সাবেক এমপি টিপু সুলতানের পুত্রবধূর রহস্যজনক মৃত্যু
রাজধানীর ধানমন্ডিতে যশোর-৫ মনিরামপুরের সাবেক এমপি খান টিপু সুলতানের পূত্রবধূর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। তার নাম শামারুখ মাহজাবিন (২৬)। ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশ তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে। নিহত মাহজাবিন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিএমএসএসইউতে এফসিপিএসে ভর্তি হয়েছিলেন। সহপাঠী ও পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, মাহজাবিনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর মাহজাবিন আত্মহত্যা করেছে বলে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন নাটক সাজিয়েছে। তবে নিহতের স্বামী এমপিপুত্র হুমায়ূন সুলতান সাদাব এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধানমন্ডি থানায় নিয়ে গেছে।
পুলিশ জানায়, ধানমন্ডির ৬ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর প্লটের কেয়ারী তাজ অ্যাপার্টমেন্টের তিন তলার ডি-২ ফ্ল্যাটে স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতেন মাহজাবিন। তার স্বামী হুমায়ূন সুলতান সাদাব পুরান ঢাকার জজকোর্টে ওকালতি করেন। গতকাল সকালে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বাসা থেকে বের হন। প্রাইভেট কারে হঠাৎ মাহজাবিনের মোবাইল ফোনে একটি কল আসে। ফোন না ধরায় সাদাব তার স্ত্রী মাহাজাবিনকে কে ফোন করেছিল জিজ্ঞেস করেন। এসময় মাহজাবিন তার এক বান্ধবীর কথা জানান। সাদাবের সন্দেহ হলে তিনি নিজে ফোনটি নিয়ে কল ব্যাক করে দেখেন একটি ছেলে ফোন ধরেছে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি ও মনোমালিন্য হয়। পরে মাহজাবিনকে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে নামিয়ে দিয়ে সাদাব জজ কোর্টে চলে যান। দুপুরে সাদাব বাসায় ফিরলে মাহজাবিন তার কাছ থেকে ক্ষমা চান। এর কিছুক্ষণ পর তিনি বাথরুমে গিয়ে দীর্ঘ সময় ভেতর থেকে ছিটকিনি আটকিয়ে রাখেন। পরে পরিবারের লোকজনের সন্দেহ হলে প্রথমে ডাকাডাকি ও পরে বাথরুমের দরজা ভেঙে মাহজাবিনকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। দ্রুত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের সেন্ট্রাল হাসপাতালে। সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে ধানমন্ডি থানার এসআই কাজী শরীফ জানান, বাথরুমের জানালায় ওড়না বেঁধে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে মাহজাবিনের শশুর-শাশুড়ি ও স্বামী জানিয়েছে। একটি সূত্র জানান, মাহজাবিনকে যখন উদ্ধার করা হয় তখন তিনি বাথরুমে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় হাঁটুমোড়া দিয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। এছাড়া তার হাতে কাটা দাগ রয়েছে।
গতকাল রাতে ধানমন্ডির সেন্ট্রাল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিহত মাহজাবিনের স্বজন ও সহপাঠীরা সবাই ভিড় করছেন। তারা কেউই সদ্য চিকিৎসক হয়ে ওঠা মাহজাবিনের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। কেউ বিশ্বাসও করতে চাইছেন না মাহজাবিন আত্মহত্যা করতে পারেন। সহপাঠী ও স্বজনদের ধারণা মাহজাবিনকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত মাহজাবিনের মামা প্রকৌশলী কাজী ফিরোজুর রহমান বলেন, তার ভাগ্নি আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। মাহজাবিনের খালাতো বোন দিলারা আরিফ বলেন, তার বোন আত্মহত্যা করতে পারে না। ও (মাহাজাবিন) একটু চাপা স্বভাবের ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। পর্দানশীনও ছিল। তাকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতের বান্ধবী হলি ফ্যামিলির ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. ডালিয়া নওশিন বলেন, মাহজাবিন এত চাপা স্বভাবের ছিল যে সে ব্যক্তিগত কোন বিষয় কারও সঙ্গে শেয়ার করতো না। নিহতের বড় ভাই শাহনূর শরীফ বলেন, মাহজাবিনকে তার শশুর-শাশুড়ি পিতার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিতো না। তাকে নিয়মিত মানসিক টর্চার করা হতো। মাহজাবিন কখনওই আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে হত্যা করা হয়েছে। আর বাথরুমে যে ভাবে ঝুলে থাকার কথা বলা হচ্ছে সেভাবে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে না। নিহতের ভাবী ডা. ওয়াহিদা গণি তানিয়া বলেন, গত বছরের ২৬শে এপ্রিল সাদাবের সঙ্গে পারিবারিকভাবে মাহজাবিনের বিয়ে হয়। বিয়ের আগে তারা জানতেন সাদাব লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেছেন। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর জানতে পারেন সাদাব লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ না করেই দেশে ফেরেন। পরে দেশেই একটি ল কলেজ থেকে এলএলবি পাস করে জজকোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। বিষয়টি জানার পর মাহজাবিন অনেক ভেঙে পড়ে। তিনি বলেন, স্বামীর চেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হওয়ায় শ্বশুর-শাশুড়ি কেউ তাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হতে দিতে চায়নি। বাসার বুয়া বাদ দিয়ে তাকে দিন-রাত কাজ করতে বাধ্য করা হতো। এমনকি শ্বশুরবাড়ির কোন গাড়িও ব্যবহার করতে দিতো না তাকে। ডা. তানিয়া বলেন, মাহজাবিনের শাশুড়ি ডা. জেসমিন আরা বেগম হলি ফ্যামিলির গাইনি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি পুত্রবধূর কাছে যৌতুক হিসেবে নানা জিনিসপত্র দাবি করতেন। তাকে পিতার বাড়িতে আসতে দিতে চাইতেন না। কিন্তু বিয়ের আগে তিনিই নিজে উদ্যোগী হয়ে মিষ্টি কথা বলে মাহজাবিনকে পূত্রবধূ করে ঘরে তোলেন।
স্বজনরা জানান, নিহত মাহজাবিনের পিতার নাম নূরুল ইসলাম। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। তার মা ডা. কাজী শাহানা পারভীন বছর দুই আগে মারা যান। দুই ভাইবোনের মধ্যে মাহজাবিন ছোট। তার গ্রামের বাড়ি যশোরের আরিফপুরে। খবর পেয়ে গতকাল রাতেই পরিবারের সদস্যরা যশোর থেকে আকাশ পথে ও সড়কপথে ঢাকায় আসেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার রেজাউল করিম বলেন, সাবেক এমপির পূত্রবধূ আত্মহত্যা করেছেন বলে তারা খবর পেয়েছেন। এটা আত্মহত্যা নাকি অন্য কিছু ময়নাতদন্তের আগে কিছু বলা যাবে না। ময়নাতদন্তের পর বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এর আগে নিহতের স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেয়া হয়েছে।
No comments