সাক্ষাৎকার-শফীকে আইয়ামে জাহিলিয়াতের মানুষ মনে হয়েছে by সেলিনা হোসেন
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : নাসির আহমেদ
সমকাল : আপনি হেফাজত আমির শাহ আহমদ শফীর বহুল বিতর্কিত ওয়াজের ভিডিও শুনেছেন নিশ্চয়ই।
সমকাল : আপনি হেফাজত আমির শাহ আহমদ শফীর বহুল বিতর্কিত ওয়াজের ভিডিও শুনেছেন নিশ্চয়ই।
আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
সেলিনা হোসেন : তাকে আমার আইয়ামে জাহিলিয়া যুগের মানুষ মনে হয়েছে, যখন কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলে জ্যান্ত কবর দেওয়া হতো। আহমদ শফী এই একবিংশ শতাব্দীর মানুষ নন। চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা_ সবকিছু মিলিয়ে আদিম বর্বর যুগের একজন বলেই মনে হয়েছে তার ভিডিও বক্তব্য শুনে।
সমকাল :তিনি মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন, বিশেষ করে কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ূয়া মেয়েদের চরিত্র নিয়ে কথা বলেছেন। নারী শিক্ষা নিয়ে তার এই দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সেলিনা হোসেন : এটা ব্যাখ্যা করাও আমি প্রচণ্ডভাবে অযৌক্তিক বলে মনে করি। যে বক্তব্যের পেছনে কোনো যুক্তি থাকে না, যে বক্তব্য বিবেকহীন অন্ধতার শামিল, তাকে আমরা ঘৃণা করতে পারি। এর বেশি আরও যদি কিছু থাকে, সেটাই করা উচিত। আগেই বলেছি, তিনি একুশ শতকের মানুষ নন। এখন থেকে একশ' বছরেরও বেশি সময় আগে আমাদের একজন অসাধারণ মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষার জন্য যে অমানুষিক পরিশ্রম করে মেয়েদের ঘরের বাইরে টেনে এনে শিক্ষার মুখোমুখি করার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই ইতিহাস কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের একজন প্রধানের জানা উচিত বলে মনে করি। ভাবতে পারি না যে, তিনি বিষয়টি জানেন না। এই জানা থেকে তিনি মেয়েদের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেছেন। এটা ধরে নেওয়া এ মুহূর্তে সঙ্গত মনে করছি না। কারণ উচ্চশিক্ষাঙ্গনের মেয়েদের চরিত্র সম্পর্কে তিনি যে অশালীন মন্তব্য করেছেন, উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের সম্পর্কে যে ঢালাও নিন্দা করেছেন, তা ভাবতেও ক্রোধে মাথায় রক্ত উঠে যায়। মাত্র গত সপ্তাহে পাকিস্তানের ১৬ বছরের কিশোরী মালালা জাতিসংঘে বক্তৃতা করেছে। সে বক্তৃতায় নারী শিক্ষার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার কথা বিশ্ববাসীর কাছে নতুন করে তুলে ধরেছে, আমাদের কওমি মাদ্রাসার একজন শিক্ষক এ বক্তব্য টেলিভিশনে দেখেননি বা কোনো সংবাদপত্রে পড়েননি_ ভাবতে পারি না। যদিও কুসংস্কারবশত জ্ঞান-বিজ্ঞানের দরজা তারা বহুকাল ধরেই বন্ধ করে রেখেছেন। নারী শিক্ষার প্রবক্তা হিসেবে তালেবানদের হাতে আক্রান্ত মালালাকে বিশ্ববাসী স্যালুট করেছে। বাংলাদেশের মেয়েদের শিক্ষার বিরুদ্ধে এমন অশালীন উপদেশ দিয়ে আহমদ শফী দেশের মর্যাদাকেই ক্ষুণ্ন করেছেন।
সমকাল : নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ শুধু এশিয়ার নয়, আমরা মনে করি, এখন বিশ্ব প্রেক্ষাপটেই একটি রোল মডেল। এ অবস্থায় হাটহাজারী মাদ্রাসার এই প্রবীণ শিক্ষক হেফাজত নেতা যেসব কথা বলেছেন তা ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে বহির্বিশ্বেও পেঁৗছে গেছে। এতে বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে কীভাবে দেখবে?
সেলিনা হোসেন : আমরা এ বক্তব্যকে হেয়প্রতিপন্ন করে নারীর ক্ষমতায়নের যে জায়গা তৃণমূল পর্যায় থেকে তৈরি হতে দেখেছি, তা আজকে বিশ্ববাসীর কাছে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একজন আহমদ শফী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা বিশ্ববাসীর কাছে কোনো পাত্তা পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থায় জেন্ডার ইকুয়ালিটির যে জায়গাটি তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে পিছু হটে যেতে পারবে না। আমাদের মেয়েরা, আগেই বলেছি_ তৃণমূল থেকে সর্বত্র সচেতনভাবে এ জায়গাটি পরিচর্যা করেছে। তারা জানে তারা কখনোই কওমি মাদ্রাসায় পড়তে যাবে না। তাদের জন্য অন্যসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা খোলা। তারা নিজেরাই নিজেদের জায়গাটি প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের মাধ্যমে অক্ষুণ্ন রাখবে।
সমকাল : কিন্তু বিশ্ববাসীর কাছে পাত্তা না পেলেও দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াবে না? যেখানে আমাদের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ এখনও নিরক্ষর এবং পশ্চাৎপদ।
সেলিনা হোসেন : আমি গ্রামগঞ্জে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষ লক্ষ্য করেছি, মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে তাদের কোনো দ্বিধা নেই। বিশেষ করে নিরক্ষর পরিবারের বাবা-মাও মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেন। সরকার প্রদত্ত উপবৃত্তি তাদের চেতনার জায়গাটিকে অনেক অগ্রসর করে দিয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক মেয়েকেই পেয়েছি, যারা ঘরে সকালের পান্তা না খেয়ে খালি পেটেই স্কুলে চলে এসেছে। আমি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। এমনকি দরিদ্র বাবা-মা মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করার জন্য আমার কাছে কীভাবে স্কলারশিপ পাওয়া যাবে, সে কথাও জানতে চেয়েছেন। এই জনসংখ্যার ১০ শতাংশ যদি মেয়েদের প্রতি শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীন থাকেন, তাহলে বলতেই হবে এটি কোনো বড় সংখ্যা নয়। আমার বিশ্বাস, আগামী কয়েক বছরেই মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার আর কোনো বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত থাকবে না।
সমকাল : আপনি নারী শিক্ষা এবং অধিকার নিয়েও কাজ করেন। আহমদ শফীর এ বক্তব্য বা নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে এমন উগ্র পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?
সেলিনা হোসেন : আমি মনে করি, এর প্রধান কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে আসা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নতিতে তাদের অংশগ্রহণ একজন ধর্মান্ধ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। কারণ তার দৃষ্টি সামনে প্রসারিত নয়। নারীকে অবদমিত রেখে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে, শিক্ষা ও তার অধিকার সচেতনতার বোধ রুদ্ধ রেখে একতরফা ভোগ-লালসার সামগ্রীতে পরিণত করে রাখার জন্যই এমন বক্তব্য যে, নারী শুধু স্বামীর সংসারের আসবাবপত্র দেখাশোনা করবে। এর দ্বারা এ-ও প্রমাণিত হয়_ হেফাজতে ইসলাম নামক সংগঠনটি নারীর মানবাধিকার স্বীকার করে না। এ সংগঠনের তরুণরা যদি একইভাবে নারীর প্রতি এ রকম বিদ্বেষমূলক আচরণ করতে থাকেন, তবে সমাজকে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে এবং তারা যা খুশি তা করার সুযোগটি ভোগ করবেন। আরও একটি কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রযাত্রার এ সময়ে শিক্ষিত নারীরা তাদের সন্তানদের কওমি মাদ্রাসার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে চাইবেন না। ফলে তারা পরবর্তী প্রজন্মকে হারিয়ে নিজেদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হতে দেখবেন। শাহ আহমদ শফীর উগ্র নারীবিদ্বেষের কারণ হিসেবে এসব কথাও বিবেচনায় আসে।
সমকাল : একটু আগেই আপনি বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম নারীর মৌলিক মানবাধিকারে বিশ্বাস করে না_ সঙ্গত কারণেই আমাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের সঙ্গে আহমদ শফীর পুরো বক্তব্য সাংঘর্ষিক। আপনি কি মনে করেন, সংবিধানবিরোধী বক্তব্যের কারণে তিনি আইনের আওতায় আসতে পারেন?
সেলিনা হোসেন : অবশ্যই। সংবিধানে যেখানে নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবেন_ এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, সেখানে নারী বলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন না, বাইরে কর্মক্ষেত্রে যেতে পারবেন না, নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে অশ্লীল ভাষায় ভোগের সামগ্রী বলে প্রচার করবেন, তিনি তো আইনের চোখে ছাড় পেতে পারেন না। যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন, সেখানেই প্রতিটি মানুষকে তার বক্তব্যের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। তিনি তার বাইরের কেউ নন।
সমকাল :শাহ আহমদ শফী জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সোচ্চার বক্তব্য রেখেছেন এবং উচ্চশিক্ষিত নারীদের পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা শিক্ষাঙ্গনেই নষ্ট হয়ে যায় বলে অভিমত দিয়েছেন, তিনি জানতে চান পুত্রসন্তান না হলে বংশ কে রক্ষা করবে? এ বক্তব্যের প্রভাব কি সমাজে পড়বে না?
সেলিনা হোসেন : নিরক্ষর, অসচেতন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতেই পারেন। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা এ সময়ের কোনো সুস্থ মানুষের চিন্তার ফসল নয়। প্রতিটি দেশই তার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং উৎপাদিত পণ্য দিয়ে দেশের মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার চিন্তা করে। সেখানে সীমিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে জীবনমানের উন্নয়নের জন্যই পরিকল্পিত পরিবারের কথা বিশ্বের সব উন্নত দেশই চিন্তা করে। যার ফলে প্রতিটি শিশুই উন্নত জীবনমান অর্জনের সুযোগ পায়। যারা মানুষের জন্য, সমাজের জন্য এই পরিকল্পিত পরিবারের কথা অস্বীকার করে, তারা এক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করছে বলে বিবেচনা করাই যায়। যেখানে সরকার যুগ যুগ ধরে পরিকল্পিত জনসংখ্যার পক্ষে কাজ করছে, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে এই কর্মসূচি সফল করতে, ইতিমধ্যে বহু পরিবার এর সুফলও ভোগ করছে, সেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য জনসমাবেশে এমন বিষোদ্গার রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করারই শামিল। আমরা জানি না, সরকার আহমদ শফীর এত বড় চ্যালেঞ্জকে শুধু নিন্দা-সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে কি-না।
সমকাল : কিন্তু তিনি যে বলেছেন উচ্চশিক্ষিত নারীরা শিক্ষাঙ্গনেই পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, প্রশ্ন করেছেন পুত্রসন্তান না হলে বংশ পরিচয় রক্ষা করবে কে?
সেলিনা হোসেন : মেডিকেল সায়েন্সবিবর্জিত এ ধরনের বিদ্বেষপ্রসূত মনগড়া বক্তব্য দিয়েছেন তিনি নারীর উচ্চশিক্ষা চান না বলে। যাতে মানুষের ধারণা খারাপ হয় উচ্চশিক্ষিত নারীর প্রতি। এমন ঘৃণা ছড়ানোর জন্য যে কেউ তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয়ও নিতে পারেন। আর বংশ রক্ষা? বংশ কি শুধু পুত্রসন্তান দিয়ে রক্ষা করা যায়? যে পিতা কন্যাসন্তানের জন্মদান করেন, তিনি কীভাবে সেই মেয়েটিকে তার বংশ রক্ষা থেকে বঞ্চিত করবেন? আজকের দিনে একথা প্রকৃতই সত্য যে, পিতা-মাতার ধারাবাহিকতা কন্যাসন্তানও রক্ষা করে। আহমদ শফীকে প্রশ্ন করতে চাই যে, আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো পুত্রসন্তানের জন্য আক্ষেপ কিংবা বংশ রক্ষার কথা তো বলেননি। তাহলে এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
সমকাল : গার্মেন্ট শিল্পে কর্মরত হাজার হাজার নারীর প্রতি শাহ আহমদ শফীর যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা আপনি তার বক্তব্য থেকেই জেনেছেন। কঠোর ভাষায় তিনি মেয়েদের উচ্চশিক্ষার মতো চাকরিরও বিরোধিতা করছেন। বলেছেন, চাকরিজীবী 'মেয়েরা জেনা করে উপার্জন করে।'
সেলিনা হোসেন : এ ক্ষেত্রেও তার বর্বর মানসিকতাই প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বুঝে না বুঝে এমন সব কথা কীভাবে উচ্চারণ করলেন, তা আমার বোধগম্য নয়। নাকি তিনি বিষয়টিকে পুরো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তালেবানদের মতাদর্শ প্রচারের চেষ্টা করছেন। যে দেশের হাজার হাজার মেয়ে গার্মেন্ট শিল্পে কাজ করে দেশের রেমিট্যান্সের বিশাল অঙ্ক অর্থনীতিতে সংযোজন করছে, নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছে, দারিদ্র্যজর্জর পরিবারকেও দু'বেলা দু'মুঠো অন্নের সংস্থান করছে, সেখানে এত বড় একটি জনগোষ্ঠীর অবমাননা করা ধৃষ্টতার শামিল। আসলে তার বিকৃত মানসিকতাই এর দ্বারা প্রকাশ পেয়েছে।
সমকাল : একটু আগে সংশয় প্রকাশ করেছেন এ বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কি-না। আহমদ শফীর নেতৃত্বে যে কওমি মাদ্রাসার সংগঠন হেফাজতে ইসলাম, তা তো এখন রাজনৈতিকভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে গত ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে তাদের অবস্থান এবং পরবর্তী ভূমিকা আপনিও জানেন। আমাদের বিরোধী দল হেফাজতের পক্ষে। তাহলে কি নারীর উচ্চশিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের বিরুদ্ধে দেশের প্রধান বিরোধী দল অবস্থান নিয়েছে?
সেলিনা হোসেন : অবস্থাদৃষ্টে সে প্রশ্ন তো এখন জাগতেই পারে। বড় ভয়ের কথা। গত রোববার টেলিভিশনে বিএনপির সংসদ সদস্য আসিফা আশরাফি পাপিয়ার বক্তব্য যখন শুনি, তখন আমি টিভি পর্দায় অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। তিনি নারীদের বিরুদ্ধে আহমদ শফীর এমন ঘোরতর আপত্তিকর বক্তব্য সমর্থন করে কীভাবে তার পক্ষে বক্তব্য দিলেন, ভাবতেও পারি না। নারী সমাজের জেগে ওঠার জন্য তার দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তারাও তো কাজ করেন। কিন্তু একজন ধর্মান্ধ, নারীবিদ্বেষী এবং আইয়ামে জাহিলিয়া যুগের মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে একজন নারী হয়ে কেমন করে বিএনপির এ সাংসদ দাঁড়ান, তা বিস্ময়কেও হার মানায়। তাহলে দলীয় রাজনীতির সাময়িক সুবিধার জন্যই তিনি বললেন যে, 'আহমদ শফীর বক্তব্য বিকৃত করা হচ্ছে?' আমরাও ইসলাম ধর্মের অনুসারী। আমরা জানি, আমাদের প্রিয় নবী যখন ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেছিলেন, তখন প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বিবি খাদিজা। তার সহধর্মিণী বিবি আয়েশা উটের পিঠে চড়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এসব কথা আমরা কখনোই ভুলে যাইনি। ইসলাম নারীকে অবমাননা করেনি, ভোগের সামগ্রীও মনে করেনি। বরং রাসূল 'মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত' বলে নারী জাতিকেই মহিমান্বিত করেছিলেন। একালেও বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ জাকার্তায় আমি একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে নামাজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় নারী-পুরুষকে একসঙ্গে জোহরের নামাজ পড়তে দেখেছি। সুতরাং ইসলাম নারীকে কখনও হেয় করেনি, যা করছেন শাহ আহমদ শফীরা। যদি কেউ রাজনৈতিক স্বার্থে এ ধনের ধর্মান্ধতা আর নারীবিদ্বেষ সমর্থন করেন, তা হবে আত্মঘাতী।
সমকাল : বিএনপি সাংসদ পাপিয়া জাতীয় সংসদে বলেছেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মতো একজন আলেম ব্যক্তির বক্তব্য বিকৃত করে তাকে হেয় করার চেষ্টা হচ্ছে। পক্ষান্তরে হেফাজতের চার নায়েবে আমির এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।' তারা কিন্তু কেউই আহমদ শফীর কোনো বক্তব্য অস্বীকার করেননি। বলেছেন, 'এমন ভাষা বই-পুস্তক, বিজ্ঞাপনচিত্র, স্বাস্থ্যবিষয়ক লিফলেটে অহরহ দেখা যায়।' বিএনপি সাংসদের বক্তব্য এবং হেফাজতের বিবৃতি সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
সেলিনা হোসেন : বিরোধী দলের সংসদ সদস্য যে বক্তব্য দিয়েছেন সংসদে দাঁড়িয়ে, আমি তার সঙ্গে হেফাজতের চার নায়েবে আমিরের বক্তব্যের কোনো সঙ্গতি খুঁজে পাই না। পাপিয়া তার বক্তব্যটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মৌলবাদী দর্শনের পক্ষে দিয়েছেন। অন্যদিকে তিনি বলেছেন, শাহ আহমদ শফীর বক্তব্য বিকৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। লক্ষণীয় যে, হেফাজতে ইসলামের চার নায়েবে আমির যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেখানে তারা আহমদ শফীর বক্তব্য স্বীকার করে নিয়েই সেই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাত্র। বলেছেন, কিছু চিহ্নিত গণমাধ্যমে অপপ্রচার করা হচ্ছে তার বক্তব্য।
প্রশ্ন হলো, একজন সংসদ সদস্য, যিনি নিজেও নারী, তিনি কীভাবে এমন তীব্র ভাষায় তার বক্তব্য প্রদান করে নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন! তিনি নিজেও তার দলের একজন তরুণ নেতা। তাহলে এ দলের কাছে ভবিষ্যতে বাংলার নারী সমাজ কী প্রত্যাশা করবে? এ প্রসঙ্গেই বলতে চাই, ভবিষ্যতে বিএনপি সরকারে এলে তারা কি হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা গ্রহণ করে বাংলাদেশের নারীদের আইয়ামে জাহিলিয়া যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন? গার্মেন্ট শিল্পসহ বাইরের কর্মস্থল নারীর জন্য কি নিষিদ্ধ হবে? সংসদ সদস্য হিসেবে আজকে যারা আছেন সংসদে তাদের দরজা কি ভবিষ্যতে বন্ধ হয়ে যাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর সংসদের মাধ্যমে জানানো উচিত বলে মনে করি।
সমকাল : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সেলিনা হোসেন : আপনাকে এবং সমকালের পাঠকদেরও ধন্যবাদ।
সেলিনা হোসেন : তাকে আমার আইয়ামে জাহিলিয়া যুগের মানুষ মনে হয়েছে, যখন কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলে জ্যান্ত কবর দেওয়া হতো। আহমদ শফী এই একবিংশ শতাব্দীর মানুষ নন। চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা_ সবকিছু মিলিয়ে আদিম বর্বর যুগের একজন বলেই মনে হয়েছে তার ভিডিও বক্তব্য শুনে।
সমকাল :তিনি মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন, বিশেষ করে কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ূয়া মেয়েদের চরিত্র নিয়ে কথা বলেছেন। নারী শিক্ষা নিয়ে তার এই দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সেলিনা হোসেন : এটা ব্যাখ্যা করাও আমি প্রচণ্ডভাবে অযৌক্তিক বলে মনে করি। যে বক্তব্যের পেছনে কোনো যুক্তি থাকে না, যে বক্তব্য বিবেকহীন অন্ধতার শামিল, তাকে আমরা ঘৃণা করতে পারি। এর বেশি আরও যদি কিছু থাকে, সেটাই করা উচিত। আগেই বলেছি, তিনি একুশ শতকের মানুষ নন। এখন থেকে একশ' বছরেরও বেশি সময় আগে আমাদের একজন অসাধারণ মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষার জন্য যে অমানুষিক পরিশ্রম করে মেয়েদের ঘরের বাইরে টেনে এনে শিক্ষার মুখোমুখি করার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই ইতিহাস কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের একজন প্রধানের জানা উচিত বলে মনে করি। ভাবতে পারি না যে, তিনি বিষয়টি জানেন না। এই জানা থেকে তিনি মেয়েদের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেছেন। এটা ধরে নেওয়া এ মুহূর্তে সঙ্গত মনে করছি না। কারণ উচ্চশিক্ষাঙ্গনের মেয়েদের চরিত্র সম্পর্কে তিনি যে অশালীন মন্তব্য করেছেন, উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের সম্পর্কে যে ঢালাও নিন্দা করেছেন, তা ভাবতেও ক্রোধে মাথায় রক্ত উঠে যায়। মাত্র গত সপ্তাহে পাকিস্তানের ১৬ বছরের কিশোরী মালালা জাতিসংঘে বক্তৃতা করেছে। সে বক্তৃতায় নারী শিক্ষার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার কথা বিশ্ববাসীর কাছে নতুন করে তুলে ধরেছে, আমাদের কওমি মাদ্রাসার একজন শিক্ষক এ বক্তব্য টেলিভিশনে দেখেননি বা কোনো সংবাদপত্রে পড়েননি_ ভাবতে পারি না। যদিও কুসংস্কারবশত জ্ঞান-বিজ্ঞানের দরজা তারা বহুকাল ধরেই বন্ধ করে রেখেছেন। নারী শিক্ষার প্রবক্তা হিসেবে তালেবানদের হাতে আক্রান্ত মালালাকে বিশ্ববাসী স্যালুট করেছে। বাংলাদেশের মেয়েদের শিক্ষার বিরুদ্ধে এমন অশালীন উপদেশ দিয়ে আহমদ শফী দেশের মর্যাদাকেই ক্ষুণ্ন করেছেন।
সমকাল : নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ শুধু এশিয়ার নয়, আমরা মনে করি, এখন বিশ্ব প্রেক্ষাপটেই একটি রোল মডেল। এ অবস্থায় হাটহাজারী মাদ্রাসার এই প্রবীণ শিক্ষক হেফাজত নেতা যেসব কথা বলেছেন তা ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে বহির্বিশ্বেও পেঁৗছে গেছে। এতে বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে কীভাবে দেখবে?
সেলিনা হোসেন : আমরা এ বক্তব্যকে হেয়প্রতিপন্ন করে নারীর ক্ষমতায়নের যে জায়গা তৃণমূল পর্যায় থেকে তৈরি হতে দেখেছি, তা আজকে বিশ্ববাসীর কাছে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একজন আহমদ শফী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা বিশ্ববাসীর কাছে কোনো পাত্তা পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থায় জেন্ডার ইকুয়ালিটির যে জায়গাটি তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে পিছু হটে যেতে পারবে না। আমাদের মেয়েরা, আগেই বলেছি_ তৃণমূল থেকে সর্বত্র সচেতনভাবে এ জায়গাটি পরিচর্যা করেছে। তারা জানে তারা কখনোই কওমি মাদ্রাসায় পড়তে যাবে না। তাদের জন্য অন্যসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা খোলা। তারা নিজেরাই নিজেদের জায়গাটি প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের মাধ্যমে অক্ষুণ্ন রাখবে।
সমকাল : কিন্তু বিশ্ববাসীর কাছে পাত্তা না পেলেও দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াবে না? যেখানে আমাদের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ এখনও নিরক্ষর এবং পশ্চাৎপদ।
সেলিনা হোসেন : আমি গ্রামগঞ্জে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষ লক্ষ্য করেছি, মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে তাদের কোনো দ্বিধা নেই। বিশেষ করে নিরক্ষর পরিবারের বাবা-মাও মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেন। সরকার প্রদত্ত উপবৃত্তি তাদের চেতনার জায়গাটিকে অনেক অগ্রসর করে দিয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক মেয়েকেই পেয়েছি, যারা ঘরে সকালের পান্তা না খেয়ে খালি পেটেই স্কুলে চলে এসেছে। আমি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। এমনকি দরিদ্র বাবা-মা মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করার জন্য আমার কাছে কীভাবে স্কলারশিপ পাওয়া যাবে, সে কথাও জানতে চেয়েছেন। এই জনসংখ্যার ১০ শতাংশ যদি মেয়েদের প্রতি শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীন থাকেন, তাহলে বলতেই হবে এটি কোনো বড় সংখ্যা নয়। আমার বিশ্বাস, আগামী কয়েক বছরেই মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার আর কোনো বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত থাকবে না।
সমকাল : আপনি নারী শিক্ষা এবং অধিকার নিয়েও কাজ করেন। আহমদ শফীর এ বক্তব্য বা নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে এমন উগ্র পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?
সেলিনা হোসেন : আমি মনে করি, এর প্রধান কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে আসা এবং দেশের সামগ্রিক উন্নতিতে তাদের অংশগ্রহণ একজন ধর্মান্ধ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। কারণ তার দৃষ্টি সামনে প্রসারিত নয়। নারীকে অবদমিত রেখে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে, শিক্ষা ও তার অধিকার সচেতনতার বোধ রুদ্ধ রেখে একতরফা ভোগ-লালসার সামগ্রীতে পরিণত করে রাখার জন্যই এমন বক্তব্য যে, নারী শুধু স্বামীর সংসারের আসবাবপত্র দেখাশোনা করবে। এর দ্বারা এ-ও প্রমাণিত হয়_ হেফাজতে ইসলাম নামক সংগঠনটি নারীর মানবাধিকার স্বীকার করে না। এ সংগঠনের তরুণরা যদি একইভাবে নারীর প্রতি এ রকম বিদ্বেষমূলক আচরণ করতে থাকেন, তবে সমাজকে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে এবং তারা যা খুশি তা করার সুযোগটি ভোগ করবেন। আরও একটি কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রযাত্রার এ সময়ে শিক্ষিত নারীরা তাদের সন্তানদের কওমি মাদ্রাসার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে চাইবেন না। ফলে তারা পরবর্তী প্রজন্মকে হারিয়ে নিজেদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হতে দেখবেন। শাহ আহমদ শফীর উগ্র নারীবিদ্বেষের কারণ হিসেবে এসব কথাও বিবেচনায় আসে।
সমকাল : একটু আগেই আপনি বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম নারীর মৌলিক মানবাধিকারে বিশ্বাস করে না_ সঙ্গত কারণেই আমাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের সঙ্গে আহমদ শফীর পুরো বক্তব্য সাংঘর্ষিক। আপনি কি মনে করেন, সংবিধানবিরোধী বক্তব্যের কারণে তিনি আইনের আওতায় আসতে পারেন?
সেলিনা হোসেন : অবশ্যই। সংবিধানে যেখানে নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবেন_ এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, সেখানে নারী বলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন না, বাইরে কর্মক্ষেত্রে যেতে পারবেন না, নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে অশ্লীল ভাষায় ভোগের সামগ্রী বলে প্রচার করবেন, তিনি তো আইনের চোখে ছাড় পেতে পারেন না। যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন, সেখানেই প্রতিটি মানুষকে তার বক্তব্যের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। তিনি তার বাইরের কেউ নন।
সমকাল :শাহ আহমদ শফী জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সোচ্চার বক্তব্য রেখেছেন এবং উচ্চশিক্ষিত নারীদের পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা শিক্ষাঙ্গনেই নষ্ট হয়ে যায় বলে অভিমত দিয়েছেন, তিনি জানতে চান পুত্রসন্তান না হলে বংশ কে রক্ষা করবে? এ বক্তব্যের প্রভাব কি সমাজে পড়বে না?
সেলিনা হোসেন : নিরক্ষর, অসচেতন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতেই পারেন। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা এ সময়ের কোনো সুস্থ মানুষের চিন্তার ফসল নয়। প্রতিটি দেশই তার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং উৎপাদিত পণ্য দিয়ে দেশের মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার চিন্তা করে। সেখানে সীমিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে জীবনমানের উন্নয়নের জন্যই পরিকল্পিত পরিবারের কথা বিশ্বের সব উন্নত দেশই চিন্তা করে। যার ফলে প্রতিটি শিশুই উন্নত জীবনমান অর্জনের সুযোগ পায়। যারা মানুষের জন্য, সমাজের জন্য এই পরিকল্পিত পরিবারের কথা অস্বীকার করে, তারা এক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করছে বলে বিবেচনা করাই যায়। যেখানে সরকার যুগ যুগ ধরে পরিকল্পিত জনসংখ্যার পক্ষে কাজ করছে, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে এই কর্মসূচি সফল করতে, ইতিমধ্যে বহু পরিবার এর সুফলও ভোগ করছে, সেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য জনসমাবেশে এমন বিষোদ্গার রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করারই শামিল। আমরা জানি না, সরকার আহমদ শফীর এত বড় চ্যালেঞ্জকে শুধু নিন্দা-সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে কি-না।
সমকাল : কিন্তু তিনি যে বলেছেন উচ্চশিক্ষিত নারীরা শিক্ষাঙ্গনেই পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, প্রশ্ন করেছেন পুত্রসন্তান না হলে বংশ পরিচয় রক্ষা করবে কে?
সেলিনা হোসেন : মেডিকেল সায়েন্সবিবর্জিত এ ধরনের বিদ্বেষপ্রসূত মনগড়া বক্তব্য দিয়েছেন তিনি নারীর উচ্চশিক্ষা চান না বলে। যাতে মানুষের ধারণা খারাপ হয় উচ্চশিক্ষিত নারীর প্রতি। এমন ঘৃণা ছড়ানোর জন্য যে কেউ তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয়ও নিতে পারেন। আর বংশ রক্ষা? বংশ কি শুধু পুত্রসন্তান দিয়ে রক্ষা করা যায়? যে পিতা কন্যাসন্তানের জন্মদান করেন, তিনি কীভাবে সেই মেয়েটিকে তার বংশ রক্ষা থেকে বঞ্চিত করবেন? আজকের দিনে একথা প্রকৃতই সত্য যে, পিতা-মাতার ধারাবাহিকতা কন্যাসন্তানও রক্ষা করে। আহমদ শফীকে প্রশ্ন করতে চাই যে, আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো পুত্রসন্তানের জন্য আক্ষেপ কিংবা বংশ রক্ষার কথা তো বলেননি। তাহলে এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
সমকাল : গার্মেন্ট শিল্পে কর্মরত হাজার হাজার নারীর প্রতি শাহ আহমদ শফীর যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা আপনি তার বক্তব্য থেকেই জেনেছেন। কঠোর ভাষায় তিনি মেয়েদের উচ্চশিক্ষার মতো চাকরিরও বিরোধিতা করছেন। বলেছেন, চাকরিজীবী 'মেয়েরা জেনা করে উপার্জন করে।'
সেলিনা হোসেন : এ ক্ষেত্রেও তার বর্বর মানসিকতাই প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বুঝে না বুঝে এমন সব কথা কীভাবে উচ্চারণ করলেন, তা আমার বোধগম্য নয়। নাকি তিনি বিষয়টিকে পুরো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তালেবানদের মতাদর্শ প্রচারের চেষ্টা করছেন। যে দেশের হাজার হাজার মেয়ে গার্মেন্ট শিল্পে কাজ করে দেশের রেমিট্যান্সের বিশাল অঙ্ক অর্থনীতিতে সংযোজন করছে, নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছে, দারিদ্র্যজর্জর পরিবারকেও দু'বেলা দু'মুঠো অন্নের সংস্থান করছে, সেখানে এত বড় একটি জনগোষ্ঠীর অবমাননা করা ধৃষ্টতার শামিল। আসলে তার বিকৃত মানসিকতাই এর দ্বারা প্রকাশ পেয়েছে।
সমকাল : একটু আগে সংশয় প্রকাশ করেছেন এ বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কি-না। আহমদ শফীর নেতৃত্বে যে কওমি মাদ্রাসার সংগঠন হেফাজতে ইসলাম, তা তো এখন রাজনৈতিকভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে গত ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে তাদের অবস্থান এবং পরবর্তী ভূমিকা আপনিও জানেন। আমাদের বিরোধী দল হেফাজতের পক্ষে। তাহলে কি নারীর উচ্চশিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের বিরুদ্ধে দেশের প্রধান বিরোধী দল অবস্থান নিয়েছে?
সেলিনা হোসেন : অবস্থাদৃষ্টে সে প্রশ্ন তো এখন জাগতেই পারে। বড় ভয়ের কথা। গত রোববার টেলিভিশনে বিএনপির সংসদ সদস্য আসিফা আশরাফি পাপিয়ার বক্তব্য যখন শুনি, তখন আমি টিভি পর্দায় অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। তিনি নারীদের বিরুদ্ধে আহমদ শফীর এমন ঘোরতর আপত্তিকর বক্তব্য সমর্থন করে কীভাবে তার পক্ষে বক্তব্য দিলেন, ভাবতেও পারি না। নারী সমাজের জেগে ওঠার জন্য তার দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তারাও তো কাজ করেন। কিন্তু একজন ধর্মান্ধ, নারীবিদ্বেষী এবং আইয়ামে জাহিলিয়া যুগের মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে একজন নারী হয়ে কেমন করে বিএনপির এ সাংসদ দাঁড়ান, তা বিস্ময়কেও হার মানায়। তাহলে দলীয় রাজনীতির সাময়িক সুবিধার জন্যই তিনি বললেন যে, 'আহমদ শফীর বক্তব্য বিকৃত করা হচ্ছে?' আমরাও ইসলাম ধর্মের অনুসারী। আমরা জানি, আমাদের প্রিয় নবী যখন ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেছিলেন, তখন প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বিবি খাদিজা। তার সহধর্মিণী বিবি আয়েশা উটের পিঠে চড়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এসব কথা আমরা কখনোই ভুলে যাইনি। ইসলাম নারীকে অবমাননা করেনি, ভোগের সামগ্রীও মনে করেনি। বরং রাসূল 'মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত' বলে নারী জাতিকেই মহিমান্বিত করেছিলেন। একালেও বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ জাকার্তায় আমি একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে নামাজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় নারী-পুরুষকে একসঙ্গে জোহরের নামাজ পড়তে দেখেছি। সুতরাং ইসলাম নারীকে কখনও হেয় করেনি, যা করছেন শাহ আহমদ শফীরা। যদি কেউ রাজনৈতিক স্বার্থে এ ধনের ধর্মান্ধতা আর নারীবিদ্বেষ সমর্থন করেন, তা হবে আত্মঘাতী।
সমকাল : বিএনপি সাংসদ পাপিয়া জাতীয় সংসদে বলেছেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মতো একজন আলেম ব্যক্তির বক্তব্য বিকৃত করে তাকে হেয় করার চেষ্টা হচ্ছে। পক্ষান্তরে হেফাজতের চার নায়েবে আমির এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।' তারা কিন্তু কেউই আহমদ শফীর কোনো বক্তব্য অস্বীকার করেননি। বলেছেন, 'এমন ভাষা বই-পুস্তক, বিজ্ঞাপনচিত্র, স্বাস্থ্যবিষয়ক লিফলেটে অহরহ দেখা যায়।' বিএনপি সাংসদের বক্তব্য এবং হেফাজতের বিবৃতি সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
সেলিনা হোসেন : বিরোধী দলের সংসদ সদস্য যে বক্তব্য দিয়েছেন সংসদে দাঁড়িয়ে, আমি তার সঙ্গে হেফাজতের চার নায়েবে আমিরের বক্তব্যের কোনো সঙ্গতি খুঁজে পাই না। পাপিয়া তার বক্তব্যটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মৌলবাদী দর্শনের পক্ষে দিয়েছেন। অন্যদিকে তিনি বলেছেন, শাহ আহমদ শফীর বক্তব্য বিকৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। লক্ষণীয় যে, হেফাজতে ইসলামের চার নায়েবে আমির যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেখানে তারা আহমদ শফীর বক্তব্য স্বীকার করে নিয়েই সেই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাত্র। বলেছেন, কিছু চিহ্নিত গণমাধ্যমে অপপ্রচার করা হচ্ছে তার বক্তব্য।
প্রশ্ন হলো, একজন সংসদ সদস্য, যিনি নিজেও নারী, তিনি কীভাবে এমন তীব্র ভাষায় তার বক্তব্য প্রদান করে নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন! তিনি নিজেও তার দলের একজন তরুণ নেতা। তাহলে এ দলের কাছে ভবিষ্যতে বাংলার নারী সমাজ কী প্রত্যাশা করবে? এ প্রসঙ্গেই বলতে চাই, ভবিষ্যতে বিএনপি সরকারে এলে তারা কি হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা গ্রহণ করে বাংলাদেশের নারীদের আইয়ামে জাহিলিয়া যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন? গার্মেন্ট শিল্পসহ বাইরের কর্মস্থল নারীর জন্য কি নিষিদ্ধ হবে? সংসদ সদস্য হিসেবে আজকে যারা আছেন সংসদে তাদের দরজা কি ভবিষ্যতে বন্ধ হয়ে যাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর সংসদের মাধ্যমে জানানো উচিত বলে মনে করি।
সমকাল : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সেলিনা হোসেন : আপনাকে এবং সমকালের পাঠকদেরও ধন্যবাদ।
No comments