গোলাম আযমের বিচার-লাভ-লোকসানের হিসাব নয় by অনিরুদ্ধ আহমেদ
গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধ বিচারের রায়ে
বাংলাদেশের মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। যে ব্যক্তি ১৯৭১ সালে বাঙালি
হত্যার নাটের গুরু ছিলেন এবং একাত্তর-পরবর্তী সময়েও যিনি বাংলাদেশের
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন,
বিদেশে
বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং রক্তের বিনিময়ে অর্জিত
বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, দেশদ্রোহিতা করেছেন বাঙালির
সঙ্গে, তার একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত ছিল মৃত্যুদণ্ড। বাংলাদেশের আইনে
স্বীকৃত এই সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিষয়ক
ট্রাইব্যুনালের ব্যর্থতাকে অনেকেই গোটা জাতির জন্য লজ্জার বিষয় বলে মনে
করছেন। গোলাম আযমের অপরাধগুলো মৃত্যুদণ্ডযজ্ঞ অপরাধ এ কথা স্বীকার করে
নিয়েও ট্রাইব্যুনাল যখন বলেন, তার বয়স ও অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে সব
অপরাধের জন্য মোট ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো_ তখন প্রথমত, অনেকেরই যথার্থ
জিজ্ঞাসা যে গোলাম আযম যখন বাংলার মাটিতে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও
লুণ্ঠনে উৎসাহিত করেছেন রাজাকার-আলবদরসহ সব স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে, তখন
তারা কেউই বয়সের ব্যাপারটি গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে শুরু
করে দুগ্ধপোষ্য শিশু কেউ বাদ পড়েনি সেই নির্যাতন থেকে। দ্বিতীয়ত, যে
মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গোলাম আযমের বিচার হলো, সেই বিচারের রায় তার
প্রতি উদার মানবিকতা প্রদর্শনের অবকাশই-বা কতটুকু? এ জিজ্ঞাসাই বাংলাদেশের
মানুষকে বিস্মিত করেছে এই রায়ে। একাত্তরের ট্র্যাজেডি নিয়ে যে গভীর ক্ষত
রয়েছে আমাদের মর্মমূলে সেই ক্ষত উপশমে ব্যর্থ হয়েছে এ রায়। সে জন্যই দেখি,
প্রতিবাদে আবারও ফুঁসে উঠেছে মানুষ। প্রজন্ম চত্বরে আরও একবার গণজাগরণ
ঘটেছে বাংলাদেশের মানুষের। কিন্তু আমাদের এই ক্ষোভ, উষ্মা ও ক্রোধের পেছনে
যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে অযৌক্তিক অসামঞ্জস্য রয়েছে সেটা যেমন বলাই
বাহুল্য, তেমনি রয়েছে আরও কিছু কারণ, যা বাংলাদেশের মানুষকে করেছে শঙ্কিত।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল কাউকেই এখন আর আস্থায় নিতে চাইছে না। বিরোধী দল যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় সম্পর্কে মন্তব্য করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় এবং যুদ্ধাপরাধীদের দলের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে, নিজেদের হরতালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছেলেদের ব্যবহার করে, প্রজন্ম চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চকে যখন খালেদা জিয়া পরিষ্কারভাবে নাস্তিকদের মঞ্চ বলে আখ্যায়িত করেন, তখন তাদের অবস্থানটি পরিষ্কার হয়ে পড়ে। তারেক রহমান তো এক সময় নিজামীর সঙ্গে একই মঞ্চে বসে বলেছিলেন, তারা একই পরিবারের সদস্য। নিতান্ত কৌশলগত কারণে তারা যুদ্ধাপরাধীদের সুষ্ঠু বিচারের অজুহাতে কখনও নীরব থাকেন, কখনও বলেন আওয়ামী লীগের মধ্যের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হোক। যেন তাদের বিচার না শুরু হলে গোলাম আযম গংয়ের বিচার শুদ্ধ হবে না। সুতরাং এ ব্যাপারে বিএনপি নেত্রী এবং সম্ভবত তার কারণেই যুদ্ধাপরাধীসহ সব জামায়াতির ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার। তারা অতীতে যুদ্ধাপরাধীদের পুরস্কৃত করেছেন, সুযোগ পেলে আগামীতেও করবেন। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা তাদের আদর্শিক এবং রাজনৈতিক নীতির অংশ।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা, তারা সেদিকে এগিয়েছেন অনেকটাই কিন্তু অনেক দেরি করেছেন সিদ্ধান্ত নিতে। জাতীয় নির্বাচনের কাছাকাছি এসে তারাও এখন লাভ-লোকসানের হিসাব কষছেন। অনেকেই বলে আসছিলেন যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ভরাডুবির সম্মুখীন হয়েছে, সেটি পুষিয়ে তোলার জন্য জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী উভয়কে পোষ মানানোর প্রয়োজনীয়তা সম্ভবত অনুভব করছেন আওয়ামী লীগের উচ্চ মহল। পত্রপত্রিকায় এমন খবরও দেখা গেছে, জামায়াতের কোনো কোনো নেতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার বৈঠক হয়েছে। আওয়ামী লীগ সামনের নির্বাচনে যেমন জাতীয় পার্টিকে তার জোটেই রাখতে আগ্রহী, তেমনি জামায়াতে ইসলামীকে ১৮ দলীয় জোট থেকে বের করে নিয়ে আসতেও আগ্রহী হতেই পারে। ভোটের গাণিতিক হিসাবে, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জোট ভাঙা-গড়ার রেওয়াজ বহু দেশেই আছে। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ যদি সত্যি সত্যি কোনো রকম আঁতাত করে থাকে তাহলে নিশ্চিত বলা যায় যে, সেটি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি বা অন্যান্য দলের মতো কোনো দল নয় যে তাদের সঙ্গে কোনো রকম আঁতাত বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে। আদালতের রায়েও কেবল গোলাম আযম নন, খোদ জামায়াতে ইসলামীকেও দেশদ্রোহী দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং এ দলটির সঙ্গে অতীতে আওয়ামী লীগ যতই একত্রে আন্দোলন করুক না কেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর আর কোনো সম্পর্ক রাখার অবকাশ নেই। আওয়ামী লীগ তেমন কিছু যদি করার চেষ্টা করে, এমনকি স্রেফ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও, তা হলে দলটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে এবং মুক্তিযুদ্ধের দল বলে তাদের নিজেদের দাবি করার কোনো অধিকারই থাকবে না। স্মরণ করা যেতে পারে যে, আওয়ামী-জামায়াতের সম্ভাব্য আঁতাত অনুমানেই শাহবাগে প্রজন্ম চত্বরের জন্ম, যখন মানুষ মনে করল যে কাদের মোল্লার গুরুতর অপরাধে লঘুতর শাস্তি দেওয়ার পেছনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া একটি কারণ। আরও স্মরণ করা যেতে পারে, ওই রায়ের আগে জামায়াত-শিবির ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল পুলিশদের, পরে অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তনে সেই পুলিশদেরই পিটিয়ে হত্যা করেছে জামায়াতি সন্ত্রাসীরা। সুতরাং সাধারণ মানুষের এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, ভোটের ঝোল নিজের কোলে টানার জন্য, জামায়াতকে কিছুটা ছাড় দিতে পারে আওয়ামী লীগ। এ ঘটনা হবে আওয়ামী লীগের জন্য ততটাই আত্মঘাতী যতটা হয়েছিল, ঢাকা শহরে হেফাজতিদের সভা করার অনুমতি দেওয়া। এখানেও স্মর্তব্য যে, গণজাগরণ মঞ্চে আক্রমণ করা সত্ত্বেও, হেফাজতে ইসলামের প্রথম সভার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে সেটাকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বলেছিলেন সেই অসত্য উচ্চারণের কথাও। হেফাজতের দ্বিতীয় সমাবেশের সময়ে তো আওয়ামী-মেহমানরা জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রায় সরকারেরই পতন ঘটাতে চলেছিল। এতসব ঘটনা সত্ত্বেও জামায়াতকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের কারণেই কি গোলাম আযম মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেলেন? যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে তাতে আওয়ামী লীগই শেষে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি এবং দেশের মানুষ জিম্মি হয়ে পড়বে একাত্তরের অপরাধীদের কাছে।
এত বিচার-বিশ্লেষণের পরও, অনেক ক্ষোভ ও হতাশা নিয়েও আমি বলব যে, এই ট্রাইব্যুনালের রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবার জন্যই হবে আত্মঘাতী। জামায়াত-বিএনপি জোট এবং যুদ্ধাপরাধীরা বরাবর বলে এসেছে, এই ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়, নিরপেক্ষও নয়, তাদের এই দাবিকে যৌক্তিকতা প্রদান করবে যদি গণজাগরণ মঞ্চসহ দেশের জনগণও এ কথা বলতে থাকে। মনে রাখা প্রয়োজন যে এই প্রথম গোলাম আযম দেশের বৈধ আইন ব্যবস্থার আওতায় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে স্বীকৃত হলেন, চিহ্নিত হলেন। ট্রাইব্যুনাল স্পষ্টই বলেছেন তিনি যে অপরাধ করেছেন, তার জন্য মৃত্যুদণ্ডই হতে পারত তার যোগ্য শাস্তি। ট্রাইব্যুনালের এই রায় কি আমাদের উল্লেখযোগ্য বিজয় নয়? এই তো প্রথম ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কিংবা প্রজন্ম চত্বরের বাইরে, আদালত কক্ষে, সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে, প্রতিষ্ঠিত হলো বিয়ালি্লশ বছর পর এই সত্যটি যে গোলাম আযম কোনো রাজনৈতিক বৈরিতার শিকার নন, তিনি যুদ্ধাপরাধের হোতা। যে ৯০ বছরের কারাদণ্ড তাকে দেওয়া হলো, সে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই, গোলাম আযমের জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি হিসেবে তিলে তিলে তার এই শাস্তিটি কম কিসের?
তবে দ্বিতীয় যে আশঙ্কা রয়েছে জনমনে তা হলো আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই যুদ্ধাপরাধীর কারাদণ্ডের মেয়াদ হয়তো ছয় মাস পরই ফুরিয়ে যাবে। সেই আশঙ্কা থেকেই গণজাগরণ মঞ্চের এই প্রতিবাদ। অনুমান করা যায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন রাষ্ট্রপক্ষও। সেই আপিলে গোলাম আযমের প্রাণদণ্ডের সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না। আর আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যারাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করে এ ব্যাপারে আপস করে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করবে, তাদের চওড়া মূল্য দিতে হবে শিগগিরই। তবে গোলাম আযমসহ সব যুদ্ধাপরাধীর শাস্তির দাবিদার কারও উচিত হবে না এমন কিছু করা, যা কি-না যুদ্ধাপরাধীদের হাতকেই শক্ত করবে। বাঙালি জাতি ৪২ বছর ধৈর্য ধরেছে। এ ব্যাপারে আমরা এগিয়েছি অনেক দূর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যথার্থ আইন অনুমোদিত হয়েছে, দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে, বিচারকাজও সম্পন্ন হতে চলেছে। তাই যুদ্ধাপরাধীদের যথার্থ শাস্তি যখন আসন্ন, তখন আমরা কেউ যেন কোনোভাবেই আত্মঘাতী না হই।
স অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী
সাংবাদিক ও বিশ্লেষক
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল কাউকেই এখন আর আস্থায় নিতে চাইছে না। বিরোধী দল যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় সম্পর্কে মন্তব্য করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় এবং যুদ্ধাপরাধীদের দলের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে, নিজেদের হরতালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছেলেদের ব্যবহার করে, প্রজন্ম চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চকে যখন খালেদা জিয়া পরিষ্কারভাবে নাস্তিকদের মঞ্চ বলে আখ্যায়িত করেন, তখন তাদের অবস্থানটি পরিষ্কার হয়ে পড়ে। তারেক রহমান তো এক সময় নিজামীর সঙ্গে একই মঞ্চে বসে বলেছিলেন, তারা একই পরিবারের সদস্য। নিতান্ত কৌশলগত কারণে তারা যুদ্ধাপরাধীদের সুষ্ঠু বিচারের অজুহাতে কখনও নীরব থাকেন, কখনও বলেন আওয়ামী লীগের মধ্যের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হোক। যেন তাদের বিচার না শুরু হলে গোলাম আযম গংয়ের বিচার শুদ্ধ হবে না। সুতরাং এ ব্যাপারে বিএনপি নেত্রী এবং সম্ভবত তার কারণেই যুদ্ধাপরাধীসহ সব জামায়াতির ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার। তারা অতীতে যুদ্ধাপরাধীদের পুরস্কৃত করেছেন, সুযোগ পেলে আগামীতেও করবেন। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা তাদের আদর্শিক এবং রাজনৈতিক নীতির অংশ।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা, তারা সেদিকে এগিয়েছেন অনেকটাই কিন্তু অনেক দেরি করেছেন সিদ্ধান্ত নিতে। জাতীয় নির্বাচনের কাছাকাছি এসে তারাও এখন লাভ-লোকসানের হিসাব কষছেন। অনেকেই বলে আসছিলেন যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ভরাডুবির সম্মুখীন হয়েছে, সেটি পুষিয়ে তোলার জন্য জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী উভয়কে পোষ মানানোর প্রয়োজনীয়তা সম্ভবত অনুভব করছেন আওয়ামী লীগের উচ্চ মহল। পত্রপত্রিকায় এমন খবরও দেখা গেছে, জামায়াতের কোনো কোনো নেতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার বৈঠক হয়েছে। আওয়ামী লীগ সামনের নির্বাচনে যেমন জাতীয় পার্টিকে তার জোটেই রাখতে আগ্রহী, তেমনি জামায়াতে ইসলামীকে ১৮ দলীয় জোট থেকে বের করে নিয়ে আসতেও আগ্রহী হতেই পারে। ভোটের গাণিতিক হিসাবে, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জোট ভাঙা-গড়ার রেওয়াজ বহু দেশেই আছে। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ যদি সত্যি সত্যি কোনো রকম আঁতাত করে থাকে তাহলে নিশ্চিত বলা যায় যে, সেটি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি বা অন্যান্য দলের মতো কোনো দল নয় যে তাদের সঙ্গে কোনো রকম আঁতাত বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে। আদালতের রায়েও কেবল গোলাম আযম নন, খোদ জামায়াতে ইসলামীকেও দেশদ্রোহী দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং এ দলটির সঙ্গে অতীতে আওয়ামী লীগ যতই একত্রে আন্দোলন করুক না কেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর আর কোনো সম্পর্ক রাখার অবকাশ নেই। আওয়ামী লীগ তেমন কিছু যদি করার চেষ্টা করে, এমনকি স্রেফ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও, তা হলে দলটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে এবং মুক্তিযুদ্ধের দল বলে তাদের নিজেদের দাবি করার কোনো অধিকারই থাকবে না। স্মরণ করা যেতে পারে যে, আওয়ামী-জামায়াতের সম্ভাব্য আঁতাত অনুমানেই শাহবাগে প্রজন্ম চত্বরের জন্ম, যখন মানুষ মনে করল যে কাদের মোল্লার গুরুতর অপরাধে লঘুতর শাস্তি দেওয়ার পেছনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া একটি কারণ। আরও স্মরণ করা যেতে পারে, ওই রায়ের আগে জামায়াত-শিবির ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল পুলিশদের, পরে অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তনে সেই পুলিশদেরই পিটিয়ে হত্যা করেছে জামায়াতি সন্ত্রাসীরা। সুতরাং সাধারণ মানুষের এটা মনে করা স্বাভাবিক যে, ভোটের ঝোল নিজের কোলে টানার জন্য, জামায়াতকে কিছুটা ছাড় দিতে পারে আওয়ামী লীগ। এ ঘটনা হবে আওয়ামী লীগের জন্য ততটাই আত্মঘাতী যতটা হয়েছিল, ঢাকা শহরে হেফাজতিদের সভা করার অনুমতি দেওয়া। এখানেও স্মর্তব্য যে, গণজাগরণ মঞ্চে আক্রমণ করা সত্ত্বেও, হেফাজতে ইসলামের প্রথম সভার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে সেটাকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বলেছিলেন সেই অসত্য উচ্চারণের কথাও। হেফাজতের দ্বিতীয় সমাবেশের সময়ে তো আওয়ামী-মেহমানরা জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রায় সরকারেরই পতন ঘটাতে চলেছিল। এতসব ঘটনা সত্ত্বেও জামায়াতকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের কারণেই কি গোলাম আযম মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেলেন? যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে তাতে আওয়ামী লীগই শেষে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি এবং দেশের মানুষ জিম্মি হয়ে পড়বে একাত্তরের অপরাধীদের কাছে।
এত বিচার-বিশ্লেষণের পরও, অনেক ক্ষোভ ও হতাশা নিয়েও আমি বলব যে, এই ট্রাইব্যুনালের রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবার জন্যই হবে আত্মঘাতী। জামায়াত-বিএনপি জোট এবং যুদ্ধাপরাধীরা বরাবর বলে এসেছে, এই ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়, নিরপেক্ষও নয়, তাদের এই দাবিকে যৌক্তিকতা প্রদান করবে যদি গণজাগরণ মঞ্চসহ দেশের জনগণও এ কথা বলতে থাকে। মনে রাখা প্রয়োজন যে এই প্রথম গোলাম আযম দেশের বৈধ আইন ব্যবস্থার আওতায় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে স্বীকৃত হলেন, চিহ্নিত হলেন। ট্রাইব্যুনাল স্পষ্টই বলেছেন তিনি যে অপরাধ করেছেন, তার জন্য মৃত্যুদণ্ডই হতে পারত তার যোগ্য শাস্তি। ট্রাইব্যুনালের এই রায় কি আমাদের উল্লেখযোগ্য বিজয় নয়? এই তো প্রথম ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কিংবা প্রজন্ম চত্বরের বাইরে, আদালত কক্ষে, সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে, প্রতিষ্ঠিত হলো বিয়ালি্লশ বছর পর এই সত্যটি যে গোলাম আযম কোনো রাজনৈতিক বৈরিতার শিকার নন, তিনি যুদ্ধাপরাধের হোতা। যে ৯০ বছরের কারাদণ্ড তাকে দেওয়া হলো, সে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই, গোলাম আযমের জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি হিসেবে তিলে তিলে তার এই শাস্তিটি কম কিসের?
তবে দ্বিতীয় যে আশঙ্কা রয়েছে জনমনে তা হলো আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই যুদ্ধাপরাধীর কারাদণ্ডের মেয়াদ হয়তো ছয় মাস পরই ফুরিয়ে যাবে। সেই আশঙ্কা থেকেই গণজাগরণ মঞ্চের এই প্রতিবাদ। অনুমান করা যায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন রাষ্ট্রপক্ষও। সেই আপিলে গোলাম আযমের প্রাণদণ্ডের সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না। আর আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যারাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করে এ ব্যাপারে আপস করে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করবে, তাদের চওড়া মূল্য দিতে হবে শিগগিরই। তবে গোলাম আযমসহ সব যুদ্ধাপরাধীর শাস্তির দাবিদার কারও উচিত হবে না এমন কিছু করা, যা কি-না যুদ্ধাপরাধীদের হাতকেই শক্ত করবে। বাঙালি জাতি ৪২ বছর ধৈর্য ধরেছে। এ ব্যাপারে আমরা এগিয়েছি অনেক দূর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যথার্থ আইন অনুমোদিত হয়েছে, দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে, বিচারকাজও সম্পন্ন হতে চলেছে। তাই যুদ্ধাপরাধীদের যথার্থ শাস্তি যখন আসন্ন, তখন আমরা কেউ যেন কোনোভাবেই আত্মঘাতী না হই।
স অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী
সাংবাদিক ও বিশ্লেষক
No comments