বর্তমান সংকটে ক্যাপটিভ এডিটর ও সুশীল সমাজের ভূমিকা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশের
ইংরেজি সাংবাদিকতায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটার মতো একটি ঘটনা ঘটছে দেখতে
পাচ্ছি। মনীষীদের মতে, ইতিহাস নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। প্রথমে ঘটায়
ট্রাজেডিতে। তারপর ঘটায় ফার্স বা প্রহসনে। বাংলাদেশের ইংরেজি সাংবাদিকতার
ক্ষেত্রেও এই মনীষী বাক্যের সত্যতা এখন প্রমাণিত হতে দেখতে পাচ্ছি।
সম্প্রতি ঢাকার একটি ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক ঘন ঘন তার পত্রিকায় নিজ নামে
প্রতিবেদন লিখতে শুরু করেছেন। সবই নিরপেক্ষতা ও ইংরেজি ভাষার শালীনতার
আড়ালে হাসিনা ও তার সরকারের ক্রুড সমালোচনা। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটিতে
আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান বন্ধ রাখার জন্য একটি কপট আবেদন
জানানো হয়েছে শেখ হাসিনার কাছে। এর আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরে আলোচনায়
আসছি। আগে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির কথায় আসি। আজ থেকে ৪৩ বছর আগের কথা।
পাকিস্তান আমলের ঘটনা। ১৯৭০ সালে সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন। অত্যন্ত
সংকট-সন্ধির নির্বাচন। এ নির্বাচনেই পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।
পাকিস্তান তার গণতান্ত্রিক অস্তিত্ব ফিরে পেয়ে তার অখণ্ডতা রক্ষা করতে
পারবে, না সামরিক শাসনের থাবার নিচে ধ্বংস হয়ে যাবে। তা নির্ধারিত হবে এ
নির্বাচনে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধু তার আওয়ামী লীগ নিয়ে বাঙালির
ম্যাগনাকাটা ছয় দফা দাবি নিয়ে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং পশ্চিম
পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো তার পিপলস পার্টি নিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে
নেমেছেন।
নির্বাচনী প্রচারযুদ্ধ শুরু হতেই যখন বোঝা গেল, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন অনিবার্য, তখন এই নির্বাচন স্থগিত করা, বিলম্বিত করা অথবা বাতিল করার জন্য সামরিক শাসকচক্র এবং দেশটির কায়েমি স্বার্থ উঠেপড়ে লাগে। পূর্ব পাকিস্তানেও সাম্প্রদায়িক দলগুলো এবং কিছু কট্টর আওয়ামীবিরোধী নেতা ও মিডিয়া এই চক্রান্তে হাত মেলায়। হামিদুল হক চৌধুরী ও তার অবজারভার গ্র“পের পত্রিকাগুলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির সমর্থক হলেও আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের চরম বিদ্বেষী হওয়ায় এ নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে তখন বহুল পঠিত ইংরেজি দৈনিক ছিল পাকিস্তান অবজারভার (বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাম হয়েছিল বাংলাদেশ অবজারভার)। আবদুস সালাম ছিলেন সম্পাদক, তখনকার বিখ্যাত ত্রয়ী সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন। স্বাধীনচেতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। কিন্তু পত্রিকার মালিক হামিদুল হক চৌধুরীর চাপে তাকে তার মতামত প্রকাশের ব্যাপারে অনেক সীমাবদ্ধতা মেনে চলতে হতো।
’৭০ সালের নির্বাচনের ব্যাপারেও অবজারভারের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। এ সময় যেন সামরিক জান্তার মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্যই নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক আগে ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসের গোড়ায় এক ভয়াবহ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোন হল পূর্ব পাকিস্তানে। এক রাতে ১০ লাখ নরনারী মারা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এর সুযোগ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক জান্তার সমর্থক মহল, এমনকি কিছু অনুগ্রহভোগী বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট দাবি তোলেন, বিপন্ন মানবতার উদ্ধারকার্য ও ত্রাণকার্যের স্বার্থে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেয়া হোক। ঢাকার রাস্তায় স্লোগান উঠল, আগে বিপন্ন মানবতার ত্রাণ, তারপর নির্বাচন। এ সময় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) খণ্ডিত অংশটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক দল। মওলানা ভাসানী ধ্বনি তুললেন, ভোটের আগে ভাত চাই। তা নইলে নির্বাচন বর্জন। সঙ্গে সঙ্গে প্রচার শুরু হল, ন্যাপের (ভাসানী) মতো দেশের একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না এলে এই নির্বাচন ‘সকলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না।’ সুতরাং নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য পেছাতেই হবে।
এ প্রচারণার জবাবে বঙ্গবন্ধু এবং তার আওয়ামী লীগের বক্তব্য ছিল, পাকিস্তানের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, আর একদিনও সামরিক শাসন বহাল রাখতে দেয়া যায় না। যথাসময়ে নির্বাচন করতে হবে। একমাত্র জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকারই বিপন্ন মানবতা ও দুর্গত ত্রাণে দ্রুত দায়িত্ব পালনে সক্ষম। সুতরাং নির্বাচন পেছালে চলবে না। শুধু ভয়ানকভাবে বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোতে নির্বাচন স্থগিত রেখে পরবর্তী কাছাকাছি একটা সময়ে তা সম্পন্ন করে ফেলা যাবে।
ঢাকার ইংরেজি দৈনিক ‘অবজারভার’ পত্রিকাটি তখন নির্বাচন স্থগিত রাখার প্রশ্নে ক্যাম্পেইন শুরু করে। যেমন- বর্তমানে শুরু করেছে হালের একটি ইংরেজি দৈনিক। অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম তখন স্বনামে একাধিক উপ-সম্পাদকীয় লেখেন। একটি লেখায় তিনি শেখ মুজিবকে রাজা ক্যানিউটের সঙ্গে তুলনা করে লেখেন, “শেখ মুজিব কি রাজা ক্যানিউটের মতো ভাবেন, তার হুকুমে ঝড় বন্যা সমুদ্রের ঢেউ স্থগিত হয়ে থাকবে? বাংলাদেশে এই শীতের মৌসুমে একটা বড় গর্কি (সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস) হয়ে গেছে। আরেকটি শিগগিরই হওয়া সম্পর্কে আবহাওয়া বিশারদরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। তা সত্ত্বেও শেখ মুজিব যথাসময়ে নির্বাচন চান। তা পেছাতে চান না। তিনি কি ভাবছেন, তার নির্দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগও মান্য করে চলবে?”
তখনকার একাধিক শক্তিশালী মিডিয়া এবং তৎকালীন এলিট শ্রেণী বা সুশীল সমাজের একটি অংশের এই জোর বিরোধিতা সত্ত্বেও সামরিক শাসকরা নির্বাচন মুলতবি ঘোষণা করতে সাহসী হননি। মাত্র কয়েক দিন পিছিয়ে ডিসেম্বর মাসেই (১৯৭০) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কয়েকটি দুর্গত এলাকায় কিছু পরে স্থগিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সময় একদিন একটি সরকারি প্রেস ব্রিফিং-মিটিংয়ে গেছি। মানিক মিয়া তখন নেই। আমি ইত্তেফাকে কর্মরত। তখনকার অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালামও এসেছেন সেই ব্রিফিং-মিটিংয়ে। ‘পাসবান’ নামে একটি উর্দু দৈনিক তখন ঢাকায় ছিল। এই পত্রিকার বিহারি সম্পাদক ছিলেন অত্যন্ত ভালো মানুষ। তিনি নির্বাচন বন্ধ বা স্থগিত রাখার ক্যাম্পেইনের সমর্থন করেননি। তখন জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছিল যে, মওলানা ভাসানীর ন্যাপের মতো দেশের একটি বৃহৎ দল যখন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, তখন এই নির্বাচন জনগণের সার্বিক ম্যান্ডেট হিসেবে বৈধতা পাবে না। ‘পাসবান’ কাগজটি এই প্রচারণার জবাবে লিখেছিল, ‘নির্বাচনের দরজা কোনো দলের জন্য বন্ধ রাখা হয়নি। ভাসানী ন্যাপ যদি স্বেচ্ছায় এই নির্বাচনে না আসে, তাহলে দেশের ভাগ্য নির্ধারণকারী একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন শুধুমাত্র একটি দলের খেয়ালখুশিকে প্রশ্রয়দানের জন্য বন্ধ রেখে দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তোলা কি উচিত হবে?’ আমার ধারণা ‘পাসবান’ কাগজটি আজ বেঁচে থাকলে ২০১৩ সালেও বিএনপি ও সুশীল সমাজের নির্বাচন বন্ধ রাখার দাবি সম্পর্কে একই কথা লিখত।
যা হোক সরকারি ব্রিফিং-মিটিংয়ের কথায় ফিরে আসি। এই মিটিংয়ে পাসবান সম্পাদক হঠাৎ অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালামকে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘সালাম ভাইয়া, মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী এবং আপনাকে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানের জাগ্রত বিবেক। মানিক মিয়া আজ নেই। তিনি আজ বেঁচে থাকলে সামরিক জান্তাকে খুশি করার জন্য বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক নির্বাচন বন্ধ করার ক্যাম্পেইনে সমর্থন দিতেন না। আপনি তো বেঁচে আছেন। আপনি কেন এ ক্যাম্পেইনে সমর্থন দিতে গেলেন?’ দীর্ঘকাল আগের কথা। তবু এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে, সালাম সাহেব বিমর্ষ হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘আপনিও তো একজন এডিটর। কিন্তু স্বাধীন এডিটর। নিজেই কাগজের মালিক। মানিক মিয়াও ছিলেন তাই। ইত্তেফাকের মালিক। আপনারা নিজেদের স্বাধীন মত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করতে পেরেছেন এবং এখনও পারেন। কিন্তু আমি তো ক্যাপটিভ এডিটর। আমার মাথার উপরে সব সময় সূক্ষ্ম দড়িতে বাঁধা একটি তলোয়ার ঝোলে। আমি কি ইচ্ছা করলেই সব সময় স্বাধীনভাবে নিজের মত ব্যক্ত করতে পারি?’
দীর্ঘ ৪৩ বছর পর প্রয়াত অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালামের মুখে উচ্চারিত এই ক্যাপটিভ এডিটর কথাটি আমার মনে পড়েছে ঢাকায় অধুনা বহুল পঠিত একটি ইংরেজি কাগজের সম্পাদকের শেখ হাসিনার কাছে নির্বাচন বন্ধ রাখার অনুরোধ(?) জানানো প্রতিবেদনটি পাঠ করে। কারণ তিনিও কাগজটির মালিক নন। আংশিক মালিকানা থাকতে পারে, কিন্তু বেতনভোগী সম্পাদক। দেশ-কাল পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। এ ধরনের সম্পাদকদের মাথার ওপর এখন আর শুধু মালিকের বিধিনিষেধের সূক্ষ্ম তরবারি ঝোলে না, আরও অনেক স্বার্থ সুবিধার তরবারি ঝোলে। এগুলো হল বিগ এনজিও, বিগ বিজনেস, মৌলবাদী অর্থভাণ্ডার ও বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের অঢেল অর্থ ও অনুগ্রহ। এগুলোর কাছে আজ বিবেক, আত্মা ও সততা বন্ধক রাখার একটা হিড়িক পড়েছে বাংলাদেশে। কেবল একজন কি দুজন ক্যাপটিভ এডিটরকে দোষ দিয়ে লাভ কি? একটি ক্যাপটিভ সিভিল সোসাইটিও গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে।
এ লেখার শুরুতে আমাদের ইংরেজি সাংবাদিকতায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে প্রথমে ট্রাজেডি এবং পরে ফার্স বা প্রহসন ঘটার কথা উল্লেখ করেছি। ১৯৭০ সালে নির্বাচন বন্ধ রাখার ক্যাম্পেইন সফল না হলেও নির্বাচনটি ট্রাজিক পরিণতি ডেকে এনেছিল। অর্থাৎ ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা নির্বাচনের রায় মেনে না নিয়ে বাংলাদেশে বর্বর গণহত্যা চালিয়েছিল। অন্যদিকে ২০১৩ সালে নির্বাচন বন্ধ বা পিছিয়ে দেয়ার ক্যাম্পেইনটিও সফল হবে মনে হয় না। প্রহসনে পরিণত হবে মনে হয়। তবে এই প্রহসনেও দেশের মানুষের রক্ত ঝরছে। সেদিকে ক্যাপটিভ এডিটর বা ক্যাপটিভ সুশীল সমাজের নজর নেই।
বিস্ময়ের কথা, নির্বাচন বন্ধ রাখার দাবিতে ৪৩ বছর আগে ঢাকার তখনকার ইংরেজি দৈনিকটি যেসব কথা লিখেছিল, ৪৩ বছর পর আজ তারই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে আরেকটি ইংরেজি দৈনিকের কণ্ঠে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনটি ছিল বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য একটি ভাগ্য নির্ধারণকারী নির্বাচন। প্রশ্ন ছিল বাংলা মুক্ত স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ হবে, না ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী পাকিস্তানের জঙ্গিশাহীর পদানত দেশ হয়ে থাকবে? তেমনি বর্তমানের (২০১৩-১৪) নির্বাচনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এই যে, এই নির্বাচন দ্বারাই অথবা তা অনুষ্ঠিত হওয়া বা না হওয়ার মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন মুক্ত ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে টিকে থাকবে, না ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের পতাকাবাহী রাজনৈতিক জোটের আধা তালেবানি শাসনের অধীনে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো স্থায়ী কিলিং ফিল্ডে পরিণত হবে? এই শেষোক্ত পরিণতির একমাত্র প্রতিষেধক ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। কোনো অজুহাতেই এ নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা উচিত হবে না।
১৯৭০ সালে নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখার পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছিল, নির্বাচন করতে গেলে দুর্গতদের ত্রাণকার্য ব্যাহত হবে এবং ভাসানী ন্যাপের সম্ভাব্য নির্বাচন বর্জনের আন্দোলনের ফলে রক্তপাত হবে, নির্বাচন কেন্দ্র আক্রান্ত হবে এবং দেশে বিপর্যয় দেখা দেবে। ২০১৩ সালের ইংরেজি দৈনিকটির কণ্ঠেও একই যুক্তি। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নেই। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ফলে দেশে রক্তপাত ঘটবে। নির্বাচন বৈধতা পাবে না। দেশের সর্বনাশ হবে।
কিন্তু ক্যাপটিভ এডিটর মহোদয় এ কথা বুঝতে চাইছেন না যে, দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই ভয়াবহ রক্তপাত হচ্ছে। তা ঘটাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরই এবং কিছু তুচ্ছ দাবি তুলে বিএনপি স্বেচ্ছায় এ নির্বাচনে আসছে না। এ ব্যাপারটি ক্যাপটিভ সুশীল সমাজেরও দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি তথাকথিত সুজন, ট্রান্সপারেন্সির উদ্যোগে যেসব সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে রেহমান সোবহান, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রমুখ সুশীল সমাজের মাথাওয়ালা ব্যক্তিরাও হাজির হয়েছিলেন। নির্বাচন পেছানোর জন্য তারা যে যুক্তি দেখিয়েছেন তার সঙ্গে ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদনের যুক্তির বিস্ময়কর মিল। বুঝতে অসুবিধা হয় না এসব যুক্তিতর্কের উৎস এবং উৎসাহদাতা অভিন্ন। এ বিতর্ক সভায় রাশেদ খান মেনন একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবির জবাবে বলেছেন, ‘নির্বাচন না হয় পিছিয়ে দেয়া গেল, কিন্তু পিছিয়ে দেয়ার পরও বিএনপি নির্বাচনে আসবে তার নিশ্চয়তা কি কেউ (সুশীল সমাজ) দিতে পারেন?’ মেননের এ প্রশ্নের জবাব ইংরেজি পত্রিকাটির সম্পাদকের কাছে নেই। তিনিও আজকাল বিভিন্ন টকশোতে জোরেশোরে অংশ নিচ্ছেন।
যেখানে এই ইংরেজি কাগজের সম্পাদক ও সুশীল সমাজের উচিত ছিল, নির্বাচন বন্ধ করার দাবি জানানোর আগে বিএনপির কাছে আন্দোলনের নামে এই বিভৎস হত্যাকাণ্ড, অগ্নিকাণ্ড, গুপ্তহত্যা বন্ধ করার জন্য এবং যুদ্ধাপরাধী সন্ত্রাসী দল জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে আসার জন্য দাবি জানানো এবং তারপর প্রয়োজন হলে সরকারকে নির্বাচন স্থগিত রাখার পরামর্শ দেয়ার, সেখানে তারা সরকারকে সব অপরাধে অপরাধী করে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণের জন্য দাবি জানাচ্ছেন! এরা কি সত্যিই একটি দেশের দেশপ্রেমিক সুশীল সমাজ?
এদের তো জানা উচিত ছিল আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একটি স্বাভাবিক সময়ের স্বাভাবিক নির্বাচন নয়। এটা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নির্বাচন নয়। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্বাধীনতাবিরোধী শিবির ও সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে মুক্ত রাখার নির্বাচন। এ নির্বাচনের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু দেশের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকাঠামো রক্ষা করার জন্য বর্তমান সরকারের সামনে এর কোনো বিকল্প পথও নেই। অবশ্যই এ নির্বাচনের রায় দ্বারা হাসিনা সরকার আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশ শাসন করতে চাইবে না। দেশ এই ক্রাইসিস পিরিয়ড মুক্ত হলে, মৌলবাদী সন্ত্রাস দমন হলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র বিপদমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে অবশ্যই অতি দ্রুত (ছয় মাস কিংবা এক বছরের মধ্যে) আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ততদিন আল্লাহর ওয়াস্তে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই ক্যাপটিভ এডিটর ও ক্যাপটিভ সুশীল সমাজ তাদের মায়াকান্না বন্ধ করুন। নইলে ইতিহাসের কাছে তারা দেশের আপতকালের ‘চরম অমিত্র’ বলে গণ্য হতে পারেন এবং সেদিনটি খুব দূরে নয়।
নির্বাচনী প্রচারযুদ্ধ শুরু হতেই যখন বোঝা গেল, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন অনিবার্য, তখন এই নির্বাচন স্থগিত করা, বিলম্বিত করা অথবা বাতিল করার জন্য সামরিক শাসকচক্র এবং দেশটির কায়েমি স্বার্থ উঠেপড়ে লাগে। পূর্ব পাকিস্তানেও সাম্প্রদায়িক দলগুলো এবং কিছু কট্টর আওয়ামীবিরোধী নেতা ও মিডিয়া এই চক্রান্তে হাত মেলায়। হামিদুল হক চৌধুরী ও তার অবজারভার গ্র“পের পত্রিকাগুলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির সমর্থক হলেও আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের চরম বিদ্বেষী হওয়ায় এ নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে তখন বহুল পঠিত ইংরেজি দৈনিক ছিল পাকিস্তান অবজারভার (বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাম হয়েছিল বাংলাদেশ অবজারভার)। আবদুস সালাম ছিলেন সম্পাদক, তখনকার বিখ্যাত ত্রয়ী সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন। স্বাধীনচেতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। কিন্তু পত্রিকার মালিক হামিদুল হক চৌধুরীর চাপে তাকে তার মতামত প্রকাশের ব্যাপারে অনেক সীমাবদ্ধতা মেনে চলতে হতো।
’৭০ সালের নির্বাচনের ব্যাপারেও অবজারভারের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। এ সময় যেন সামরিক জান্তার মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্যই নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক আগে ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসের গোড়ায় এক ভয়াবহ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোন হল পূর্ব পাকিস্তানে। এক রাতে ১০ লাখ নরনারী মারা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এর সুযোগ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক জান্তার সমর্থক মহল, এমনকি কিছু অনুগ্রহভোগী বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট দাবি তোলেন, বিপন্ন মানবতার উদ্ধারকার্য ও ত্রাণকার্যের স্বার্থে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেয়া হোক। ঢাকার রাস্তায় স্লোগান উঠল, আগে বিপন্ন মানবতার ত্রাণ, তারপর নির্বাচন। এ সময় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) খণ্ডিত অংশটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক দল। মওলানা ভাসানী ধ্বনি তুললেন, ভোটের আগে ভাত চাই। তা নইলে নির্বাচন বর্জন। সঙ্গে সঙ্গে প্রচার শুরু হল, ন্যাপের (ভাসানী) মতো দেশের একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না এলে এই নির্বাচন ‘সকলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না।’ সুতরাং নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য পেছাতেই হবে।
এ প্রচারণার জবাবে বঙ্গবন্ধু এবং তার আওয়ামী লীগের বক্তব্য ছিল, পাকিস্তানের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, আর একদিনও সামরিক শাসন বহাল রাখতে দেয়া যায় না। যথাসময়ে নির্বাচন করতে হবে। একমাত্র জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকারই বিপন্ন মানবতা ও দুর্গত ত্রাণে দ্রুত দায়িত্ব পালনে সক্ষম। সুতরাং নির্বাচন পেছালে চলবে না। শুধু ভয়ানকভাবে বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোতে নির্বাচন স্থগিত রেখে পরবর্তী কাছাকাছি একটা সময়ে তা সম্পন্ন করে ফেলা যাবে।
ঢাকার ইংরেজি দৈনিক ‘অবজারভার’ পত্রিকাটি তখন নির্বাচন স্থগিত রাখার প্রশ্নে ক্যাম্পেইন শুরু করে। যেমন- বর্তমানে শুরু করেছে হালের একটি ইংরেজি দৈনিক। অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম তখন স্বনামে একাধিক উপ-সম্পাদকীয় লেখেন। একটি লেখায় তিনি শেখ মুজিবকে রাজা ক্যানিউটের সঙ্গে তুলনা করে লেখেন, “শেখ মুজিব কি রাজা ক্যানিউটের মতো ভাবেন, তার হুকুমে ঝড় বন্যা সমুদ্রের ঢেউ স্থগিত হয়ে থাকবে? বাংলাদেশে এই শীতের মৌসুমে একটা বড় গর্কি (সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস) হয়ে গেছে। আরেকটি শিগগিরই হওয়া সম্পর্কে আবহাওয়া বিশারদরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। তা সত্ত্বেও শেখ মুজিব যথাসময়ে নির্বাচন চান। তা পেছাতে চান না। তিনি কি ভাবছেন, তার নির্দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগও মান্য করে চলবে?”
তখনকার একাধিক শক্তিশালী মিডিয়া এবং তৎকালীন এলিট শ্রেণী বা সুশীল সমাজের একটি অংশের এই জোর বিরোধিতা সত্ত্বেও সামরিক শাসকরা নির্বাচন মুলতবি ঘোষণা করতে সাহসী হননি। মাত্র কয়েক দিন পিছিয়ে ডিসেম্বর মাসেই (১৯৭০) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কয়েকটি দুর্গত এলাকায় কিছু পরে স্থগিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সময় একদিন একটি সরকারি প্রেস ব্রিফিং-মিটিংয়ে গেছি। মানিক মিয়া তখন নেই। আমি ইত্তেফাকে কর্মরত। তখনকার অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালামও এসেছেন সেই ব্রিফিং-মিটিংয়ে। ‘পাসবান’ নামে একটি উর্দু দৈনিক তখন ঢাকায় ছিল। এই পত্রিকার বিহারি সম্পাদক ছিলেন অত্যন্ত ভালো মানুষ। তিনি নির্বাচন বন্ধ বা স্থগিত রাখার ক্যাম্পেইনের সমর্থন করেননি। তখন জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছিল যে, মওলানা ভাসানীর ন্যাপের মতো দেশের একটি বৃহৎ দল যখন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, তখন এই নির্বাচন জনগণের সার্বিক ম্যান্ডেট হিসেবে বৈধতা পাবে না। ‘পাসবান’ কাগজটি এই প্রচারণার জবাবে লিখেছিল, ‘নির্বাচনের দরজা কোনো দলের জন্য বন্ধ রাখা হয়নি। ভাসানী ন্যাপ যদি স্বেচ্ছায় এই নির্বাচনে না আসে, তাহলে দেশের ভাগ্য নির্ধারণকারী একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন শুধুমাত্র একটি দলের খেয়ালখুশিকে প্রশ্রয়দানের জন্য বন্ধ রেখে দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তোলা কি উচিত হবে?’ আমার ধারণা ‘পাসবান’ কাগজটি আজ বেঁচে থাকলে ২০১৩ সালেও বিএনপি ও সুশীল সমাজের নির্বাচন বন্ধ রাখার দাবি সম্পর্কে একই কথা লিখত।
যা হোক সরকারি ব্রিফিং-মিটিংয়ের কথায় ফিরে আসি। এই মিটিংয়ে পাসবান সম্পাদক হঠাৎ অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালামকে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘সালাম ভাইয়া, মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী এবং আপনাকে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানের জাগ্রত বিবেক। মানিক মিয়া আজ নেই। তিনি আজ বেঁচে থাকলে সামরিক জান্তাকে খুশি করার জন্য বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক নির্বাচন বন্ধ করার ক্যাম্পেইনে সমর্থন দিতেন না। আপনি তো বেঁচে আছেন। আপনি কেন এ ক্যাম্পেইনে সমর্থন দিতে গেলেন?’ দীর্ঘকাল আগের কথা। তবু এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে, সালাম সাহেব বিমর্ষ হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘আপনিও তো একজন এডিটর। কিন্তু স্বাধীন এডিটর। নিজেই কাগজের মালিক। মানিক মিয়াও ছিলেন তাই। ইত্তেফাকের মালিক। আপনারা নিজেদের স্বাধীন মত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করতে পেরেছেন এবং এখনও পারেন। কিন্তু আমি তো ক্যাপটিভ এডিটর। আমার মাথার উপরে সব সময় সূক্ষ্ম দড়িতে বাঁধা একটি তলোয়ার ঝোলে। আমি কি ইচ্ছা করলেই সব সময় স্বাধীনভাবে নিজের মত ব্যক্ত করতে পারি?’
দীর্ঘ ৪৩ বছর পর প্রয়াত অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালামের মুখে উচ্চারিত এই ক্যাপটিভ এডিটর কথাটি আমার মনে পড়েছে ঢাকায় অধুনা বহুল পঠিত একটি ইংরেজি কাগজের সম্পাদকের শেখ হাসিনার কাছে নির্বাচন বন্ধ রাখার অনুরোধ(?) জানানো প্রতিবেদনটি পাঠ করে। কারণ তিনিও কাগজটির মালিক নন। আংশিক মালিকানা থাকতে পারে, কিন্তু বেতনভোগী সম্পাদক। দেশ-কাল পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। এ ধরনের সম্পাদকদের মাথার ওপর এখন আর শুধু মালিকের বিধিনিষেধের সূক্ষ্ম তরবারি ঝোলে না, আরও অনেক স্বার্থ সুবিধার তরবারি ঝোলে। এগুলো হল বিগ এনজিও, বিগ বিজনেস, মৌলবাদী অর্থভাণ্ডার ও বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের অঢেল অর্থ ও অনুগ্রহ। এগুলোর কাছে আজ বিবেক, আত্মা ও সততা বন্ধক রাখার একটা হিড়িক পড়েছে বাংলাদেশে। কেবল একজন কি দুজন ক্যাপটিভ এডিটরকে দোষ দিয়ে লাভ কি? একটি ক্যাপটিভ সিভিল সোসাইটিও গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে।
এ লেখার শুরুতে আমাদের ইংরেজি সাংবাদিকতায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে প্রথমে ট্রাজেডি এবং পরে ফার্স বা প্রহসন ঘটার কথা উল্লেখ করেছি। ১৯৭০ সালে নির্বাচন বন্ধ রাখার ক্যাম্পেইন সফল না হলেও নির্বাচনটি ট্রাজিক পরিণতি ডেকে এনেছিল। অর্থাৎ ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা নির্বাচনের রায় মেনে না নিয়ে বাংলাদেশে বর্বর গণহত্যা চালিয়েছিল। অন্যদিকে ২০১৩ সালে নির্বাচন বন্ধ বা পিছিয়ে দেয়ার ক্যাম্পেইনটিও সফল হবে মনে হয় না। প্রহসনে পরিণত হবে মনে হয়। তবে এই প্রহসনেও দেশের মানুষের রক্ত ঝরছে। সেদিকে ক্যাপটিভ এডিটর বা ক্যাপটিভ সুশীল সমাজের নজর নেই।
বিস্ময়ের কথা, নির্বাচন বন্ধ রাখার দাবিতে ৪৩ বছর আগে ঢাকার তখনকার ইংরেজি দৈনিকটি যেসব কথা লিখেছিল, ৪৩ বছর পর আজ তারই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে আরেকটি ইংরেজি দৈনিকের কণ্ঠে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনটি ছিল বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য একটি ভাগ্য নির্ধারণকারী নির্বাচন। প্রশ্ন ছিল বাংলা মুক্ত স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ হবে, না ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী পাকিস্তানের জঙ্গিশাহীর পদানত দেশ হয়ে থাকবে? তেমনি বর্তমানের (২০১৩-১৪) নির্বাচনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এই যে, এই নির্বাচন দ্বারাই অথবা তা অনুষ্ঠিত হওয়া বা না হওয়ার মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন মুক্ত ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে টিকে থাকবে, না ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের পতাকাবাহী রাজনৈতিক জোটের আধা তালেবানি শাসনের অধীনে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো স্থায়ী কিলিং ফিল্ডে পরিণত হবে? এই শেষোক্ত পরিণতির একমাত্র প্রতিষেধক ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। কোনো অজুহাতেই এ নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা উচিত হবে না।
১৯৭০ সালে নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখার পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছিল, নির্বাচন করতে গেলে দুর্গতদের ত্রাণকার্য ব্যাহত হবে এবং ভাসানী ন্যাপের সম্ভাব্য নির্বাচন বর্জনের আন্দোলনের ফলে রক্তপাত হবে, নির্বাচন কেন্দ্র আক্রান্ত হবে এবং দেশে বিপর্যয় দেখা দেবে। ২০১৩ সালের ইংরেজি দৈনিকটির কণ্ঠেও একই যুক্তি। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নেই। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ফলে দেশে রক্তপাত ঘটবে। নির্বাচন বৈধতা পাবে না। দেশের সর্বনাশ হবে।
কিন্তু ক্যাপটিভ এডিটর মহোদয় এ কথা বুঝতে চাইছেন না যে, দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই ভয়াবহ রক্তপাত হচ্ছে। তা ঘটাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরই এবং কিছু তুচ্ছ দাবি তুলে বিএনপি স্বেচ্ছায় এ নির্বাচনে আসছে না। এ ব্যাপারটি ক্যাপটিভ সুশীল সমাজেরও দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি তথাকথিত সুজন, ট্রান্সপারেন্সির উদ্যোগে যেসব সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে রেহমান সোবহান, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রমুখ সুশীল সমাজের মাথাওয়ালা ব্যক্তিরাও হাজির হয়েছিলেন। নির্বাচন পেছানোর জন্য তারা যে যুক্তি দেখিয়েছেন তার সঙ্গে ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদনের যুক্তির বিস্ময়কর মিল। বুঝতে অসুবিধা হয় না এসব যুক্তিতর্কের উৎস এবং উৎসাহদাতা অভিন্ন। এ বিতর্ক সভায় রাশেদ খান মেনন একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবির জবাবে বলেছেন, ‘নির্বাচন না হয় পিছিয়ে দেয়া গেল, কিন্তু পিছিয়ে দেয়ার পরও বিএনপি নির্বাচনে আসবে তার নিশ্চয়তা কি কেউ (সুশীল সমাজ) দিতে পারেন?’ মেননের এ প্রশ্নের জবাব ইংরেজি পত্রিকাটির সম্পাদকের কাছে নেই। তিনিও আজকাল বিভিন্ন টকশোতে জোরেশোরে অংশ নিচ্ছেন।
যেখানে এই ইংরেজি কাগজের সম্পাদক ও সুশীল সমাজের উচিত ছিল, নির্বাচন বন্ধ করার দাবি জানানোর আগে বিএনপির কাছে আন্দোলনের নামে এই বিভৎস হত্যাকাণ্ড, অগ্নিকাণ্ড, গুপ্তহত্যা বন্ধ করার জন্য এবং যুদ্ধাপরাধী সন্ত্রাসী দল জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে আসার জন্য দাবি জানানো এবং তারপর প্রয়োজন হলে সরকারকে নির্বাচন স্থগিত রাখার পরামর্শ দেয়ার, সেখানে তারা সরকারকে সব অপরাধে অপরাধী করে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণের জন্য দাবি জানাচ্ছেন! এরা কি সত্যিই একটি দেশের দেশপ্রেমিক সুশীল সমাজ?
এদের তো জানা উচিত ছিল আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একটি স্বাভাবিক সময়ের স্বাভাবিক নির্বাচন নয়। এটা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নির্বাচন নয়। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্বাধীনতাবিরোধী শিবির ও সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে মুক্ত রাখার নির্বাচন। এ নির্বাচনের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু দেশের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকাঠামো রক্ষা করার জন্য বর্তমান সরকারের সামনে এর কোনো বিকল্প পথও নেই। অবশ্যই এ নির্বাচনের রায় দ্বারা হাসিনা সরকার আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশ শাসন করতে চাইবে না। দেশ এই ক্রাইসিস পিরিয়ড মুক্ত হলে, মৌলবাদী সন্ত্রাস দমন হলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র বিপদমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে অবশ্যই অতি দ্রুত (ছয় মাস কিংবা এক বছরের মধ্যে) আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ততদিন আল্লাহর ওয়াস্তে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই ক্যাপটিভ এডিটর ও ক্যাপটিভ সুশীল সমাজ তাদের মায়াকান্না বন্ধ করুন। নইলে ইতিহাসের কাছে তারা দেশের আপতকালের ‘চরম অমিত্র’ বলে গণ্য হতে পারেন এবং সেদিনটি খুব দূরে নয়।
No comments