অ্যান্টিবায়োটিক by জয়া ফারহানা

শেকসপিয়ারের হ্যামলেট নাটকের শেষ সংলাপ ছিল : 'এরপর নীরবতা'। ভাঙা রেকর্ডের মতো এই শব্দবন্ধটি মাথার ভেতরে বেজেই চলেছে কয়েক দিন ধরে। হেফাজতের আমির আহমদ শফী একটি বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে নারী বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের সূত্র ধরে সেসব এখন আমাদের সবারই জানা। টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো বড় আশা নিয়ে তাদের লেন্স ঘোরাচ্ছে নারী নেত্রীদের দিকে। সংবাদপত্র অপেক্ষায় ছিল বিশিষ্টজনদের বিবৃতির জন্য। যথারীতি তাঁরা বিবৃতি দিয়েছেন। নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ সভা হয়েছে নিয়মমাফিক। সংসদে আহমদ শফীর বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হলো (১৪ জুলাই), দেখা গেল আহমদ শফীর বক্তব্যের পক্ষে বলার মতো বক্তাও (সংসদ সদস্য) আছেন সংসদে। এরপর? হ্যামলেটের সংলাপের মতো 'এরপর নীরবতা'। তবে এই 'নীরবতা' আভিধানিক, শাব্দিক এবং হ্যামলেটীয় পরিভাষায় যদি কেউ বুঝে থাকেন তাঁকে মনে করিয়ে দিতে হবে And miles to go before I sleep কবিতার কথা। নারীকে পেরোতে হবে লক্ষ কোটি মাইল, এই সময় কেউ যদি তার (নারীর) কবরের এপিটাফ রচনা করতে চান তাহলে 'এরপর নীরবতা' (বিপরীত অর্থে)। পিটার্স সেলার্স বলতেন, 'এই জীবন লইয়া কী করিতে হয়?' তাঁর ভাষা ঋণ করে আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আহমদ শফীর মতো নেতাদের নিয়ে কী করতে হয়? 'সূর্যদীঘল বাড়ি'র জয়গুনের কথা মনে আছে? কত দিন মনেই পড়েনি তাকে। আবার মনে পড়ছে তাকে। আর যখন মনে পড়ছে তখন কিছুতেই ফেরাতে পারছি না মন। মনে পড়ছে ফারুখ ফয়সলকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ডলি ইব্রাহিম বলেছিলেন, 'জয়গুন চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে আমার এতটুকু অসুবিধা হয়নি। আমার আর জয়গুনের সমস্যা তো একই জায়গায়। কেবল প্রেক্ষাপট আলাদা।' অসাধারণ অভিনয়দক্ষতায় যিনি জয়গুনদের সংকটকে চিরায়ত প্রতীকে পরিণত করে নিলীন এবং প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা থেকে নিজেকে একেবারে মুক্ত করে চলে গেলেন। একই ধারাবাহিকতায় মনে পড়ছে মিতা নূরের নামও। উপরিতলের সাংবাদিকতা নির্মোহ অনুসন্ধানে তুলে আনে না সেই তথ্য কেন, কী কারণে এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দেন তাঁরা জীবনের আলো? আদি অন্তহীন ক্ষত-বিক্ষত নারীজীবনে নারী এক দলছুট নক্ষত্র। 'সিসিমা' চরিত্রের মতো প্রস্থানের আগেই যাদের মহাপ্রস্থান ঘটে, নিশ্চয়ই তাদের পাশে এমন কেউ থাকেন না। যিনি মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব শূন্যে নেমে আসার আগেই তাঁকে অন্তিম যাত্রার পথ থেকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে আনবেন। নারীর জন্য চ্যালেঞ্জিং এই সময়ে যখন প্রয়োজন ছিল খুব স্বচ্ছন্দময় একটি পরিবেশের, সেখানে পুরুষকে সে পাবে একটি নিরপেক্ষ সহজ চরিত্র হিসেবে, তখন হেফাজতের আমিরের এই বক্তব্য নারীকে আকাশে উত্তীর্ণ হওয়ার পরিবর্তে মাটিতে পুঁতে ফেলার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। তাতানো মাটিতে (নারীর জন্য) দগদগে পোড়া পা দুটি নিয়ে যখন সে জোর কদমে পুরুষের পাশে হাঁটতে চাইছে, তখন তাকে এই খণ্ডিত এবং দণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র কেন? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দগ্ধ হতে হতে এই একুশ শতকে যেই কি না নারী একটুখানি রৌদ্রোজ্জ্বল জীবনের কথা ভাবছে, ঠিক তখনই চারদিকের কীট ও তুঁত নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নারীজীবনের ছিদ্রান্বেষণে। খুঁজে বেড়াচ্ছে কোন শিকলে বাঁধবে তার স্বপ্নের ডানা?
যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা কিছু দিয়েই যখন দমানো (দাবিয়ে রাখা) যাচ্ছে না নারীকে, হাত থেকে এক এক করে খসে পড়ছে সমস্ত তাস; পড়তে পড়তেই শেষ পর্যন্ত আর একটি কার্ডই অবশিষ্ট থাকার কথা অতএব অবশ্যম্ভাবী সেই কার্ডটি ধর্মের। এই একই কার্ড ব্যবহার করে একাত্তরে গোলাম আযমরা বাংলাদেশের নারীদের ধর্ষণ করা জায়েজ, কেননা তারা গনিমতের মাল- মর্মে প্রত্যাদেশ জারি করেছিলেন। আহমদ শফীর বক্তৃতা অনুযায়ী মনোবিজ্ঞানের ভাষায় তিনি নিজে 'একজন পিডোফাইলাক এবং যাদের সমস্যার সমাধানার্থে বাংলাদেশের আট কোটি নারীকে তিনি স্বামীর সংসারের হিসাব-নিকাশ করতে বলেছেন, তারা সেক্স ম্যানিয়াক। এই সেক্স ম্যানিয়াকদের জন্য আট কোটি নারী তাদের সব কাজকর্ম ছেড়ে পুত্র-সন্তান লালন-পালন করতে ঘরে ঢুকে যাবে? কেউ কেউ তাঁর হয়ে সাফাই গেয়েছেন (হেফজাতের নন), তিনি নাকি নারীদের প্রধান দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। নারীর প্রধান দায়িত্ব পুত্রসন্তানের লালন-পালন, এটা কোরআনের কোন আয়াতে লেখা আছে? পাভলভের সেই কুকুরটির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। পাভলভের সেই কুকুর, যে কুকুরের প্রথমে খাবার দেখলে মুখ থেকে লালা ঝরত, তারপর খাবার আর ঘণ্টার ঠং ঠং যখন একসঙ্গে বাজত তখনো তার মুখ দিয়ে লালা ঝরত। তারপর যখন আর খাবার আসত না কিন্তু ঘণ্টার ঠং বাজত, সেই ঠং শুনেই লোভী কুকুরের মুখ দিয়ে লালা ঝরত খাবারের কথা ভেবে। লালা ঝরার রোগ যাদের আছে, তা নিরাময়ের দায়িত্ব তাদের নিজেদের। মনের জিভ দিয়ে যারা লালা ঝরায় বাংলাদেশের সব নারী ঘরে বন্দি থাকলেও তারা তা ঝরাবেই। কোনো ধর্ম, কোনো আইন, কোনো বিবেক, কোনো অনুশাসন এই সাইক্লিক রেপিস্টদের ঠেকাতে পারবে না। নারীর মেধার সৌন্দর্য, আত্মিক উন্নতির সচেতনতা, সভ্যতা বিকাশে তার অবদান, কিছুই যেখানে মুখ্য নয়, মুখ্য কেবল নারী পণ্যেরও অধম এই তত্ত্ব, সেখানে সোনার পর্দা করলেও বাঁশঝাড়ের আড়ালে, পাটক্ষেতে, ধানক্ষেতে, আলের ধারে ৯ বছরের কন্যাশিশুরাও ধর্ষিত হতেই থাকবে। লোলুপ পুরুষের দৃষ্টির ভেতর দিয়ে যে লোভের লালা ঝরে পড়ে তার ভেতর থাকে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া। আর সভ্যতা যত এগোচ্ছে ব্যাকটেরিয়া বিনাশের কঠিন থেকে কঠিনতর অ্যান্টিবায়োটিকও আবিষ্কৃত হচ্ছে ততই দ্রুততায়। এবং নারীর ঘাড়ের ওপর যে মাথাটি রয়েছে সেই মাথা থেকেই এসব অ্যান্টিবায়োটিকের ফর্মুলা আসছে। লগ অন করুন। অ্যান্টিবায়োটিকের ওয়েবসাইটগুলো ভিজিট করে আসুন।
লেখক : পরিচালক, কিংবদন্তি মিডিয়া
joyajoybangla@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.