কয়েদি নাম্বার ৭৪০২ by মহীউদ্দীন আহমদ
চিকিৎসার জন্য সস্ত্রীক চেন্নাই গিয়েছিলাম। আর তখনই ভারতীয় রাজনীতির এক ঐতিহাসিক ঘটনা অবলোকন করার সুযোগ হলো। দিনটা শনিবার ২৭ অক্টোবর। আমরা চেন্নাই ছাড়ার আগে শহরটা দেখার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। ফেরার পথে বাসটা হঠাৎ থেমে গেল। সামনে লাঠি হাতে একটি মিছিল, দোকানপাট দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জায়গায় জায়গায় মানুষের জটলা। চোখেমুখে বিষণœœতার ছাপ, ব্যস্ত সড়ক দ্রুত পরিবহনশূন্য হতে চলছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। হাসপাতালের গেস্ট হাউজে এসে শুনলাম আদালতের রায়ে ওই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার জেল হয়েছে। তাই শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের সতর্ক করে দেয়া হলো যেন রাস্তায় বের না হই। গেস্ট হাউজের ব্যালকনি থেকে ব্যস্ততম সড়ক স্পষ্ট দেখা যায়। দেখলাম রাস্তায় বিশেষ করে বাস নেই বললেই চলে। অথচ এমআরটি হচ্ছে মূল নাগরিক পরিবহন। টেলিভিশনের পর্দায় জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখলাম। সরকারি সম্পত্তি পোড়ানোর দৃশ্য অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। ভাঙচুর, আগুন, গাড়ি পোড়ানো প্রভৃতি ঘটেছে। তবে ব্যতিক্রম আত্মাহুতির ঘটনা।
জয়ললিতা তামিলনাড়ুর জনপ্রিয় এক নেত্রী। ফিল্মের নায়িকা থেকে মুখ্যমন্ত্রী। ভারতীয় রাজনীতিতে নায়ক-নায়িকাদের উত্থান নতুন কিছু নয়, তবে ব্যতিক্রম জয়ললিতার ক্ষেত্রে। বড় দুর্নীতির অভিযোগ কাঁধে নিয়েই তিনি বরাবর জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেছেন। লোকসভার বিগত নির্বাচনে যেখানে নরেন্দ্র মোদি বড় চমক দেখিয়েছেন, সেই নির্বাচনেও জয়ললিতা ৩৯টি আসনের মধ্যে ৩৭টি জিতেছেন। অর্থাৎ তার রাজ্যে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় এক নেতা। জনগণ শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে ‘আম্মা’ বলে সম্বোধন করে তাকে। এই নেত্রী তার নেতৃত্বে তামিলনাড়–তে সফলভাবে মোদি ঝড় থামিয়েছেন।
১৯৯৬ সালে জয়ললিতার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বিজেপির এক নেতা। তখন তিনি গ্রেফতার হয়ে কয়েক সপ্তাহ জেলে থেকে জামিনে মুক্তি পান। ২০০১ সালে তার দল ক্ষমতা গ্রহণ করলে তিনি হন মুখ্যমন্ত্রী। মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও সেপ্টেম্বর মাসেই আদালতের রায়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু এবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আদালতে উপস্থিত হয়ে সরাসরি জেলে যেতে হলো। আদালত থেকেই জেলে গেলেন জয়ললিতা। মুখ্যমন্ত্রী থেকে জেলের কয়েদি। ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। জয়ললিতার আয়ের সাথে সম্পদের কোনো মিল খঁুঁজে পাননি আদালত। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি যে সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন, তার মূল্য ৬৭ কোটি রুপি। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির এমন নজির ভারতীয় রাজনীতিতে বিরল। এত অল্প সময়ে এত সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার পেছনে যে দুর্নীতি রয়েছে, তা বোঝা কঠিন নয়। ২০০২ সালে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জয়ললিতা আবার মুখ্যমন্ত্রী হন। বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি প্রভাবিত করার চেষ্টাও করেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তামিলনাড়– থেকে মামলাটি কর্নাটকের ব্যাঙ্গালুরুর একটি আদালতে সরিয়ে নেয়া হয়। এবার সে আদালতের রায়ে মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার চার বছর কারাদণ্ড ও ১০০ কোটি রুপি জরিমানা হয়েছে। আদালতে হাজিরা দিতে এসে তিনি সেখান থেকে সরাসরি পৌঁছলেন জেলে। সুপ্রিম কোর্টের গত বছরের এক আদেশে বলা হয়েছে- কোনো আইনপ্রণেতা দুই বা ততোধিক সময়ের জন্য দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তার পদের জন্য অযোগ্য হবেন। জয়ললিতার ক্ষেত্রে উচ্চতর আদালতের রায় কার্যকর হয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই রায় নজির হয়ে থাকবে। তারই পুলিশ আদালতের রায়ের পর ভ্যানে তুলে তাকে নিয়ে গেল জেলে। দুর্নীতির এই মামলা থেকে মুক্তি পেতে জয়ললিতা তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বিশাল জনপ্রিয়তা সব কিছুকেই কাজে লাগিয়েছেন; কিন্তু অবশেষে আদালতের সামনে তাকে হার মানতে হয়েছে। তিনি এখন জেলের সাধারণ একজন কয়েদি। কয়েদি নাম্বার ৭৪০২। ব্যাঙ্গালুরুর পারাপুন্নি আগ্রাহারা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাধারণ কয়েদিদের মতোই তাকে রাখা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য আলাদা কক্ষ নেই সেখানে। জয়ললিতা তাকে কোনো বেসরকারি হাসপাতালে নেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এখন একজন দণ্ডিত আসামি মাত্র। তাই তাকে কারা বিধি মেনে চলতে হবে। জামিন হয়তো তিনি পাবেন, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, বড় বিষয় হলো মুখ্যমন্ত্রীর প্রচণ্ড প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং জনপ্রিয়তা, ক্ষমতা সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে বিশাল বিজয় অর্জন সত্ত্বেও তাকে অবশেষে দুর্নীতির দায় বহন করে জেলে যেতে হয়েছে। এটাই বাস্তবতা। রাজনীতিবিদেরা যদি মনে করে থাকেন তারা আইনের ঊর্ধ্বে, তাহলে তারা নিশ্চিত ভুল করবেন। আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। কোনো-না-কোনো সময় তার প্রয়োগও হবে। এটা মনে রাখতে হবে তাদের। জনকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা আর নিজের জন্য অর্থসম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা এক কথা নয়। সম্পদের বিষয়েও আদালত কোনো ছাড় দেননি। ৬৭ কোটির বিপরীতে জয়ললিতাকে ১০০ কোটি রুপি সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে। আর্থিক দণ্ডও কম নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির বিষয়টি ভারতীয় রাজনীতিতে বেশ জোরেশোরে উঠে এসেছে। কংগ্রেসের দুর্নীতির ইস্যু মোদি উত্থানের বড় কারণ বললে অত্যুক্তি হবে না। দুর্নীতির রায়ে ভারতীয় ব্যবসায়ী, সাহারা গ্রুপের মালিকও জেলে রয়েছেন। জেলে বসেই তিনি জনগণের অর্থসম্পদ ফেরত দেয়ার কাজ করছেন আদালতের নির্দেশে। দুর্নীতি উপমহাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় ইস্যু হলেও আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের বিবেচনায় গুরুত্বহীন হয়ে রয়েছে। তারা বিষয়টিকে কবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করবেন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের মনে এই প্রশ্ন্, এখন তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয়। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির বিষয় কখনোই বিবেচনায় আনা হয় না। সরকারি অর্থ আত্মসাৎ ও লুটপাটের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও তা গুরুত্ব পায় না। ক্ষমতাসীনদের ‘কুছ পরোয়া নেহি’ মনোভাবের অবসান হওয়া উচিত। শক্তিশালী আইনিব্যবস্থা গড়ে উঠলে দেশের জনগণ উপকৃত হতো। রাজনীতিবিদ যখন আদালত ও বিচারের ঊর্ধ্বে নিজেকে ভাবেন, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনেরা যখন এমন ভাবনার মধ্যে থাকেন, তখন দুর্নীতি নতুন মাত্রা লাভ করে। শুধু বিরোধী রাজনীতিবিদদের টার্গেট করে কখনোই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বিচারব্যবস্থা হবে নির্ভেজাল, যা সরকারি দল, বিরোধী দল ও সাধারণ নাগরিকদের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। বিচারের স্বচ্ছতা থাকবে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। সর্বোপরি, মানুষের আস্থা থাকতে হবে বিচার বিভাগের ওপর। দুর্নীতির মামলা বা বিচার সর্বপ্রকার প্রভাব-প্রতিপত্তির ঊর্ধ্বে থেকে চলতে থাকলে সামাজিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে। ভারতের জনগণের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে সচেতনতা গড়ে উঠেছে, জয়ললিতার বিরুদ্ধে রায়ের মধ্য দিয়ে তারই হয়তো প্রতিফলন ঘটেছে। ভারতের রাজনীতিবিদদের মধ্যে পরিচিত অনেক মুখ দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ও জেল খেটেছেন। একই অভিযোগে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন। মুলায়ম সিং যাদবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে। মামলা চলছে মায়াবতীর বিরুদ্ধেও। ঝাড়খণ্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মধু কোড়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মামলা চলছে। এরা সবাই পরিচিত মুখ। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে তারা দুর্নীতি করেছেন। এখন আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সহজেই নির্বাচনে জিতে মন্ত্রীও বনে যান। বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। জনগণকে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। দুর্নীতি ও জনপ্রিয়তা দুটো বিষয় মিলে একাকার হয়ে গেলে হয়তো শেষ পর্যন্ত জনপ্রিয়তা টিকে যায়; কিন্তু কত দিন এই পরিস্থিতি চলতে থাকবে?
জয়ললিতা প্রভাব খাটিয়ে বিচার হয়তো বিলম্বিত করেছেন; বিচারকেরা বিচারিক কাজে হয়তো বা বিব্রতবোধ করেছেন; কিন্তু বিচার থেমে যায়নি। উচ্চতর আদালতের হস্তক্ষেপে বিচারকাজ চলেছে। আমাদের দেশে সব আদালত সঠিকভাবে কাজ করতে সক্ষম হলে পরিস্থিতি ভিন্নতর হতো। জবাবদিহিতা, আইনের শাসন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে করণীয় সব কিছুই করতে হবে নিষ্ঠার সাথে। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির বিচার এবং রায় শুধু ভারত নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। শক্তিশালী, জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাবান রাজনীতিক রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে থেকে আদালতের বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন এবং দণ্ডিত হয়ে সাধারণ কয়েদির মতো কয়েদ খাটা শুরু করেছেন। এতে করে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা বেড়েছে। প্রমাণিত হয়েছেÑ সেখানে বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন ও কার্যকর। এমন বিচার বিভাগের ভূমিকা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কতটা অপরিহার্য, তা সুস্পষ্ট হয়েছে এই রায়ের মধ্য দিয়ে। প্রভাবশালী নেতার এমন পরিণতি থেকে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের শেখার কি কিছুই নেই? রাজনীতিতে পাকাপাকি বন্দোবস্তর চিন্তাভাবনা থেকে সরে এসে নেতা-নেত্রীরা যদি দেশকে পরিচ্ছন্ন করার ‘পরিচ্ছন্ন’ মনোভাব নিয়ে চলার শপথ গ্রহণ করেন, তাহলেই দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে। আমাদের জনগণকে তাই সজাগ হতে হবে।
জয়ললিতা তামিলনাড়ুর জনপ্রিয় এক নেত্রী। ফিল্মের নায়িকা থেকে মুখ্যমন্ত্রী। ভারতীয় রাজনীতিতে নায়ক-নায়িকাদের উত্থান নতুন কিছু নয়, তবে ব্যতিক্রম জয়ললিতার ক্ষেত্রে। বড় দুর্নীতির অভিযোগ কাঁধে নিয়েই তিনি বরাবর জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেছেন। লোকসভার বিগত নির্বাচনে যেখানে নরেন্দ্র মোদি বড় চমক দেখিয়েছেন, সেই নির্বাচনেও জয়ললিতা ৩৯টি আসনের মধ্যে ৩৭টি জিতেছেন। অর্থাৎ তার রাজ্যে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় এক নেতা। জনগণ শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে ‘আম্মা’ বলে সম্বোধন করে তাকে। এই নেত্রী তার নেতৃত্বে তামিলনাড়–তে সফলভাবে মোদি ঝড় থামিয়েছেন।
১৯৯৬ সালে জয়ললিতার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বিজেপির এক নেতা। তখন তিনি গ্রেফতার হয়ে কয়েক সপ্তাহ জেলে থেকে জামিনে মুক্তি পান। ২০০১ সালে তার দল ক্ষমতা গ্রহণ করলে তিনি হন মুখ্যমন্ত্রী। মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও সেপ্টেম্বর মাসেই আদালতের রায়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু এবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আদালতে উপস্থিত হয়ে সরাসরি জেলে যেতে হলো। আদালত থেকেই জেলে গেলেন জয়ললিতা। মুখ্যমন্ত্রী থেকে জেলের কয়েদি। ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। জয়ললিতার আয়ের সাথে সম্পদের কোনো মিল খঁুঁজে পাননি আদালত। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি যে সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন, তার মূল্য ৬৭ কোটি রুপি। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির এমন নজির ভারতীয় রাজনীতিতে বিরল। এত অল্প সময়ে এত সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার পেছনে যে দুর্নীতি রয়েছে, তা বোঝা কঠিন নয়। ২০০২ সালে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জয়ললিতা আবার মুখ্যমন্ত্রী হন। বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি প্রভাবিত করার চেষ্টাও করেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তামিলনাড়– থেকে মামলাটি কর্নাটকের ব্যাঙ্গালুরুর একটি আদালতে সরিয়ে নেয়া হয়। এবার সে আদালতের রায়ে মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার চার বছর কারাদণ্ড ও ১০০ কোটি রুপি জরিমানা হয়েছে। আদালতে হাজিরা দিতে এসে তিনি সেখান থেকে সরাসরি পৌঁছলেন জেলে। সুপ্রিম কোর্টের গত বছরের এক আদেশে বলা হয়েছে- কোনো আইনপ্রণেতা দুই বা ততোধিক সময়ের জন্য দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তার পদের জন্য অযোগ্য হবেন। জয়ললিতার ক্ষেত্রে উচ্চতর আদালতের রায় কার্যকর হয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই রায় নজির হয়ে থাকবে। তারই পুলিশ আদালতের রায়ের পর ভ্যানে তুলে তাকে নিয়ে গেল জেলে। দুর্নীতির এই মামলা থেকে মুক্তি পেতে জয়ললিতা তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বিশাল জনপ্রিয়তা সব কিছুকেই কাজে লাগিয়েছেন; কিন্তু অবশেষে আদালতের সামনে তাকে হার মানতে হয়েছে। তিনি এখন জেলের সাধারণ একজন কয়েদি। কয়েদি নাম্বার ৭৪০২। ব্যাঙ্গালুরুর পারাপুন্নি আগ্রাহারা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাধারণ কয়েদিদের মতোই তাকে রাখা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য আলাদা কক্ষ নেই সেখানে। জয়ললিতা তাকে কোনো বেসরকারি হাসপাতালে নেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এখন একজন দণ্ডিত আসামি মাত্র। তাই তাকে কারা বিধি মেনে চলতে হবে। জামিন হয়তো তিনি পাবেন, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, বড় বিষয় হলো মুখ্যমন্ত্রীর প্রচণ্ড প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং জনপ্রিয়তা, ক্ষমতা সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে বিশাল বিজয় অর্জন সত্ত্বেও তাকে অবশেষে দুর্নীতির দায় বহন করে জেলে যেতে হয়েছে। এটাই বাস্তবতা। রাজনীতিবিদেরা যদি মনে করে থাকেন তারা আইনের ঊর্ধ্বে, তাহলে তারা নিশ্চিত ভুল করবেন। আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। কোনো-না-কোনো সময় তার প্রয়োগও হবে। এটা মনে রাখতে হবে তাদের। জনকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা আর নিজের জন্য অর্থসম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা এক কথা নয়। সম্পদের বিষয়েও আদালত কোনো ছাড় দেননি। ৬৭ কোটির বিপরীতে জয়ললিতাকে ১০০ কোটি রুপি সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে। আর্থিক দণ্ডও কম নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতির বিষয়টি ভারতীয় রাজনীতিতে বেশ জোরেশোরে উঠে এসেছে। কংগ্রেসের দুর্নীতির ইস্যু মোদি উত্থানের বড় কারণ বললে অত্যুক্তি হবে না। দুর্নীতির রায়ে ভারতীয় ব্যবসায়ী, সাহারা গ্রুপের মালিকও জেলে রয়েছেন। জেলে বসেই তিনি জনগণের অর্থসম্পদ ফেরত দেয়ার কাজ করছেন আদালতের নির্দেশে। দুর্নীতি উপমহাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় ইস্যু হলেও আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের বিবেচনায় গুরুত্বহীন হয়ে রয়েছে। তারা বিষয়টিকে কবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করবেন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের মনে এই প্রশ্ন্, এখন তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয়। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির বিষয় কখনোই বিবেচনায় আনা হয় না। সরকারি অর্থ আত্মসাৎ ও লুটপাটের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও তা গুরুত্ব পায় না। ক্ষমতাসীনদের ‘কুছ পরোয়া নেহি’ মনোভাবের অবসান হওয়া উচিত। শক্তিশালী আইনিব্যবস্থা গড়ে উঠলে দেশের জনগণ উপকৃত হতো। রাজনীতিবিদ যখন আদালত ও বিচারের ঊর্ধ্বে নিজেকে ভাবেন, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনেরা যখন এমন ভাবনার মধ্যে থাকেন, তখন দুর্নীতি নতুন মাত্রা লাভ করে। শুধু বিরোধী রাজনীতিবিদদের টার্গেট করে কখনোই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বিচারব্যবস্থা হবে নির্ভেজাল, যা সরকারি দল, বিরোধী দল ও সাধারণ নাগরিকদের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। বিচারের স্বচ্ছতা থাকবে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। সর্বোপরি, মানুষের আস্থা থাকতে হবে বিচার বিভাগের ওপর। দুর্নীতির মামলা বা বিচার সর্বপ্রকার প্রভাব-প্রতিপত্তির ঊর্ধ্বে থেকে চলতে থাকলে সামাজিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে। ভারতের জনগণের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে সচেতনতা গড়ে উঠেছে, জয়ললিতার বিরুদ্ধে রায়ের মধ্য দিয়ে তারই হয়তো প্রতিফলন ঘটেছে। ভারতের রাজনীতিবিদদের মধ্যে পরিচিত অনেক মুখ দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ও জেল খেটেছেন। একই অভিযোগে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন। মুলায়ম সিং যাদবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে। মামলা চলছে মায়াবতীর বিরুদ্ধেও। ঝাড়খণ্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মধু কোড়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মামলা চলছে। এরা সবাই পরিচিত মুখ। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে তারা দুর্নীতি করেছেন। এখন আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সহজেই নির্বাচনে জিতে মন্ত্রীও বনে যান। বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। জনগণকে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। দুর্নীতি ও জনপ্রিয়তা দুটো বিষয় মিলে একাকার হয়ে গেলে হয়তো শেষ পর্যন্ত জনপ্রিয়তা টিকে যায়; কিন্তু কত দিন এই পরিস্থিতি চলতে থাকবে?
জয়ললিতা প্রভাব খাটিয়ে বিচার হয়তো বিলম্বিত করেছেন; বিচারকেরা বিচারিক কাজে হয়তো বা বিব্রতবোধ করেছেন; কিন্তু বিচার থেমে যায়নি। উচ্চতর আদালতের হস্তক্ষেপে বিচারকাজ চলেছে। আমাদের দেশে সব আদালত সঠিকভাবে কাজ করতে সক্ষম হলে পরিস্থিতি ভিন্নতর হতো। জবাবদিহিতা, আইনের শাসন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে করণীয় সব কিছুই করতে হবে নিষ্ঠার সাথে। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির বিচার এবং রায় শুধু ভারত নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। শক্তিশালী, জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাবান রাজনীতিক রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে থেকে আদালতের বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন এবং দণ্ডিত হয়ে সাধারণ কয়েদির মতো কয়েদ খাটা শুরু করেছেন। এতে করে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা বেড়েছে। প্রমাণিত হয়েছেÑ সেখানে বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন ও কার্যকর। এমন বিচার বিভাগের ভূমিকা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কতটা অপরিহার্য, তা সুস্পষ্ট হয়েছে এই রায়ের মধ্য দিয়ে। প্রভাবশালী নেতার এমন পরিণতি থেকে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের শেখার কি কিছুই নেই? রাজনীতিতে পাকাপাকি বন্দোবস্তর চিন্তাভাবনা থেকে সরে এসে নেতা-নেত্রীরা যদি দেশকে পরিচ্ছন্ন করার ‘পরিচ্ছন্ন’ মনোভাব নিয়ে চলার শপথ গ্রহণ করেন, তাহলেই দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে। আমাদের জনগণকে তাই সজাগ হতে হবে।
No comments