‘তাবিজে পোলাপানের চিকিৎসা অয়’ by আবু জাফর খান
উপকূলীয় অঞ্চলে অবহেলিত জনপদ চরহাদি। এখানে চিকিৎসক নেই। স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই। তাবিজ আর কবজ এ চরের ওষুধ এবং বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। জান্নাত এই চরের একটি গরিব ঘরের শিশু। জন্মের পরপর তার গলায় ঝুলানো হয়েছে চারটি তাবিজ। একটি দেয়া হয়েছে পাতলা পায়খানা ও বমি না হওয়ার জন্য, একটি ঠান্ডাজনিত হাঁচি-কাশি থেকে রক্ষা, একটি জ্বর না হওয়া এবং আরেকটি দেয়া হয়েছে জিন-পরীর আছর থেকে রক্ষা ও ভয়ভীতি থেকে মুক্ত থাকার জন্য। ওঝা বা ফকিরের ঝাড়-ফুঁক দেয়া ওই সব তাবিজ-কবজ। এত সব তাবিজ-কবজ অতিক্রম করে শিশুটির মাঝে মধ্যে পাতলা পায়খানা হয়েছে, বমি, হাঁচি-কাশি এবং জ্বর হয়েছে, আবার সুস্থও হয়েছে। তবে এসব রোগ দেখা দিলে রোগের ধরন অনুযায়ী তাবিজ কবজের পাশাপাশি খাবার স্যালাইন খাওয়ানো হয়, হাতে-পায়ে ও বুকে সরিষার তেল এবং রোশন গরম করে মালিশ করা হয়। কখনও আবার প্যারাসিটামল সিরাপ নদী পাড়ি দিয়ে শহর থেকে নিয়ে এসে খাওয়ানো হয়। এ বক্তব্য জান্নাতের মা জামিলা আক্তারের। তার বাবা নুর হোসেন গাজী। দশমিনা উপজেলার চরহাদিতে বসবাস। অজ্ঞতাবশত জান্নাতের মা জামিলার ধারণা, তাবিজ তার সন্তানের শরীরে না থাকলে ওই সব রোগ শিশুটিকে চেপে ধরত এবং সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। তিনি আরও বলেন, ‘চউরগ্যা সব গুরাগ্যারার গলায়, মাজায় (কোমর), আতে (হাতে) জন্মের পর তাবিজ-কবজ দেয়া অয়। তাবিজ-কবজই বাঁচাইয়া রাহে চরের গুরাগ্যারারে। চর গুইরগ্যা (ঘুরে) দ্যাহেন কোন হানে একটা ডাক্তার কবিরাজ পাওয়ন যাইবে না। এই তাবিজেই আমাগো পোলাপানের চিকিৎসা অয়।’ চরাঞ্চলে ডাক্তার নেই, তাই চরের শিশুদের রোগ সারাতে তাবিজ-কবজ, ঝাড়-ফুঁক চরবাসীর একমাত্র উপায়, এ বিশ্বাস চরবাসীর। এ কারণে চরের শিশুদের কোন রোগ কিংবা অসুখ দেখা দিলে ওঝা ফকিরের কাছে ছুটে যায় সবাই। চরবাসীর পুরোনো ওই সব ধ্যান-ধারণার বিশ্বাস এবং সরলতার সুযোগে এক শ্রেণীর তাবিজ-কবজ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন চরে ঘুরে তাবিজ বিক্রি করে। মওসুুমি ওই সব তাবিজ ব্যবসায়ীরা চরে গিয়ে বেশি সময় অবস্থান করে না। ৪ থেকে ৫ দিনের ব্যবধানে স্থান পরির্বতন করে চলে যায় অন্য চরে। চড়া দামে তাবিজ বিক্রি করে হাতিয়ে নেয় চরের মানুষের অর্থ কড়ি। সম্প্রতি ওইচরে দেখা মেলে এমনই এক মওসুমি ওঝার। নাম আছির উদ্দিন মাতুব্বর (৫৫)। বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার গোয়ালনিমাদ্রা গ্রামে। তাবিজ-কবজ বিক্রি করে চলে তার সংসার। বছরের পুরো সময় বিভিন্ন চর কিংবা গ্রামাঞ্চলে তাবিজ-কবজ বিক্রি করেন। তিনি জানান, তার কাছে যে তাবিজ রয়েছে তাতে শিশুদের ১০টি রোগ ভাল হয়। এর মধ্যে বাচ্চাদের কড়ি ব্যথা, শরীর ব্যথা, শ্বাস, কাশ, রাতে বিছানায় প্রস্রাব করা, বাচ্চাদের জিন-ভূতের আছরসহ ১০টি রোগের সমাধান হয়। আর এসব সমস্যা থেকে রেহাই পেতে তার কাছে রয়েছে আটমোড়, হুক্কারকাঠী, রুদ্রাক্ষর, ঠান্ডিগোটা, নজরগোটা ও কড়ি। এসব নিয়ে ওঝাদের ছলাকলায় কাবু চরের মানুষরা। আছির উদ্দিন মাতুব্বর বলেন, ‘বছরের সব সময় আমাদের লোকজন চরে আসে। আজ এক চরে, কাল আবার আরেক চরে। আমরা যেসব রোগের চিকিৎসা করি ওইসব সমস্যা চরের লোকজনের বেশি। তাই চরেই বেশি আসি। এছাড়াও বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে তাবিজ বিক্রি করি। দৈনিক ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। রোগ ভাল না হলে মানুষ আমাদের কাছ থেকে তাবিজ কিনত না। উপকার পায় তাই কেনে।’ চরের বিভিন্ন ব্যক্তির কথা বলে জানা গেছে, লেখাপড়া না জানা, অজ্ঞতা, আর্থিক দৈন্যতা, প্রয়োজন মতো চিকিৎসক ও ওষুধ না পাওয়ার কারণে তারা ওঝা কিংবা ফকিরের দারস্থ হয় এবং তুকতাক কিংবা ঝাড়-ফুঁকে বিশ্বাস করে চরের শিশুদের চিকিৎসা করে। ফলে অবহেলিত চরের শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা বছরের পর বছর ধরে শত ভাগ ঝূঁকিপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. এএম মজিদুল হক বলেন, ‘চরাঞ্চলে আমাদের যথেষ্ট জনশক্তি রয়েছে। কিন্তু চরের মানুষগুলো অধিকাংশই অশিক্ষিত, তাই পুরোনো ধ্যানধারণার কারণে তারা ওইসব চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে বের হতে পারছে না। এজন্য জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় সকল দপ্তরের সম্মিলিত ব্যবস্থার মাধ্যমে এদের সচেতন করতে পারলে চরের শিশুদের চিকিৎসায় পরির্বতন নিয়ে আসা সম্ভব।’
No comments