লিবারেলিজম বা উদার রাজনীতি by ফরহাদ মজহার
আজ
আমি কিছু তত্ত্বকথা বলব লিবারেলিজম নিয়ে। কারণ উদার রাজনীতি সম্পর্কে
আমাদের অনেক ভুল ধারণা আছে। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে কঠিন
কিছু বলার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। তত্ত্বকথার মধ্য দিয়ে কিছু কথা বলার
চেষ্টা করব। লিবারেলিজম বা উদার রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে আমাদের ধারণা
নেতিবাচক। সে কারণে এই লেখা। ইংরেজিতে রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ‘লিবারেলিজম’
কথাটার খুব ভালো বাংলা অনুবাদ নেই। অবশ্য তা থাকার কথাও নয়। কারণ রাজনৈতিক
দর্শন বা আদর্শ হিসেবে এর আবির্ভাব ও দানা বাঁধার জন্য একটি সমাজে কমপক্ষে
তিনটা শর্ত পূরণের দরকার আছে : এক. পুরনো প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন
সম্পর্কের জায়গায় গতিশীল পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের আবির্ভাব ও
বিকাশ; অর্থাৎ এমন এক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হওয়া দরকার, যার ফলে
সামন্ততন্ত্র বলি কিংবা বলি জমিদারতন্ত্র, সব ধরনের প্রাচীন উৎপাদন
ব্যবস্থা পুঁজির তোড়ের মুখে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়া। বাংলাদেশে
পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক গতিশীল নাকি প্রতিক্রিয়াশীল সে তর্ক করা যায়,
কিন্তু এর যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য আমরা দেখছি, সেখানে ব্যক্তির
অধিকার সম্পর্কে সচেতনতাকে ভালো দিকে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। একটি গতিশীল
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। প্রথম শর্ত খানিক পূরণ হয়েছে
বলা যায়।
দুই. কোনো দৈব অধিকার কিংবা অভিজাত রক্তের দোহাই দিয়ে অপরকে নিজের অধীন রাখার প্রতি মানুষের প্রতিবাদী হয়ে ওঠা। ‘রাজা’র অধীনে জনগণকে ‘প্রজা গণ্য করার ধারণার ক্ষয় ও রাজা-প্রজা সম্পর্কের বিলুপ্তি। যে বিশ্বাসের বলে মানুষ দৈব ক্ষমতা কিংবা অভিজাত রক্তের সূত্রে কাউকে শাসনকর্তা হিসেবে স্বাভাবিক মেনে নিত, সেই বিশ্বাসেরও ক্ষয় ঘটা। বাংলাদেশে এই শর্তও কিছুটা পূরণ হয়েছে। তিন. চিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে বিপ্লব; ইউরোপে যে-বিপ্লব ‘এনলাইটমেন্ট’ বলে পরিচিত। এ বিষয়টি বড়সড় আলোচনা দাবি করে। কিন্তু লিবারেলিজম সম্পর্কে যে কথা বলতে চাইছি তার দরকারে দুই-একটি দিক একটু সংক্ষেপে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করব।
যে-সমাজে আদর্শ হিসেবে ‘লিবারেলিজম’ দানা বাঁধে সেই সমাজে মানুষ তার নানা জৈবিক ও মানসিক প্রবৃত্তির মধ্যে বিচারবুদ্ধিকেই সর্দার মেনে নেয়। নিদেন পক্ষে মানতে আপত্তি করে না। অন্যের সঙ্গে তর্কবিতর্কে বাস্তবতা ও যুক্তিকেই প্রাধান্য দেয়। সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞান বলি কী রাজনীতি বলি, ‘রিজন’ বা বুদ্ধির বিচারই ‘সত্য’ নির্ণয়ের পথ- এই চিন্তা সমাজে অন্যান্য অনুদার চিন্তার চেয়েও অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। নীতিনৈতিকতার ক্ষেত্রেও। মানুষের বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কিংবা যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা সত্য বিচারের পদ্ধতিকে নানা ধরনের অযৌক্তিক বা দৈব দোহাই দিয়ে অস্বীকার করার ইতিহাস আজকের নয়, বহু পুরনো। শুধু অস্বীকার নয়, যুগে যুগে যুক্তি, বুদ্ধি ও বিজ্ঞানচিন্তার জন্য মানুষকে মূল্য দিতে হয়েছে চরমভাবে। দমন-নিপীড়ন সহ্য করেছে মানুষ। বিজ্ঞানীরা পুড়ে মরেছে। সেই দিক থেকে দেখলে মানুষের অন্যান্য বৃত্তির অধীনস্থতা থেকে বুদ্ধির ‘মুক্তি’ গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক ঘটনা।
তবে বুদ্ধি যখন পাল্টা মানুষের অন্যান্য স্বভাব বা বৃত্তির ভূমিকা ও গুরুত্বকে অস্বীকার বা নাকচ করে বুদ্ধিই সত্য নির্ণয়ের একমাত্র পথ ও পদ্ধতি বলে দাবি করতে শুরু করে, তখন সেটা নতুন আপদ তৈরি করে। তখনই তার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রও ধরা পড়া শুরু হয়। বুদ্ধির দোহাই দিয়ে যখন মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস, কল্পনা, আকাক্সক্ষা ইত্যাদি দমন করা হয়, তখন সেটাও মানুষের মুক্তির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠে। বুদ্ধি যখন একমাত্র নিজেকেই সব বৃত্তির সর্দার দাবি করে, তখন সেটা একরোখা বুদ্ধিহীনতা। এর হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া দরকার। এই বুদ্ধিহীনতার নানা লক্ষণ আছে। কমন কিছু আবর্জনা সব সময়ই আমরা চারপাশে হাজির দেখি। যেমন ধর্মের বিপরীতে যুক্তি, আধুনিকতার বিপরীতে অনাধুনিকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপরীতে প্রগতিশীলতা ইত্যাদি বদ্ধমূল বাইনারি ধারণা দিয়ে চিন্তা করার প্রাচীন পদ্ধতি বুদ্ধিহীনতার নানা লক্ষণের মধ্যে একটি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তার এই পশ্চাৎপদ পদ্ধতির বিপদ সম্পর্কে হুশিয়ার হওয়া খুবই দরকার।
এক সময় দার্শনিকদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই প্রবল ছিল, যারা মনে করতেন বুদ্ধি ছাড়া মানুষের অন্যান্য বৃত্তির ভূমিকা গৌণ। বিশেষত বিশ্বাস, ইনটুইশান বা মানুষের কোনো কিছু আগাম জানার স্বাভাবিক কিছু প্রবৃত্তি। যেমন ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা, দিব্য অভিজ্ঞতার মূল্য, ইত্যাদি। বলা হতো, সত্য নির্ণয়ে বা কোনো অভিজ্ঞতার স্বরূপ নির্ণয়ে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।
যুক্তিই সত্য প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ, যুক্তিই সত্যের স্বরূপ। ‘এনলাইটমেন্ট’ যুগে যুক্তি ও বিজ্ঞানের জয়গান গাইতে গিয়ে মানুষের অপরাপর বৃত্তি খুবই তুচ্ছ ব্যাপারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আজকাল এদের সংখ্যা কমই বলা যাবে। একসময় বলা হতো বিশ্বাসের যুগ শেষ হয়ে গেছে, এসেছে যুক্তি, বিজ্ঞান ও ভোগের যুগ। আধুনিকতার প্রাবল্যে বিশ্বাসের শেষ তলানিটুকু শুকিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু দেখা যাচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া দূরের কথা, ধর্ম বা বিশ্বাসের রাজনীতি ফিরে আসছে প্রবলভাবে।
মানুষ কি আসলে কেবলি যুক্তিবাদী? বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলেই কি তার মুক্তি? ভোগেই কি তার জীবনের চরম অর্থ নিহিত? প্রাণ, পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসের এই তাণ্ডব মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির কোনো সমন্বয় বা ভাবগত সম্পর্ক রচনা ছাড়া কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব? মানুষ যদি শুধু ‘ব্যক্তি’ হয়ে থাকে, তাহলে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক রচনার ভিত্তি কী? কী ধরনের রাষ্ট্র ব্যক্তির ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও সংকল্প ধারণ করতে সক্ষম? এই প্রশ্নগুলো নতুনভাবে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ফিরে এসেছে। লিবারেলিজমের জন্য এনলাইটমেন্ট দরকার। দর্শনের দিক থেকে দেখলে পাশ্চাত্যে তা এসে চলেও যাচ্ছে। রাজনীতিতে লিবারেলিজম নামে যা এসেছিল তা রূপ নিয়েছে নিউ লিবারেলিজম বা নব্য উদারবাদে।
জন লককে যদি রাজনৈতিক লিবারেলিজমের বীজদাতা গণ্য করি তাহলে তিনটি ব্যাপার মুখস্থ রাখলে আমাদের রাজনীতি পর্যালোচনার খুব সুবিধা হবে। লকের দাবি, তিনটি ব্যাপারে মানুষের অধিকার ‘প্রকৃতিদত্ত’। সেই তিনটি অধিকার হচ্ছে- ১. জীবনের অধিকার, ২. সম্পত্তির অধিকার এবং ৩. স্বাধীনতার অধিকার, যাকে আমরা নাগরিক অধিকার বলে থাকি। এগুলো এমন এক ‘অধিকার’ যা আইনেরও ঊর্ধ্বে কিংবা আইনের বাইরে। এই অর্থে যে কোনো আইন দিয়ে তা হরণ করা যাবে না। আর মানুষকে যদি সমাজে ও রাষ্ট্রে এক সূত্রে বাঁধতে হয়, তাহলে কোনো সরকার বা রাষ্ট্র কখনোই এই অধিকার ভঙ্গ করতে পারবে না। লিবারেলিজমের সঙ্গে পুরনো সংরক্ষণবাদীদের প্রধান বা মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে লিবারেলিজম স্বৈরতন্ত্র কিংবা একনায়কতান্ত্রিক সরকার চায় না। লিবারেলিজম চায় প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র ও আইনের শাসন।
পাঠক হয়তো একটু বিরক্ত হয়ে ভাববেন, এত তত্ত্বকথার দরকার কী? দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে তত্ত্বচর্চা খুবই বিব্রতকর, কোনো সন্দেহ নেই। সম্প্রতি দৈনিক যুগান্তর ও অন্যত্র কয়েকটি লেখায় আমি বেশ কয়েকবার জোর দিয়ে বলেছিলাম, পুঁজির প্রান্তের দেশগুলোতে ‘লিবারেল’ বা উদার রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে। উপরে যে তিনটি শর্তের কথা বলেছি, আমার ধারণা প্রথম ও দ্বিতীয় শর্তের পূরণ ঘটলেও তৃতীয় শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি।
লিবারেলিজম শক্তির জায়গাটা হচ্ছে এই শব্দ এবং শব্দের অন্তর্গত ধারণার মধ্যে মুক্তির ধারণা নিহিত রয়েছে। লিবারেলিজম দাবি করে মানুষ মাত্রই স্বাধীন, সে কারও দাস বা গোলাম নয়। তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারও অধীনস্থ রাখা যাবে না। যে তাকে শাসন করবে, তাকে তার কাছ থেকে সম্মতি আদায় করতে হবে। নির্বাচন সম্মতি আদায়ের একটি পদ্ধতি। সম্মতি ছাড়া যে শাসন, সেটা অবৈধ শাসন। যে শাসক নৈতিক বৈধতা হারায়, তার পতন ঘটেই। ঘটতে বাধ্য। সেটা নিয়মতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে ঘটবে সেটা জনগণই স্থির করে।
বাংলাদেশে লিবারেল বা উদার রাজনীতির যদি কোনো ভূমিকা থাকে তাহলে অবৈধ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত, এটা রাজনৈতিক ও দার্শনিকভাবে প্রমাণ করাই তার কাজ। বাংলাদেশে ব্যক্তির অধিকার হরণকারী সরকারের পক্ষাবলম্বনকারী ও গণবিরোধী ‘সুশীল’ রাজনীতির সঙ্গে লিবারেল বা উদার রাজনৈতিক চিন্তা ও মতাদর্শের প্রধান পার্থক্য এখানেই।
দুই. কোনো দৈব অধিকার কিংবা অভিজাত রক্তের দোহাই দিয়ে অপরকে নিজের অধীন রাখার প্রতি মানুষের প্রতিবাদী হয়ে ওঠা। ‘রাজা’র অধীনে জনগণকে ‘প্রজা গণ্য করার ধারণার ক্ষয় ও রাজা-প্রজা সম্পর্কের বিলুপ্তি। যে বিশ্বাসের বলে মানুষ দৈব ক্ষমতা কিংবা অভিজাত রক্তের সূত্রে কাউকে শাসনকর্তা হিসেবে স্বাভাবিক মেনে নিত, সেই বিশ্বাসেরও ক্ষয় ঘটা। বাংলাদেশে এই শর্তও কিছুটা পূরণ হয়েছে। তিন. চিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে বিপ্লব; ইউরোপে যে-বিপ্লব ‘এনলাইটমেন্ট’ বলে পরিচিত। এ বিষয়টি বড়সড় আলোচনা দাবি করে। কিন্তু লিবারেলিজম সম্পর্কে যে কথা বলতে চাইছি তার দরকারে দুই-একটি দিক একটু সংক্ষেপে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করব।
যে-সমাজে আদর্শ হিসেবে ‘লিবারেলিজম’ দানা বাঁধে সেই সমাজে মানুষ তার নানা জৈবিক ও মানসিক প্রবৃত্তির মধ্যে বিচারবুদ্ধিকেই সর্দার মেনে নেয়। নিদেন পক্ষে মানতে আপত্তি করে না। অন্যের সঙ্গে তর্কবিতর্কে বাস্তবতা ও যুক্তিকেই প্রাধান্য দেয়। সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞান বলি কী রাজনীতি বলি, ‘রিজন’ বা বুদ্ধির বিচারই ‘সত্য’ নির্ণয়ের পথ- এই চিন্তা সমাজে অন্যান্য অনুদার চিন্তার চেয়েও অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। নীতিনৈতিকতার ক্ষেত্রেও। মানুষের বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কিংবা যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা সত্য বিচারের পদ্ধতিকে নানা ধরনের অযৌক্তিক বা দৈব দোহাই দিয়ে অস্বীকার করার ইতিহাস আজকের নয়, বহু পুরনো। শুধু অস্বীকার নয়, যুগে যুগে যুক্তি, বুদ্ধি ও বিজ্ঞানচিন্তার জন্য মানুষকে মূল্য দিতে হয়েছে চরমভাবে। দমন-নিপীড়ন সহ্য করেছে মানুষ। বিজ্ঞানীরা পুড়ে মরেছে। সেই দিক থেকে দেখলে মানুষের অন্যান্য বৃত্তির অধীনস্থতা থেকে বুদ্ধির ‘মুক্তি’ গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক ঘটনা।
তবে বুদ্ধি যখন পাল্টা মানুষের অন্যান্য স্বভাব বা বৃত্তির ভূমিকা ও গুরুত্বকে অস্বীকার বা নাকচ করে বুদ্ধিই সত্য নির্ণয়ের একমাত্র পথ ও পদ্ধতি বলে দাবি করতে শুরু করে, তখন সেটা নতুন আপদ তৈরি করে। তখনই তার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রও ধরা পড়া শুরু হয়। বুদ্ধির দোহাই দিয়ে যখন মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস, কল্পনা, আকাক্সক্ষা ইত্যাদি দমন করা হয়, তখন সেটাও মানুষের মুক্তির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠে। বুদ্ধি যখন একমাত্র নিজেকেই সব বৃত্তির সর্দার দাবি করে, তখন সেটা একরোখা বুদ্ধিহীনতা। এর হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া দরকার। এই বুদ্ধিহীনতার নানা লক্ষণ আছে। কমন কিছু আবর্জনা সব সময়ই আমরা চারপাশে হাজির দেখি। যেমন ধর্মের বিপরীতে যুক্তি, আধুনিকতার বিপরীতে অনাধুনিকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপরীতে প্রগতিশীলতা ইত্যাদি বদ্ধমূল বাইনারি ধারণা দিয়ে চিন্তা করার প্রাচীন পদ্ধতি বুদ্ধিহীনতার নানা লক্ষণের মধ্যে একটি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তার এই পশ্চাৎপদ পদ্ধতির বিপদ সম্পর্কে হুশিয়ার হওয়া খুবই দরকার।
এক সময় দার্শনিকদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই প্রবল ছিল, যারা মনে করতেন বুদ্ধি ছাড়া মানুষের অন্যান্য বৃত্তির ভূমিকা গৌণ। বিশেষত বিশ্বাস, ইনটুইশান বা মানুষের কোনো কিছু আগাম জানার স্বাভাবিক কিছু প্রবৃত্তি। যেমন ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা, দিব্য অভিজ্ঞতার মূল্য, ইত্যাদি। বলা হতো, সত্য নির্ণয়ে বা কোনো অভিজ্ঞতার স্বরূপ নির্ণয়ে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।
যুক্তিই সত্য প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ, যুক্তিই সত্যের স্বরূপ। ‘এনলাইটমেন্ট’ যুগে যুক্তি ও বিজ্ঞানের জয়গান গাইতে গিয়ে মানুষের অপরাপর বৃত্তি খুবই তুচ্ছ ব্যাপারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আজকাল এদের সংখ্যা কমই বলা যাবে। একসময় বলা হতো বিশ্বাসের যুগ শেষ হয়ে গেছে, এসেছে যুক্তি, বিজ্ঞান ও ভোগের যুগ। আধুনিকতার প্রাবল্যে বিশ্বাসের শেষ তলানিটুকু শুকিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু দেখা যাচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া দূরের কথা, ধর্ম বা বিশ্বাসের রাজনীতি ফিরে আসছে প্রবলভাবে।
মানুষ কি আসলে কেবলি যুক্তিবাদী? বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলেই কি তার মুক্তি? ভোগেই কি তার জীবনের চরম অর্থ নিহিত? প্রাণ, পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসের এই তাণ্ডব মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির কোনো সমন্বয় বা ভাবগত সম্পর্ক রচনা ছাড়া কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব? মানুষ যদি শুধু ‘ব্যক্তি’ হয়ে থাকে, তাহলে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক রচনার ভিত্তি কী? কী ধরনের রাষ্ট্র ব্যক্তির ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও সংকল্প ধারণ করতে সক্ষম? এই প্রশ্নগুলো নতুনভাবে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ফিরে এসেছে। লিবারেলিজমের জন্য এনলাইটমেন্ট দরকার। দর্শনের দিক থেকে দেখলে পাশ্চাত্যে তা এসে চলেও যাচ্ছে। রাজনীতিতে লিবারেলিজম নামে যা এসেছিল তা রূপ নিয়েছে নিউ লিবারেলিজম বা নব্য উদারবাদে।
জন লককে যদি রাজনৈতিক লিবারেলিজমের বীজদাতা গণ্য করি তাহলে তিনটি ব্যাপার মুখস্থ রাখলে আমাদের রাজনীতি পর্যালোচনার খুব সুবিধা হবে। লকের দাবি, তিনটি ব্যাপারে মানুষের অধিকার ‘প্রকৃতিদত্ত’। সেই তিনটি অধিকার হচ্ছে- ১. জীবনের অধিকার, ২. সম্পত্তির অধিকার এবং ৩. স্বাধীনতার অধিকার, যাকে আমরা নাগরিক অধিকার বলে থাকি। এগুলো এমন এক ‘অধিকার’ যা আইনেরও ঊর্ধ্বে কিংবা আইনের বাইরে। এই অর্থে যে কোনো আইন দিয়ে তা হরণ করা যাবে না। আর মানুষকে যদি সমাজে ও রাষ্ট্রে এক সূত্রে বাঁধতে হয়, তাহলে কোনো সরকার বা রাষ্ট্র কখনোই এই অধিকার ভঙ্গ করতে পারবে না। লিবারেলিজমের সঙ্গে পুরনো সংরক্ষণবাদীদের প্রধান বা মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে লিবারেলিজম স্বৈরতন্ত্র কিংবা একনায়কতান্ত্রিক সরকার চায় না। লিবারেলিজম চায় প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র ও আইনের শাসন।
পাঠক হয়তো একটু বিরক্ত হয়ে ভাববেন, এত তত্ত্বকথার দরকার কী? দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে তত্ত্বচর্চা খুবই বিব্রতকর, কোনো সন্দেহ নেই। সম্প্রতি দৈনিক যুগান্তর ও অন্যত্র কয়েকটি লেখায় আমি বেশ কয়েকবার জোর দিয়ে বলেছিলাম, পুঁজির প্রান্তের দেশগুলোতে ‘লিবারেল’ বা উদার রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে। উপরে যে তিনটি শর্তের কথা বলেছি, আমার ধারণা প্রথম ও দ্বিতীয় শর্তের পূরণ ঘটলেও তৃতীয় শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে রয়েছি।
লিবারেলিজম শক্তির জায়গাটা হচ্ছে এই শব্দ এবং শব্দের অন্তর্গত ধারণার মধ্যে মুক্তির ধারণা নিহিত রয়েছে। লিবারেলিজম দাবি করে মানুষ মাত্রই স্বাধীন, সে কারও দাস বা গোলাম নয়। তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারও অধীনস্থ রাখা যাবে না। যে তাকে শাসন করবে, তাকে তার কাছ থেকে সম্মতি আদায় করতে হবে। নির্বাচন সম্মতি আদায়ের একটি পদ্ধতি। সম্মতি ছাড়া যে শাসন, সেটা অবৈধ শাসন। যে শাসক নৈতিক বৈধতা হারায়, তার পতন ঘটেই। ঘটতে বাধ্য। সেটা নিয়মতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে ঘটবে সেটা জনগণই স্থির করে।
বাংলাদেশে লিবারেল বা উদার রাজনীতির যদি কোনো ভূমিকা থাকে তাহলে অবৈধ শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত, এটা রাজনৈতিক ও দার্শনিকভাবে প্রমাণ করাই তার কাজ। বাংলাদেশে ব্যক্তির অধিকার হরণকারী সরকারের পক্ষাবলম্বনকারী ও গণবিরোধী ‘সুশীল’ রাজনীতির সঙ্গে লিবারেল বা উদার রাজনৈতিক চিন্তা ও মতাদর্শের প্রধান পার্থক্য এখানেই।
No comments