ছিঃ ছিঃ এত্তা জঞ্জাল! by জয়া ফারহানা
বুদ্ধদেব গুহ একবার জনাকীর্ণ এক সম্মেলনে শ্রোতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনারা কেউ কি আমার কোনো বই পড়েছেন?’ খানিক নীরবতার পর লজ্জিত স্বরে যখন উত্তর এলো ‘না’, তখন মুচকি হেসে প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘যাক, বুদ্ধিমান পাঠক এখনও তাহলে আছে কিছু।’ কথাটা মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে, তখন শ্রীমান গুহকে আমারও বলতে ইচ্ছে করে খালি বুদ্ধিমান পাঠকই নন, বুদ্ধিমান লেখকও আছেন ঢের। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তারা চারদিকের উচ্চতর সাফল্য দেখেন কেবল। দেখতেই থাকেন, আর লিখতেই থাকেন। এসব সাফল্যের ফিরিস্তি গাইতে গিয়ে সম্পাদকীয় বিভাগের পাতা মার্জিন ছুঁয়ে যায় তবু তাদের সাফল্যের বয়ান শেষ হতে চায় না। তো এই লম্বা সাফল্য বয়ানের জন্য যথাসময়ে তাদের ভাগ্যে লম্বা লিস্টির পুরস্কারও জুটে যায়। সময়মতো তারা অভিজাত এলাকায় প্লট পেয়ে যান। আবার প্রি-ম্যাচিউর পেয়ে যান রেডিও-টেলিভিশনের লাইসেন্সও। সরকারি সফরে গেলে কাস্টমস চেকিং ছাড়াই শাহজালালের গ্রিন চ্যানেল দিয়ে তাদের ঐশ্বর্য বোঝাই বাক্স-পেটরা আসতেই থাকে। আর এসব ব্যক্তিগত ঐশ্বর্য দেখে তাদের মনে হতে থাকে, এ দেশে অভাব কোথায়? সবই তো চলছে ঠিকঠাক। তখন তারা আবার দেশের ঐশ্বর্যের বয়ান দিতে গিয়ে বিশাল বিশাল নিবন্ধ লিখতে বসে যান। বেশ এক অলংঘনীয় চক্র আর কী! দেশের উন্নয়নের গতি উসাইন বোল্টের চেয়েও দ্রুত ধাবমান বলে তারা মত দেন। চোখ-কান বুজে তারা লিখে দেন তাদের নেতাই পারছেন এবং তাদের নেতাই পারবেন, তাতে আর সন্দেহ কী! আমরাও মানি সে কথা। স্বাধীন বাংলাদেশে এভাবে আর কোনো নেতা পেরেছিলেন বলে জানা নেই। যাহোক, উন্নয়নের নসিহত বর্ণনার সময় তারা লেখেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাবেই। কেউ এর গতি রুখতে পারবে না।
শরীরের সমস্ত রক্ত কেবল মাথায় প্রবাহিত হলে তাকে যেমন সুস্বাস্থ্য বলা যায় না, তেমন কেবল দলীয় উন্নয়নকেও দেশের উন্নয়ন বলা যাবে না। তারপরও কে রুখতে পারে তাদের উন্নয়নসংক্রান্ত বয়ান বরং কেউ সত্য বয়ান করলে সেই বয়ানের মধ্যেই চালানো হয় কাঁচি। বাধ্য হয়ে বোকাসোকা নিবন্ধকারদের লিখতে হয়- ‘ফুল কেন ফোটে,’ ‘পাখি কেন গান গায়’, ‘আকাশ কেন নীল’, ‘সাগর কেন অসীম’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব লেখা ছাড়া উপায়-ই বা কী? লেখা কি যাবে, পুলিশ কেন হাজার হাজার নিরীহ মানুষ ধরে নিয়ে যায়, ভালো মানুষগুলো কেন নিভৃতচারী আর মন্দরা পর্দায়? না, লেখা যাবে না। হয়তো ইতিমধ্যে লেখার এই অংশ ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এখানে কাঁচির কর্ম সম্পাদিত হয়ে গেছে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, উন্নয়ন উন্নয়ন বলে রাত-দিন যে জিগির চলছে, সেই উন্নয়নের আসল দাবিদার কারা? বাইশ হাজার কোটি টাকার যে বিশাল বিদেশী মুদ্রা অর্জিত হয়েছে, তা কাদের শ্রম আর ঘামের বদলে? এর দাবিদার কেবল আমার পোশাক-শ্রমিক বোন আর ভায়েরা। প্রবাসী ভাইদের পাঠানো রেমিটেন্সের কল্যাণে গড়া বিদেশী মুদ্রার রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভের জন্য কেউ কেউ যে চিল চিৎকার করেন, সেই চিৎকারের ভিত্তি-ই বা কী? রাজনৈতিক নেতৃত্বের আহামরি কোনো পদক্ষেপের কারণে তো নয়, দেশের অর্থনীতি যে সচল আছে, তা কেবল আমার দেশের শ্রমিক আর কৃষকের প্রাণান্ত শ্রমের কারণে। দেশের মাথাপিছু গড় আয় এক হাজার চুয়াল্লিশ ডলার বলে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বলা হয় না এর মধ্যে প্রশিক্ষিত চোরদের এক হাজার ডলার আর রহিমুদ্দি-কলিমুদ্দির ভাগে যে চুয়াল্লিশ ডলার ছিল, তাই-ই রয়ে গেছে।
পুরোটাই শুভঙ্করের ফাঁকি। দেশের আপাদমস্তক নাকি মুড়ে দেয়া হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির স্বর্ণময় সাফল্যে। বিচ্ছিন্নপ্রায় দুর্গম দ্বীপ থেকেও পাসপোর্ট-ভিসার ফরম পূরণ করা যায়। অনলাইনে ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, টেন্ডার ড্রপ শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। বলি কী, আপনারা আর আপনাদের মামারা মিলে চুরিদারিও অনলাইনভিত্তিক করে ফেলেছেন। সর্বাধুনিক পশ্চিমা প্রযুক্তির কল্যাণে সর্বাধুনিক চুরি! এখানে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড মানে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন আর কিন্ডারগার্টেন দলের সমান দূরত্বে থেকে গোল করা (আকেলমান্দ পাঠক বুঝে নিন)। যে শ্রমিকের কৃতিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ, রানা প্লাজা ধসে তাদের কাতারে কাতারে মৃত্যুর সময় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ধুয়ে মুছে কীভাবে স্যানিটাইজ করে দেখানো হয়েছিল, আমরা ভুলিনি। সবকিছুই স্যানিটাইজড হয়, সেন্সরড হয়, তার মধ্যেও আবার যখন একজন বদি, লতিফ সিদ্দিকী কিংবা মান্নান খানের মতো কীর্তিমানের কীর্তিগুলো খবরের কাগজে চলে আসে, তখন তারা একখানা কমন ডায়ালগ ঝেড়ে দেন। সেটা হল ‘আমাদের কথা’ গণমাধ্যমে সঠিকভাবে আসেনি।
ইহুদিবাদে আছে- ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে অসংখ্য বিরূপ পরিস্থিতি সহ্য করা যায় (রাব্বিনিক ইহুদিবাদের টেক্সট তালমুদ দ্রষ্টব্য)। বাইবেল বলছে, ‘দেখ কীভাবে কৃষক মাটিতে মূল্যবান ফসল জন্মানোর জন্য অপেক্ষায় থাকে, যতদিন না মাটি পায় মৌসুমের শুরুর এবং শেষের বৃষ্টির’ (জেমস ৫ : ৭-১১)। হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মে ধ্যানের মাধ্যমে ধৈর্য ধারণের কথা বলা হয়েছে। আর কোরআনে আছে, ‘আল্লাহ তাদেরই দেন যোগ্য পুরস্কার, যারা ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে থাকে।’
দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর ইতিহাস ধৈর্যের-ই ইতিহাস। ‘হিউম্যান, টু অল হিউম্যান’ (Human, All Too Human) গ্রন্থের নিটশের অবশ্য ধৈর্য ধরার ব্যাপারটা এতই কঠিন মনে হয়েছিল যে, শ্রেষ্ঠ কবিদেরও শেষ পর্যন্ত তিনি ধৈর্য ধরার অপারগতাকে কবিতায় প্রতিস্থাপন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তো নিটশের পরামর্শমতো সবাই তো আর কবিতা লিখতে পারবেন না। অতএব যারা কবিতা লিখতে পারে না, অবশেষে, তাদের হাতে থাকে কেবল মর্জিনার ঝাড়ু (আলী বাবা চল্লিশ চোর)। জঞ্জাল পরিষ্কার করতে ঝাড়ু হাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া ছাড়া তাদের উপায় তো আর কিছু দেখি না!
জয়া ফারহানা : লেখিকা, উন্নয়নকর্মী
শরীরের সমস্ত রক্ত কেবল মাথায় প্রবাহিত হলে তাকে যেমন সুস্বাস্থ্য বলা যায় না, তেমন কেবল দলীয় উন্নয়নকেও দেশের উন্নয়ন বলা যাবে না। তারপরও কে রুখতে পারে তাদের উন্নয়নসংক্রান্ত বয়ান বরং কেউ সত্য বয়ান করলে সেই বয়ানের মধ্যেই চালানো হয় কাঁচি। বাধ্য হয়ে বোকাসোকা নিবন্ধকারদের লিখতে হয়- ‘ফুল কেন ফোটে,’ ‘পাখি কেন গান গায়’, ‘আকাশ কেন নীল’, ‘সাগর কেন অসীম’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব লেখা ছাড়া উপায়-ই বা কী? লেখা কি যাবে, পুলিশ কেন হাজার হাজার নিরীহ মানুষ ধরে নিয়ে যায়, ভালো মানুষগুলো কেন নিভৃতচারী আর মন্দরা পর্দায়? না, লেখা যাবে না। হয়তো ইতিমধ্যে লেখার এই অংশ ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এখানে কাঁচির কর্ম সম্পাদিত হয়ে গেছে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, উন্নয়ন উন্নয়ন বলে রাত-দিন যে জিগির চলছে, সেই উন্নয়নের আসল দাবিদার কারা? বাইশ হাজার কোটি টাকার যে বিশাল বিদেশী মুদ্রা অর্জিত হয়েছে, তা কাদের শ্রম আর ঘামের বদলে? এর দাবিদার কেবল আমার পোশাক-শ্রমিক বোন আর ভায়েরা। প্রবাসী ভাইদের পাঠানো রেমিটেন্সের কল্যাণে গড়া বিদেশী মুদ্রার রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভের জন্য কেউ কেউ যে চিল চিৎকার করেন, সেই চিৎকারের ভিত্তি-ই বা কী? রাজনৈতিক নেতৃত্বের আহামরি কোনো পদক্ষেপের কারণে তো নয়, দেশের অর্থনীতি যে সচল আছে, তা কেবল আমার দেশের শ্রমিক আর কৃষকের প্রাণান্ত শ্রমের কারণে। দেশের মাথাপিছু গড় আয় এক হাজার চুয়াল্লিশ ডলার বলে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বলা হয় না এর মধ্যে প্রশিক্ষিত চোরদের এক হাজার ডলার আর রহিমুদ্দি-কলিমুদ্দির ভাগে যে চুয়াল্লিশ ডলার ছিল, তাই-ই রয়ে গেছে।
পুরোটাই শুভঙ্করের ফাঁকি। দেশের আপাদমস্তক নাকি মুড়ে দেয়া হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির স্বর্ণময় সাফল্যে। বিচ্ছিন্নপ্রায় দুর্গম দ্বীপ থেকেও পাসপোর্ট-ভিসার ফরম পূরণ করা যায়। অনলাইনে ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, টেন্ডার ড্রপ শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। বলি কী, আপনারা আর আপনাদের মামারা মিলে চুরিদারিও অনলাইনভিত্তিক করে ফেলেছেন। সর্বাধুনিক পশ্চিমা প্রযুক্তির কল্যাণে সর্বাধুনিক চুরি! এখানে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড মানে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন আর কিন্ডারগার্টেন দলের সমান দূরত্বে থেকে গোল করা (আকেলমান্দ পাঠক বুঝে নিন)। যে শ্রমিকের কৃতিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ, রানা প্লাজা ধসে তাদের কাতারে কাতারে মৃত্যুর সময় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ধুয়ে মুছে কীভাবে স্যানিটাইজ করে দেখানো হয়েছিল, আমরা ভুলিনি। সবকিছুই স্যানিটাইজড হয়, সেন্সরড হয়, তার মধ্যেও আবার যখন একজন বদি, লতিফ সিদ্দিকী কিংবা মান্নান খানের মতো কীর্তিমানের কীর্তিগুলো খবরের কাগজে চলে আসে, তখন তারা একখানা কমন ডায়ালগ ঝেড়ে দেন। সেটা হল ‘আমাদের কথা’ গণমাধ্যমে সঠিকভাবে আসেনি।
ইহুদিবাদে আছে- ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে অসংখ্য বিরূপ পরিস্থিতি সহ্য করা যায় (রাব্বিনিক ইহুদিবাদের টেক্সট তালমুদ দ্রষ্টব্য)। বাইবেল বলছে, ‘দেখ কীভাবে কৃষক মাটিতে মূল্যবান ফসল জন্মানোর জন্য অপেক্ষায় থাকে, যতদিন না মাটি পায় মৌসুমের শুরুর এবং শেষের বৃষ্টির’ (জেমস ৫ : ৭-১১)। হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মে ধ্যানের মাধ্যমে ধৈর্য ধারণের কথা বলা হয়েছে। আর কোরআনে আছে, ‘আল্লাহ তাদেরই দেন যোগ্য পুরস্কার, যারা ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে থাকে।’
দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর ইতিহাস ধৈর্যের-ই ইতিহাস। ‘হিউম্যান, টু অল হিউম্যান’ (Human, All Too Human) গ্রন্থের নিটশের অবশ্য ধৈর্য ধরার ব্যাপারটা এতই কঠিন মনে হয়েছিল যে, শ্রেষ্ঠ কবিদেরও শেষ পর্যন্ত তিনি ধৈর্য ধরার অপারগতাকে কবিতায় প্রতিস্থাপন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তো নিটশের পরামর্শমতো সবাই তো আর কবিতা লিখতে পারবেন না। অতএব যারা কবিতা লিখতে পারে না, অবশেষে, তাদের হাতে থাকে কেবল মর্জিনার ঝাড়ু (আলী বাবা চল্লিশ চোর)। জঞ্জাল পরিষ্কার করতে ঝাড়ু হাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া ছাড়া তাদের উপায় তো আর কিছু দেখি না!
জয়া ফারহানা : লেখিকা, উন্নয়নকর্মী
No comments