মধ্যপ্রাচ্য সিরিয়ায় কাকে অস্ত্র দেবে যুক্তরাষ্ট্র? by রবার্ট ফিস্ক
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এখন
বেজায় খুশি। এত দিন তাঁর কোনো মন্ত্রী বা জেনারেল পক্ষ ত্যাগ করে
বিদ্রোহীদের দলে যোগ দেওয়া মাত্রই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হাততালি
দিয়েছিল।
আসাদ সরকারের মধ্যে যেকোনো ভাঙন দেখা দিলেই তারা
বলেছে, সরকার ‘ভেঙে পড়ার মুখে’। আর এখন হঠাৎ জানা যাচ্ছে, আসাদের শত্রুরাই
কোন্দলে লিপ্ত। মাসের পর মাস ধরে আসাদের পক্ষের লোকজন এ কথাই বলে আসছিল
এবং এখন তা-ই সত্য হয়ে দেখা দিল। আসাদ বিদ্রোহীদের মধ্যকার অন্তঃকোন্দলে
নিহত কামাল হামামি ও তাঁর ভাইয়ের লাশই প্রমাণ করে যে বিদ্রোহীরা বিভক্ত হয়ে
গেছে। ইসলামপন্থী আর ফ্রি সিরিয়ান আর্মি সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।
শিগগিরই ওবামা আর ক্যামেরনদের (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) দম আটকে আসতে যাচ্ছে। হাজার হোক, তাঁরা চেয়েছেন—বলা ভালো, চেয়েছিলেন ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে (এফএসএ) অস্ত্রের জোগান দিতে। তাঁদের চোখে সেক্যুলার এফএসএ গণতন্ত্রের জন্য দামেস্কের ফ্যাসিবাদী সরকারের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ‘বীরের মতো’ লড়াই করছে। আর আমাদের নেতারা এখনো যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন যে এফএসএর যোদ্ধারা অস্ত্র পাওয়ার দাবিদার। তাদের অস্ত্র দেওয়া উচিত। কারণ, আল-কায়েদা জঙ্গিরা তাদের নেতাদের হত্যা করছে। এফএসএর ভালো যোদ্ধারা যদি খারাপ ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, আমাদের তো উচিত তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। তাই না?
কিন্তু ইতিহাস দেখায় যে ভালো লোকেরা খারাপ হয়ে যেতে পারে এবং দিনের শেষে খারাপই জিততে পারে। ইসলামপন্থীরা এফএসএকে একেবারে মুছে ফেললে কী হবে? তাহলে আমাদের সরবরাহ করা অস্ত্রপাতি সত্যি সত্যিই ‘ভুল হাতে’ গিয়ে পড়বে। আর কোনোভাবে এত দ্রুত তারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবে না। আর যেহেতু জানাই আছে, গৃহযুদ্ধের সময় অস্ত্রই অর্থ এবং আল নুসরাসহ অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীদের হাতে এফএসএকে দেওয়া আমাদের অস্ত্রগুলো কিনে নেওয়ার মতো যথেষ্ট অর্থ আছে। তারপর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা শুনতে না চাইলেও এই কথা ওঠে যে যদি এফএসএ তাদের সাবেক মৌলবাদী মিত্রদের হাত থেকে রেহাই পেতে চায়, তাহলে তাদের অনিবার্য মিত্র হবে দামেস্কে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।
ইসলামপন্থীদের বিপক্ষে দুর্বল এফএসএকে সাহায্যের ব্যাপারে আসাদ অতিমাত্রায় আগ্রহী হওয়ারই কথা (এফএসএ আসাদবিরোধী হলেও বিরোধী জোটের ভাঙন আরও তীব্র করতে আল-কায়েদা জঙ্গিদের বিপক্ষে তাদের সাহায্যে কৌশলগত সুবিধাই হবে সিরিয়ার সরকারের)। তারা হয়তো এফএসএকে সরকারি সেনাবাহিনীতে সম্মানের সঙ্গে পুনঃ যোগদানের আহ্বান জানাতে পারে। সরকারের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এক বছরেরও বেশি সময় হলো এফএসএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে এসেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য বিদ্রোহীদের আবার আসাদের পক্ষে নিয়ে আসা। এবং এ কাজে যদি তাঁরা সফল হন, তাহলে উদার হস্তে পশ্চিমাদের দেওয়া অস্ত্রগুলো ইসলামপন্থীদের ভুল হাতে যাওয়ার বদলে বাথ পার্টির ‘ভুল হাতে’ গিয়ে পৌঁছাবে।
এটাই যদি ঘটে, তাহলেও পশ্চিমা নেতাদের অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিদ্রোহীরা সব সময়ই ছত্রভঙ্গ হয়। আফগানিস্তানের রুশবিরোধী শিয়া ও সুন্নি প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের দেশ রাশিয়ার দখলে থাকা অবস্থাতেই নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে। তারা পরস্পরকে হত্যার এমন এক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যে তাতে সুযোগ হয় তালেবানদের উত্থানের। আলজেরিয়ায় মুক্তিকামী এফএনএ তার প্রতিদ্বন্দ্বী এমএনএকে, এটাও জাতীয়তাবাদী সংগঠন হলেও তাদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার অভিযোগ ছিল, ধ্বংস করে। এর পরই ১৯৬২ সালে তারা ফরাসিদের এই উত্তর আফ্রিকান উপনিবেশ থেকে চিরতরে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এমন উদাহরণ পাওয়া যায়। সে সময় একদল ফরাসি মুক্তিযোদ্ধা আরেক দল ফরাসি মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যায় নেমে পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই ব্রিটিশ সরকার যুগোস্লাভিয়ায় নাৎসিবিরোধী লড়াইয়ে রাজতন্ত্রী মিহাইলোভিচের বাহিনীকে অস্ত্রের জোগান দেয়। এটা থামে তখনই, যখন ব্রিটিশ গোয়েন্দারা প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে জানাল যে মিহাইলোভিচের যোদ্ধাদের চেয়ে কমিউনিস্টরাই বেশি জার্মানদের পরাজিত করছে। এটা জানার পর চার্চিল যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট নেতা টিটোর পক্ষে চলে যান। সে সময় এক তরুণ গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, যুদ্ধের পরে যে কমিউনিস্টরা যুগোস্লাভিয়ার ক্ষমতায় চলে যাবে, সেটা তিনি জানেন কি না। উত্তরে চার্চিল পাল্টা প্রশ্ন ছোড়েন, ‘যুদ্ধের পরে তো তুমি আর যুগোস্লাভিয়ায় গিয়ে থাকতে যাচ্ছ না?’
বাজি ধরে বলতে পারি, যুদ্ধের পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেগ সিরিয়ায় বসবাস করতে যাচ্ছেন না। তাহলেও সিরিয়ায় পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে তাঁদের বন্ধু এফএসএকে অস্ত্র জোগানোর আগে ভালোভাবে চিন্তা করে দেখা উচিত যে সেখানে আসলে শেষ পর্যন্ত কে জিততে যাচ্ছে।
ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
শিগগিরই ওবামা আর ক্যামেরনদের (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) দম আটকে আসতে যাচ্ছে। হাজার হোক, তাঁরা চেয়েছেন—বলা ভালো, চেয়েছিলেন ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে (এফএসএ) অস্ত্রের জোগান দিতে। তাঁদের চোখে সেক্যুলার এফএসএ গণতন্ত্রের জন্য দামেস্কের ফ্যাসিবাদী সরকারের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ‘বীরের মতো’ লড়াই করছে। আর আমাদের নেতারা এখনো যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন যে এফএসএর যোদ্ধারা অস্ত্র পাওয়ার দাবিদার। তাদের অস্ত্র দেওয়া উচিত। কারণ, আল-কায়েদা জঙ্গিরা তাদের নেতাদের হত্যা করছে। এফএসএর ভালো যোদ্ধারা যদি খারাপ ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, আমাদের তো উচিত তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। তাই না?
কিন্তু ইতিহাস দেখায় যে ভালো লোকেরা খারাপ হয়ে যেতে পারে এবং দিনের শেষে খারাপই জিততে পারে। ইসলামপন্থীরা এফএসএকে একেবারে মুছে ফেললে কী হবে? তাহলে আমাদের সরবরাহ করা অস্ত্রপাতি সত্যি সত্যিই ‘ভুল হাতে’ গিয়ে পড়বে। আর কোনোভাবে এত দ্রুত তারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবে না। আর যেহেতু জানাই আছে, গৃহযুদ্ধের সময় অস্ত্রই অর্থ এবং আল নুসরাসহ অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীদের হাতে এফএসএকে দেওয়া আমাদের অস্ত্রগুলো কিনে নেওয়ার মতো যথেষ্ট অর্থ আছে। তারপর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা শুনতে না চাইলেও এই কথা ওঠে যে যদি এফএসএ তাদের সাবেক মৌলবাদী মিত্রদের হাত থেকে রেহাই পেতে চায়, তাহলে তাদের অনিবার্য মিত্র হবে দামেস্কে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।
ইসলামপন্থীদের বিপক্ষে দুর্বল এফএসএকে সাহায্যের ব্যাপারে আসাদ অতিমাত্রায় আগ্রহী হওয়ারই কথা (এফএসএ আসাদবিরোধী হলেও বিরোধী জোটের ভাঙন আরও তীব্র করতে আল-কায়েদা জঙ্গিদের বিপক্ষে তাদের সাহায্যে কৌশলগত সুবিধাই হবে সিরিয়ার সরকারের)। তারা হয়তো এফএসএকে সরকারি সেনাবাহিনীতে সম্মানের সঙ্গে পুনঃ যোগদানের আহ্বান জানাতে পারে। সরকারের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এক বছরেরও বেশি সময় হলো এফএসএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে এসেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য বিদ্রোহীদের আবার আসাদের পক্ষে নিয়ে আসা। এবং এ কাজে যদি তাঁরা সফল হন, তাহলে উদার হস্তে পশ্চিমাদের দেওয়া অস্ত্রগুলো ইসলামপন্থীদের ভুল হাতে যাওয়ার বদলে বাথ পার্টির ‘ভুল হাতে’ গিয়ে পৌঁছাবে।
এটাই যদি ঘটে, তাহলেও পশ্চিমা নেতাদের অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিদ্রোহীরা সব সময়ই ছত্রভঙ্গ হয়। আফগানিস্তানের রুশবিরোধী শিয়া ও সুন্নি প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের দেশ রাশিয়ার দখলে থাকা অবস্থাতেই নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে। তারা পরস্পরকে হত্যার এমন এক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যে তাতে সুযোগ হয় তালেবানদের উত্থানের। আলজেরিয়ায় মুক্তিকামী এফএনএ তার প্রতিদ্বন্দ্বী এমএনএকে, এটাও জাতীয়তাবাদী সংগঠন হলেও তাদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার অভিযোগ ছিল, ধ্বংস করে। এর পরই ১৯৬২ সালে তারা ফরাসিদের এই উত্তর আফ্রিকান উপনিবেশ থেকে চিরতরে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এমন উদাহরণ পাওয়া যায়। সে সময় একদল ফরাসি মুক্তিযোদ্ধা আরেক দল ফরাসি মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যায় নেমে পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই ব্রিটিশ সরকার যুগোস্লাভিয়ায় নাৎসিবিরোধী লড়াইয়ে রাজতন্ত্রী মিহাইলোভিচের বাহিনীকে অস্ত্রের জোগান দেয়। এটা থামে তখনই, যখন ব্রিটিশ গোয়েন্দারা প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে জানাল যে মিহাইলোভিচের যোদ্ধাদের চেয়ে কমিউনিস্টরাই বেশি জার্মানদের পরাজিত করছে। এটা জানার পর চার্চিল যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট নেতা টিটোর পক্ষে চলে যান। সে সময় এক তরুণ গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, যুদ্ধের পরে যে কমিউনিস্টরা যুগোস্লাভিয়ার ক্ষমতায় চলে যাবে, সেটা তিনি জানেন কি না। উত্তরে চার্চিল পাল্টা প্রশ্ন ছোড়েন, ‘যুদ্ধের পরে তো তুমি আর যুগোস্লাভিয়ায় গিয়ে থাকতে যাচ্ছ না?’
বাজি ধরে বলতে পারি, যুদ্ধের পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেগ সিরিয়ায় বসবাস করতে যাচ্ছেন না। তাহলেও সিরিয়ায় পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে তাঁদের বন্ধু এফএসএকে অস্ত্র জোগানোর আগে ভালোভাবে চিন্তা করে দেখা উচিত যে সেখানে আসলে শেষ পর্যন্ত কে জিততে যাচ্ছে।
ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
No comments