জজবাড়ির অমর্ত্য সেন by রিপন আনসারী
মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার ঐতিহ্যবাহী মত্ত গ্রাম। আলোকিত এ গ্রামের ছেলে ছিলেন অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী বাঙালি ড. অমর্ত্য সেন। এক সময় জজবাড়ি হিসেবে মানুষ এ বাড়িটিকে চিনতো। কিন্তু এ বাড়িতে এখন বসবাস করছে ছিন্নমূল কিছু অসহায় মানুষ। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ক’বছর আগে জজবাড়ির লোকেরা অনেক স্মৃতি, অনেক মায়া পেছনে ফেলে ভারতে চলে যান। এসব তথ্য বলার মতো বয়সী মানুষ বর্তমানে এখন আর মত্ত গ্রামে নেই। একসময়কার আলোচিত জজবাড়িটি এখন অর্পিত সম্পত্তি। এ গ্রামে শিকড় প্রথিত রয়েছে দেশ এবং বিশ্বখ্যাত বেশ কয়েকজন মানুষের। বিশাল উচ্চতার মত্ত মঠের নজর কাড়ে বহুদূর থেকেই। মঠের ঠিক পেছনে টলমলে জলের বিশাল একটি দিঘি। দিঘির চারপাশে আগাছা আর জঙ্গলে ভরপুর। এর উঁচু দক্ষিণ পাড় এখন পায়ে চলার পথ। সেখানে রিকশাও চলে অনায়াসে। এ পথের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ দিকে তাকালেই নজর পড়ে জড়াগ্রস্ত বস্তির মতো ডজনখানেক কাঁচামাটির টিনের ঘর আর ৯-১০ বছর বয়সী মেহগনির বাগান। একসনা লিজ নিয়ে এ বাড়িতে বসবাস করছে ইদ্রিস আলী, ময়জুদ্দিন, কছিমুদ্দিনের মতো ৭-৮টি দরিদ্র ভূমিহীন পরিবার। পেশায় কেউ কৃষক, কেউ দিনমজুর আর কেউ ক্ষুদ্র দোকানি। এদের অনেকে জানেন না এ বাড়ির জজ সাহেবের ইতিকথা। বোঝেন না নোবেল পুরস্কার, অর্থনীতি, আর জানেনও না অমর্ত্য সেনকে। এখানে এক সময় ছিল বিখ্যাত জজবাড়ি। তবে জজবাড়ির একটি ইট-কাঠও অবশিষ্ট নেই। কালের গর্ভে সব হারিয়ে গেছে। সবাই ভুলে গেছে জজবাড়ির নাম। এ বাড়ির সন্তান বাঙালির গর্ব নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন। ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২০-এর মাঝামাঝি সময়ে সারদা প্রসাদ সেন বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন দেওয়ান বাহাদুর উপাধি। পেশায় ছিলেন সেশন জজ। তার ছোট ভাই অম্বিকা প্রসাদ সেনও ছিলেন সাব জজ। আর এ কারণে তাদের এ বাড়িটিকে সবাই জজবাড়ি বলতো। সারদা প্রসাদের ছেলে বিলেতে পড়া আশুতোষ সেন শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ‘নটির পূজা’ নামক নাটক দেখতে। নাটকটি দেখে নাটকের অভিনেত্রী অমিতাকে ভাল লেগে যায় তার। সিদ্ধান্ত নেন তাকেই জীবনসঙ্গী করবেন। বাবাও অমত করেননি। সেই সুবাদে অমিতাকে বিয়ে করে অশুতোষ সেন ফিরে আসেন মানিকগঞ্জের ওই মত্ত গ্রামে। নতুন বউ দেখতে সেদিন পুরো গ্রাম ভেঙে পড়েছিল জজবাড়ির উঠানে। এই আশুতোষ সেন আর অমিতা সেনের ঘরেই জন্ম নিয়েছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন। সে সময়ের আলোচিত জজবাড়িতে ছিল ৭-৮টি নকশাদার দৃষ্টিনন্দন টিনের ঘর, ছিল নজরকাড়া পূজামণ্ডপ। চাকরি সূত্রে জজবাড়ির দুই জজ ভাই বাইরে থাকলেও তাদের পিতা-মাতা স্থায়ীভাবেই থাকতেন এ বাড়িতে। আর অমর্ত্য সেন নিজের পিতা-মাতার সঙ্গে ঢাকার ওয়ারীর বাড়িতে বড় হয়েছেন। অমর্ত্য সেনের পিতা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন। দেশ ভাগের পরে আশুতোষ সেন দিল্লিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। তবে বিভিন্ন উৎসব, পূজা পার্বণে ছুটি পেলেই পিতা-মাতার সঙ্গে ছুটে আসতেন অমর্ত্য সেনও। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের ক’বছর আগে জজবাড়ির লোকেরা অনেক স্মৃতি, অনেক মায়া পেছনে ফেলে ভারতে চলে যান। তবে ১৯৮৮ সালের বন্যার আগে অমর্ত্য সেন যখন বিশ্ববিখ্যাত নোবেল পদটি পাননি তখন একবার হঠাৎ করেই নাড়ির টানে পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটির স্পর্শ নিতে মত্ত গ্রামে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন চিরকুমার মাস্টার মশাই। অমর্ত্য সেন সেদিন ঘুরে ঘুরে হেঁটেছেন তার বসতবাড়ি, পূজামণ্ডপ, স্বপ্নময় উঠোনে। এরপর আর তিনি মত্ত গ্রামে আসেননি। তবে বিশ্বখ্যাত নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনকে নিয়ে মত্ত গ্রামের মানুষ গর্ববোধ করবেন জন্মজন্মান্তর।
No comments