সুই বলে চালুনিরে... by মাহমুদুর রহমান মান্না
১৫ জুন সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী ও খুলনা
সিটি করপোরেশন ও ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন বাংলাদেশের
রাজনীতির চালচিত্রই পাল্টে দিয়েছে। রাজনীতি, শক্তি-সাম্যের হিসাব-নিকাশও
গেছে বদলে।
সাড়ে চার বছর হয় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে।
প্রথম দিকে বছরখানেক বিরোধী দলের তেমন কোনো হুমকি ছিল না। অনতিবিলম্বে
অবশ্য বিডিআর বিদ্রোহ সরকারের জন্য একটি নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।
সরকার বিরোধী দল বিএনপিকে এ জন্য দায়ী করে কথাবার্তাও বলেছিল। কিন্তু
বিরোধী দল এ বিদ্রোহের পেছনে ছিল, সেটা কেউ তেমন একটা গ্রহণ করেনি। বিরোধী
দল প্রথমে সংসদ অধিবেশনে যোগও দিয়েছিল। কিন্তু বেশি দিন থাকেনি তারা সংসদে।
বিরোধী দলের অভিযোগ ছিল, সরকার পক্ষ সংসদে এমন অশালীন আচরণ করে যে সেখানে
তাদের পক্ষে থাকা সম্ভব হয় না। ধীরে ধীরে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। বিরোধী দল
সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। একপর্যায়ে আন্দোলনে জামায়াতকেও
তারা সঙ্গী করে।
শুরু থেকেই এ আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করতে থাকে সরকার। এমনকি মানববন্ধনেও বাধা দেয় তারা। গ্রেপ্তার করা হয় বিরোধী দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে। আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে না। তখন থেকেই আওয়ামী লীগ দম্ভ করতে শুরু করে, বিএনপি আবার কী আন্দোলন করবে! আন্দোলন করতে জানে কেবল আওয়ামী লীগ! বিএনপিকে আগে আন্দোলনের জন্য আওয়ামী লীগের স্কুলে ভর্তি হতে হবে। প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগ বোঝাতে চাইছিল যে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করতে যেমন জানে, তেমনি আন্দোলন ভাঙতেও জানে। পাঠকবৃন্দ নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন, কোনো গণতান্ত্রিক দল বা সরকার এ রকম আস্ফালন করতে পারে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাই করছিল এবং জনগণ মনে করছিল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আসলে অদম্য, অজেয়। জুন-জুলাইয়ের পাঁচটি সিটি নির্বাচন সেই ধারণা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে।
এ কথা ঠিক, বিএনপি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। বিএনপির আসলে আওয়ামী লীগের মতো আন্দোলনের ঐতিহ্য নেই। দলটি গড়ে উঠেছে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। বলা যেতে পারে, ক্ষমতা হাতে নিয়েই জন্মেছিল বিএনপি। এ ক্ষমতা যে চলে যাবে, ক্ষমতার জন্য আবার লড়াই করতে হবে- এ রকম হয়তো তাদের ভাবনাতেই ছিল না। অতএব,লড়াইয়ের জন্য যেটা প্রাথমিকভাবে দরকার মানসিক প্রস্তুতি, তাই তাদের ছিল না। খালেদা জিয়া অনেক পরে অভিজ্ঞতা দিয়ে, পুড়ে, পোড় খেয়ে সেটা বুঝেছিলেন। অতএব তিনি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সেটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিল। বিএনপি যে স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসর- সেটা জনগণের সামনে প্রচার করে সফলতা পেয়েছিল।
জামায়াত যোগ দিয়ে রীতিমতো জঙ্গি আক্রমণ করেছিল সরকারের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকার তার বিরুদ্ধে সমধিক শক্তি প্রয়োগ করেছিল এবং তাতে সফলতাও অর্জন করেছিল। খালেদা জিয়া অতঃপর হেফাজতের দিকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন। হেফাজত কী দাবিতে আন্দোলন করছে, তা দেখেননি তিনি। হেফাজতের সহযোগিতায় ক্ষমতা থেকে সরকারকে নামিয়ে দেওয়া যাবে, এ অঙ্কে তিনি সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দিয়েছিলেন। কিন্তু হেফাজতের আন্দোলনকে এক রাতে আধাঘণ্টারও কম সময়ের অপারেশনে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল সরকার। দম্ভ তো তাদের হবেই। হেফাজতকে সবাই ভয় পেয়েছিল। কোনো বাধা তাদের গণপ্লাবনকে আটকাতে পারেনি তখন। গাজীপুর বলুন, আর কুমিল্লা বলুন, যেখানেই পুলিশ তাদের বাধা দিয়েছে, সেখান থেকেই হেঁটে ঢাকায় রওনা হয়েছে হেফাজতের কর্মীরা। খবরের কাগজগুলোতে এ রকমই লেখা হয়েছিল। তারা এসে শাপলা চত্বর যেভাবে দখল করে বসেছিল, বুঝি আরেকটি তাহরির স্কয়ারই তৈরি হয়েছে- এ রকম আশঙ্কা করেছিল অনেকে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার সেই তাহরির স্কয়ার তথা শাপলা চত্বরই গিলে ফেলেছিল। কিন্তু বাংলায় প্রবাদ আছে, বেশি বাড় বেড় না, ঝড়ে পড়ে যাবে, বেশি ছোট হয়ো না, ছাগলে খাবে!
আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব বেশি বাড় বেড়েছিল। এ কথা জনগণ মনে করেছে এবং তারই শিক্ষা তারা পেয়েছে পাঁচটি সিটি নির্বাচনে। আমি মূল নেতৃত্ব বলছি। কারণ পাঁচটি সিটিতে যাঁরা মেয়র প্রার্থী ছিলেন, তাঁদের বাড়াবাড়ি নিয়ে জনগণের কোনো অভিযোগ আছে বলে আমি শুনিনি। এই প্রার্থীরা যোগ্য ছিলেন। তাঁরা বিগত টার্মে মেয়র ছিলেন এবং মেয়র হিসেবে তাঁরা সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে তাঁরা পরাজিত হলেন কেন? কয়েক দিন ধরে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর থেকে নির্বাচনসমূহে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করার প্রয়াস চলছে। এ অনুসন্ধানে নাকি একটি কারণ পাওয়া গেছে; আর সেটা হলো সংগঠনের অভ্যন্তরে গ্রুপিং। কোনো একটি পত্রিকায় লেখা দেখলাম, গাজীপুরের এমপিরা নাকি প্রার্থীর বিরুদ্ধে গ্রুপিং করেছেন। মজার ব্যাপার না! আওয়ামী লীগে গ্রুপিং নেই কোথায়? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারাই না সব সময় বলে থাকেন, বড় বড় দলে এ রকম গ্রুপিং থাকবেই। তাহলে এখন আবার সেই গ্রুপিংকে পরাজয়ের জন্য দায়ী করা হচ্ছে কেন? গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করল; তখন সংগঠনে গ্রুপিং ছিল না? সেই নির্বাচনের আগে শুধু গ্রুপিং নয়, দলের অভ্যন্তরে বড় নেতারা মূল নেত্রীকে বাদ দেওয়ার জন্য মাইনাস টু ফর্মুলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। গাজীপুর তো আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় দুর্গ বলে পরিচিত ছিল। দুর্গ কথাটির ব্যাখ্যা কী রকম করে দেন নেতৃত্ব? সংগঠনের যে শাখায় এত বড় গ্রুপিং থাকে, তাকে কি দুর্গ বলা যায়? সেটা জেনেই কি গাজীপুরকে দুর্গ বলা হতো? নিশ্চয়ই না। বরং আমার অভিজ্ঞতায় গাজীপুর বহু দিক দিয়ে সংগঠন ও আদর্শগতভাবে গোপালগঞ্জের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। আজও আছে। একজন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন এবং সেভাবে থাকার পক্ষে নিশ্চয়ই অনেকে ছিলেন। না হলে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো না কেন? কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কি ব্যাপারটা বোঝেননি, নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করেছিলেন?
আরেকটি মূল্যায়ন দেখছি। বলা হচ্ছে, এ পরাজয় আওয়ামী লীগের জাতীয় রাজনীতির পরাজয়। বলা হচ্ছে, ধর্মকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছে বিরোধী জোট। এটাও হাস্যকর কথা। আওয়ামী লীগের জাতীয় রাজনীতি কী? সেই রাজনীতি কি চর্চা হচ্ছে? আওয়ামী লীগও কি ধর্মের ব্যবহার করে না? এই যে সর্বশেষ বলা হলো, রোজার কারণে প্রধানমন্ত্রী এক দিন আগে দেশে চলে এসেছেন, সেটা কী? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে রোজার সেহরি খাওয়া বড় হয়ে গেল? বেলারুশ থেকে মানুষ রোজা করতে পারে না? পাঁচ সিটি করপোরেশনে বিএনপি প্রার্থী জিতেছেন বলে এ কথা কি বলা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধুলায় লুটিয়ে পড়েছে? মানুষ কি ভোটের আগুনে দেশের পতাকা পুড়িয়ে ফেলল! এ রকম করে যাঁরা ঘটনা দেখতে চান, তাঁরা বুঝতে ভুল করেন যে ভোটে এ বিষয়ে কোনো ইস্যুই ছিল না। যাঁরা বুঝেশুনে এ রকম বলেন, তাঁরা সাড়ে চার বছরে শেয়ার কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে হলমার্ক, বিশ্বজিৎ হত্যাসহ যে দুর্নীতি-অপশাসন তা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চান। অথচ জনগণ এদিকেই তাকিয়ে আছে। ড. ইউনূস, ড. আকবর আলি খান, এবিএম মূসাসহ যেসব ব্যক্তিত্বকে অকারণে অসম্মান করা হয়েছে, মানুষ সেগুলো পছন্দ করেনি। দোষ করেছে প্রধানত সরকার। দলও তার জন্য সাজা পাচ্ছে। মুশকিল হয়েছে, দল আর সরকারকে এখানে আলাদা করে বিচার করা যাচ্ছে না।
এক পত্রিকায় দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী বেলারুশ থেকে ফিরে বিমানবন্দরে তাঁর দল ও সরকারের নেতাদের সহাস্যে প্রশ্ন করছেন, কী খবর হারু পার্টি, কেমন আছেন? খুব মজা লাগল। আবারও একটা প্রবাদ মনে পড়ল, সুই বলে চালুনিরে, তোর বড় ছেঁদা!
লেখক : রাজনীতিক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক
mrmanna51@yahoo.com
শুরু থেকেই এ আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করতে থাকে সরকার। এমনকি মানববন্ধনেও বাধা দেয় তারা। গ্রেপ্তার করা হয় বিরোধী দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে। আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে না। তখন থেকেই আওয়ামী লীগ দম্ভ করতে শুরু করে, বিএনপি আবার কী আন্দোলন করবে! আন্দোলন করতে জানে কেবল আওয়ামী লীগ! বিএনপিকে আগে আন্দোলনের জন্য আওয়ামী লীগের স্কুলে ভর্তি হতে হবে। প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগ বোঝাতে চাইছিল যে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করতে যেমন জানে, তেমনি আন্দোলন ভাঙতেও জানে। পাঠকবৃন্দ নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন, কোনো গণতান্ত্রিক দল বা সরকার এ রকম আস্ফালন করতে পারে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাই করছিল এবং জনগণ মনে করছিল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আসলে অদম্য, অজেয়। জুন-জুলাইয়ের পাঁচটি সিটি নির্বাচন সেই ধারণা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে।
এ কথা ঠিক, বিএনপি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। বিএনপির আসলে আওয়ামী লীগের মতো আন্দোলনের ঐতিহ্য নেই। দলটি গড়ে উঠেছে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। বলা যেতে পারে, ক্ষমতা হাতে নিয়েই জন্মেছিল বিএনপি। এ ক্ষমতা যে চলে যাবে, ক্ষমতার জন্য আবার লড়াই করতে হবে- এ রকম হয়তো তাদের ভাবনাতেই ছিল না। অতএব,লড়াইয়ের জন্য যেটা প্রাথমিকভাবে দরকার মানসিক প্রস্তুতি, তাই তাদের ছিল না। খালেদা জিয়া অনেক পরে অভিজ্ঞতা দিয়ে, পুড়ে, পোড় খেয়ে সেটা বুঝেছিলেন। অতএব তিনি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সেটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিল। বিএনপি যে স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসর- সেটা জনগণের সামনে প্রচার করে সফলতা পেয়েছিল।
জামায়াত যোগ দিয়ে রীতিমতো জঙ্গি আক্রমণ করেছিল সরকারের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকার তার বিরুদ্ধে সমধিক শক্তি প্রয়োগ করেছিল এবং তাতে সফলতাও অর্জন করেছিল। খালেদা জিয়া অতঃপর হেফাজতের দিকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন। হেফাজত কী দাবিতে আন্দোলন করছে, তা দেখেননি তিনি। হেফাজতের সহযোগিতায় ক্ষমতা থেকে সরকারকে নামিয়ে দেওয়া যাবে, এ অঙ্কে তিনি সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দিয়েছিলেন। কিন্তু হেফাজতের আন্দোলনকে এক রাতে আধাঘণ্টারও কম সময়ের অপারেশনে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল সরকার। দম্ভ তো তাদের হবেই। হেফাজতকে সবাই ভয় পেয়েছিল। কোনো বাধা তাদের গণপ্লাবনকে আটকাতে পারেনি তখন। গাজীপুর বলুন, আর কুমিল্লা বলুন, যেখানেই পুলিশ তাদের বাধা দিয়েছে, সেখান থেকেই হেঁটে ঢাকায় রওনা হয়েছে হেফাজতের কর্মীরা। খবরের কাগজগুলোতে এ রকমই লেখা হয়েছিল। তারা এসে শাপলা চত্বর যেভাবে দখল করে বসেছিল, বুঝি আরেকটি তাহরির স্কয়ারই তৈরি হয়েছে- এ রকম আশঙ্কা করেছিল অনেকে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার সেই তাহরির স্কয়ার তথা শাপলা চত্বরই গিলে ফেলেছিল। কিন্তু বাংলায় প্রবাদ আছে, বেশি বাড় বেড় না, ঝড়ে পড়ে যাবে, বেশি ছোট হয়ো না, ছাগলে খাবে!
আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব বেশি বাড় বেড়েছিল। এ কথা জনগণ মনে করেছে এবং তারই শিক্ষা তারা পেয়েছে পাঁচটি সিটি নির্বাচনে। আমি মূল নেতৃত্ব বলছি। কারণ পাঁচটি সিটিতে যাঁরা মেয়র প্রার্থী ছিলেন, তাঁদের বাড়াবাড়ি নিয়ে জনগণের কোনো অভিযোগ আছে বলে আমি শুনিনি। এই প্রার্থীরা যোগ্য ছিলেন। তাঁরা বিগত টার্মে মেয়র ছিলেন এবং মেয়র হিসেবে তাঁরা সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে তাঁরা পরাজিত হলেন কেন? কয়েক দিন ধরে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর থেকে নির্বাচনসমূহে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করার প্রয়াস চলছে। এ অনুসন্ধানে নাকি একটি কারণ পাওয়া গেছে; আর সেটা হলো সংগঠনের অভ্যন্তরে গ্রুপিং। কোনো একটি পত্রিকায় লেখা দেখলাম, গাজীপুরের এমপিরা নাকি প্রার্থীর বিরুদ্ধে গ্রুপিং করেছেন। মজার ব্যাপার না! আওয়ামী লীগে গ্রুপিং নেই কোথায়? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারাই না সব সময় বলে থাকেন, বড় বড় দলে এ রকম গ্রুপিং থাকবেই। তাহলে এখন আবার সেই গ্রুপিংকে পরাজয়ের জন্য দায়ী করা হচ্ছে কেন? গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করল; তখন সংগঠনে গ্রুপিং ছিল না? সেই নির্বাচনের আগে শুধু গ্রুপিং নয়, দলের অভ্যন্তরে বড় নেতারা মূল নেত্রীকে বাদ দেওয়ার জন্য মাইনাস টু ফর্মুলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। গাজীপুর তো আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় দুর্গ বলে পরিচিত ছিল। দুর্গ কথাটির ব্যাখ্যা কী রকম করে দেন নেতৃত্ব? সংগঠনের যে শাখায় এত বড় গ্রুপিং থাকে, তাকে কি দুর্গ বলা যায়? সেটা জেনেই কি গাজীপুরকে দুর্গ বলা হতো? নিশ্চয়ই না। বরং আমার অভিজ্ঞতায় গাজীপুর বহু দিক দিয়ে সংগঠন ও আদর্শগতভাবে গোপালগঞ্জের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। আজও আছে। একজন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন এবং সেভাবে থাকার পক্ষে নিশ্চয়ই অনেকে ছিলেন। না হলে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো না কেন? কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কি ব্যাপারটা বোঝেননি, নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করেছিলেন?
আরেকটি মূল্যায়ন দেখছি। বলা হচ্ছে, এ পরাজয় আওয়ামী লীগের জাতীয় রাজনীতির পরাজয়। বলা হচ্ছে, ধর্মকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছে বিরোধী জোট। এটাও হাস্যকর কথা। আওয়ামী লীগের জাতীয় রাজনীতি কী? সেই রাজনীতি কি চর্চা হচ্ছে? আওয়ামী লীগও কি ধর্মের ব্যবহার করে না? এই যে সর্বশেষ বলা হলো, রোজার কারণে প্রধানমন্ত্রী এক দিন আগে দেশে চলে এসেছেন, সেটা কী? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে রোজার সেহরি খাওয়া বড় হয়ে গেল? বেলারুশ থেকে মানুষ রোজা করতে পারে না? পাঁচ সিটি করপোরেশনে বিএনপি প্রার্থী জিতেছেন বলে এ কথা কি বলা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধুলায় লুটিয়ে পড়েছে? মানুষ কি ভোটের আগুনে দেশের পতাকা পুড়িয়ে ফেলল! এ রকম করে যাঁরা ঘটনা দেখতে চান, তাঁরা বুঝতে ভুল করেন যে ভোটে এ বিষয়ে কোনো ইস্যুই ছিল না। যাঁরা বুঝেশুনে এ রকম বলেন, তাঁরা সাড়ে চার বছরে শেয়ার কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে হলমার্ক, বিশ্বজিৎ হত্যাসহ যে দুর্নীতি-অপশাসন তা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চান। অথচ জনগণ এদিকেই তাকিয়ে আছে। ড. ইউনূস, ড. আকবর আলি খান, এবিএম মূসাসহ যেসব ব্যক্তিত্বকে অকারণে অসম্মান করা হয়েছে, মানুষ সেগুলো পছন্দ করেনি। দোষ করেছে প্রধানত সরকার। দলও তার জন্য সাজা পাচ্ছে। মুশকিল হয়েছে, দল আর সরকারকে এখানে আলাদা করে বিচার করা যাচ্ছে না।
এক পত্রিকায় দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী বেলারুশ থেকে ফিরে বিমানবন্দরে তাঁর দল ও সরকারের নেতাদের সহাস্যে প্রশ্ন করছেন, কী খবর হারু পার্টি, কেমন আছেন? খুব মজা লাগল। আবারও একটা প্রবাদ মনে পড়ল, সুই বলে চালুনিরে, তোর বড় ছেঁদা!
লেখক : রাজনীতিক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক
mrmanna51@yahoo.com
No comments