বিশেষজ্ঞ মতামত

ড. সৈয়দা শাহনাজ বেগম
সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা
বর্তমানের এই অত্যাধুনিক যুগে বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ঠেলে দেয়ার ট্র্যাডিশন যেন বেড়েই চলেছে। এর মূল কারণ কী? আর এই মূল্যবোধহীন জীবন থেকে উত্তরণের উপায় কী? এই প্রশ্ন দুটো সামনে রেখে সরকারি তিতুমীর কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দা শাহনাজ বেগমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেনÑ জীবনযাত্রার মান আগের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি উন্নত। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থাও ঠিক সেভাবে পরিবর্তিত হয়ে নিজের শিকড় থেকে দূরে চলে গিয়ে জন্মদাতা বাবা-মায়ের ঋণ ভুলে নিজেদের আরাম-আয়েশ ও স্ত্রী-সন্তানের মন রক্ষায় আজ অনেক পুত্রসন্তানই মাকে ঠেলে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। অনেক সময় তারা এ-ও বলছে যে, স্বামী-স্ত্রী দু’জনই যেহেতু চাকরিজীবী সুতরাং বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবাযতœ ঠিকমতো করা সম্ভব নয়, তাই বৃদ্ধাশ্রমে সমবয়সী বৃদ্ধদের সাথে তারা ভালোই থাকবেন তাই এ ব্যবস্থা। তা ছাড়া তাদের অনেকেই পাশ্চাত্য বিশ্বের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানকার ব্যাপারগুলো তো কেউ কিছু মনে করে না, আমরা কেন মনে করব। আসলে রাতারাতি এত পরিবর্তন কি আমরা হজম করতে পারব? কারণÑ আদিকাল থেকেই বাংলার আবহমান সংস্কৃতিতে বাবা-মা ও সন্তানদের সম্পর্ক হচ্ছে যুগ-যুগান্তরের, সেখানে বিদেশের উদাহরণ হচ্ছে নিছকই বাতুলতা। তা ছাড়া বিদেশের ট্র্যাডিশন হচ্ছে ১৮ বছর পর থেকে সন্তানরা সাবলম্বী হয়। বৃদ্ধ হলে সে দেশের সরকার তাদের দেখভালের দায়িত্ব নেয় সুতরাং তাদের সাথে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। এ ক্রাইসিস থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেনÑ একেবারে ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা সম্পর্কে সন্তানদের মধ্যে এই মূল্যবোধটুকু ঢুকিয়ে দেয়ার ট্র্যাডিশন গ্রো করার চেষ্টা করতে হবে। ছেলেমেয়েদের বোঝাতে হবেÑ আজ তোমার (সন্তান) জন্য তোমার বাবা-মা যা করছেন তার প্রতিদান তোমাকেই দিতে হবে যখন তারা বৃদ্ধ হবেন। কারণ বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত যার ফলে বাবা-মা তার সর্বস্ব দিয়েই সন্তানকে বড় করে তোলেন, নিজেদের জন্য কিছুই রাখে না। দায়িত্ব তার নিতেই হবেÑ এটা অবশ্যই কর্তব্যের মধ্যে পড়ে যায়। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটানোর উপায় নেই। তা ছাড়া সরকার বা কোনো দাতাগোষ্ঠী অসহায় এমন বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেন তাহলে তো কোনো কথাই থাকে না। যদি কোনো সন্তান বাবা-মায়ের খোঁজখবর না নেন তখন না হয় তারা বৃদ্ধাশ্রমেই আশ্রয় নিবেন অথবা যাদের সন্তানই নেই তারা বৃদ্ধাশ্রমেই যাবেন।


খালেদা সুলতানা নূর
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
মোল্লার ‘মোহাম্মাদান ল’ বইয়ের ৩৭১ নম্বর ধারার ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ প্রত্যেক সচ্ছল-অবস্থাপন্ন ছেলেমেয়ে তাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে ভরণ পোষণ করতে বাধ্য থাকিবে। এবং একই ধারার ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ অভাবগ্রস্ত ও গরিব সন্তানও বৃদ্ধ মায়ের দায়িত্ব নেয়ার জন্য বাধ্য করা হয়েছে এবং ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে পিতাকেও গরিব সন্তান তার ভরণ-পোষণ করার জন্য বাধ্য করা হয়েছে। অন্য দিকে মেয়েসন্তানদের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে পিতা-মাতাকে অর্থ দিয়ে না পারুক অন্তত সেবাযতœ দিয়ে হলেও কর্তব্য পালন করার কথা। এসব আইনের মাধ্যমে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য পালনে বাধ্য করা এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে আদালতে মামলা করার আইন রয়েছে। যদিও আজ পর্যন্ত কোনো বাবা-মা সন্তানের বিরুদ্ধে ভরণ-পোষণ আইনের বিরুদ্ধে মামলা করেনি। কারণ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিচার করলে হাজারো যন্ত্রণা বা কষ্টেও কোনো বাবা-মা সন্তানের বিরুদ্ধে এসব মামলা করেন না। কথা প্রসঙ্গে আইনজীবী সুলতানা নূর জানান, সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ এলাকায় এক বৃদ্ধ মাকে তার ছেলেরা বস্তার মধ্যে বন্দী করে দূরে ফেলে এলে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে কোর্টে ছেলের বিরুদ্ধে মাকে মামলা করতে বললে তিনি তাতে রাজি হননি। যখন সরকারি উকিল বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেনÑ ছেলেকে শাস্তি দিতে বলেন, তখন মা ছেলেকে সব অপরাধ থেকে মুক্ত করে দেন। অতঃপর তাকে কোথায় যাবেন জিজ্ঞেস করলে বলেনÑ আমি আমার চোখের মণি ছেলের কাছেই যাবো।
বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থা অনুযায়ী সাধারণ জনগণের ধারণা শুধু ছেলেরাই বুঝি বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেবেÑ আসলে কিন্তু তা নয়। বাবা-মা সন্তান মানুষ করার সময় যেহেতু ছেলেসন্তান বা মেয়েসন্তানকে আলাদাভাবে বিবেচনা করেন না সুতরাং মেয়েসন্তানদেরও সমান দায়িত্ব রয়েছে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেয়া। যদিও আমাদের সমাজে মেয়েরা টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য না করতে পারলেও খোঁজখবর নেয়া, বাবা-মায়ের সেবাযতেœর বেলায় মেয়েসন্তানেরা কিন্তু অনেকাংশে এগিয়ে আছেÑ এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার পরও যতটুকু সম্ভব ছেলেমেয়ে উভয়ই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেয়া অবশ্যই কর্তব্যের একটি অংশ হিসেবে গ্রাহ্য করা হয়। আর এসব কর্তব্যের ব্যাপারে প্রত্যেক বাবা-মায়েরই উচিত ছেলেবেলায় সন্তানদের মনের ভেতর মূল্যবোধ সৃষ্টি করার মানসিকতা তৈরি করা, যাতে কোনো অনৈতিক কাজ তারা না করে।
বিশেষজ্ঞ মতামত

No comments

Powered by Blogger.