ছয় অভিযোগে ফাঁসি, চারটিতে ৪০ বছর জেল
ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগের মধ্যে ছয়টিতেই ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া চারটিতে মোট ৪০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আর একটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। পৃথক পৃথক অভিযোগে পৃথকভাবে দণ্ড ঘোষণা করা হলেও রায়ে বলা হয়েছে, তিনি একটি দণ্ড- মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অন্যান্য দণ্ড এই মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে।
গত বছরের ৯ অক্টোবর বিএনপি নেতা খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে এক নম্বর অভিযোগটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুই নম্বর অভিযোগে ৫ বছর, তিন নম্বর অভিযোগে ১০ বছর, চার নম্বর অভিযোগে ২০ বছর এবং ১১ নম্বর অভিযোগে ৫ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।যেসব অপরাধে মৃত্যুদণ্ড : জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযোগটি ছিল লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, গণহত্যা, নিপীড়ন, জখম ও আটক করার বিষয়ে। এ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৩০ মে সকাল ৮টার দিকে খোকন তার রাজাকার বাহিনী নিয়ে কোদালিয়া শহীদনগর গ্রামে প্রবেশ করেন। এ সময় পাকিস্তানি আর্মিরা গ্রামের অনেক বাড়িঘরে লুটপাট চালায়। ভেলুর ভিটা জঙ্গলে আত্মগোপন থাকা ৫০-৬০ জনকে সেখান থেকে ধরে আনে খোকন ও পাকিস্তানি সেনারা। পরে তাদের তিন ভাগে ভাগ করে লাইনে দাঁড় করায়। একপর্যায়ে খোকন রাজাকার ও তার সঙ্গীরা গুলি ও ব্রাশফায়ার করে। এতে ১৬ জন নারী ও শিশু নিহত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন আকরামুন নেছা (৪৫), রোকসানা আক্তার (১৮), রাবেয়া বেগম (৫০), হেলেনা আক্তার (১৫) ও হামেদা বেগম (২৫)। এ ছাড়াও ওই দিন খোকন রাজাকার কোদালিয়া গ্রামের আফজাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করেন। এসব অপরাধের জন্য খোকনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।তার বিরুদ্ধে ষষ্ঠ অভিযোগ ছিল- হত্যা, গণহত্যা, গুরুতর জখম, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের। একাত্তরের ৩০ মে দুপুরে সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী তার নেতৃত্বে ঈশ্বরদী গ্রামে প্রবেশ করে। এ সময় তাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাও ছিল। তারা অনেক বাড়িঘড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামের লোকজন প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকলে রাজাকার খোকন এবং পকিস্তানি আর্মিরা পলায়নরত সালাম মাতুব্বর, শ্রীমতি খাতুন, লাল মিয়া, আ. মাজেদ- এ চারজনকে উত্তর মাঠ নামক স্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। এ সময় তারা শিশু ফুলমতিকেও গুলি করে আহত করে। এ অভিযোগেও তাকে দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।সপ্তম অভিযোগ ছিল- হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের। একাত্তরের ৩১ মে সকাল অনুমান সাড়ে ৭টার দিকে খোকনের নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকাররা পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে শহীদনগর কোদালিয়া গ্রামের পাশে দিঘলিয়া-ঘোড়ারনারা বিলে যায়। তারা ২৯ মে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পাকিস্তানি আর্মিদের লাশের সন্ধান করে। তখন গ্রামের লোকজন ভয়ে এদিক-সেদিক পালিয়ে যায়। এ সময় রাজাকাররা অসুস্থ পিজির উদ্দিনের বসতঘর, তার ভাই আফাজ এবং তাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী সাদেকের বসতঘর পুড়িয়ে দেয়। পিজির, আফাজ ও ছাদেক আগুনে পুড়ে মারা যান। পরে খোকন রাজাকার আছির উদ্দিন মাতুব্বরকে গুলি করে হত্যা করেন। ইদ্রিস সদ্দারের পিতা সফিজউদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগেও তাকে দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম অভিযোগে বলা হয়- একাত্তরের ৩১ মে দুপুরে জাহিদ হোসেন খোকনের নেতৃত্বে রাজাকাররা একদল পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে গোয়ালদী গ্রামে প্রবেশ করে। এ সময় পলায়নরত বৃদ্ধ রাজেন্দ্রনাথ রায়কে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা হান্নান মুন্সি তালগাছের আড়াল থেকে দেখতে পান। হান্নান মুন্সীর মায়ের কোলে থাকা তার দুই বছরের বোন বুলু খাতুন গুলিতে নিহত হয়। এ অভিযোগেও খোকনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।নবম অভিযোগে বলা হয়- একাত্তরের ৩১ মে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সশস্ত্র খোকনের নেতৃত্বে আতাহার, আয়নালসহ অন্য রাজাকাররা একদল পাকিস্তানি সেনা নিয়ে পুড়াপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে। একপর্যায়ে তারা রতন শেখ, বারেক মোল্লা, ছোট খাতুন ও সফিজউদ্দিন শেখসহ ৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে রতন শেখ ও ছোট খাতুনকে রাজাকার জাহিদ হোসেন নিজ হাতে গুলি করেন। এ ছাড়া বারেক মোল্লাকে সশস্ত্র রাজাকাররা ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। তারা গ্রামের অনেক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এ অভিযোগেও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।তার বিরুদ্ধে দশম অভিযোগটিও ছিল- হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের। এ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১ জুন সকাল অনুমান ৬টার দিকে জাহিদ হোসেন খোকন বাগাট চুড়িয়ারচর গ্রামে প্রবেশ করেন। তারা ফজলুল হকের বাড়ি পুড়িয়ে দেন। অনেকের বাড়িতে লুটপাট চালান। এ সময় মালেক মাতুব্বর, ভাই মোশারফ মাতুব্বরসহ চারজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমজাদ মুন্সিকে রাজাকাররা ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। ওই সময় মিনি বেগম ও তার আম্মা লুকানো অবস্থায় খোকনকে চিনতে পারেন। এ ছাড়া গ্রামের পশ্চিমপাড়ার দক্ষিণ মাঠের মধ্যে পলায়নরত অবস্থায় রতন মাতুব্বর, আইয়ুব, মঞ্জু ও রানীসহ ১০-১৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগেও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।তার বিরুদ্ধে আনা দুই নম্বর অভিযোগে বলা হয়- ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত যেকোনো দিন খোকন ও তার বড় ভাই জাফরের নেতৃত্বে রাজাকাররা জংগুরুদী বাগুটিয়া গ্রামের কানাই লাল মণ্ডলসহ দুজনের ঘর পুড়িয়ে দেয়। এরপর সবাইকে হুমকি দেয় যে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে না হলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে বা মরতে হবে। ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করেন।তৃতীয় অভিযোগটিও ছিল- হিন্দুদের ধরে হত্যাসহ নানাবিধ ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের। এ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৬ মে থেকে ২৮ মে যেকোনো দিন সকালের দিকে সশস্ত্র রাজাকার খোকন ও তার ভাই জাফরের নেতৃত্বে রাজাকাররা জীবন দাশের বাড়িতে যায়। জীবন দাশ ও তার তিন ভাইকে জোরপূর্বক মুসলমান বানায়। এরপর তাদের স্ত্রীদের হাতের শাখা ভাঙিয়ে সিঁথির মুছে মৌলভী দিয়ে কলেমা পড়িয়ে ধর্মান্তরিত করে। জীবন দাশসহ তার ভাইয়েরা প্রাণভয়ে ভারতে চলে যান। পরে তারা আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে আসেন। এটি প্রমাণিত হওয়ায় ১০ বছর দণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়- ১৯৭১ সালের ২৭ মে খোকন ও জাফরের নেতৃত্বাধীন রাজাকাররা চাঁদহাট গ্রামের হিন্দু এলাকা বণিকপাড়ায় প্রবেশ করে। এ সময় পলায়নরত জগন্নাথ দত্তের বাবা ভুবন মোহন দত্ত, ভুবন মোহন দত্তের ভাইদেরসহ ১৬-১৭ জনকে ধরে। রাজাকাররা জগন্নাথ দত্তের কাকি সুচিত্রার কাছ থেকে ৪২ ভরি স্বর্ণালংকার, ৩২৮ ভরি রুপার অলংকার, রেডিও ও ঘড়ি ছিনিয়ে নেয়। জগন্নাথ দত্তের বসতঘর ও মন্দির লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। চাঁদহাট গ্রামের বণিকপাড়ায় আসামি খোকন রাজাকার ঠাকুর দাশের স্ত্রী রাধা রানীকে ধর্ষণ করেন। একইভাবে হলধরদের অবিবাহিত কন্যা খুকুমনিকেও ধর্ষণ করে খোকন। পরে ধর্ষিতারা তাদের পরিবারসহ ভারতে চলে যান। এটি প্রমাণীত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে ২০ বছরের দণ্ড দিয়েছেন।রাষ্ট্রপক্ষের ১১তম অভিযোগে বলা হয়- ১৯৭১ সালের ১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত খোকন রাজাকার ও তার দলবল নিয়ে জংগুরদী বাগুটিয়া গ্রামে যায়। ওই গ্রামের কানাই লাল মণ্ডলদের বাড়িতে প্রবেশ করে। সশস্ত্র রাজাকারদের দেখে কানাই লাল মণ্ডল তাদের বাড়ির উত্তর পাশের পাটখেতে পালান। রাজাকাররা তাদের খুঁজে ধরে ফেলে। সেখান থেকে কানাইকে আটক করে তার বাড়ির দক্ষিণ পাশে রাস্তার ওপর নিয়ে আসে। কানাই লাল মণ্ডল মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়েছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না- এ কথা বলে জাহিদ হোসেন খোকন নিজের হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে কানাইকে হত্যা করার জন্য তার বুকের ওপর গুলি করেন। কানাই কাত হয়ে রাস্তার ওপর মাটিতে পড়ে যাওয়ার কারণে, গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কানাইয়ের ডান হাতের কনুইর ওপর দিয়ে মাংস ভেদ করে নিচ দিয়ে বের হয়ে যায়। এ অভিযোগে পাঁচ বছরের দণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ৯ অক্টোবর বিএনপি নেতা খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে এক নম্বর অভিযোগটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুই নম্বর অভিযোগে ৫ বছর, তিন নম্বর অভিযোগে ১০ বছর, চার নম্বর অভিযোগে ২০ বছর এবং ১১ নম্বর অভিযোগে ৫ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।যেসব অপরাধে মৃত্যুদণ্ড : জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযোগটি ছিল লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, গণহত্যা, নিপীড়ন, জখম ও আটক করার বিষয়ে। এ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৩০ মে সকাল ৮টার দিকে খোকন তার রাজাকার বাহিনী নিয়ে কোদালিয়া শহীদনগর গ্রামে প্রবেশ করেন। এ সময় পাকিস্তানি আর্মিরা গ্রামের অনেক বাড়িঘরে লুটপাট চালায়। ভেলুর ভিটা জঙ্গলে আত্মগোপন থাকা ৫০-৬০ জনকে সেখান থেকে ধরে আনে খোকন ও পাকিস্তানি সেনারা। পরে তাদের তিন ভাগে ভাগ করে লাইনে দাঁড় করায়। একপর্যায়ে খোকন রাজাকার ও তার সঙ্গীরা গুলি ও ব্রাশফায়ার করে। এতে ১৬ জন নারী ও শিশু নিহত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন আকরামুন নেছা (৪৫), রোকসানা আক্তার (১৮), রাবেয়া বেগম (৫০), হেলেনা আক্তার (১৫) ও হামেদা বেগম (২৫)। এ ছাড়াও ওই দিন খোকন রাজাকার কোদালিয়া গ্রামের আফজাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করেন। এসব অপরাধের জন্য খোকনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।তার বিরুদ্ধে ষষ্ঠ অভিযোগ ছিল- হত্যা, গণহত্যা, গুরুতর জখম, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের। একাত্তরের ৩০ মে দুপুরে সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী তার নেতৃত্বে ঈশ্বরদী গ্রামে প্রবেশ করে। এ সময় তাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাও ছিল। তারা অনেক বাড়িঘড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামের লোকজন প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকলে রাজাকার খোকন এবং পকিস্তানি আর্মিরা পলায়নরত সালাম মাতুব্বর, শ্রীমতি খাতুন, লাল মিয়া, আ. মাজেদ- এ চারজনকে উত্তর মাঠ নামক স্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। এ সময় তারা শিশু ফুলমতিকেও গুলি করে আহত করে। এ অভিযোগেও তাকে দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।সপ্তম অভিযোগ ছিল- হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের। একাত্তরের ৩১ মে সকাল অনুমান সাড়ে ৭টার দিকে খোকনের নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকাররা পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে শহীদনগর কোদালিয়া গ্রামের পাশে দিঘলিয়া-ঘোড়ারনারা বিলে যায়। তারা ২৯ মে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পাকিস্তানি আর্মিদের লাশের সন্ধান করে। তখন গ্রামের লোকজন ভয়ে এদিক-সেদিক পালিয়ে যায়। এ সময় রাজাকাররা অসুস্থ পিজির উদ্দিনের বসতঘর, তার ভাই আফাজ এবং তাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী সাদেকের বসতঘর পুড়িয়ে দেয়। পিজির, আফাজ ও ছাদেক আগুনে পুড়ে মারা যান। পরে খোকন রাজাকার আছির উদ্দিন মাতুব্বরকে গুলি করে হত্যা করেন। ইদ্রিস সদ্দারের পিতা সফিজউদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগেও তাকে দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম অভিযোগে বলা হয়- একাত্তরের ৩১ মে দুপুরে জাহিদ হোসেন খোকনের নেতৃত্বে রাজাকাররা একদল পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে গোয়ালদী গ্রামে প্রবেশ করে। এ সময় পলায়নরত বৃদ্ধ রাজেন্দ্রনাথ রায়কে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা হান্নান মুন্সি তালগাছের আড়াল থেকে দেখতে পান। হান্নান মুন্সীর মায়ের কোলে থাকা তার দুই বছরের বোন বুলু খাতুন গুলিতে নিহত হয়। এ অভিযোগেও খোকনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।নবম অভিযোগে বলা হয়- একাত্তরের ৩১ মে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সশস্ত্র খোকনের নেতৃত্বে আতাহার, আয়নালসহ অন্য রাজাকাররা একদল পাকিস্তানি সেনা নিয়ে পুড়াপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে। একপর্যায়ে তারা রতন শেখ, বারেক মোল্লা, ছোট খাতুন ও সফিজউদ্দিন শেখসহ ৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে রতন শেখ ও ছোট খাতুনকে রাজাকার জাহিদ হোসেন নিজ হাতে গুলি করেন। এ ছাড়া বারেক মোল্লাকে সশস্ত্র রাজাকাররা ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। তারা গ্রামের অনেক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এ অভিযোগেও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।তার বিরুদ্ধে দশম অভিযোগটিও ছিল- হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের। এ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১ জুন সকাল অনুমান ৬টার দিকে জাহিদ হোসেন খোকন বাগাট চুড়িয়ারচর গ্রামে প্রবেশ করেন। তারা ফজলুল হকের বাড়ি পুড়িয়ে দেন। অনেকের বাড়িতে লুটপাট চালান। এ সময় মালেক মাতুব্বর, ভাই মোশারফ মাতুব্বরসহ চারজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমজাদ মুন্সিকে রাজাকাররা ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। ওই সময় মিনি বেগম ও তার আম্মা লুকানো অবস্থায় খোকনকে চিনতে পারেন। এ ছাড়া গ্রামের পশ্চিমপাড়ার দক্ষিণ মাঠের মধ্যে পলায়নরত অবস্থায় রতন মাতুব্বর, আইয়ুব, মঞ্জু ও রানীসহ ১০-১৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগেও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।তার বিরুদ্ধে আনা দুই নম্বর অভিযোগে বলা হয়- ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত যেকোনো দিন খোকন ও তার বড় ভাই জাফরের নেতৃত্বে রাজাকাররা জংগুরুদী বাগুটিয়া গ্রামের কানাই লাল মণ্ডলসহ দুজনের ঘর পুড়িয়ে দেয়। এরপর সবাইকে হুমকি দেয় যে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে না হলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে বা মরতে হবে। ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করেন।তৃতীয় অভিযোগটিও ছিল- হিন্দুদের ধরে হত্যাসহ নানাবিধ ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের। এ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৬ মে থেকে ২৮ মে যেকোনো দিন সকালের দিকে সশস্ত্র রাজাকার খোকন ও তার ভাই জাফরের নেতৃত্বে রাজাকাররা জীবন দাশের বাড়িতে যায়। জীবন দাশ ও তার তিন ভাইকে জোরপূর্বক মুসলমান বানায়। এরপর তাদের স্ত্রীদের হাতের শাখা ভাঙিয়ে সিঁথির মুছে মৌলভী দিয়ে কলেমা পড়িয়ে ধর্মান্তরিত করে। জীবন দাশসহ তার ভাইয়েরা প্রাণভয়ে ভারতে চলে যান। পরে তারা আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে আসেন। এটি প্রমাণিত হওয়ায় ১০ বছর দণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়- ১৯৭১ সালের ২৭ মে খোকন ও জাফরের নেতৃত্বাধীন রাজাকাররা চাঁদহাট গ্রামের হিন্দু এলাকা বণিকপাড়ায় প্রবেশ করে। এ সময় পলায়নরত জগন্নাথ দত্তের বাবা ভুবন মোহন দত্ত, ভুবন মোহন দত্তের ভাইদেরসহ ১৬-১৭ জনকে ধরে। রাজাকাররা জগন্নাথ দত্তের কাকি সুচিত্রার কাছ থেকে ৪২ ভরি স্বর্ণালংকার, ৩২৮ ভরি রুপার অলংকার, রেডিও ও ঘড়ি ছিনিয়ে নেয়। জগন্নাথ দত্তের বসতঘর ও মন্দির লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। চাঁদহাট গ্রামের বণিকপাড়ায় আসামি খোকন রাজাকার ঠাকুর দাশের স্ত্রী রাধা রানীকে ধর্ষণ করেন। একইভাবে হলধরদের অবিবাহিত কন্যা খুকুমনিকেও ধর্ষণ করে খোকন। পরে ধর্ষিতারা তাদের পরিবারসহ ভারতে চলে যান। এটি প্রমাণীত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে ২০ বছরের দণ্ড দিয়েছেন।রাষ্ট্রপক্ষের ১১তম অভিযোগে বলা হয়- ১৯৭১ সালের ১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত খোকন রাজাকার ও তার দলবল নিয়ে জংগুরদী বাগুটিয়া গ্রামে যায়। ওই গ্রামের কানাই লাল মণ্ডলদের বাড়িতে প্রবেশ করে। সশস্ত্র রাজাকারদের দেখে কানাই লাল মণ্ডল তাদের বাড়ির উত্তর পাশের পাটখেতে পালান। রাজাকাররা তাদের খুঁজে ধরে ফেলে। সেখান থেকে কানাইকে আটক করে তার বাড়ির দক্ষিণ পাশে রাস্তার ওপর নিয়ে আসে। কানাই লাল মণ্ডল মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়েছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না- এ কথা বলে জাহিদ হোসেন খোকন নিজের হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে কানাইকে হত্যা করার জন্য তার বুকের ওপর গুলি করেন। কানাই কাত হয়ে রাস্তার ওপর মাটিতে পড়ে যাওয়ার কারণে, গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কানাইয়ের ডান হাতের কনুইর ওপর দিয়ে মাংস ভেদ করে নিচ দিয়ে বের হয়ে যায়। এ অভিযোগে পাঁচ বছরের দণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
No comments