কপালে যা আছে তা-ই by সাহস রতন
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, চেতনা- এই শব্দগুলো বলতে বলতে রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজ মুখে ফেনা তুলে ফেললো। জনগণেরও কান ঝালাপালা হয়ে গেল। গণতন্ত্র তো শুধু মুখে বলার ব্যাপার না। এটা চর্চা করার বিষয়। আর এই গণতন্ত্র চর্চার জন্য সর্বপ্রথম যা দরকার তা হলো সুশিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠী। তার সঙ্গে অতি আবশ্যক হলো পরমতসহিষ্ণুতা। যে দেশে শিক্ষিতের হার এখনও ৫০ শতাংশের নিচে সে দেশে গণতন্ত্র কিভাবে সুফল আনবে? আমাদের দেশে গণতন্ত্র মানে তো, ভীষণরকম ব্যস্ত রাস্তা আটকে মিটিং-মিছিল কিংবা অন্য কোন কর্মসূচি বা অনুষ্ঠানের আয়োজন। এতে যে অন্যের বারোটা বেজে গেল তা তো বিবেচনায় নিচ্ছে না কেউ। আর অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয়া? আমাদের দেশে এটা এখন দূরবীন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। তাহলে এটা কি ধরনের গণতন্ত্র চর্চা হলো? গণতন্ত্রের প্রচলিত একটা উদাহরণ হলো- ‘আপনি আপনার হাতটা ততটুকু পর্যন্ত প্রসারিত করতে পারবেন যাতে অন্যের নাক স্পর্শ না করে।’ আমাদের এখানে কি সেটা হচ্ছে? গণতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু আমাদের এখানে অধিকারের ব্যাপারটি শুধু ক্ষমতাবানদের জন্য প্রযোজ্য। এখানে হরতাল ডাকার অধিকার আছে কিন্তু হরতাল না মানার অধিকার কারও নেই। রাষ্ট্রের সম্পদ চুরি-দুর্নীতি করার অধিকার প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আছে। কিন্তু এ বিষয়ে অভিযোগ করার অধিকার জনগণের নেই। কি হবে এ গণতন্ত্র দিয়ে যে গণতন্ত্র আমার মতো সাধারণ মানুষের কথা বলে না। যে গণতন্ত্র শোষিতের নয়, শোষকের। মিথ্যাচার করে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র আর যা-ই হোক মানুষের মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। আমাদের জাতির কপালে ইতিমধ্যে বিএনপি সরকার, আওয়ামী সরকার, এরশাদ সরকার নাজিল হয়েছে। এগুলো সবই দলীয় সরকার। দলীয় সরকার দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছে। বাংলাদেশের মানুষের কপালে কবে আসবে কাঙ্ক্ষিত সেই ‘জনগণের সরকার’ যে সরকার শুধুমাত্র জনগণের কথা মাথায় রেখে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করবে? এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে চিহ্নিত স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। দলীয় ক্যাডারদের রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি বানানো হয়েছে। গণতন্ত্রের লেবাসে সবাই জনগণকে শোষণ করছে বিগত তিন দশক ধরে। এরা নির্বাচনের আগে নানা রকম ফন্দি-ফিকির করে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে, হাতে-পায়ে ধরে ভোট আদায় করে। আর সরকার গঠনের পর, ‘কাউকেই চিনি না’ ভাব। নির্বাচনের আগে, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। নির্বাচনের পর, সাংসদই সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। আর এটা করা হচ্ছে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রচুর অবৈধ সুবিধা দিয়ে। বুদ্ধিজীবীরা দলীয় লেজুড়বৃত্তি চর্চার বাইরে যেতে পারছে না। আহা কি যে মধু ক্ষমতায়! ক্ষমতা রে ক্ষমতা! নেতা নির্বাচনে বারবার নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছি আমরা। একই লোক পাঁচ বছর অন্তর অন্তর এসে একই কথা বলছে। ‘এইবারই আমার শেষ নির্বাচন। এই শেষবারের মতো আমারে ভোট দিয়া পাস করাইয়া দেন। তারপর দেখেন আমি কি করি।’ আর আমরা বোকার দল প্রতিবারই তাদের মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আর ঠকেছি। কবে আমাদের বোধোদয় হবে? আর কত যুগ শোষিত হলে আমাদের ঘুম ভাঙবে? আয়নায় নিজের মুখটি দেখার সময় এসেছে। বিশ্বাসঘাতকদের কৃতঘ্নতার প্রতিদান দেয়ার সময় হয়েছে। গণ্ডারের চেয়েও ভারি হয়ে গেছে আমাদের শরীরের চামড়া। তা না হলে চোখের সামনে ঘটতে থাকা এত অন্যায় যুগ যুগ ধরে কিভাবে সহ্য করে যাচ্ছি আমরা? আগে তা-ও মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ হতো। এখন পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়ে ‘আল্লাহ ভরসা’ টাইপের হয়ে পড়েছে সবাই। কপালে যা আছে তা-ই হবে, এটাই যেন মেনে নিয়েছি সবাই। আসুন আমরা সবাই গণতন্ত্র বাদ দিয়ে ‘ঘনতন্ত্র’ চর্চায় লিপ্ত হই।
No comments