দয়াময় আল্লাহ ক্ষমা চাইবার শক্তি দিন by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
ঈদ মোবারক। আশা করেছিলাম এবার কোরবানির ঈদ বেশ আনন্দে কাটবে। প্রতি বছর দু-এক মাস আগে কোরবানির গরু কিনে লালনপালন করি। মুক্তিযুদ্ধের সহকর্মী আব্দুল্লাহ বীর প্রতীক এবার কোরবানিতে তার পালের গরু আমাকে দিয়েছে। গরুটা আমার বাড়িতেই বড় হয়েছে। বেশ শক্তিশালী হৃষ্টপুষ্ট ছিল। ভীষণ ফোঁস ফোঁস করত। খুব সহজে তার কাছে কেউ ঘেঁষতে পারত না। সেটাই এবার আমরা আল্লাহর নামে বাবা-মা, দীপ-কুঁড়ি-কুশি, ওদের মা এবং আমার পে কোরবানি দিয়েছি। ঈদের আগের রাতে প্রচণ্ড জ্বর এসে শরীর খারাপ করেছিল। তবু মোটামুটি ঈদ পালন করেছি। কোরবানি দিয়েছি, বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করেছি। বহু দিন পর এবার শুক্রবার আকবরি হজ হয়েছে। হজ আর পূজা একেবারে কাছাকাছি ছিল। আমার মনে হয়, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, তিথি, নত্র বিচার করলে ঈদ কোনোক্রমেই সোমবারে হয় না। রোববারের পরে যাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না; কিন্তু ডিজিটাল কর্মকাণ্ডে ধর্মকর্মের শুদ্ধতা নেই। যার যখন যা মর্জি, তাই তারা করছে। বিশেষ করে সরকারের মর্জি মানুষের বোঝা অসাধ্য। মানুষ বাড়ি পৌঁছতে পারছিল না, সে কারণে কি সময় দেয়ার জন্য ঈদ এক দিন পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল? বুঝব কী করে? ইসলাম তো কোনো রাজনৈতিক দল নয়, ইসলাম একটি ধর্ম। তার সব অনুশাসন আগে থেকে স্থির করা। কারো মর্জিমাফিক সেসব অদল-বদল হওয়ার সুযোগ কোথায়? যে যা-ই বলুন, ৫ তারিখের স্থলে ৬ অক্টোবর ঈদুল আজহার দিন নির্ধারণ কোনো মতেই যুক্তিযুক্ত মনে করি না। ওটা একটা মারাত্মক অধার্মিক কাজ হয়েছে।
সরকার তারস্বরে চিৎকার করছে, দেশে শান্তির হিমেল হাওয়া বইছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব, মানবতা, প্রেমপ্রীতি-ভালোবাসার লেশমাত্র নেই। মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। পরম দয়াময় প্রভু আমাদের সাপ, ব্যাঙ, কুকুর, বিড়াল হিসেবেও সৃষ্টি করতে পারতেন; কিন্তু দয়া করে তিনি আমাদের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ বানিয়েছেন। আজ আমাদের মনুষ্যত্ব কোথায়? পবিত্র ঈদুল আজহার গভীর রাতে টাঙ্গাইলের গোড়াই সোহাগপুরে একটি পাকা ঘরে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে এক নরপশু পাষণ্ড মাসহ তিন মেয়েকে পুড়িয়ে মেরেছে। সব থেকে ছোটটির বয়স ছিল পাঁচ বছর। মুসলমান ঘরের নারী আগুনে পুড়ে অঙ্গারÑ এটাকে আল্লাহর রহমত-বরকত মনে করব, নাকি গজবের আলামত? কুরআন-হাদিসে দেখেছি, আল্লাহ প্রেমের কারণে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ পবিত্র প্রেমকে ভালোবাসেন। সেখানে রহমত-বরকত দান করেন। জাহাঙ্গীর নামে এক বখাটে তরুণ ১৩ বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে করার জন্য লালায়িত হলে সে এবং তার পরিবার রাজি না হওয়ায় গোষ্ঠীসুদ্ধ পুড়িয়ে মারার মাঝে আমি তো কোনো প্রেম খুঁজে পাই না। শুধু জিঘাংসাই দেখতে পাই। প্রেম করেছেন লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রজকিনী-চণ্ডিদাসÑ এখানে তার লেশ কোথায়? কাউকে কেউ ভালোবাসলে যার জন্য হৃদয়ের বোঁটা ছিঁড়তে চায়, তাকে পুড়িয়ে মারার কথা কল্পনা করা যায় কি? খবরটি শুনে স্থির থাকতে পারিনি। ছুটে গিয়েছিলাম সোহাগপুর মজিবরের বাড়িতে। পরিবারে সচ্ছলতা আনতে গাধার খাটুনি খাটতে সে মালয়েশিয়া গিয়েছিল। পরিবারের অবস্থাও অনেকটা ফিরিয়েছিল। ছোট্ট সুন্দর পাকা বাড়ি, ঘরে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রÑ সবই ছিল; কিন্তু বুকের ধন কেউ নেই। ও রকম পাকা ঘর না হয়ে কাঁচা ঘর হলে মা-মেয়ে চারজনই হয়তো আগুনে পুড়ে ছারখার হতো না। জানি না দোজখের আগুন কেমন হবে, তবে ৬০ লিটার পেট্রল ঢেলে অমন একটি ১৪-১৫ ফুট আশপাশের ঘরে আগুন দিলে তা যে কেমন হতে পারে, সেটা একমাত্র স্রষ্টাই জানেন।
ধরপাকড় চলছে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়। রাজনৈতিক প্রভাব না পড়লে, টানাটানি না হলে হয়তো ঘাতকদের সাজা হবে। সেদিন দেখলাম, প্রধান আসামি জাহাঙ্গীরকে ধরিয়ে দিতে পুলিশ এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। অনেকে মনে করেন, আসামির জন্য সরকারি পুরস্কার ঘোষণা একটি কঠিন পদপে; কিন্তু কেন যেন আমার কাছে মনে হয়, কোনো আসামিকে ধরতে না পারায় পুলিশের পুরস্কার ঘোষণা তাদের দুর্বলতারই স্বার। তবু পুলিশ কিছুটা তৎপর বলে তাদের সাধুবাদ জানাই। সত্যিই মনটা ভালো নেই। তুমি হয়তো জানো না, তোমার এক অত্যন্ত প্রিয় কর্মী, আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ঈদের ক’দিন আগে ওয়াশিংটনে পবিত্র হজসহ কিছু বিষয় সম্পর্কে মারাত্মক আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। আসলে আওয়ামী লীগ নিজেকে ধর্মনিরপে বোঝাতে গিয়ে কী সব যে করে, অনেক কিছু হয়তো তারা নিজেরাই খেয়াল করে না। ধর্মনিরপেতা আর ধর্মহীনতা যে এক নয়, তাও বুঝতে চায় না। সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। তোমার কন্যা বড় দতার সাথে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলে দিয়েছেন, সরকারের এবং আওয়ামী লীগের কোনো বিপদ বা অসুবিধা নয়, যে মন্তব্য করেছে এ অসুবিধা তার। পিতা, এখন তুমিই বলো, আমার বাবা মৌলভী মুহাম্মদ আব্দুল আলী সিদ্দিকীর অনুযোগ-অভিযোগ ছিল, আমরা তার কথা শুনিনি, মানিনি; বরং তোমার কথা শুনেছি।’ জনাব লতিফ সিদ্দিকী বামপন্থী আওয়ামী লীগার নন, আওয়ামী লীগেই তার জন্ম। তারপরও নাকি যে বক্তব্য দিয়েছেন সব দায়দায়িত্ব তার, তার দলের নয়। যে পাঠশালায় তিনি সারা জীবন পড়লেন, শিখলেন, এখন তিকর কিছু বলায় সে পাঠশালার বিদ্যাবুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেলÑ এ কেমন কথা? সারা জীবন যা বললেন সব ছিল আওয়ামী লীগের, আজ যখন বেকায়দা তখন সেটা আওয়ামী লীগের না, সরকারের না! মনে হয়, দেশের মানুষও অনেকটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা মেনে নিয়েছে। ২৮-২৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনা, এখনো তিনি সরকারের মন্ত্রী। তারপরও আওয়ামী লীগে তার বিরোধীরা গালাগাল করছে। তুমি তো ভালো করেই জানো, গোলামি করতে পারি না, জি হুজুর বলতে পারি না, বিবেকের সাথে প্রতারণা করতে পারি নাÑ যে কারণে আওয়ামী লীগ করতে পারিনি। আজ ১৬ বছর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নিয়ে পড়ে আছি। ছোট মানুষ ছোট দল, কেউ বাধা দেয়ার নেই, তাই বিবেকের নির্দেশে কথা বলি। আওয়ামী লীগের লোকজনেরা প্রায় সবাই পণ্ডিত। আমি আওয়ামী লীগ করি না, কিন্তু তোমাকে ছাড়তে পারিনি। তুমি আমার অস্তিত্ব, তুমি আমার ঠিকানা। তোমাকে ছেড়ে যাবো কোথায়? এতকাল লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ‘মাননীয় মন্ত্রী’। যেই মাত্র অসুবিধায় পড়েছেন, বেজুত কথা বলেছেন, তখনই কাদের সিদ্দিকীর ভাই। তখন আর আওয়ামী লীগের নেতা নন। কী যে এক মারাত্মক জ্বালায় আছি, তোমাকে বোঝাই কী করে?
দল ও পরিবারের অবস্থা স্পষ্ট করতে ১১ অক্টোবর জাতীয় প্রেস কাবে গিয়েছিলাম। বিপুল সাংবাদিকে হল ভরে গিয়েছিল। তারা যে সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমার কিছু বলার ছিল না। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মাননীয় মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী আমার কেউ না, কিছু না; কিন্তু আল্লাহপ্রদত্ত সম্পর্কে তিনি আমার ভাই, আমরা একই মা-বাবার সন্তান। একই রক্ত আমাদের ধমনিতে প্রবাহিতÑ সে সম্পর্ক অস্বীকার করি কী করে? রক্তের সম্পর্ক তো পুঁটি মাছের মতো বাজার থেকে কেনা যায় না। তাই দয়াময় আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করেছি, হে প্রভু, আপনি আমার ভাইকে মা চাইবার শক্তি দান করুন। সত্যিকার অর্থে আল্লাহ শক্তি না দিলে কারো মা চাইবার সামর্থ্য নেই। মুসলিম জাহান, বিশেষ করে দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগায় পরিবারের প থেকে তাদের কাছে মা প্রার্থনা করেছি। তাকেও আল্লাহর কাছে এবং দেশবাসীর কাছে মা চাইতে বিনীত অনুরোধ করেছি। তিনি চাইবেন কি চাইবেন না, সেটা তার ব্যাপার। মুসলমানের ঘরে জন্মেছি, প্রকৃত মুসলমান হিসেবে মরতে চাইÑ এটাই আমার প্রার্থনা।
আমার সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য বেশ গুরুত্বের সাথে প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে প্রচার করার জন্য আমি ও আমার দল তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি; কিন্তু তারপরও কিছু কিছু সংবাদপত্র তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে তাদের মতো করেই খবর প্রচারের চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ আমার উদ্ধৃতি দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেনÑ লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের শিকার। আমি করি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। আওয়ামী লীগের কেউ ষড়যন্ত্রের শিকার হলে আমার মাথাব্যথা হবে কেন? সংবাদ সম্মেলনের সব বক্তব্য রেকর্ড করা আছে। আমি একবারো আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের কথা মুখেও আনিনি। শুধু দলীয়ভাবে বলা হয়েছে, যাই বলুন, হজ সম্পর্কে লতিফ সিদ্দিকীর বিতর্কিত বক্তব্য তার একার হতে পারে না। সেটা সম্পূর্ণই আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান অনির্বাচিত অবৈধ সরকারের। কোনো কোনো পত্রিকা এমন লেখার চেষ্টা করেছে, লতিফ সিদ্দিকীর ইসলামবিরোধী বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছি। সেদিনের সম্মেলনে ইসলাম শব্দটিও আমরা উচ্চারণ করিনি। হজ, মুসলমানÑ এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছি। কারো কারো রিপোর্ট দেখে মনে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আমার সাথে কথাবার্তা বলেই যেন তিনি তার রিপোর্ট তৈরি করেছেন, ‘লতিফ সিদ্দিকী আউট, কাদের সিদ্দিকী ইন’। লিখতে কোনো বাধা নেই; কিন্তু এমন লিখতে লিখতে লেখার গুরুত্ব হারিয়ে ফেললে একসময় সংবাদমাধ্যমেরই অসুবিধা হবে। মানুষ তখন সত্যকেও বিশ্বাস করতে চাইবে না। তাই যতটা সম্ভব, সত্যের অন্বেষণ করা উচিত।
ঈদ মোবারক। আশা করেছিলাম এবার কোরবানির ঈদ বেশ আনন্দে কাটবে। প্রতি বছর দু-এক মাস আগে কোরবানির গরু কিনে লালনপালন করি। মুক্তিযুদ্ধের সহকর্মী আব্দুল্লাহ বীর প্রতীক এবার কোরবানিতে তার পালের গরু আমাকে দিয়েছে। গরুটা আমার বাড়িতেই বড় হয়েছে। বেশ শক্তিশালী হৃষ্টপুষ্ট ছিল। ভীষণ ফোঁস ফোঁস করত। খুব সহজে তার কাছে কেউ ঘেঁষতে পারত না। সেটাই এবার আমরা আল্লাহর নামে বাবা-মা, দীপ-কুঁড়ি-কুশি, ওদের মা এবং আমার পে কোরবানি দিয়েছি। ঈদের আগের রাতে প্রচণ্ড জ্বর এসে শরীর খারাপ করেছিল। তবু মোটামুটি ঈদ পালন করেছি। কোরবানি দিয়েছি, বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করেছি। বহু দিন পর এবার শুক্রবার আকবরি হজ হয়েছে। হজ আর পূজা একেবারে কাছাকাছি ছিল। আমার মনে হয়, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, তিথি, নত্র বিচার করলে ঈদ কোনোক্রমেই সোমবারে হয় না। রোববারের পরে যাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না; কিন্তু ডিজিটাল কর্মকাণ্ডে ধর্মকর্মের শুদ্ধতা নেই। যার যখন যা মর্জি, তাই তারা করছে। বিশেষ করে সরকারের মর্জি মানুষের বোঝা অসাধ্য। মানুষ বাড়ি পৌঁছতে পারছিল না, সে কারণে কি সময় দেয়ার জন্য ঈদ এক দিন পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল? বুঝব কী করে? ইসলাম তো কোনো রাজনৈতিক দল নয়, ইসলাম একটি ধর্ম। তার সব অনুশাসন আগে থেকে স্থির করা। কারো মর্জিমাফিক সেসব অদল-বদল হওয়ার সুযোগ কোথায়? যে যা-ই বলুন, ৫ তারিখের স্থলে ৬ অক্টোবর ঈদুল আজহার দিন নির্ধারণ কোনো মতেই যুক্তিযুক্ত মনে করি না। ওটা একটা মারাত্মক অধার্মিক কাজ হয়েছে।
সরকার তারস্বরে চিৎকার করছে, দেশে শান্তির হিমেল হাওয়া বইছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব, মানবতা, প্রেমপ্রীতি-ভালোবাসার লেশমাত্র নেই। মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। পরম দয়াময় প্রভু আমাদের সাপ, ব্যাঙ, কুকুর, বিড়াল হিসেবেও সৃষ্টি করতে পারতেন; কিন্তু দয়া করে তিনি আমাদের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ বানিয়েছেন। আজ আমাদের মনুষ্যত্ব কোথায়? পবিত্র ঈদুল আজহার গভীর রাতে টাঙ্গাইলের গোড়াই সোহাগপুরে একটি পাকা ঘরে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে এক নরপশু পাষণ্ড মাসহ তিন মেয়েকে পুড়িয়ে মেরেছে। সব থেকে ছোটটির বয়স ছিল পাঁচ বছর। মুসলমান ঘরের নারী আগুনে পুড়ে অঙ্গারÑ এটাকে আল্লাহর রহমত-বরকত মনে করব, নাকি গজবের আলামত? কুরআন-হাদিসে দেখেছি, আল্লাহ প্রেমের কারণে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ পবিত্র প্রেমকে ভালোবাসেন। সেখানে রহমত-বরকত দান করেন। জাহাঙ্গীর নামে এক বখাটে তরুণ ১৩ বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে করার জন্য লালায়িত হলে সে এবং তার পরিবার রাজি না হওয়ায় গোষ্ঠীসুদ্ধ পুড়িয়ে মারার মাঝে আমি তো কোনো প্রেম খুঁজে পাই না। শুধু জিঘাংসাই দেখতে পাই। প্রেম করেছেন লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রজকিনী-চণ্ডিদাসÑ এখানে তার লেশ কোথায়? কাউকে কেউ ভালোবাসলে যার জন্য হৃদয়ের বোঁটা ছিঁড়তে চায়, তাকে পুড়িয়ে মারার কথা কল্পনা করা যায় কি? খবরটি শুনে স্থির থাকতে পারিনি। ছুটে গিয়েছিলাম সোহাগপুর মজিবরের বাড়িতে। পরিবারে সচ্ছলতা আনতে গাধার খাটুনি খাটতে সে মালয়েশিয়া গিয়েছিল। পরিবারের অবস্থাও অনেকটা ফিরিয়েছিল। ছোট্ট সুন্দর পাকা বাড়ি, ঘরে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রÑ সবই ছিল; কিন্তু বুকের ধন কেউ নেই। ও রকম পাকা ঘর না হয়ে কাঁচা ঘর হলে মা-মেয়ে চারজনই হয়তো আগুনে পুড়ে ছারখার হতো না। জানি না দোজখের আগুন কেমন হবে, তবে ৬০ লিটার পেট্রল ঢেলে অমন একটি ১৪-১৫ ফুট আশপাশের ঘরে আগুন দিলে তা যে কেমন হতে পারে, সেটা একমাত্র স্রষ্টাই জানেন।
ধরপাকড় চলছে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়। রাজনৈতিক প্রভাব না পড়লে, টানাটানি না হলে হয়তো ঘাতকদের সাজা হবে। সেদিন দেখলাম, প্রধান আসামি জাহাঙ্গীরকে ধরিয়ে দিতে পুলিশ এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। অনেকে মনে করেন, আসামির জন্য সরকারি পুরস্কার ঘোষণা একটি কঠিন পদপে; কিন্তু কেন যেন আমার কাছে মনে হয়, কোনো আসামিকে ধরতে না পারায় পুলিশের পুরস্কার ঘোষণা তাদের দুর্বলতারই স্বার। তবু পুলিশ কিছুটা তৎপর বলে তাদের সাধুবাদ জানাই। সত্যিই মনটা ভালো নেই। তুমি হয়তো জানো না, তোমার এক অত্যন্ত প্রিয় কর্মী, আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ঈদের ক’দিন আগে ওয়াশিংটনে পবিত্র হজসহ কিছু বিষয় সম্পর্কে মারাত্মক আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। আসলে আওয়ামী লীগ নিজেকে ধর্মনিরপে বোঝাতে গিয়ে কী সব যে করে, অনেক কিছু হয়তো তারা নিজেরাই খেয়াল করে না। ধর্মনিরপেতা আর ধর্মহীনতা যে এক নয়, তাও বুঝতে চায় না। সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। তোমার কন্যা বড় দতার সাথে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলে দিয়েছেন, সরকারের এবং আওয়ামী লীগের কোনো বিপদ বা অসুবিধা নয়, যে মন্তব্য করেছে এ অসুবিধা তার। পিতা, এখন তুমিই বলো, আমার বাবা মৌলভী মুহাম্মদ আব্দুল আলী সিদ্দিকীর অনুযোগ-অভিযোগ ছিল, আমরা তার কথা শুনিনি, মানিনি; বরং তোমার কথা শুনেছি।’ জনাব লতিফ সিদ্দিকী বামপন্থী আওয়ামী লীগার নন, আওয়ামী লীগেই তার জন্ম। তারপরও নাকি যে বক্তব্য দিয়েছেন সব দায়দায়িত্ব তার, তার দলের নয়। যে পাঠশালায় তিনি সারা জীবন পড়লেন, শিখলেন, এখন তিকর কিছু বলায় সে পাঠশালার বিদ্যাবুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেলÑ এ কেমন কথা? সারা জীবন যা বললেন সব ছিল আওয়ামী লীগের, আজ যখন বেকায়দা তখন সেটা আওয়ামী লীগের না, সরকারের না! মনে হয়, দেশের মানুষও অনেকটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা মেনে নিয়েছে। ২৮-২৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনা, এখনো তিনি সরকারের মন্ত্রী। তারপরও আওয়ামী লীগে তার বিরোধীরা গালাগাল করছে। তুমি তো ভালো করেই জানো, গোলামি করতে পারি না, জি হুজুর বলতে পারি না, বিবেকের সাথে প্রতারণা করতে পারি নাÑ যে কারণে আওয়ামী লীগ করতে পারিনি। আজ ১৬ বছর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নিয়ে পড়ে আছি। ছোট মানুষ ছোট দল, কেউ বাধা দেয়ার নেই, তাই বিবেকের নির্দেশে কথা বলি। আওয়ামী লীগের লোকজনেরা প্রায় সবাই পণ্ডিত। আমি আওয়ামী লীগ করি না, কিন্তু তোমাকে ছাড়তে পারিনি। তুমি আমার অস্তিত্ব, তুমি আমার ঠিকানা। তোমাকে ছেড়ে যাবো কোথায়? এতকাল লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ‘মাননীয় মন্ত্রী’। যেই মাত্র অসুবিধায় পড়েছেন, বেজুত কথা বলেছেন, তখনই কাদের সিদ্দিকীর ভাই। তখন আর আওয়ামী লীগের নেতা নন। কী যে এক মারাত্মক জ্বালায় আছি, তোমাকে বোঝাই কী করে?
দল ও পরিবারের অবস্থা স্পষ্ট করতে ১১ অক্টোবর জাতীয় প্রেস কাবে গিয়েছিলাম। বিপুল সাংবাদিকে হল ভরে গিয়েছিল। তারা যে সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমার কিছু বলার ছিল না। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মাননীয় মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী আমার কেউ না, কিছু না; কিন্তু আল্লাহপ্রদত্ত সম্পর্কে তিনি আমার ভাই, আমরা একই মা-বাবার সন্তান। একই রক্ত আমাদের ধমনিতে প্রবাহিতÑ সে সম্পর্ক অস্বীকার করি কী করে? রক্তের সম্পর্ক তো পুঁটি মাছের মতো বাজার থেকে কেনা যায় না। তাই দয়াময় আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করেছি, হে প্রভু, আপনি আমার ভাইকে মা চাইবার শক্তি দান করুন। সত্যিকার অর্থে আল্লাহ শক্তি না দিলে কারো মা চাইবার সামর্থ্য নেই। মুসলিম জাহান, বিশেষ করে দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগায় পরিবারের প থেকে তাদের কাছে মা প্রার্থনা করেছি। তাকেও আল্লাহর কাছে এবং দেশবাসীর কাছে মা চাইতে বিনীত অনুরোধ করেছি। তিনি চাইবেন কি চাইবেন না, সেটা তার ব্যাপার। মুসলমানের ঘরে জন্মেছি, প্রকৃত মুসলমান হিসেবে মরতে চাইÑ এটাই আমার প্রার্থনা।
আমার সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য বেশ গুরুত্বের সাথে প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে প্রচার করার জন্য আমি ও আমার দল তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি; কিন্তু তারপরও কিছু কিছু সংবাদপত্র তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে তাদের মতো করেই খবর প্রচারের চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ আমার উদ্ধৃতি দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেনÑ লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের শিকার। আমি করি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। আওয়ামী লীগের কেউ ষড়যন্ত্রের শিকার হলে আমার মাথাব্যথা হবে কেন? সংবাদ সম্মেলনের সব বক্তব্য রেকর্ড করা আছে। আমি একবারো আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের কথা মুখেও আনিনি। শুধু দলীয়ভাবে বলা হয়েছে, যাই বলুন, হজ সম্পর্কে লতিফ সিদ্দিকীর বিতর্কিত বক্তব্য তার একার হতে পারে না। সেটা সম্পূর্ণই আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান অনির্বাচিত অবৈধ সরকারের। কোনো কোনো পত্রিকা এমন লেখার চেষ্টা করেছে, লতিফ সিদ্দিকীর ইসলামবিরোধী বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছি। সেদিনের সম্মেলনে ইসলাম শব্দটিও আমরা উচ্চারণ করিনি। হজ, মুসলমানÑ এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছি। কারো কারো রিপোর্ট দেখে মনে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আমার সাথে কথাবার্তা বলেই যেন তিনি তার রিপোর্ট তৈরি করেছেন, ‘লতিফ সিদ্দিকী আউট, কাদের সিদ্দিকী ইন’। লিখতে কোনো বাধা নেই; কিন্তু এমন লিখতে লিখতে লেখার গুরুত্ব হারিয়ে ফেললে একসময় সংবাদমাধ্যমেরই অসুবিধা হবে। মানুষ তখন সত্যকেও বিশ্বাস করতে চাইবে না। তাই যতটা সম্ভব, সত্যের অন্বেষণ করা উচিত।
No comments