ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পথে by মোহাম্মদ হাসান শরীফ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান তাদের মধ্যকার ৩৫ বছরের বিধ্বংসী শত্রুতার অবসান ঘটাতে সাহসী পদক্ষেপ নেবেÑ এমন সম্ভাবনা পাশ্চাত্যের পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ক্রমেই দানা বাঁধছে। তারা মনে করছে, এ দুই দেশের সঙ্ঘাতের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অংশজুড়ে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাপ্তির জন্য তাদেরই প্রয়োজন একটা বিশাল পদক্ষেপ নেয়া। দু’টি ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুগান্তকারী এই সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। একটি হলো উভয় পক্ষের অভিন্ন শত্রু হিসেবে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আবির্ভাব এবং ২৪ নভেম্বরের মধ্যেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রশ্নে চুক্তি স্বাক্ষরের আশাবাদ সৃষ্টি। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানকালে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি পারমাণবিক আলোচনার ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার মতো বক্তব্য রেখেছেন। তার মতে, এই অচলাবস্থা নিরসনে আর মাত্র একটা সিঁড়ি বাকি আছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরব এ ব্যাপারে এত আশাবাদী ছিলেন যে তিনি বলে ফেললেন, চুক্তি স্বাক্ষরের আলোচনা প্রায় ৯৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। রুহানি অনেকবারই জোর দিয়ে বলেছেন, কেবল পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো যায়, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার পরিস্থিতি হয়ে পড়বে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই। তার মতে, ভবিষ্যতে সহযোগিতার অনেক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তিনি এই অঞ্চলের বিশৃঙ্খলায় ইরানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি স্পষ্টভাবেই তার কথা বলেছেন, ‘পারমাণবিক ফাইলটার প্রতি একটু ছাড় দিন, সব ধরনের ভালো ভালো বিষয় ঢলের মতো প্রবাহিত হতে থাকবে।’
কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র এক বছরে আমেরিকা ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কে অনেক উন্নতি ঘটেছে। অনেক বছর ধরে উচ্চপর্যায়ের কোনো বৈঠক না হওয়ার পর সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তার ইরানি প্রতিপক্ষ মোহাম্মদ জাভেদ জরিফের সাথে বৈঠক করছেন। তাদের মধ্যকার বৈঠক নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পাশ্চাত্যের এক কর্মকর্তার কথায়, তাদের মধ্যে বেশ আন্তরিকতা দেখা যাচ্ছে। তবে অত্যন্ত দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সহযোগিতার মাত্রাটি কত দূর এগোয়, তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
খুব ঘনিষ্ঠ নয়
পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের সমূহ সম্ভাবনার মধ্যে এখন এ প্রশ্নটি সৃষ্টি হয়েছে, ইরান কি আইএসের বিরুদ্ধে আমেরিকান নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনে যোগ দেবে, নাকি সংগঠনটির বিরুদ্ধে সে পরোক্ষ যুদ্ধ চালাবে? ইরানের আইএস থেকে দূরে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। ইতোমধ্যেই ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের অস্ত্র দেয়া শুরু করেছে ইরান। তা ছাড়া সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদের বাহিনীকেও বিপুলভাবে সহায়তা করছে তেহরান। তবে সহযোগিতা করার মতো আরো অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। বাগদাদের ওপর তেহরানের বিরাট প্রভাব রয়েছে (উগ্র শিয়া প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিকে যখন সরানোর দরকার হয়ে পড়ল, তখন সরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে)। সুন্নি ও কুর্দিদের ক্ষোভ প্রশমনে হায়দার আল আবাদি সরকারকে রাজি করাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইরান অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
ইরান বাশার আল আসাদকে ত্যাগ করবে, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ অবসানে তেহরান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তা ছাড়া লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে যেভাবে ইরানের সমর্থন পাচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতে পারে। অধিকন্তু আফগানিস্তানেও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ইরান। এর ফলে এই সম্ভাবনাই সৃষ্টি হচ্ছে, ইরানের নতুন নেতৃত্ব হয়তো এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন, যার ফলে দেশটি আঞ্চলিক পরাশক্তির স্বীকৃতি পেয়ে যাবে। এই অঞ্চলে কর্তৃত্ব ফলাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যে রক্তক্ষরণ ঘটাতে হচ্ছে এবং অর্থ ঢালতে হচ্ছে, সেটা ছাড়াই যদি স্বার্থসিদ্ধি করতে পারে, তবে ক্ষতি কী? অবশ্য এর পরও সন্দেহের কিছু কারণ থাকে। ইরান পি৫+১ (আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানি)-এর সাথে পারমাণবিক কর্মসূচি প্রশ্নে যে আলোচনা চালাচ্ছে, তাতে এমন কোনো চুক্তি করতে চাইবে না যা আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও কার্যত খারাপ। আবার ইসরাইলও চাইবে না ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হোক। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আমেরিকা সফর করেও সেটা বলে এসেছেন।
দ্বিতীয়ত, পারমাণবিক সমঝোতা প্রশ্নে ব্যাপক আশাবাদ দেখা গেলেও সত্যিকার অর্থে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট ঐকমত্য দেখা যায়নি। আর যদি আলোচনা ভেঙে যায়, তবে হয়তো ইরান অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। আমেরিকা এই দাবিতে এখনো অনড় রয়েছে যে, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সামর্থ্য বর্তমানে ব্যবহৃত ৯৫০০ সেন্ট্রিফিউজের অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। আর এই সামর্থ্য আগামী ২০ বছরে বাড়ানো যাবে না। কিন্তু ইরান জোর দিয়ে বলছে, তাদের ক্রমবর্ধমান শিল্পচাহিদা পূরণ করার জন্য অদূর ভবিষ্যতে অন্তত এক লাখ সেন্ট্রিফিউজের প্রয়োজন পড়বে। লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বিস্তার রোধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মার্ক ফিটজপ্যাট্রিক মনে করেন, ইরানি প্রেসিডেন্ট রুহানি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জরিফ হয়তো কোনো ধরনের সমঝোতায় আসতে চান। কিন্তু দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে রাজি হবেন না।
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণবিষয়ক হোয়াইট হাউজের সাবেক উপদেষ্টা (বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলফার সেন্টারে কর্মরত) গ্যারি স্যামোর মনে করেন, নভেম্বরের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক কোনো সমঝোতা সম্ভবত হবে না। তবে দুই পক্ষের মধ্যে অন্তর্বর্তী একটা সমঝোতা হতে পারে, যার সূত্র ধরে আলোচনা অব্যাহত থাকার একটা ব্যবস্থা হতে পারে। ইরানি প্রেসিডেন্ট হয়তো মনে করতে পারেন, আইএসের উত্থানের ফলে তার সামনে আমেরিকার কাছ থেকে ফায়দা হাসিলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আইএস সৃষ্টি নিয়ে ইরান ও পাশ্চাত্যের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ রয়েছে। রুহানি প্রায়ই অভিযোগ করছেন, ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা এবং সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো এবং উপসাগরীয় দেশগুলো যে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে আসছে, তার ফলেই আইএসের উত্থান ঘটেছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করছে, বাশার আল আসাদের নৃশংস শাসন এবং ইরাকের শিয়া প্রাধান্যবিশিষ্ট সরকারের দুর্নীতি এবং সুন্নিদের বিরুদ্ধে নির্যাতন চালানোর পরিণতিতে আইএসের আবির্ভাব ঘটেছে।
অধিকন্তু আইএসকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র যে পরিকল্পনা করছে, তাতে মধ্যম পন্থা অবলম্বনকারী মুসলমানদের এই সংগঠনটির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তারা সুন্নি গোত্র ও কুর্দিদের এটাই বোঝাতে চাইছে, ভবিষ্যতে অসাম্প্রদায়িক কেন্দ্রীয় ইরাক রাষ্ট্রের অধিবাসী হবে তারা। আর সিরিয়ায় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ) অস্ত্র পেয়ে যাবে, যত দিন আইএস এবং আসাদ সরকার উভয়ই বিদায় না নেয়। এ দু’টি বিষয়ে ইরান কিভাবে সাড়া দেয়, সেটাও দেখার বিষয়। আসাদ সরকারকে সরিয়ে দেয়া এবং ইরাকে শিয়া সরকার না থাকা ইরান কতটুকু মেনে নেবে, সেটা এখন দেখার বিষয়।
আমার শত্রুর শত্রু হলো আমারও শত্রু
ইরানি প্রেসিডেন্ট গত সপ্তাহে অভিযোগ করেছেন, আমেরিকা আরেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সিরিয়ায় পাঠাচ্ছে। আবার আইএসের বিরুদ্ধে হামলার একপর্যায়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলার শিকার হতে পারে আসাদের বাহিনী এবং তাদেরই মিত্র এফএসএ। আইএসের বিরুদ্ধে হামলায় অংশ নেয়া আরব বিমান বাহিনী ইতোমধ্যেই ইরাকের চেয়ে সিরিয়ায় হামলা চালাতেই বেশি আগ্রহী দেখা গেছে। এত কিছু সামাল দেয়ার পরও রুহানি ও জরিফ যদি পাশ্চাত্যের সাথে কোনো একটা সমঝোতায় পৌঁছতে পারেন, তবেই সব কিছু ভালোয় ভালোয় হবে তা নয়। তখন আবার তাদের খামেনির সামনে পড়তে হবে। তা ছাড়া রয়েছে প্রভাবশালী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী। তারাও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগ করতে দেবে না। ফলে খুব সহজ হবে না কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো। তবে সব কিছুর জন্যই আমাদের আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।
(ইকোনমিস্ট অবলম্বনে)
কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র এক বছরে আমেরিকা ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কে অনেক উন্নতি ঘটেছে। অনেক বছর ধরে উচ্চপর্যায়ের কোনো বৈঠক না হওয়ার পর সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তার ইরানি প্রতিপক্ষ মোহাম্মদ জাভেদ জরিফের সাথে বৈঠক করছেন। তাদের মধ্যকার বৈঠক নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পাশ্চাত্যের এক কর্মকর্তার কথায়, তাদের মধ্যে বেশ আন্তরিকতা দেখা যাচ্ছে। তবে অত্যন্ত দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সহযোগিতার মাত্রাটি কত দূর এগোয়, তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
খুব ঘনিষ্ঠ নয়
পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের সমূহ সম্ভাবনার মধ্যে এখন এ প্রশ্নটি সৃষ্টি হয়েছে, ইরান কি আইএসের বিরুদ্ধে আমেরিকান নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনে যোগ দেবে, নাকি সংগঠনটির বিরুদ্ধে সে পরোক্ষ যুদ্ধ চালাবে? ইরানের আইএস থেকে দূরে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। ইতোমধ্যেই ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের অস্ত্র দেয়া শুরু করেছে ইরান। তা ছাড়া সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদের বাহিনীকেও বিপুলভাবে সহায়তা করছে তেহরান। তবে সহযোগিতা করার মতো আরো অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। বাগদাদের ওপর তেহরানের বিরাট প্রভাব রয়েছে (উগ্র শিয়া প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিকে যখন সরানোর দরকার হয়ে পড়ল, তখন সরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে)। সুন্নি ও কুর্দিদের ক্ষোভ প্রশমনে হায়দার আল আবাদি সরকারকে রাজি করাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইরান অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
ইরান বাশার আল আসাদকে ত্যাগ করবে, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ অবসানে তেহরান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তা ছাড়া লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে যেভাবে ইরানের সমর্থন পাচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতে পারে। অধিকন্তু আফগানিস্তানেও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ইরান। এর ফলে এই সম্ভাবনাই সৃষ্টি হচ্ছে, ইরানের নতুন নেতৃত্ব হয়তো এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন, যার ফলে দেশটি আঞ্চলিক পরাশক্তির স্বীকৃতি পেয়ে যাবে। এই অঞ্চলে কর্তৃত্ব ফলাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যে রক্তক্ষরণ ঘটাতে হচ্ছে এবং অর্থ ঢালতে হচ্ছে, সেটা ছাড়াই যদি স্বার্থসিদ্ধি করতে পারে, তবে ক্ষতি কী? অবশ্য এর পরও সন্দেহের কিছু কারণ থাকে। ইরান পি৫+১ (আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানি)-এর সাথে পারমাণবিক কর্মসূচি প্রশ্নে যে আলোচনা চালাচ্ছে, তাতে এমন কোনো চুক্তি করতে চাইবে না যা আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও কার্যত খারাপ। আবার ইসরাইলও চাইবে না ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হোক। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আমেরিকা সফর করেও সেটা বলে এসেছেন।
দ্বিতীয়ত, পারমাণবিক সমঝোতা প্রশ্নে ব্যাপক আশাবাদ দেখা গেলেও সত্যিকার অর্থে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট ঐকমত্য দেখা যায়নি। আর যদি আলোচনা ভেঙে যায়, তবে হয়তো ইরান অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। আমেরিকা এই দাবিতে এখনো অনড় রয়েছে যে, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সামর্থ্য বর্তমানে ব্যবহৃত ৯৫০০ সেন্ট্রিফিউজের অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। আর এই সামর্থ্য আগামী ২০ বছরে বাড়ানো যাবে না। কিন্তু ইরান জোর দিয়ে বলছে, তাদের ক্রমবর্ধমান শিল্পচাহিদা পূরণ করার জন্য অদূর ভবিষ্যতে অন্তত এক লাখ সেন্ট্রিফিউজের প্রয়োজন পড়বে। লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বিস্তার রোধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মার্ক ফিটজপ্যাট্রিক মনে করেন, ইরানি প্রেসিডেন্ট রুহানি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জরিফ হয়তো কোনো ধরনের সমঝোতায় আসতে চান। কিন্তু দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে রাজি হবেন না।
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণবিষয়ক হোয়াইট হাউজের সাবেক উপদেষ্টা (বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলফার সেন্টারে কর্মরত) গ্যারি স্যামোর মনে করেন, নভেম্বরের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক কোনো সমঝোতা সম্ভবত হবে না। তবে দুই পক্ষের মধ্যে অন্তর্বর্তী একটা সমঝোতা হতে পারে, যার সূত্র ধরে আলোচনা অব্যাহত থাকার একটা ব্যবস্থা হতে পারে। ইরানি প্রেসিডেন্ট হয়তো মনে করতে পারেন, আইএসের উত্থানের ফলে তার সামনে আমেরিকার কাছ থেকে ফায়দা হাসিলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আইএস সৃষ্টি নিয়ে ইরান ও পাশ্চাত্যের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ রয়েছে। রুহানি প্রায়ই অভিযোগ করছেন, ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা এবং সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো এবং উপসাগরীয় দেশগুলো যে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে আসছে, তার ফলেই আইএসের উত্থান ঘটেছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করছে, বাশার আল আসাদের নৃশংস শাসন এবং ইরাকের শিয়া প্রাধান্যবিশিষ্ট সরকারের দুর্নীতি এবং সুন্নিদের বিরুদ্ধে নির্যাতন চালানোর পরিণতিতে আইএসের আবির্ভাব ঘটেছে।
অধিকন্তু আইএসকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র যে পরিকল্পনা করছে, তাতে মধ্যম পন্থা অবলম্বনকারী মুসলমানদের এই সংগঠনটির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তারা সুন্নি গোত্র ও কুর্দিদের এটাই বোঝাতে চাইছে, ভবিষ্যতে অসাম্প্রদায়িক কেন্দ্রীয় ইরাক রাষ্ট্রের অধিবাসী হবে তারা। আর সিরিয়ায় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ) অস্ত্র পেয়ে যাবে, যত দিন আইএস এবং আসাদ সরকার উভয়ই বিদায় না নেয়। এ দু’টি বিষয়ে ইরান কিভাবে সাড়া দেয়, সেটাও দেখার বিষয়। আসাদ সরকারকে সরিয়ে দেয়া এবং ইরাকে শিয়া সরকার না থাকা ইরান কতটুকু মেনে নেবে, সেটা এখন দেখার বিষয়।
আমার শত্রুর শত্রু হলো আমারও শত্রু
ইরানি প্রেসিডেন্ট গত সপ্তাহে অভিযোগ করেছেন, আমেরিকা আরেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সিরিয়ায় পাঠাচ্ছে। আবার আইএসের বিরুদ্ধে হামলার একপর্যায়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলার শিকার হতে পারে আসাদের বাহিনী এবং তাদেরই মিত্র এফএসএ। আইএসের বিরুদ্ধে হামলায় অংশ নেয়া আরব বিমান বাহিনী ইতোমধ্যেই ইরাকের চেয়ে সিরিয়ায় হামলা চালাতেই বেশি আগ্রহী দেখা গেছে। এত কিছু সামাল দেয়ার পরও রুহানি ও জরিফ যদি পাশ্চাত্যের সাথে কোনো একটা সমঝোতায় পৌঁছতে পারেন, তবেই সব কিছু ভালোয় ভালোয় হবে তা নয়। তখন আবার তাদের খামেনির সামনে পড়তে হবে। তা ছাড়া রয়েছে প্রভাবশালী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী। তারাও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগ করতে দেবে না। ফলে খুব সহজ হবে না কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো। তবে সব কিছুর জন্যই আমাদের আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।
(ইকোনমিস্ট অবলম্বনে)
No comments