পরিবেশ-পাহাড় যাচ্ছে আহারে by মুকিত মজুমদার বাবু
সবুজে ঘেরা উঁচু-নিচু পাহাড়। তার মাঝ দিয়ে
এঁকেবেঁকে চলেছে পাহাড়ি নদী। মাঝে মাঝে ঝরনার চপলা পায়ে ছুটে চলা নূপুরের
ছন্দ। যেদিকে তাকানো যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। খারাপ মনটাও ভালো হয়ে যায়
সবুজের সানি্নধ্যে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়।
যে
নিঃশ্বাসে নেই ধুলাবালি, নেই সিসা; নেই কোনো কালো ধোঁয়ার বিষ। নির্মল
বাতাসে তাজা হয়ে ওঠে দেহ-মন। তবে বর্তমানে প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যেও
লেগেছে অসুন্দরের ছোঁয়া। স্থানীয় প্রভাবশালীদের পাহাড় দখলের প্রতিযোগিতায়
উঁচু পাহাড় সমতল হয়ে গেছে। আর তা প্লট বানিয়ে বিক্রি চলছে দেদার। পাশাপাশি
পাহাড় জ্বালিয়ে করা হচ্ছে জুম চাষ। পাহাড়, পাহাড়ি নদীর দু'পাড়ের বিস্তীর্ণ
অঞ্চল ছেয়ে গেছে মরণনেশা তামাকের চাষে। পাহাড় কেটে ইটের ভাটাও তৈরি করা
হচ্ছে। আর পাহাড় কাটা মাটি যাচ্ছে শহরের কোনো নিচু জমি ভরাট করে সুরম্য
অট্টালিকা তৈরির জন্য। পাহাড়ের গায়ে মানুষের বসতি গড়ে ওঠার কারণে
জীববৈচিত্র্য রয়েছে হুমকির মুখে। নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি হারিয়ে যাচ্ছে
পাচার ও ধ্বংসযজ্ঞে। অনিন্দ্য সবুজের বিবর্ণতা নিয়ে ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে
আছে পাহাড় আমাদের অসচেতন কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে। পাহাড়ি বনাঞ্চল এক সময়
মুখরিত ছিল হরিণ, বানর, হনুমান, সজারু, ময়ূর, টিয়া, ময়না, খরগোশ, শূকর,
বনমুরগি, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, ব্যাঙসহ অসংখ্য পাখ-পাখালির কলতানে। আজ
শুধু কয়েক প্রজাতির সাপ, পাখি, আর বানর ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ে না। দেখা
যায় না বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদকুল। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ পাহাড় আজ ন্যাড়া মাথায়
দাঁড়িয়ে আছে পত্রঝরা মহীরুহের মতো।
ক্ষুদ্র নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী জীবন-জীবিকার তাগিদে পাহাড়ের গায়ে যে জুম চাষ করছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের ক্ষেত্রে তা-ও অনেকাংশে দায়ী। চাষের শুরুতে প্রথমে নির্বাচিত পাহাড়ের জঙ্গল ও আগাছা পরিষ্কার করতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বাঁশ, গাছ ও লতাগুল্মে ভরা পাহাড় জ্বলতে থাকে। পুড়ে যায় মূল্যবান সেগুন, গর্জন, গামারি, চাপালিশ, কড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা। কখনও কখনও জুম চাষ করতে গিয়ে বনাঞ্চলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলছে এসব কাজ। যার ফলে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস ও উপকারী কীটপতঙ্গ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গা থেকে।
পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্ষা মৌসুমে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে মেশে ঝরনা, ছড়া, পাহাড়ি নদীসহ বিভিন্ন নদীতে। এর ফলে নদী নাব্য হারিয়ে ফেলছে। সৃষ্টি হচ্ছে বন্যার। অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসে মৃত্যুর আশঙ্কা নির্মম বাস্তবতা হলেও একই ঘটনা ঘটছে বারবার। তাজা প্রাণ মাটিচাপা পড়ে প্রায় প্রতি বছর বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বৃষ্টিপাতের এই মৌসুমে যে প্রাণহানি হবে না_ তা জোর দিয়ে বলা যায় না।
পাহাড়ের অর্থনীতিতে কাঠের ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রভাবশালী ও এক শ্রেণীর অসাধু বন কর্মকর্তা যোগসাজশ করে মূল্যবান কাঠ কম মূল্যে বিক্রি করে পাহাড়ি বন উজাড় করছে। এর সঙ্গে রয়েছে বনদস্যুর অপতৎপরতা। তারা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে গোপনে পাচার করছে। আবার ক্ষুুদ্র নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী ও সমতল ভূমির মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো পাহাড়ের বৃক্ষরাজি ধ্বংস করছে।
পরিবেশ আইনে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ হলেও পাহাড়ের মাটি ইটভাটা, রাস্তা মেরামত, নিচু জমি ভরাটসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাহাড়ের মাটি কাটার ফলে বৃক্ষরাজি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য। বৃষ্টিপাতের ফলে নামছে ধস। বেড়ে যাচ্ছে পাহাড় ধসে মৃত্যুর আশঙ্কা।
পাহাড়ের ওপর ও পাদদেশে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বেড়েই চলেছে। অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে পাহাড়ে বসতি স্থাপনের জায়গা। মানুষের বসতির কারণে যেমন জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে মানুষ। ২০০৭ সালের ১১ জুন প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড় ও দেয়াল ধসে ১৩২ জনের প্রাণহানির পর গঠন করা হয়েছিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। ওই কমিটির মাধ্যমে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়া বা বিকল্প কোনো আবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। ১২টি পাহাড়ে ছয় শতাধিক ঝুঁঁকিপূর্ণ বসতি চিহ্নিত হলেও গত ছয় বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। বরং দিন দিন পাহাড়ে মানুষের বসতি বেড়েই চলেছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের পাহাড় ধসের আশঙ্কায় থাকা ছিন্নমূল মানুষের জন্য টাইগারপাস নবদিগন্ত ক্লাব মাঠের অস্থায়ী তাঁবুতে ৯০টি পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। পাশেই অবস্থিত টাইগারপাস প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আরও শ'খানেক তাঁবু স্থাপন করা হবে বলে জানা যায়। এ ছাড়া আকবর শাহ এলাকাতেও স্থাপিত হবে তাঁবু। এর পর মতিঝরনা ও আকবর শাহ এলাকায় ঝুঁকির ভেতরে থাকা মানুষকে সরিয়ে আনা হবে পর্যায়ক্রমে। স্বল্প পরিসরে দেরিতে হলেও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষ সরিয়ে আনার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
পাহাড় মানুষের আহারে পরিণত হচ্ছে। আর পাহাড়ের আহারে পরিণত হচ্ছে ছিন্নমূল অসহায় মানুষ, যারা পাহাড়ের ওপর ও পাদদেশে বসবাস করছে। মানবতার কারণে এসব ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসন করতে হবে। পাহাড় কাটা, পাহাড়ি বৃক্ষ উজাড় করা, অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধ, কাঠ পাচার রোধ করতে সরকারি নজরদারি জোরদার করতে হবে। মানুষের ভেতর সচেতনতা তৈরি করতে নিতে হবে নানাবিধ উদ্যোগ। এই উদ্যোগে শামিল হয়ে প্রকৃতির সাম্যাবস্থা বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
স মুকিত মজুমদার বাবু :চেয়ারম্যান
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন
ক্ষুদ্র নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী জীবন-জীবিকার তাগিদে পাহাড়ের গায়ে যে জুম চাষ করছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের ক্ষেত্রে তা-ও অনেকাংশে দায়ী। চাষের শুরুতে প্রথমে নির্বাচিত পাহাড়ের জঙ্গল ও আগাছা পরিষ্কার করতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বাঁশ, গাছ ও লতাগুল্মে ভরা পাহাড় জ্বলতে থাকে। পুড়ে যায় মূল্যবান সেগুন, গর্জন, গামারি, চাপালিশ, কড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা। কখনও কখনও জুম চাষ করতে গিয়ে বনাঞ্চলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলছে এসব কাজ। যার ফলে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস ও উপকারী কীটপতঙ্গ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গা থেকে।
পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্ষা মৌসুমে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে মেশে ঝরনা, ছড়া, পাহাড়ি নদীসহ বিভিন্ন নদীতে। এর ফলে নদী নাব্য হারিয়ে ফেলছে। সৃষ্টি হচ্ছে বন্যার। অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসে মৃত্যুর আশঙ্কা নির্মম বাস্তবতা হলেও একই ঘটনা ঘটছে বারবার। তাজা প্রাণ মাটিচাপা পড়ে প্রায় প্রতি বছর বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। বৃষ্টিপাতের এই মৌসুমে যে প্রাণহানি হবে না_ তা জোর দিয়ে বলা যায় না।
পাহাড়ের অর্থনীতিতে কাঠের ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রভাবশালী ও এক শ্রেণীর অসাধু বন কর্মকর্তা যোগসাজশ করে মূল্যবান কাঠ কম মূল্যে বিক্রি করে পাহাড়ি বন উজাড় করছে। এর সঙ্গে রয়েছে বনদস্যুর অপতৎপরতা। তারা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে গোপনে পাচার করছে। আবার ক্ষুুদ্র নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠী ও সমতল ভূমির মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো পাহাড়ের বৃক্ষরাজি ধ্বংস করছে।
পরিবেশ আইনে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ হলেও পাহাড়ের মাটি ইটভাটা, রাস্তা মেরামত, নিচু জমি ভরাটসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাহাড়ের মাটি কাটার ফলে বৃক্ষরাজি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য। বৃষ্টিপাতের ফলে নামছে ধস। বেড়ে যাচ্ছে পাহাড় ধসে মৃত্যুর আশঙ্কা।
পাহাড়ের ওপর ও পাদদেশে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বেড়েই চলেছে। অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে পাহাড়ে বসতি স্থাপনের জায়গা। মানুষের বসতির কারণে যেমন জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে মানুষ। ২০০৭ সালের ১১ জুন প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড় ও দেয়াল ধসে ১৩২ জনের প্রাণহানির পর গঠন করা হয়েছিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। ওই কমিটির মাধ্যমে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়া বা বিকল্প কোনো আবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। ১২টি পাহাড়ে ছয় শতাধিক ঝুঁঁকিপূর্ণ বসতি চিহ্নিত হলেও গত ছয় বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। বরং দিন দিন পাহাড়ে মানুষের বসতি বেড়েই চলেছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের পাহাড় ধসের আশঙ্কায় থাকা ছিন্নমূল মানুষের জন্য টাইগারপাস নবদিগন্ত ক্লাব মাঠের অস্থায়ী তাঁবুতে ৯০টি পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। পাশেই অবস্থিত টাইগারপাস প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আরও শ'খানেক তাঁবু স্থাপন করা হবে বলে জানা যায়। এ ছাড়া আকবর শাহ এলাকাতেও স্থাপিত হবে তাঁবু। এর পর মতিঝরনা ও আকবর শাহ এলাকায় ঝুঁকির ভেতরে থাকা মানুষকে সরিয়ে আনা হবে পর্যায়ক্রমে। স্বল্প পরিসরে দেরিতে হলেও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষ সরিয়ে আনার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
পাহাড় মানুষের আহারে পরিণত হচ্ছে। আর পাহাড়ের আহারে পরিণত হচ্ছে ছিন্নমূল অসহায় মানুষ, যারা পাহাড়ের ওপর ও পাদদেশে বসবাস করছে। মানবতার কারণে এসব ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসন করতে হবে। পাহাড় কাটা, পাহাড়ি বৃক্ষ উজাড় করা, অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধ, কাঠ পাচার রোধ করতে সরকারি নজরদারি জোরদার করতে হবে। মানুষের ভেতর সচেতনতা তৈরি করতে নিতে হবে নানাবিধ উদ্যোগ। এই উদ্যোগে শামিল হয়ে প্রকৃতির সাম্যাবস্থা বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
স মুকিত মজুমদার বাবু :চেয়ারম্যান
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন
No comments