ভিমরুলিতে নেই ভিমরুল by সুভাষ সাহা
ভয় নেই! ভিমরুলিতে ভিমরুল নেই। তাই
ভিমরুলিতে গেলে ভিমরুলের হুলের জ্বালা সইতে হতে পারে, এমন আতঙ্কেরও কোনো
কারণ নেই; বরং ঝালকাঠির ভিমরুলি লেবুরহাটে কাগজিলেবুর ম-ম করা গন্ধ যখন
নাকে ঝাপটা দেবে, তখন মনটাও লেবুর বাহারি সবুজ রঙের মতো সতেজ হয়ে উঠতে
পারে।
কিন্তু যাদের হাড়ভাঙা শ্রমে নৌকাবোঝাই লেবু এই হাট
হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের রসনা তৃপ্ত করে, ক্লান্তি
দূর করে, দেহে ভিটামিন-সির অভাব পূরণ করে_ তাদের জীবনে কি রসাল লেবুর
প্রাণজুড়ানো রঙ-রূপ-গন্ধের মতো সব সময় আবির ছড়ায়! তাদের জীবন সব সময় ছন্দময়
হয় না। ঝালকাঠির বাউকাঠি, শতদশকাঠি, ভিমরুলি, বাফুড়কাঠি, আটগড়,
গাভারামচন্দ্রপুর, পোষণ্ডা, ঢুমুরিয়া, খেজুরা, কৃত্তিপাশা, মিরাকাঠির মতো
২২টি গ্রামের কৃষিজীবীরা যখন পাকা লেবু ভিমরুলি হাটে তোলেন বিক্রির জন্য,
তখন তাদের পরিবারে চলে অপেক্ষার পালা। পরিবারগুলো তখন আনন্দ-বিষাদের
মাঝামাঝি অবস্থায় থেকে প্রিয়জনের হাট থেকে বাড়িতে ফেরার অপেক্ষার প্রহর
গোনে। হাটে নৌকাবোঝাই লেবু বিক্রিতে রোজগারটা ভালো হলে ওই কৃষক পরিবারে
খুশির জোয়ার বয়। আর বিক্রি থেকে আয় কম হলে কিষানির চোখ-মুখেও তার ছাপ পড়ে।
তখন কৃষককেও বড় মাছটা বাজার থেকে কিনে নিয়ে ঝাঁপাতে ঝাঁপাতে বাড়ি ফিরতে
দেখা যায় না; বরং কৃষকের বাড়ির পথ যেন আর ফুরোতে চায় না। তারপরও সমাজ-সংসার
চলে। তিন মাস পরপর লেবু উৎপাদন হয় বলে পরেরবার বেশি রোজগারের আশায়
ক্লান্তি ঝেড়ে কৃষক আবার বুক বাঁধে। এভাবেই চলে বাংলার কৃষকের হাসি-কান্নার
দোলায় দোলানো সংসার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষদের ভাগ্যলিপি বলি আর
দিনলিপিই বলি তা বদলানোর উদ্যোগ নেওয়ায় অনেক কৃষক চিরাচরিতভাবে অদৃষ্টের
ওপর নিজের-পরিবারের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়ে আগের মতো আকাশ পানে চেয়ে থাকে
না।তাদের কারও কারও দিকে ব্যাংকের আর্থিক সহায়তা প্রসারিত হয়।কিন্তু
ভিমরুলির লেবুচাষিদের ভাগ্য ততটা খোলেনি। তারা জানেই না ব্যাংলাদেশ ব্যাংক
মসলা জাতীয় ফসলের জন্য মাত্র দুই শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে রেখেছে।
তারা যদি এই ঋণের কথাটা জানতে পারত এবং লেবু চাষে সহজে ঋণ পেত তাহলে এই
কৃষক পরিবারগুলোর চোখে-মুখে কখনও কখনও হাসি মেলানোর অবকাশ থাকত না। তাদের
লেবু উৎপাদনের জন্য যদি চড়া সুদে এজিওগুলোর কাছ থেকে কর্জ করতে না হতো
তাহলে উৎপাদিত লেবুতে লাভ তাদের বেশি হতো। তা ছাড়া প্রাকৃতিক বা অন্য কোনো
কারণে উৎপাদন ক্ষতিতেও তারা বিপন্নবোধ করত না। বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষকদের
মাত্র ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খোলার একটি প্রশংসনীয় স্কিম চালু করেছে। এতে
কৃষকদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা আছে। কিন্তু কৃষকদের
কাছে লেবু উৎপাদনের মতো নানা কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য মাত্র দুই শতাংশ
সুদে প্রয়োজনীয় ঋণ পেঁৗছাচ্ছে কি-না, সে খবর কি ঠিকভাবে সব সময় বাংলাদেশ
ব্যাংকের কাছে পেঁৗছয়? প্রকৃত কৃষককে ঋণদানে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। যে কৃষক
এনজিওর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে শোধ করতে পারে, তারা ব্যাংকগুলোর কাছ
থেকেও নেওয়া অর্থ পরিশোধ করতে পারবে। এতে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের জোয়ার
সৃষ্টি হবে। কৃষক পরিবারগুলোকে আর ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিজের সামর্থ্য পদে
পদে খাটো করতে হবে না। সেদিন কি খুব দূরে! যেদিন এ দেশের কৃষকরা হাতে হাত
রেখে বলতে পারবে_ আমরা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য গড়ি, আমরাই দেশ গড়ি, আমরাই
নিজ পরিবার ও সমাজের মুখে হাসি ফোটাই। ব্যাংকের আন্তরিকতাপূর্ণ আর্থিক
সহযোগিতা প্রতিটি কৃষিজীবী পরিবারের কাছে লেবুর ম-ম ঘ্রাণের মতো সুখ-আনন্দ
স্বপ্ন চারিয়ে দিতে পারে।
No comments