মন্ত্রিত্ব হারালেন লতিফ সিদ্দিকী -প্রেসিডিয়াম থেকে বহিষ্কার by আশরাফ আলী
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:, পবিত্র হজ
ও তাবলিগ জামাত নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্যের কারণে অবশেষে মন্ত্রিত্ব হারালেন
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও
তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। নিউ ইয়র্কে প্রবাসী টাঙ্গাইল
সমিতির এক অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার ১৫ দিনের মাথায় দলের এই
জ্যেষ্ঠ নেতাকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দিয়ে গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করা
হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের ১ দফার
(গ) উপধারা অনুসারে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদে নিয়োগের অবসান ঘটানোর
নির্দেশ দিয়েছেন। এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। কেন লতিফের মন্ত্রিত্বের
‘অবসান’ ঘটানো হলো সে বিষয়টি অবশ্য জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা
হয়নি।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সাথে নিয়েই বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের সাথে সাাৎ করেন। সাাতে রাষ্ট্রপতিকে তিনি লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণের অনুরোধ জানালে অপসারণসংক্রান্ত ফাইলে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সই করার পর বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা সচিবালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। এ বিষয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপন তিনি সাংবাদিকদের পড়ে শোনান। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের ১ দফার (গ) উপধারা অনুসারে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদে নিয়োগের অবসান ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের ১ দফায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি ১ দফার (গ) উপধারা অনুযায়ী ‘প্রধানমন্ত্রী যে-কোন সময়ে কোন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিতে পারিবেন এবং উক্ত মন্ত্রী অনুরূপ অনুরোধ পালনে অসমর্থ হইলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে উক্ত মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাইবার পরামর্শ দান করিতে পারিবেন।’
কেন লতিফের মন্ত্রিত্বের ‘অবসান’ ঘটানো হলোÑ সে বিষয়টি অবশ্য জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি সচিবও প্রজ্ঞাপনের বাইরে কিছু বলেননি। প্রজ্ঞাপনে অপসারণের বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ না থাকা প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ বলার বিষয়ে সংবিধানেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এই অবসানের অর্থ ‘অপসারণ’ না ‘অব্যাহতি’Ñ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দুটো একই বিষয়। মিনিং একই। আমরা সংবিধানের ভাষা ব্যবহার করেছি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ওই পদে নতুন কেউ নিয়োগ না পাওয়া পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকবে। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়েছেন এবং রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সন্তুষ্ট হয়ে অনুরূপ নির্দেশনা প্রদান করেছেন। আমরা প্রজ্ঞাপন জারি করেছি।
এ দিকে গতকাল সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে দলের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা লতিফ সিদ্দিকীকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যের পদ থেকে বহিষ্কার এবং প্রাথমিক সদস্যপদ স্থগিত করা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কেন তার প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করা হবে না তার কারণ দর্শানো হবে। এর আগে শেখ হাসিনার গত সরকারে বাদ পড়তে হয়েছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সমালোচনায় থাকা সৈয়দ আবুল হোসেনকে। এ ছাড়া অর্থ কেলেঙ্কারিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করলেও তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে রাখা হয়েছিল। টাঙ্গাইলে প্রভাবশালী পরিবার সিদ্দিকীদের জ্যেষ্ঠ ভাই ৭১ বছর বয়সী লতিফ সিদ্দিকী রাজনীতিতে স্পষ্টভাষী হিসেবে যেমন পরিচিত, তেমনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তির্যক ও বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে এর আগেও বহুবার আলোচনা-সমালোচনায় এসেছেন।
প্রসঙ্গত প্রধানমন্ত্রী জাতিসঘঙ্ঘ সফরে থাকার সময় গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে প্রবাসী টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী হজ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। শুধু তাই-ই নয়, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় প্রসঙ্গেও আপত্তিকর মন্ত্রব্য করেন। লতিফ সিদ্দিকী সে দিন বলেছিলেন, আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। এতে কত ম্যান পাওয়ারটা নষ্ট হয় তোমরা বিবেচনা করে দেখ। হজের জন্য ২০ লাখ মানুষ আজ সৌদিতে গেছে। এদের কোনো কাম নেই। এরা কোনো প্রোডাকশনও দিচ্ছে না, শুধু ডিডাকশন করছে। শুধু খাচ্ছে। দেশের টাকা নিয়ে গিয়ে ওদের দিচ্ছে। আবদুল্লাহপুত্র মুহম্মদ কোরাইশদের আর্থিক সুবিধার জন্য হজ উৎসব চালু করেন। তা ছাড়া উপস্থিত প্রবাসীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইটি উপদেষ্টা ও পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের পে সেøাগান দিলে তিনি বিরক্তিসহকারে বলেন, তোমরা শুধু জয় ভাই, জয় ভাই করো কেন? সজীব ওয়াজেদ জয় কে? জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নয়। তার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার নেই। জয় শুধু উপদেশ দিতে পারে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক সরকার। তার ওই বক্তব্যের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যে গোটা দেশের মানুষ বিােভে ফেটে পড়ে। নিজ দল থেকেও তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কারের দাবি ওঠে। এ প্রতিবাদে প্রথমে কয়েকটি ইসলামি দল আন্দোলনের হুমকি দেয়। পরে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়ার পাশাপাশি গ্রেফতারের দাবি তোলে বিএনপিও। যদিও এর আগে গত ২০ সেপ্টেম্বর ম্যানহাটনের হোটেল ম্যারিয়ট মার্কিতে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও তার ছেলে জয়ের উপস্থিতিতে বক্তব্য দিতে গিয়ে লতিফ সিদ্দিকী তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঠিক বিপরীত কথা বলেন এই মন্ত্রী।
লতিফ সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, লতিফ সিদ্দিকী ঈদ করার পর এখনো নিউ ইয়র্কে রয়েছেন। এর মধ্যেই ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় অন্তত দুই ডজন মামলা হয়েছে। নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত লতিফ সিদ্দিকী সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন, তিনি নিজেই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং শিগগিরই তিনি দেশে ফিরবেন।
এ দিকে নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে গত ৩ অক্টোবরই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন লতিফ সিদ্দিকী আর মন্ত্রিসভায় থাকবেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমি নির্দেশ দিলে তাকে রিজাইন করতে হবে। নইলে বিদায় করে দিতে হবে; কিন্তু বিদায় দিতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ফাইল পাঠাতে হবে। রাষ্ট্রপতি হজে গেছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হজে গেছেন। আমি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ফাইল তৈরি করে রাখতে বলেছি, অফিস খুললে ফাইল চলে আসবে। ওই সংবাদ সম্মেলনে লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে বাদ দেয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দল থেকে বাদ দিতে হলে তা নিয়ে দলে আলোচনা করতে হবে। অভিযোগ তুলে ধরে আলোচনা করতে হবে। ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ওয়ার্কিং কমিটি যদি মনে করে তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া ভালো তাহলে অব্যাহতি দিয়ে দেবে। গতকাল রোববার বিকেলেই ওয়ার্কিং কমিটির সেই বৈঠক বসেছে।
তবে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ হজ পালনে সৌদি আরবে থাকায় লতিফকে বাদ দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা ঝুলে থাকে আরো এক সপ্তাহ। হজ পালনের পর রাষ্ট্রপতি দেশে ফেরেন গত শুক্রবার। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও এরই মধ্যে ফিরে আসেন। শনিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে (লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণ) একটি ফাইল আসবে। আমরা একটি সামারি তৈরি করে তা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠাব। রাষ্ট্রপতি তাতে সাইন করার পর প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এরপর গতকাল বেলা ২টায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সাথে নিয়েই বঙ্গভবনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। তিনি সেখানে বৈঠক করেন পুরো এক ঘণ্টা। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতির সই নিয়ে সচিবালয়ে ফিরে সাংবাদিকদের সামনে আসেন মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রী পদে লতিফ সিদ্দিকীর নিয়োগের অবসান ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
বাড়ি-গাড়ি খোয়ালেও সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকছে : চিফ হুইপ
মন্ত্রিত্ব হারানোর সাথে সাথে লতিফ সিদ্দিকী খোয়াবেন মন্ত্রী হিসেবে ব্যবহার করা ২০ হেয়ার রোডের বাসা ও গাড়ি। তবে তার সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকছে। বিষয়টি জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজকে অবহিত করা হলে গতকাল তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রিত্ব হারানোর পর মন্ত্রী হিসেবে পাওয়া সব সুযোগ-সুবিধা হারাবেন তিনি। এ হিসেবে তার বাড়ি ও গাড়ি বাতিল হবে। তবে মন্ত্রীর বাড়ি-গাড়ি বুঝে নেয়ার দায়িত্ব সচিবালয়ের, এটা আমার এখতিয়ারে নেই। তিনি বলেন, লতিফ সিদ্দিকী সাহেব যদি এমপি হিসেবে কোনো বাড়ি বরাদ্দ চান তাহলে ন্যাম ভবনে কোথাও হয়তো তাকে একটি ফ্যাট দেয়া হবে। তার সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকবে।
টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতি) আসনের এই সংসদ সদস্য নবম জাতীয় সংসদেও পূর্ণ পাঁচ বছর মন্ত্রী ছিলেন। তখন তিনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। যদিও সে সময় আর রাজনীতি না করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে। পরে আবারো নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে দশম সংসদের সদস্য হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ঠাঁই পান মন্ত্রিসভায়। দলের ভেতরে হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কাউকেই তিনি তেমন পাত্তা দিতেন না। শুধু কি তাই, নিউ ইয়র্কের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেয়ার জন্য উঠে গেলে তিনি সেই চেয়ারেই বসে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য শেষ করলেও লতিফ সিদ্দিকী আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াননি। সে সময় জাতিসঙ্ঘের স্থায়ী প্রতিনিধি তাকে আসন ছেড়ে দেয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি তা করেননি। তার এই ঔদ্ধত্য আচরণে প্রধানমন্ত্রী তার ওপর খুবই বিরক্ত ছিলেন বলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকেরা জানান।
নিজের ভাই আবদুল কাদের সিদ্দিকীর ‘হঠাৎ জামায়াতঘনিষ্ঠতাকে’ তিনি ‘বীর উত্তমের রাজাকার হওয়ার শখ’ বলে সমালোচনা করেছেন। তেমনি বাড়িতে ডেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলীকে পেটানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই লতিফ সিদ্দিকীই ১৯৮০-এর দশকে প্রবাসে থেকে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সভাপতি হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। আবার ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর তিনিই বঙ্গবন্ধুকন্যার পে দৃঢ় অবস্থান নেন। ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে ১৯৬৪-৬৫ সালে তিনি করটিয়া সাদত কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ৬৬তে ছয় দফা ও ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় এই নেতা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবেও ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর লতিফ সিদ্দিকীকে প্রায় ছয় বছর কারাগারে কাটাতে হয়। এরশাদের আমলে স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী নারী সংসদ সদস্য হওয়ার পর মুক্তি পান তিনি। ২০১১ সালে পাট নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘যথাযথ মর্যাদা’ না দেয়ার অভিযোগ তুলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতেই আয়োজকদের তুলোধুনা করেন তখনকার পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। বাংলাদেশে সব পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালুর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মধ্যেই গত বছর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে একটি চিঠি লেখেন তখনকার বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, যে চিঠির শিরোনাম ছিল ‘ট্রেড ইউনিয়ন প্রশ্নে আপনি বলার কে?’
প্রেসিডিয়াম পদ থেকেও বহিষ্কার
মন্ত্রিসভার পর এবার আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যের পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি দলের প্রাথমিক সদস্য পদ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে তার। গতকাল রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় কার্যনির্বাহী সংসদের বেশির ভাগ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
সৈয়দ আশরাফ বলেন, দলের প্রেসিডিয়াম পদ থেকে তাকে সর্বসম্মতিক্রমে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। একইসাথে স্থায়ীভাবে কেন তাকে প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হবে। চিঠি আগামীকালের মধ্যে তার কাছে চলে যাবে। এর উপযুক্ত জবাব দিতে না পারলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাকে স্থায়ীভাবে প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ আশরাফ বলেন, দলের প্রাথমিক সদস্য পদ না থাকলে তার সংসদ সদস্য পদও বাতিল হয়ে যাবে। তখন ওই আসন শূন্য ঘোষণা করা হবে। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শেখ হাসিনার সূচনা বক্তব্যের পর বৈঠক শুরু হয়ে প্রায় এক ঘণ্টা চলে।
বৈঠক সূত্র জানায়, সভা শুরু এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আবদুল লতিফ সিদ্দকীকে বহিষ্কারের প্রস্তাব করেন। পরে উপস্থিত সব সদস্যই তার এ প্রস্তাবে সমর্থন জানান। এ সময় কোনো কোনো সদস্য তাকে দলের সদস্য পদ থেকেও বহিষ্কারের দাবি জানান। তখন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সবাইকে গঠনতন্ত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাকে এভাবে বহিষ্কার করা যায় না। তাকে আগে শোকজ করতে হবে। শোকজের সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারলে তাকে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কার করা হবে। তাই এখন তার প্রাথমিক সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হবে। পরে তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা যাবে। পরে উপস্থিত সব সদস্যই এ সিদ্ধান্তে সায় দেন।
লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারে সিদ্ধান্তের পর প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত নেতাদের ফোর ছেড়ে দিয়ে বলেন, আমি তো আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। এবার আপনারা আপনাদের কথা বলতে পারেন। কারণ আওয়ামী লীগ কোনো স্বৈরাচারী দল নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক দল। পরে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, সাহারা খাতুন, সতীশ চন্দ্র রায়সহ বিভিন্ন নেতা বক্তব্য রাখেন। তাদের সবাই লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কারের পক্ষে মত দেন। এ সময় কেউ কেউ লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করে প্রচলিত আইনের আওতায় নিয়ে আসারও দাবি জানান। তারা বলেন, লতিফ সিদ্দিকী সব সময় উল্টাপাল্টা ও বিতর্কিত কাজ করেছেন। তিনি মানুষকে মানুষ মনে করতেন না। তিনি উদ্ভট বক্তব্য দিয়ে দলকে যেভাবে বিতর্কিত করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে কেউ আর তেমনটি করেন নি। বিশেষ করে ধর্ম ও হজ নিয়ে তার আপত্তিকর বক্তব্যের জন্য হেফাজতে ইসলামসহ আলেমসমাজ আওয়ামী লীগের ওপর চরম ুব্ধ হয়েছে। তারা আবারো রাজপথে নামার হুমকি দিচ্ছে। তাই লতিফ সিদ্দিকীকে শুধু বহিষ্কারই নয়, তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ দল নিয়ে এভাবে খেলা না করতে পারে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সাথে নিয়েই বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের সাথে সাাৎ করেন। সাাতে রাষ্ট্রপতিকে তিনি লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণের অনুরোধ জানালে অপসারণসংক্রান্ত ফাইলে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সই করার পর বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা সচিবালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। এ বিষয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপন তিনি সাংবাদিকদের পড়ে শোনান। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের ১ দফার (গ) উপধারা অনুসারে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদে নিয়োগের অবসান ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের ১ দফায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি ১ দফার (গ) উপধারা অনুযায়ী ‘প্রধানমন্ত্রী যে-কোন সময়ে কোন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিতে পারিবেন এবং উক্ত মন্ত্রী অনুরূপ অনুরোধ পালনে অসমর্থ হইলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে উক্ত মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাইবার পরামর্শ দান করিতে পারিবেন।’
কেন লতিফের মন্ত্রিত্বের ‘অবসান’ ঘটানো হলোÑ সে বিষয়টি অবশ্য জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি সচিবও প্রজ্ঞাপনের বাইরে কিছু বলেননি। প্রজ্ঞাপনে অপসারণের বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ না থাকা প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ বলার বিষয়ে সংবিধানেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এই অবসানের অর্থ ‘অপসারণ’ না ‘অব্যাহতি’Ñ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দুটো একই বিষয়। মিনিং একই। আমরা সংবিধানের ভাষা ব্যবহার করেছি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ওই পদে নতুন কেউ নিয়োগ না পাওয়া পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকবে। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়েছেন এবং রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সন্তুষ্ট হয়ে অনুরূপ নির্দেশনা প্রদান করেছেন। আমরা প্রজ্ঞাপন জারি করেছি।
এ দিকে গতকাল সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে দলের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা লতিফ সিদ্দিকীকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যের পদ থেকে বহিষ্কার এবং প্রাথমিক সদস্যপদ স্থগিত করা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কেন তার প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করা হবে না তার কারণ দর্শানো হবে। এর আগে শেখ হাসিনার গত সরকারে বাদ পড়তে হয়েছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সমালোচনায় থাকা সৈয়দ আবুল হোসেনকে। এ ছাড়া অর্থ কেলেঙ্কারিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করলেও তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে রাখা হয়েছিল। টাঙ্গাইলে প্রভাবশালী পরিবার সিদ্দিকীদের জ্যেষ্ঠ ভাই ৭১ বছর বয়সী লতিফ সিদ্দিকী রাজনীতিতে স্পষ্টভাষী হিসেবে যেমন পরিচিত, তেমনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তির্যক ও বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে এর আগেও বহুবার আলোচনা-সমালোচনায় এসেছেন।
প্রসঙ্গত প্রধানমন্ত্রী জাতিসঘঙ্ঘ সফরে থাকার সময় গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে প্রবাসী টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী হজ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। শুধু তাই-ই নয়, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় প্রসঙ্গেও আপত্তিকর মন্ত্রব্য করেন। লতিফ সিদ্দিকী সে দিন বলেছিলেন, আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। এতে কত ম্যান পাওয়ারটা নষ্ট হয় তোমরা বিবেচনা করে দেখ। হজের জন্য ২০ লাখ মানুষ আজ সৌদিতে গেছে। এদের কোনো কাম নেই। এরা কোনো প্রোডাকশনও দিচ্ছে না, শুধু ডিডাকশন করছে। শুধু খাচ্ছে। দেশের টাকা নিয়ে গিয়ে ওদের দিচ্ছে। আবদুল্লাহপুত্র মুহম্মদ কোরাইশদের আর্থিক সুবিধার জন্য হজ উৎসব চালু করেন। তা ছাড়া উপস্থিত প্রবাসীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইটি উপদেষ্টা ও পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের পে সেøাগান দিলে তিনি বিরক্তিসহকারে বলেন, তোমরা শুধু জয় ভাই, জয় ভাই করো কেন? সজীব ওয়াজেদ জয় কে? জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নয়। তার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার নেই। জয় শুধু উপদেশ দিতে পারে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক সরকার। তার ওই বক্তব্যের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যে গোটা দেশের মানুষ বিােভে ফেটে পড়ে। নিজ দল থেকেও তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কারের দাবি ওঠে। এ প্রতিবাদে প্রথমে কয়েকটি ইসলামি দল আন্দোলনের হুমকি দেয়। পরে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়ার পাশাপাশি গ্রেফতারের দাবি তোলে বিএনপিও। যদিও এর আগে গত ২০ সেপ্টেম্বর ম্যানহাটনের হোটেল ম্যারিয়ট মার্কিতে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও তার ছেলে জয়ের উপস্থিতিতে বক্তব্য দিতে গিয়ে লতিফ সিদ্দিকী তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঠিক বিপরীত কথা বলেন এই মন্ত্রী।
লতিফ সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, লতিফ সিদ্দিকী ঈদ করার পর এখনো নিউ ইয়র্কে রয়েছেন। এর মধ্যেই ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় অন্তত দুই ডজন মামলা হয়েছে। নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত লতিফ সিদ্দিকী সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন, তিনি নিজেই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং শিগগিরই তিনি দেশে ফিরবেন।
এ দিকে নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে গত ৩ অক্টোবরই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন লতিফ সিদ্দিকী আর মন্ত্রিসভায় থাকবেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমি নির্দেশ দিলে তাকে রিজাইন করতে হবে। নইলে বিদায় করে দিতে হবে; কিন্তু বিদায় দিতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ফাইল পাঠাতে হবে। রাষ্ট্রপতি হজে গেছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হজে গেছেন। আমি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ফাইল তৈরি করে রাখতে বলেছি, অফিস খুললে ফাইল চলে আসবে। ওই সংবাদ সম্মেলনে লতিফ সিদ্দিকীকে দল থেকে বাদ দেয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দল থেকে বাদ দিতে হলে তা নিয়ে দলে আলোচনা করতে হবে। অভিযোগ তুলে ধরে আলোচনা করতে হবে। ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ওয়ার্কিং কমিটি যদি মনে করে তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া ভালো তাহলে অব্যাহতি দিয়ে দেবে। গতকাল রোববার বিকেলেই ওয়ার্কিং কমিটির সেই বৈঠক বসেছে।
তবে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ হজ পালনে সৌদি আরবে থাকায় লতিফকে বাদ দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা ঝুলে থাকে আরো এক সপ্তাহ। হজ পালনের পর রাষ্ট্রপতি দেশে ফেরেন গত শুক্রবার। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও এরই মধ্যে ফিরে আসেন। শনিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে (লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণ) একটি ফাইল আসবে। আমরা একটি সামারি তৈরি করে তা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠাব। রাষ্ট্রপতি তাতে সাইন করার পর প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এরপর গতকাল বেলা ২টায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সাথে নিয়েই বঙ্গভবনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। তিনি সেখানে বৈঠক করেন পুরো এক ঘণ্টা। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতির সই নিয়ে সচিবালয়ে ফিরে সাংবাদিকদের সামনে আসেন মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রী পদে লতিফ সিদ্দিকীর নিয়োগের অবসান ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
বাড়ি-গাড়ি খোয়ালেও সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকছে : চিফ হুইপ
মন্ত্রিত্ব হারানোর সাথে সাথে লতিফ সিদ্দিকী খোয়াবেন মন্ত্রী হিসেবে ব্যবহার করা ২০ হেয়ার রোডের বাসা ও গাড়ি। তবে তার সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকছে। বিষয়টি জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজকে অবহিত করা হলে গতকাল তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রিত্ব হারানোর পর মন্ত্রী হিসেবে পাওয়া সব সুযোগ-সুবিধা হারাবেন তিনি। এ হিসেবে তার বাড়ি ও গাড়ি বাতিল হবে। তবে মন্ত্রীর বাড়ি-গাড়ি বুঝে নেয়ার দায়িত্ব সচিবালয়ের, এটা আমার এখতিয়ারে নেই। তিনি বলেন, লতিফ সিদ্দিকী সাহেব যদি এমপি হিসেবে কোনো বাড়ি বরাদ্দ চান তাহলে ন্যাম ভবনে কোথাও হয়তো তাকে একটি ফ্যাট দেয়া হবে। তার সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকবে।
টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতি) আসনের এই সংসদ সদস্য নবম জাতীয় সংসদেও পূর্ণ পাঁচ বছর মন্ত্রী ছিলেন। তখন তিনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। যদিও সে সময় আর রাজনীতি না করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে। পরে আবারো নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে দশম সংসদের সদস্য হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ঠাঁই পান মন্ত্রিসভায়। দলের ভেতরে হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কাউকেই তিনি তেমন পাত্তা দিতেন না। শুধু কি তাই, নিউ ইয়র্কের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেয়ার জন্য উঠে গেলে তিনি সেই চেয়ারেই বসে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য শেষ করলেও লতিফ সিদ্দিকী আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াননি। সে সময় জাতিসঙ্ঘের স্থায়ী প্রতিনিধি তাকে আসন ছেড়ে দেয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি তা করেননি। তার এই ঔদ্ধত্য আচরণে প্রধানমন্ত্রী তার ওপর খুবই বিরক্ত ছিলেন বলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকেরা জানান।
নিজের ভাই আবদুল কাদের সিদ্দিকীর ‘হঠাৎ জামায়াতঘনিষ্ঠতাকে’ তিনি ‘বীর উত্তমের রাজাকার হওয়ার শখ’ বলে সমালোচনা করেছেন। তেমনি বাড়িতে ডেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলীকে পেটানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই লতিফ সিদ্দিকীই ১৯৮০-এর দশকে প্রবাসে থেকে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সভাপতি হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। আবার ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর তিনিই বঙ্গবন্ধুকন্যার পে দৃঢ় অবস্থান নেন। ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে ১৯৬৪-৬৫ সালে তিনি করটিয়া সাদত কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ৬৬তে ছয় দফা ও ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় এই নেতা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবেও ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর লতিফ সিদ্দিকীকে প্রায় ছয় বছর কারাগারে কাটাতে হয়। এরশাদের আমলে স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী নারী সংসদ সদস্য হওয়ার পর মুক্তি পান তিনি। ২০১১ সালে পাট নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘যথাযথ মর্যাদা’ না দেয়ার অভিযোগ তুলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতেই আয়োজকদের তুলোধুনা করেন তখনকার পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। বাংলাদেশে সব পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালুর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মধ্যেই গত বছর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে একটি চিঠি লেখেন তখনকার বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, যে চিঠির শিরোনাম ছিল ‘ট্রেড ইউনিয়ন প্রশ্নে আপনি বলার কে?’
প্রেসিডিয়াম পদ থেকেও বহিষ্কার
মন্ত্রিসভার পর এবার আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যের পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি দলের প্রাথমিক সদস্য পদ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে তার। গতকাল রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় কার্যনির্বাহী সংসদের বেশির ভাগ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
সৈয়দ আশরাফ বলেন, দলের প্রেসিডিয়াম পদ থেকে তাকে সর্বসম্মতিক্রমে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। একইসাথে স্থায়ীভাবে কেন তাকে প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে চিঠি দেয়া হবে। চিঠি আগামীকালের মধ্যে তার কাছে চলে যাবে। এর উপযুক্ত জবাব দিতে না পারলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাকে স্থায়ীভাবে প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ আশরাফ বলেন, দলের প্রাথমিক সদস্য পদ না থাকলে তার সংসদ সদস্য পদও বাতিল হয়ে যাবে। তখন ওই আসন শূন্য ঘোষণা করা হবে। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শেখ হাসিনার সূচনা বক্তব্যের পর বৈঠক শুরু হয়ে প্রায় এক ঘণ্টা চলে।
বৈঠক সূত্র জানায়, সভা শুরু এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আবদুল লতিফ সিদ্দকীকে বহিষ্কারের প্রস্তাব করেন। পরে উপস্থিত সব সদস্যই তার এ প্রস্তাবে সমর্থন জানান। এ সময় কোনো কোনো সদস্য তাকে দলের সদস্য পদ থেকেও বহিষ্কারের দাবি জানান। তখন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সবাইকে গঠনতন্ত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাকে এভাবে বহিষ্কার করা যায় না। তাকে আগে শোকজ করতে হবে। শোকজের সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারলে তাকে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কার করা হবে। তাই এখন তার প্রাথমিক সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হবে। পরে তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা যাবে। পরে উপস্থিত সব সদস্যই এ সিদ্ধান্তে সায় দেন।
লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারে সিদ্ধান্তের পর প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত নেতাদের ফোর ছেড়ে দিয়ে বলেন, আমি তো আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। এবার আপনারা আপনাদের কথা বলতে পারেন। কারণ আওয়ামী লীগ কোনো স্বৈরাচারী দল নয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক দল। পরে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, সাহারা খাতুন, সতীশ চন্দ্র রায়সহ বিভিন্ন নেতা বক্তব্য রাখেন। তাদের সবাই লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কারের পক্ষে মত দেন। এ সময় কেউ কেউ লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করে প্রচলিত আইনের আওতায় নিয়ে আসারও দাবি জানান। তারা বলেন, লতিফ সিদ্দিকী সব সময় উল্টাপাল্টা ও বিতর্কিত কাজ করেছেন। তিনি মানুষকে মানুষ মনে করতেন না। তিনি উদ্ভট বক্তব্য দিয়ে দলকে যেভাবে বিতর্কিত করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে কেউ আর তেমনটি করেন নি। বিশেষ করে ধর্ম ও হজ নিয়ে তার আপত্তিকর বক্তব্যের জন্য হেফাজতে ইসলামসহ আলেমসমাজ আওয়ামী লীগের ওপর চরম ুব্ধ হয়েছে। তারা আবারো রাজপথে নামার হুমকি দিচ্ছে। তাই লতিফ সিদ্দিকীকে শুধু বহিষ্কারই নয়, তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ দল নিয়ে এভাবে খেলা না করতে পারে।
No comments