পরিবারের সবাই অন্ধ by রফিকুল ইসলাম সাজু
‘যার কেউ নেই, তার সঙ্গে আল্লাহ আছেন।’ এমন কথা অনেককে বলতে দেখা যায়। কথাটির যে সত্যতা রয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ঝুমুরী বেগম (৪২) এবং তার সন্তানদের দিকে তাকালে। ঝুমুরী বেগম নিজেও চোখে দেখতে পান না। তার যে তিন সন্তান রয়েছে তারাও দেখতে পায় না। জন্ম থেকেই তারা অন্ধ। এক এক করে অন্ধ সন্তান জন্ম নেয়ার পর পরিবারের কর্তা বাছের আলী স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যান এবং আরেকটি বিয়ে করে ঘর-সংসার শুরু করেন। এরপর ঝুমুরী বেগম সন্তানদের নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। পৃথিবীর আলো দেখতে যেমন যুদ্ধ করছেন, তেমনি লড়াই করছেন অভাবের সঙ্গে। রৌমারী উপজেলার উত্তর সীমান্ত ঘেষা দুর্গম ইটালুকান্দা গ্রামে অসহায় ওই পরিবারটির বসবাস। সম্প্রতি ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় পরিবারটির সঙ্গে। তারা জানায়, অন্ধত্বের কাহিনী। দুই হাতের ওপর জীবিকা নির্বাহ করেন স্ত্রী ঝুমুরী বেগম। বিয়ের পর তার চোখে হঠাৎ করেই সমস্যা দেখা দেয়। অসময়ে চিকিৎসা নেয়ার ফলে দুই চোখে কিছুই দেখন না। সব সময় চোখে যন্ত্রণা করে। এ অবস্থায় প্রথম পুত্র সন্তানের জন্ম দেন ঝুমুরী বেগম। তার চোখের গুরুতর সমস্যা। এরপর আরও দুই সন্তান হয় তাদের। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তারাও কিছু দেখতে পায় না। সন্তানদের এই যখন অবস্থা তখন বাছের আলী স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে বাড়ি থেকে চলে যান ছয় বছর আগে। বাছের আলী চলে গিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে ঘর-সংসার শুরু করেন। কিন্তু তার আগের ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের আর খোঁজখবর নেন না। ঝুমুরী বেগম ও তার সন্তানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বড় ছেলে আইয়ুব আলী (১৫) চোখে খুবই কম দেখে। তার ছোট লিমন মিয়া (১০) বছর। সে কিছুই দেখতে পায় না। একই অবস্থা পরিবারের সবার ছোট রতনা খাতুন (৭)। সেও চোখে কিছুই দেখতে পায় না। আইয়ুব আলী জানায়, ‘আমি চোখে দেখতে পাই কিন্তু কম কম। দূরের কোন কিছু দেখতে পাই না। ক্লাস সেভেনে পড়ছিলাম। খাতা-কলম কাপড়চোপড় না থাকায় পরে পড়া বাদ দিছি। আমার এহনও পড়ার ইচ্ছা আছে।’ ঝুমুরী বেগম বলেন, ‘গেদার বাপে চইলা যাওনের পর খুব কষ্ট অইছে পোলাপানের। আয়-রোজগার নাই, ঘরে খাওন নাই। কামাই করার মানুষ নাই। হেরমদ্দে আল্লাহ আমার এবং পোলাপানের চোখে অসুখ দিছে। বড় পোলা একটু-আধটু দেখপার পাইলেও আর দুইডা চোখে কিছুই দেহে না। ট্যাহা-পয়সাও নাই যে বড় ডাক্তার দেহামু। মাইনসে কয় বড় ডাক্তারের কাছে গেলে চোখ ভালা হইয়া যাবো। কিন্তু এত ট্যাহা পামু কই। আমার বুইনের (বোনের) বাড়ি থিকা খাওন না দিলে অনেক আগেই খাওনের অভাবে মইরা যাইতাম। এহনও যে অবস্থা একবেলা খাওন জোগাবার পাইলে আরেক বেলা উপোস থাহা নাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় পোলাপানেক বিষ খাইয়া নিজেও বিষ খাইয়া মইরা যাই। আবার ভাবি বিষ খাইয়া মরলে পাপ হয়।’ কথা বলে আরও জানা গেছে, পরিবারের সবাই অন্ধ হলেও সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা তাদের ভাগ্যে জোটেনি। বিধবা-ভাতা ও ভিজিডি সুবিধাও তারা পায় না। এ প্রসঙ্গে ঝুমুরী বেগম বলেন, ‘মেম্বারগর হাত ধইরা কইছিলাম এডা কার্ড দেওনের জন্য। কিন্তু ট্যাহা জোটাপার পাই নাই দেইখ্যা আমার নাম দেয় নাই। ট্যাহা দিবার পাইলে ঠিকই আমার নাম নিত।’ গ্রামবাসী আবদুুল মতিন, বানিজ উদ্দিন, ইউনুস আলী, আজিবর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন জানান, পরিবারটি খুবই অসহায়। সবাই অন্ধ। আমরাও আমাদের ওয়ার্ড মেম্বারকে বলেছিলাম, তাদের একটা মাতা কার্ড (ভিজিডি) দেয়ার জন্য কিন্তু মেম্বার টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মেম্বার মন্টু মিয়া টাকা নেয়া ও চাওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার নামে বরাদ্দই কম। তাই চাহিদা অনুসারে সবাইকে দেয়া সম্ভব হয় না।’ পরিবারের সবাই অন্ধ এমন বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদল গনি জানান, বিষয়টি আমার জানা আছে। আমরা সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করছি।
No comments