এখন প্রয়োজন ফেইথ ইন ডেমোক্রেসি by একেএম শাহ নাওয়াজ
লালনের
একটি বিখ্যাত লাইন ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। প্রয়োজনের সময়ে সঠিক রাজনৈতিক
সিদ্ধান্ত না নিতে পারায় বিএনপি এখন লক্ষ্য স্থির করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে
পড়ছে। অর্থাৎ কঠিন হয়ে পড়েছে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা। এখন নানা জটিলতার পর
অনেকটা হাবুডুবু খেয়ে আবারও নেতিবাচক পথে হাঁটার পরামর্শ পেয়েছেন বিএনপি
প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। তাই গত ২৪ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনের বক্তৃতায়
তিনি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ নামে একটি কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন। ভয়াবহ
লাগাতার সহিংসতার পর এই কর্মসূচিকে অহিংসই বলা যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ
মানুষের দশা এখন ঘরপোড়া গরুর মতো। তারা আশ্বস্ত হতে পারছে না। এর ভেতর নানা
কূটচালের সম্ভাবনা খুঁজছে। কারণ বিএনপি প্রযোজিত এবং বিএনপি-জামায়াত
পরিচালিত হরতাল-অবরোধের আগের দিন থেকেই জনমনে আতংক তৈরির জন্য সন্ত্রাস
ছড়ানো হতো। কর্মসূচির সময় তো সন্ত্রাস চলতই। এখন আবার কর্মসূচি শেষ হওয়ার
পরও সহিংসতার ইতি টানা হয় না। এই তো ২৪ ডিসেম্বর অবরোধ অবসানের পর খালেদা
জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের রাতে পুলিশ বহন করা বাসে পেট্রল বোমা ছুড়ে আহত-নিহত
করা হল দায়িত্ব পালনরত পুলিশের কয়েকজনকে। এসব কারণে বিরোধী দলের ডাকা যে
কোনো কর্মসূচি মানুষ এখন আতংকের সঙ্গেই দেখছে। তাই বিএনপি ঘোষিত ‘মার্চ ফর
ডেমোক্রেসি’ জনকল্যাণ ও দেশকল্যাণের কোনো কাজে আসতে পারবে বলে মানুষ মনে
করছে না। তার চেয়ে সচেতন মানুষ মনে করে, ‘ফেইথ ইন ডেমোক্রেসি’র পরিবেশ তৈরি
করতে পারলে তা দেশের রাজনৈতিক সংকট মোচনে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।
গণতন্ত্র তো কোনো বক্তৃতার শব্দ নয়। এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। ১৯৫৪ থেকে বাঙালি ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ক্ষমতাপ্রিয় রাজনীতিকরা গণতন্ত্রের কাঠামোকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। গণরায়ের প্রতি বিশ্বাসী না থেকে সন্ত্রাস, কালো টাকা আর প্রভাববলয় ছড়িয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন নির্বাচন, যা এত প্রকট হয়ে পড়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা তৈরি করতে হয়। গণতন্ত্রের পথ তারপরও মসৃণ হয়নি। নির্বাচন কমিশন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, আমাদের রাজনীতির বিধায়কদের উর্বর মাথায় সে ভাবনাও খেলতে থাকে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে আমরা বেশির ভাগ সময়ই মাননীয় বিচারপতিদেরই দেখেছি। বিচারকের সুমহান দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকায় নতুন দায়িত্বে তারা নিরপেক্ষভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন এমন প্রত্যাশা হয়তো ছিল মানুষের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের এ সত্যটিও মানতে হয়েছে যে, এ দেশে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বা বিচারপতি হাবিবুর রহমান যেমন আছেন, তেমনি বিচারপতি এমএ আজিজ এবং বিচারপতি ফজলুল হকদেরও অস্তিত্ব রয়েছে। তবে ১/১১-এর পরিবর্তনে সব দিক থেকেই একটি ভিন্ন চেহারার তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। সেখানে বিচারপতিদের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। গণতন্ত্রপ্রিয় এ দেশের মানুষ তবু সে সরকারকে মেনে নিয়েছিল। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কপট গণতন্ত্র চর্চা ও স্বার্থবাদী রাজনীতি মানসিকভাবে রাজনীতিকদের অনেকটা গণবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। তাই তিক্ত বিরক্ত মানুষ স্রোতের শ্যাওলাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। সাধারণ মানুষের মানসিক অবস্থাকে আমলে এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনপ্রিয় কর্মসূচি ঘোষণা করে। শনাক্ত করে মানুষের প্রধান চাওয়াকে। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের কারারুদ্ধ করে। পুনরুজ্জীবিত দুদক অনেককাল পর দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণের দৃঢ়তা দেখায়। সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে। সাধারণ মানুষের চোখে ততদিনে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া বিএনপির আমলে তৈরি ভুয়া ভোটার লিস্ট এই কমিশন বাতিল করে নতুন ভোটার লিস্ট প্রণয়ন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির ব্যবস্থা করে অনেকটাই গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতে পারে। মানুষ অচিরেই গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায় এই আধা-স্বৈরাচারী সরকারকেই সমর্থন করে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো প্রধান দলগুলো মানুষের মনে আস্থার জায়গা তৈরি না করতে পারায় সাধারণ মানুষের আস্থা অনেকটাই ধরে রাখতে পেরেছিল ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
তারপরও গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আকাক্সক্ষা মানুষকে ব্যাকুল করে তোলে। সাধারণ ও নতুন প্রজন্মের ভোটাররা চারদলীয় জোটের দুর্বল ও দুর্নীতি আকীর্ণ শাসনের জন্য যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা বিএনপিকে পরিত্যাগ করে ঐতিহ্যবাহী এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগের ওপর ভরসা রেখেছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অতীত শাসন যে খুব সুখকর ছিল এমন নয়। তবে কার্যকারণ সূত্রেই আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র সুরক্ষা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে- এ প্রত্যাশাটুকু করেছিল মানুষ। তবে পাঁচ বছরের শাসনে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্র“তি পালন করে জনমনে স্বস্তি দিলেও দুর্নীতি ও শাসন দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এ অবস্থা প্রায় ভেঙে পড়া বিএনপির জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর একটি সুযোগ তৈরি করে দেয়। বিএনপির উচিত ছিল এর সদ্ব্যবহার করা। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে দলটির জন্য উত্তম ছিল মরচে ধরা রাজনৈতিক আবর্তন থেকে বেরিয়ে আসা। জনগণের ইচ্ছাকে ধারণ করা। আওয়ামী লীগের দুর্বলতা ও ব্যর্থতাগুলোকে যথাযথ প্রচারের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা। গণতন্ত্রের পথে পদযাত্রার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল অনেক আগেই। জামায়াত সংসর্গ ত্যাগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সরব হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে পথে হাঁটল না বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল। ওয়ান লিডার শো পার্টি হিসেবে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি এ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আমরা মনে করি, দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন গতানুগতিকতার ছক থেকে বেরুতে পারেনি। রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার না করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারকে দুর্বল করতে চেয়েছে। আমাদের ধারণা, বিএনপির নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটতে না পারার পেছনে জামায়াত আর স্বয়ং খালেদা জিয়া উভয়েরই দায় রয়েছে। ১৮-দলীয় জোটের শাসনক্ষমতা লাভে বিলম্ব করার উপায় ছিল না উভয়েরই। কারণ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে জামায়াত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর ঠেকানো প্রয়োজন। আরেক টার্ম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকর হয়ে গেলে রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়বে জামায়াত। আর পারিবারিক সংকট থেকে বাঁচার জন্য বেগম জিয়ার হাতেও সময় ছিল না। তার দুই ছেলেকে মামলামুক্ত করে ফিরিয়ে আনার সময় বয়ে যাচ্ছিল। দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে এভাবেই দল বলি হয়ে যায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে।
এই কঠিন বাস্তবতায় জামায়াতের পরিকল্পনা এবং বেগম জিয়ার একান্ত সমর্থনে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে না গিয়ে শক্তি প্রয়োগের পুরনো কৌশলেই ক্ষমতার পালাবদল করতে চেয়েছে বিএনপি। ১৮-দলীয় জোটের এ আচরণকে নির্বাচনের মাঠে অনেকটা দুর্বল হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে- সরকারি শক্তি সুবিধাকে ব্যবহার করে নানা রাজনৈতিক কূটকৌশলে। ক্ষমতাসীন হওয়ার উদগ্র বাসনায় এ বিষয়টিকে আমলে নেয়নি বিএনপি। ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছিল সরকার পক্ষ বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতে চায়। সে সুযোগটি দেয়া উচিত হয়নি। বিএনপির সঠিক পথে ঘুরে দাঁড়ানোর অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দূরদৃষ্টি দিয়ে তারা তা গ্রহণ করতে পারেনি। বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভার দিন নিজের কথা না রেখে বড় একটি সুযোগ হারিয়েছেন খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটি ভিন্ন সমীকরণ দাঁড় করানোর সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কৌশলী হয়ে নানা ধরনের ছাড় দিয়ে হলেও নির্বাচনে আসা বিএনপির জন্য অলাভজনক ছিল না। তার বদলে পুরনো পন্থায় লাগাতার হরতাল-অবরোধের মধ্য দিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে, মানুষ খুন করে, আগুন লাগিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাইল।
এক ধাক্কায় সরকারের পতন ঘটাতে না পারলে এসব পদক্ষেপ বুমেরাং হয়। বিএনপির ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। সন্ত্রাস-সহিংসতার রূপকার হিসেবে জনবিক্ষোভ তৈরি হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে। অযৌক্তিক, তামাশার ও হাস্যকর যাই বলি না কেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করার যে প্রস্তুতি আওয়ামী লীগ নিয়ে ফেলেছে তা শক্তি প্রয়োগে বন্ধ করা সম্ভব হবে না বলেই আমাদের ধারণা। আওয়ামী লীগের মতো সাধারণ মানুষও মনে করে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ বিএনপির শক্তি প্রয়োগের শেষ উপলক্ষ। বহুদিন থেকেই ঢাকা অবরুদ্ধ করার জন্য এ ধারার কর্মসূচি নিয়ে আসছে বিএনপি। কখনও নিজে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে, কখনও হেফাজতকে দিয়ে। শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই সরকার এবার আরও বেশি হুশিয়ার থাকবে।
যেহেতু গণতান্ত্রিক আচরণ কোনো পক্ষের ভেতরই নেই, তাহলে অযথা জনদুর্ভোগ বাড়ানোর পথে হাঁটা কেন? তার চেয়ে নির্বাচনকে আরও বেশি তামাশায় পরিণত করার উদ্দেশ্যে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিতে পারত নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন বর্জনের জন্য জনমত তৈরি করতে। বিএনপির রাজনৈতিক অর্জন হতো তাদের আমলের ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচনের মতো আওয়ামী লীগের দশম সংসদ নির্বাচনকে কলংকিত করে রাখা। অতঃপর পূর্ণ শক্তি নিয়ে রাজনৈতিক কৌশল দিয়ে জনমত তৈরি করে যুক্তিগ্রাহ্য একাদশ সংসদের পথে হাঁটা। এতে গণতন্ত্র সংহার নয়, গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার কৃতিত্ব পেতে পারত বিএনপি। এ জন্যই জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে সম্ভাব্য ব্যর্থ ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র পথ পরিহার করে গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে ‘ফেইথ ইন ডেমোক্রেসি’তে নিজ অবস্থান নিশ্চিত করা উচিত বিএনপির। এখনও সুযোগ আছে কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেয়ার। আমরা বিশ্বাস করি, এ পথে বিএনপি অনেক বেশি সাফল্য পাবে। জনগণের সামনে নিজেকে অনেক বেশি ইতিবাচকভাবে উপস্থিত করতে পারবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
গণতন্ত্র তো কোনো বক্তৃতার শব্দ নয়। এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। ১৯৫৪ থেকে বাঙালি ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ক্ষমতাপ্রিয় রাজনীতিকরা গণতন্ত্রের কাঠামোকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। গণরায়ের প্রতি বিশ্বাসী না থেকে সন্ত্রাস, কালো টাকা আর প্রভাববলয় ছড়িয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন নির্বাচন, যা এত প্রকট হয়ে পড়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা তৈরি করতে হয়। গণতন্ত্রের পথ তারপরও মসৃণ হয়নি। নির্বাচন কমিশন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, আমাদের রাজনীতির বিধায়কদের উর্বর মাথায় সে ভাবনাও খেলতে থাকে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে আমরা বেশির ভাগ সময়ই মাননীয় বিচারপতিদেরই দেখেছি। বিচারকের সুমহান দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকায় নতুন দায়িত্বে তারা নিরপেক্ষভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন এমন প্রত্যাশা হয়তো ছিল মানুষের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের এ সত্যটিও মানতে হয়েছে যে, এ দেশে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বা বিচারপতি হাবিবুর রহমান যেমন আছেন, তেমনি বিচারপতি এমএ আজিজ এবং বিচারপতি ফজলুল হকদেরও অস্তিত্ব রয়েছে। তবে ১/১১-এর পরিবর্তনে সব দিক থেকেই একটি ভিন্ন চেহারার তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। সেখানে বিচারপতিদের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। গণতন্ত্রপ্রিয় এ দেশের মানুষ তবু সে সরকারকে মেনে নিয়েছিল। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কপট গণতন্ত্র চর্চা ও স্বার্থবাদী রাজনীতি মানসিকভাবে রাজনীতিকদের অনেকটা গণবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। তাই তিক্ত বিরক্ত মানুষ স্রোতের শ্যাওলাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। সাধারণ মানুষের মানসিক অবস্থাকে আমলে এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনপ্রিয় কর্মসূচি ঘোষণা করে। শনাক্ত করে মানুষের প্রধান চাওয়াকে। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের কারারুদ্ধ করে। পুনরুজ্জীবিত দুদক অনেককাল পর দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণের দৃঢ়তা দেখায়। সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে। সাধারণ মানুষের চোখে ততদিনে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া বিএনপির আমলে তৈরি ভুয়া ভোটার লিস্ট এই কমিশন বাতিল করে নতুন ভোটার লিস্ট প্রণয়ন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির ব্যবস্থা করে অনেকটাই গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতে পারে। মানুষ অচিরেই গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায় এই আধা-স্বৈরাচারী সরকারকেই সমর্থন করে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো প্রধান দলগুলো মানুষের মনে আস্থার জায়গা তৈরি না করতে পারায় সাধারণ মানুষের আস্থা অনেকটাই ধরে রাখতে পেরেছিল ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
তারপরও গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আকাক্সক্ষা মানুষকে ব্যাকুল করে তোলে। সাধারণ ও নতুন প্রজন্মের ভোটাররা চারদলীয় জোটের দুর্বল ও দুর্নীতি আকীর্ণ শাসনের জন্য যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা বিএনপিকে পরিত্যাগ করে ঐতিহ্যবাহী এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগের ওপর ভরসা রেখেছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অতীত শাসন যে খুব সুখকর ছিল এমন নয়। তবে কার্যকারণ সূত্রেই আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র সুরক্ষা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে- এ প্রত্যাশাটুকু করেছিল মানুষ। তবে পাঁচ বছরের শাসনে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্র“তি পালন করে জনমনে স্বস্তি দিলেও দুর্নীতি ও শাসন দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এ অবস্থা প্রায় ভেঙে পড়া বিএনপির জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর একটি সুযোগ তৈরি করে দেয়। বিএনপির উচিত ছিল এর সদ্ব্যবহার করা। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে দলটির জন্য উত্তম ছিল মরচে ধরা রাজনৈতিক আবর্তন থেকে বেরিয়ে আসা। জনগণের ইচ্ছাকে ধারণ করা। আওয়ামী লীগের দুর্বলতা ও ব্যর্থতাগুলোকে যথাযথ প্রচারের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা। গণতন্ত্রের পথে পদযাত্রার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল অনেক আগেই। জামায়াত সংসর্গ ত্যাগ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সরব হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে পথে হাঁটল না বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল। ওয়ান লিডার শো পার্টি হিসেবে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি এ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আমরা মনে করি, দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন গতানুগতিকতার ছক থেকে বেরুতে পারেনি। রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার না করে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারকে দুর্বল করতে চেয়েছে। আমাদের ধারণা, বিএনপির নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটতে না পারার পেছনে জামায়াত আর স্বয়ং খালেদা জিয়া উভয়েরই দায় রয়েছে। ১৮-দলীয় জোটের শাসনক্ষমতা লাভে বিলম্ব করার উপায় ছিল না উভয়েরই। কারণ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে জামায়াত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর ঠেকানো প্রয়োজন। আরেক টার্ম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকর হয়ে গেলে রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়বে জামায়াত। আর পারিবারিক সংকট থেকে বাঁচার জন্য বেগম জিয়ার হাতেও সময় ছিল না। তার দুই ছেলেকে মামলামুক্ত করে ফিরিয়ে আনার সময় বয়ে যাচ্ছিল। দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে এভাবেই দল বলি হয়ে যায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে।
এই কঠিন বাস্তবতায় জামায়াতের পরিকল্পনা এবং বেগম জিয়ার একান্ত সমর্থনে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে না গিয়ে শক্তি প্রয়োগের পুরনো কৌশলেই ক্ষমতার পালাবদল করতে চেয়েছে বিএনপি। ১৮-দলীয় জোটের এ আচরণকে নির্বাচনের মাঠে অনেকটা দুর্বল হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে- সরকারি শক্তি সুবিধাকে ব্যবহার করে নানা রাজনৈতিক কূটকৌশলে। ক্ষমতাসীন হওয়ার উদগ্র বাসনায় এ বিষয়টিকে আমলে নেয়নি বিএনপি। ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছিল সরকার পক্ষ বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতে চায়। সে সুযোগটি দেয়া উচিত হয়নি। বিএনপির সঠিক পথে ঘুরে দাঁড়ানোর অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দূরদৃষ্টি দিয়ে তারা তা গ্রহণ করতে পারেনি। বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভার দিন নিজের কথা না রেখে বড় একটি সুযোগ হারিয়েছেন খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটি ভিন্ন সমীকরণ দাঁড় করানোর সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কৌশলী হয়ে নানা ধরনের ছাড় দিয়ে হলেও নির্বাচনে আসা বিএনপির জন্য অলাভজনক ছিল না। তার বদলে পুরনো পন্থায় লাগাতার হরতাল-অবরোধের মধ্য দিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে, মানুষ খুন করে, আগুন লাগিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাইল।
এক ধাক্কায় সরকারের পতন ঘটাতে না পারলে এসব পদক্ষেপ বুমেরাং হয়। বিএনপির ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। সন্ত্রাস-সহিংসতার রূপকার হিসেবে জনবিক্ষোভ তৈরি হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে। অযৌক্তিক, তামাশার ও হাস্যকর যাই বলি না কেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করার যে প্রস্তুতি আওয়ামী লীগ নিয়ে ফেলেছে তা শক্তি প্রয়োগে বন্ধ করা সম্ভব হবে না বলেই আমাদের ধারণা। আওয়ামী লীগের মতো সাধারণ মানুষও মনে করে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ বিএনপির শক্তি প্রয়োগের শেষ উপলক্ষ। বহুদিন থেকেই ঢাকা অবরুদ্ধ করার জন্য এ ধারার কর্মসূচি নিয়ে আসছে বিএনপি। কখনও নিজে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে, কখনও হেফাজতকে দিয়ে। শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই সরকার এবার আরও বেশি হুশিয়ার থাকবে।
যেহেতু গণতান্ত্রিক আচরণ কোনো পক্ষের ভেতরই নেই, তাহলে অযথা জনদুর্ভোগ বাড়ানোর পথে হাঁটা কেন? তার চেয়ে নির্বাচনকে আরও বেশি তামাশায় পরিণত করার উদ্দেশ্যে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিতে পারত নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন বর্জনের জন্য জনমত তৈরি করতে। বিএনপির রাজনৈতিক অর্জন হতো তাদের আমলের ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচনের মতো আওয়ামী লীগের দশম সংসদ নির্বাচনকে কলংকিত করে রাখা। অতঃপর পূর্ণ শক্তি নিয়ে রাজনৈতিক কৌশল দিয়ে জনমত তৈরি করে যুক্তিগ্রাহ্য একাদশ সংসদের পথে হাঁটা। এতে গণতন্ত্র সংহার নয়, গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার কৃতিত্ব পেতে পারত বিএনপি। এ জন্যই জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে সম্ভাব্য ব্যর্থ ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র পথ পরিহার করে গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে ‘ফেইথ ইন ডেমোক্রেসি’তে নিজ অবস্থান নিশ্চিত করা উচিত বিএনপির। এখনও সুযোগ আছে কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেয়ার। আমরা বিশ্বাস করি, এ পথে বিএনপি অনেক বেশি সাফল্য পাবে। জনগণের সামনে নিজেকে অনেক বেশি ইতিবাচকভাবে উপস্থিত করতে পারবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments