এরা যদি অবরোধকারী, পিকেটার, রাজনৈতিক নেতাকর্মী হয়ে থাকে, তাহলে সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতকারী কারা? by মহিউদ্দিন আহমদ

কিছু দিন ধরে খবর শুনতে দেখতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো খুললে বা পত্রিকাগুলো হাতে নিলে আমার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করে। দুনিয়ার এতগুলো দেশে চাকরি করলাম, এতগুলো দেশে সরকারি বা ব্যক্তিগত সফরে গেলাম, কিন্তু কোথাও এসব দেশের টিভি চ্যানেলে বা পত্র-পত্রিকা, রেডিওর খবরে বোমা হামলাকারীদের সম্মানজনকভাবে বর্ণনা বা উল্লেখ করতে দেখিনি। এ কলামটি যখন লিখছি আজ (শুক্রবার) সকালে তখন ব্যাংকক, কায়রো, ইস্তাম্বুল, আংকারা, দক্ষিণ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, ইউক্রেনে এই-সেই কারণে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, বোমা হামলা, মারামারি-কাটাকাটির খবর দেখছি বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা টিভি চ্যানেলগুলোতে। কিন্তু কোনো বিদেশী চ্যানেলেই তো দেশের প্রযোজ্য আইন-কানুন লংঘনকারীদের এমন মর্যাদা সম্মান দিয়ে বর্ণনা করা হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতিটি নিউজ বুলেটিনে এমনটি করা হচ্ছে সৎ সাংবাদিকতার আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন-বিধিবিধান লংঘন করে।
গত ২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার চ্যানেল আই-এর দুটার খবর দেখছিলাম। প্রথম ৫ মিনিটে ১০ বারের মতো ‘অবরোধকারী’ শব্দটি ব্যবহার করা হল দেশের বিভিন্ন জায়গার অবরোধের খবর দিতে গিয়ে। তারা বোমা হামলা চালিয়েছে, মানুষ মেরেছে, ককটেল ফুটিয়েছে, গাছ কেটেছে, রাস্তা কেটেছে, রেললাইন উপড়ে তুলেছে, গাড়িতে আগুন দিয়েছে, তারপরও তারা সন্ত্রাসী নয়, পিকেটার নয়, দুর্বৃত্ত নয়, দুষ্কৃতকারী নয়; তারা অবরোধকারী, পিকেটার, শিবির বা বিএনপির নেতাকর্মী!! ২৫ তারিখ বুধবার সকাল ৬টায় এটিএন নিউজে খবর দেখছিলাম। আগের দিন রাতে পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে বাংলামোটরের পুলিশের রিকুইজিশন করা বাসে আগুন দিয়ে। তখন দেখলাম ‘দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে’ শব্দগুলো ব্যবহার হতে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর আবার ‘অবরোধকারী’ শব্দে ফিরে গেল এটিএন নিউজ। আজ (শুক্রবার) ভোর ৬টায় এটিএন নিউজের প্রতি ঘণ্টার খবরের সঙ্গে ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ’-এর ওপর আগামী দুই দিন বিশেষ খবর দেখানো হবে বলা হয়েছে। কিন্তু একই খবরে রাজশাহীর পুলিশ সদস্য সিদ্ধার্থ রায়ের হত্যা ১৮ দলীয় সমর্থকদের বোমা হামলায় ঘটেছে, বলা হয়েছে। এর বিপরীতে শুক্রবার সকাল ৭টায় চ্যানেল ’৭১-এর খবরে সিদ্ধার্থ রায়ের হত্যাকারীদের কয়েকবারই ‘দুর্বৃত্ত’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এক চ্যানেলের খবরে যারা ‘দুর্বৃত্ত’ অন্য চ্যানেলের খবরে তারা ‘সমর্থক’ কেন? এটিএন-এর বুলেটিনে যারা বোমা মেরেছে, ককটেল ফুটিয়েছে, তারা কি সন্ত্রাসী নয়? তাহলে তাদের আবার ‘অবরোধকারী’, ১৮ দলীয় সমর্থক হিসেবে বর্ণনা করা হল কেন? অবরোধকারী তাদেরই বলা যাবে, যারা আইন মেনে শান্তিপূর্ণভাবে অবরোধ করবে। প্রতিবাদ করতে, রাস্তায় শুয়ে পড়তে এবং নিজ ইচ্ছায় দলে দলে গ্রেফতার হতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে এবং পরেও অনেক দেখেছি।
সেই ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের কয়েকটি ছবি ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়েছে। এমন একটি ছিল মওলানা ভাসানী রাস্তায় হাত তুলে নামাজের নিয়ত করছেন, আর একটিতে দেখি প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় পাকিস্তানের এক এয়ারফোর্স চিফ এয়ার মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) আসগর খানের ওপর পুলিশের গাড়ি থেকে পানি ছিটানো হচ্ছে। একটি উদোম গায়ের সাত-আট বছরের এক শিশুকে আর একটি ছবিতে কচি হাত তুলে চিৎকার করে স্লোগান দিতে দেখি একটি মিছিলের আগে আগে। যতটুকু মনে পড়ছে ছবিটি তুলেছিলেন রশিদ তালুকদার। মনে রাখা জরুরি এবং ‘ফরজ’ যে, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানটি ছিল একজন সামরিক শাসক আইউব খানের বিরুদ্ধে, জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন নিয়ে বিজয়ী কোনো নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে নয়।
দুই.
দৈনিক ‘প্রথম আলো’ এবং ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’কে দেশের প্রথম শ্রেণীর, প্রভাবশালী পত্রিকা হিসেবে বর্ণনা করতে গিয়ে আমি গত দুই-তিন বছরে কত জায়গায় যে সমালোচিত এবং নিন্দিত হয়েছি, তার বর্ণনা দিতে হলে আমাকে আলাদা একটি কলাম লিখতে হবে। কিন্তু তাই বলে আমি দমিনি। পত্রিকা দুটি বিভিন্ন সময়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে আমি তার তারিফ করি। কাদের সিদ্দিকীর (‘ব্রিজোত্তম’, এই উপাধিটি মুনতাসীর মামুনের) ওপর কয়েক বছর আগে প্রথম আলো যে বিশেষ সংখ্যাটি প্রকাশ করেছে তা এখনও আমি সংরক্ষণ করে চলেছি। বসুন্ধরা গ্র“পের পত্রিকা ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ এই ‘ব্রিজোত্তম’ একজন মর্যাদাবান কলাম লেখক। কিন্তু এই ‘ব্রিজোত্তম’ টাঙ্গাইল-ময়মনসিংয়ের এতগুলো কন্ট্রাক্ট পেয়ে প্রায় সব টাকা তুলে নিলেন, কিন্তু ব্রিজগুলোর একটির কাজও কেন শেষ করলেন না- এ প্রশ্নটির জবাব এই কয়েক বছর দৈনিক প্রথম আলোর মতো আমিও খুঁজে চলেছি। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ কি কোনো দিন তাকে এ প্রশ্নটি করেছে? গোলাম মাওলা রনি চার মাস আগে সাংবাদিক পিটিয়ে এই দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিস থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেন, জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আবার ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর একজন বিশিষ্ট কলাম লেখক!! যেমন বিশিষ্ট লেখক নূরে আলম সিদ্দিকী! উদোম গায়ে নূরে আলম সিদ্দিকীকে প্রথম দেখি ছবিতে, ১৯৭২ এর প্রথম দিকে লন্ডনে সাংবাদিক সাইমন ড্রিং আয়োজিত বাংলাদেশের ওপর একটি ‘ফটোগ্রাফিক একজিবিশন’-এ। ছবিতে নূরে আলম সিদ্দিকীর কোমরে একটি রিভলবার, তখনও দাপটশালী চার খলিফার এক খলিফা। তারপর ডলার ব্যবসায়ে তার উত্থান পর্বে তাকে দেখি দ্বিতীয়বার সামনাসামনি, আমার সম্পর্কে চাচাতো ভাই মরহুম আমীর হোসেনের দিলকুশা সোনালী ব্যাংকের অফিসে। বিডিআরের ডাইরেক্টর জেনারেল শহীদ মেজর জেনারেল শাকিলের শ্বশুর মরহুম এই আমীর হোসেন তখন এই সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার। ডরিন টাওয়ার নিয়ে তার সব অপকীর্তি ডেইলি স্টার ছবিসহ প্রকাশ করেছে দুই বছর আগে। আওয়ামী লীগের টিকিটে ঝিনাইদহে এমপি নির্বাচনে দুইবার ব্যর্থ নূরে আলম সিদ্দিকী; এবার তার ছেলে একই নির্বাচনী এলাকা থেকে বিদ্রোহী প্রার্থী!
দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার এই তিন জনপ্রতিনিধির ওপর বিভিন্ন সময়ে যেসব রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সেগুলোকে আমি তারিফ করেছি। আমার ধারণা, প্রথম আলো তাদের অপকর্ম-অপকীর্তি উন্মোচন করেছে বিভিন্ন সময়ে; বসুন্ধরা গ্র“পের এই পত্রিকায় তাদের এত ইজ্জত-মর্যাদা-সম্মান। বিএনপির মিডিয়াপল্লী শিরোনামের রিপোর্টটিও আমি সংরক্ষণ করে চলেছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণাকারী আমাদের কিছু পত্র-পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল বিএনপি-জামায়াত জমানায় কেমন সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে তার ওপরও কতগুলো ফাইল আমার কাছে আছে।
আমাদের কয়েকটি টিভি চ্যানেল এই-সেই উপলক্ষে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেসব অনুষ্ঠানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণাকারী কুতুবমিনার সাইজের কিছু ‘সিভিল’কেও দেখি। গত ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলকেও উৎসব করতে দেখলাম। সেখানে বড় বড় এই ‘সিভিল’দের সাক্ষাৎকারও ছিল। ভালো কথা। কিন্তু এইসব সিভিল, আমাদের সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক আবু সায়ীদ কোনোদিন কি তাদের এইসব টিভিতে বিজ্ঞাপন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেছেন? তারপর এসব সিভিলের বোধ হয় জানা নেই; A corrupt media cannot fight corruption. দুর্নীতিগ্রস্ত গণমাধ্যম দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে না। কথাটি আমার নয়। কথাটি বলেছেন তুরস্কের এক কলাম লেখক ইয়াভুজ বেদর (Yavuz Baydor)। গত ১৯ জুলাই দুনিয়ার পাঁচটি প্রভাবশালী দৈনিকের একটি, নিউইয়র্ক টাইমস-এ ‘In Turkey Media- Bosscs Are Undermining Democrac’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে।
বাংলাদেশেও তুরস্কের মতো এমনটি হচ্ছে না তো?
তিন.
আবদুল কাদের সিদ্দিকীর ওপর প্রথম আলোতে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যাটির কথা প্রতিবারই মনে পড়ে যখন তার কোনো লেখা বা বক্তৃতা-বিবৃতি বা সাক্ষাৎকার পড়ি বা দেখি। গতকালই বোধ হয় বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়লেই দেশে শান্তি ফিরে আসবে। যোগ্য লোকের যোগ্য প্রেসক্রিপশন! মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর বীরত্বের তারিফ করি। তারিফ করি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তার প্রতিরোধের চেষ্টা। তাকে সম্মান করি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন থেকে তিনি কোনো দিন মাংস মুখে নেননি। কিন্তু তিনি এমন নিশ্চিত হলেন কি করে যে, জামায়াত নির্বাচনে না এলে বিএনপি নির্বাচনে আসবে? প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেও বিএনপি কি তখন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের দাবিতে আবার অবরোধ-হরতাল দেবে না? বিএনপির কি কখনও উছিলার অভাব হয়েছে?
প্রথম আলো ফজলে নূর তাপসের যে সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করেছে- তা পড়ে আমি আঁতকে উঠেছিলাম। তার বাবা শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে ৬০-এর দশকের প্রথমদিকে ছাত্রলীগ করতাম। ১৯৬১-তে সলিমউল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ প্রার্থীদের ‘ক্রেডেনসিয়েল’ কয়েকশ’ টাকার অভাবে ছাপাখানা থেকে যখন আনা যাচ্ছিল না, তখন এই মণি ভাই হাতের আঙুলের আংটিটি খুলে দিয়েছিলেন, স্মৃতিটা এখনও জ্বলজ্বল করে। একটি দৈনিক পত্রিকা- এমনি এমনিতে তো পত্রিকাটির পেইড সার্কুলেশন সাড়ে ৫ লাখ নয়। এতসব কৃতিত্ব পত্রিকাটির, কিন্তু এই পত্রিকাটি যে এখন বর্তমান মহাজোট সরকারবিরোধী তা আর প্রচ্ছন্ন নয়, বলতে গেলে এখন তা প্রকাশ্য। কিন্তু তাতেও আমার আপত্তি নেই। আমাদের এই দেশে তো দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং দৈনিক দিনকালও আছে। দৈনিক প্রথম আলো তো এই পত্রিকাগুলোর মতো মৌলবাদের প্রচার করছে না, যদিও মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হই।
কিন্তু এই প্রথম আলো গত ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার যে জনমত জরিপটি প্রকাশ করেছে, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। দৈনিক প্রথম আলো প্রতিদিন তার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম কলামে ‘অনলাইন ভোট’ শিরোনামে আগের দিন একটি বিষয়ের ওপর প্রশ্ন রাখে এবং এ প্রশ্নের পক্ষে-বিপক্ষে পরদিন প্রাপ্ত ভোট প্রকাশ করে থাকে। ১১ তারিখ বুধবারের প্রশ্নটি ছিল এমন- ‘১৮ দলীয় জোটের অবরোধ-কর্মসূচি শুক্রবার ৬টা পর্যন্ত বাড়ালো- সমর্থন করেন কি?
পরদিন বৃহস্পতিবার প্রথম আলোতে প্রকাশিত রেজাল্টটি ছিল এমন : অবরোধ বাড়ানোর পক্ষে হ্যাঁ, ৭০.৩২%; না, ২৭.০৫% এবং বক্তব্য নেই, ২.৬৩%!!
মানেটা কি দাঁড়াল? দেশের ৭০.৩২% মন্তব্যদানকারী বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলের অবরোধ সমর্থন করে? তার মানেটা কি আরও এই যে, এই সমর্থনকারীরা অবরোধের পক্ষে? সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত ও দুষ্কৃতকারীদের এতসব নিরীহ মানুষ হত্যা, গাছ হত্যা, বাসে-গাড়িতে-সিএনজিতে আগুন দেয়ার পরও এত বিশাল সংখ্যার সমর্থক এই বাংলাদেশে?
যদি প্রথম আলোর এই জনমত সঠিক হয়ে থাকে তাহলে এতসব টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ভয়ঙ্কর ভয়াবহ সব ছবি কি দেশের মানুষদের চিন্তাচেতনা-ভাবনায় কোনোই প্রভাব ফেলছে না! প্রথম আলোর বিভিন্ন পাতায় এতসব মর্মান্তিক ছবিসহ প্রকাশিত খবর সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়র কোনোই কি আছর পড়ছে না? তাহলে দৈনিক প্রথম আলোই বা কেন এতসব সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় ছবি খবর ছাপাচ্ছে? মূল্যবান নিউজপ্রিন্টের এমন বিপুল অপচয় করছে? ১২ ডিসেম্বরের দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠাতেই একটি সড়কের ওপর বড় বড় ১০-১২টি কাঠের গুঁড়ি দিয়ে সড়ক অচল করে দেয়ার ছবি আছে। একই প্রথম পৃষ্ঠায় আরও একটি ছবি,- ছবিটির ক্যাপশন এমন : ‘জামায়াতে ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় মঙ্গলবার রাতে কার্যকর করা হবে, এমন খবর প্রচার হওয়ার পরই দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর ও নাশকতার ঘটনা ঘটে। সেই রাতেই ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের শাহজাহানপুর উপজেলার ফত্কী সেতুর রেলিং ভাংচুর করেন শিবিরের কর্মীরা। গতকাল সকালে তোলা ছবি। প্রথম আলো।’ প্রথম আলোর ক্যাপশনের শেষ বাক্যটি আবার দেখুন! ‘ভাংচুর করেন শিবিরের কর্মীরা’। ভাংচুর করেন? এখানে দন্ত্য ‘ন’ দিতে হবে? দন্ত্য ‘ন’ যারা ভাংচুর করেছে তাদের জন্যও থাকবে? তারা ‘শিবিরের কর্মীরা’? তারা শিবিরের সন্ত্রাসী নয়? তারা শিবিরের দুর্বৃত্ত নয়?
শিবিরের সন্ত্রাসীদের সম্মান-মর্যাদা দিয়ে তাজীমের সঙ্গে উদ্ধৃত করতে হবে? লিখতে হবে? এই দিন ১২ ডিসেম্বরের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘২০ জেলায় জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব দ্বিতীয় শিরোনামের পরও?’ এই একই দিন পত্রিকাটির ভেতরের অন্যসব পাতায় অবরোধে সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতকারীদের হামলা-ভাংচুর, মানুষ হত্যা, গাছ কাটার ওপর ১১টি মর্মান্তিক ছবি আছে। বাংলাদেশে বিএনপি, আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং দেশের কতগুলো টিভি চ্যানেল এবং পত্র-পত্রিকা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরকে সমর্থন, মর্যাদা এবং গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এই জামায়াতের প্যারেন্ট রাজনৈতিক দল মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে মিসরের সরকার। মুসলিম ব্রাদারহুডকে একেবারেই সমর্থন করে না, পছন্দ করে না সৌদি সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার মুসলিম ব্রাদারহুডকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে মিসর সরকার। আর তাতে তাৎক্ষণিক সমর্থন জানিয়েছে সৌদি আরব। কিন্তু বাংলাদেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের এক সন্তান জামায়াতে ইসলামকে বুকে কোলে তুলে নিয়েছে বিএনপি!!
চার.
বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা, টিভি সম্পর্কে আমি একটু খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করি। গত অক্টোবর-নভেম্বরে আমার নিউইয়র্ক সফর শেষে আমি যে বিশ-পঁচিশটি বই এনেছি, তার মধ্যে ১০-১২টি মিডিয়ার ওপর। একটি বই দুনিয়ার মিডিয়া মোঘল রুপার্ট মারডক এবং অন্য একটি আলজাজিরা টিভি চ্যানেলের ওপর। আমাদের এই গণতন্ত্রের দেশে আমাদের টিভি এবং পত্র-পত্রিকাগুলো সবার ওপরেই খবরদারি করে প্রত্যাশিতভাবেই। কিন্তু আমাদের মিডিয়ার ওপর কার্যকর খবরদারি করার কোনো ব্যবস্থা নেই এই দেশে। তথ্য জানার অধিকার আইনে সরকারের অনেক ধরনের তথ্য জানার অধিকার আমাদের মিডিয়ার তো আছেই, আছে আমাদের সাধারণ নাগরিকদেরও।
কিন্তু আমাদের এতসব পত্র-পত্রিকা, টিভি সম্পর্কে কিছুই জানার অধিকার রাখা হয়নি তথ্য অধিকার আইনে। বিশ্বাস হয়? কিন্তু আমাদের মিডিয়াকেও খোলামেলা স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতামূলক হতে হবে নিজেদের স্বার্থে, বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হলে।
অন্যের জবাবদিহিতা চাইবেন প্রতিদিন, অথচ নিজেরা তার ঊর্ধ্বে থাকবেন, তা কি হয়? এ পর্যায়ে বিষয়ের ওপর সম্পাদক সাংবাদিক সাহেবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এক. মোহতারেমা খালেদা জিয়া গত ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তার প্রেস কনফারেন্সে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তাতে মর্মাহত হয়েছেন বলেছেন, কিন্তু পাকিস্তানের এই প্রস্তাব গ্রহণকে তিনি নিন্দা জানাননি। তার এই ‘ওমিশন’টিকে আমি ইচ্ছাকৃত মনে করি। কূটনীতিবিদ হিসেবে আমাদের যা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, তাতে যা দৃশ্যমান তা যেমন আমরা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি, যা বলা হয়নি বা অদৃশ্য এবং যা যা সব ‘ওমিশন’, তার ব্যাখ্যাও আমরা করে থাকি। মোহতারেমার এই ওমিশনটি গুরুতর মনে করি।
দুই. ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের ভোরে সাভার স্মৃৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে না গিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় দিবসকে অপমান করেছেন মোহতারেমা খালেদা জিয়া ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতদের এই আচরণের ওপর কোনোই মন্তব্য করেননি তার প্রেস কনফারেন্সে। কেন তার এই ‘ওমিশন’?
তিন. প্রেস কনফারেন্সে মোহতারেমা খালেদা জিয়া কোনো সাংবাদিকের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। তার মানে তিনি কি আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবার দেয়া হবে না, সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন ‘এনটারটেইন’ করা হবে না?
তাহলে এই প্রেস কনফারেন্স এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, নয়াপল্টন এবং দেশের অন্যসব জায়গায় বা জাতীয় সংসদে তার দেয়া বক্তৃতার মধ্যে কী ফারাক থাকল? তাহলে প্রেস কনফারেন্স এবং প্রপাগান্ডা কনফারেন্সের কী পার্থক্য? আমরা অতীতেও দেখেছি, সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে তিনি চান না। তার জোট আরোপিত এতসব হরতাল-অবরোধে দেশের যে এত বিপুল বিশাল পরিমাণে ক্ষতি হচ্ছে, এতসব মানুষ আগুনে পুড়ে, বোমা, ককটেল হামলায় মারা যাচ্ছেন, তার কি কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না? সম্পাদক সাংবাদিকরা যদি এই জবাবদিহিতা আদায় করতে না পারেন, গত কয়েক মাসে দেশের হাজার হাজার অসহায়, নিষ্পাপ শিশু, কিশোর-কিশোরী, মা-বাবা, ভাইবোন, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বিধবার চোখের পানি বুকফাটা আর্তনাদও যদি প্রশ্ন করতে আপনাদের এতটুকু সাহস না জোগায়, তাহলে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের কী দায়িত্বটা আপনারা পালন করছেন?
সবশেষে একটি সতর্কবার্তা ও একটি প্রস্তাব। সতর্কতা,- বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আতাউর রহমান আবার ঢাকায় ফিরেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বায়ান্ন জনকে একই বছর ফার্স্ট ক্লাস দিয়ে তিনি ‘খ্যাতিমান’ হয়ে উঠেছিলেন। অনুমতি ছাড়া দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এক-এগারোর সরকারকে জায়েজ করার জন্য তিনি প্রবল ভূমিকা রেখেছিলেন। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আসলেই কী ঘটতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী জানতে বাংলাদেশ প্রতিদিন বা প্রথম আলো তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.