষক ওসমান গনির ১০ বছর কারাদণ্ড হয়। হাইকোর্ট তার দণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। তিনি ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেননি। জানা গেছে, এ দেশে ওসমান গনির পরিবারের কেউ থাকেন না। স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা আমেরিকা-ইউরোপে স্থায়ী। পরিবারের প্রতি অভিমান করে তিনি স্বেচ্ছায় কারাভোগ করছেন।
এছাড়া ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময় দুদক আবুধাবিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নাজিম উল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করে। বিচারে বিশেষ আদালত তাকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে হাইকোর্ট শাস্তি ২ বছর কমিয়ে ৩ বছর করেন। নাজিম উল্লাহ চৌধুরী এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন সুপ্রিমকোর্টে। আপিলটি এখন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এ মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ফলে দুদকের মামলায় চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত হয়ে কোনো দুর্নীতিবাজ কারাভোগ করছেন তা এক বাক্যে দাবি করতে পারছেন না দুদকের আইনজীবীরাও। বিচার আদালতে দণ্ডিত হওয়ার হার কত- জানতে চাওয়া হলে দুদকের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, অনুপাত দিয়ে বিশ্লেষণ করা ঠিক হবে না। বহু মামলায় আসামি দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে। দুদকের আরেক কৌঁসুলি খুরশিদ আলম খান বলেন, আপিল বিভাগে বহু সাজা বহাল রয়েছে। অনেকেই এখন কারাভোগ করছেন। না দেখে আপনাকে পরিসংখ্যান দিতে পারব না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, যে প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা হয়েছিল সেটি পূরণে দুদক ব্যর্থ হয়েছে। দুদক আর সরকার একাকার হয়ে গেছে। সব সময়ই রাজনৈতিক ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় থেকেছে কমিশন। এক দশক পূর্তি উপলক্ষে দুদক এখন একটি কাজই করতে পারে। তা হল, দশ বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে পরবর্তী দশ বছরের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা।
দুদকের পথ চলার এক দশকের মূল্যায়ন করে আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক উল হক যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত। এ কারণে একটি দুর্নীতি মামলাও প্রমাণিত হয়নি।
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে নয়, রাজনীতি দমনে কাজ করছে দুদক। পলিটিক্যালি ভিক্টিমাইজ করছে। লক্ষ্য করুন, সরকার বলছে, রফিক উল হক দুর্নীতিবাজ, তাকে ধরো। দুদক ধরছে। আবার দেখুন, ইদানীং সরকারদলীয় লোকদের দায়মুক্তি দিচ্ছে। অর্থাৎ দুদকের উদ্দেশ্যের মাঝেই দুর্নীতি নিহিত। ফলে এক দশকে একটি মামলাও দুদক প্রমাণ করতে পারেনি। কেউ ফাইনালি কনভিক্ট হয়ে কারাগারে যায়নি। এতে প্রমাণিত হয় দুদক জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
কমিশনের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সমালোচনা থেকেই প্রমাণিত হয় দুদক গত এক দশকে অনেক কাজ করেছে। অনেক সাফল্য রয়েছে আমাদের। সমালোচনাকে তাই স্বাগত জানাই। তিনি দাবি করেন, দুদক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। কে ক্ষমতায় আছে, কে নেই- এ বিবেচনা কখনও আমাদের মধ্যে কাজ করে না। লক্ষ্য করবেন, সম্প্রতি সরকারদলীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে আমরা কুণ্ঠিত হইনি। ফলে দুদক প্রভাবশালীদের দায়মুক্তি দিচ্ছে- এ কথা সঠিক নয়। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, কমিশন প্রতিষ্ঠার পর আইন সংশোধন করা হয়েছে। দুদককে আরও গতিশীল করতে আমরা আইনের আরেকটি সংশোধনী প্রস্তাব করেছি। এছাড়া অর্থ পাচার রোধে জানুয়ারি থেকে দুদক নতুন একটি সেল চালুর চিন্তা করছে। তাই এক বাক্যে দুদককে ব্যর্থ বলা সমীচীন হবে না।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন আজ : এমন অবস্থার মধ্যেই দুদক দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে আজ। ২১ নভেম্বর ১০ বছর পূর্ণ হলেও ওইদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় দুদিন দেরিতে উদযাপন করা হচ্ছে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জানান, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুদক সদর দফতর, ৬ বিভাগীয় কার্যালয় ও ২২ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রধান কার্যালয়ে সকাল সোয়া ৯টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা ও দুদকের পতাকা উত্তোলন। সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা অডিটোরিয়ামে আয়োজন করা হয়েছে শপথ, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এছাড়া প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুদক জাতীয় দৈনিকে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে।
No comments