সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতি এভাবে আর চলতে পারে না
দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা থেকে মনে হয়, এগুলো যেন উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান নয়। কোনো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ব্যাপক পরিসরে অনিয়ম-দুর্নীতি ঘটতে থাকলে সেই দেশ সভ্য, শিক্ষিত, দক্ষ ও উন্নত জাতি গঠন করতে পারে না; বরং জাতি গঠনের ভিতটাই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
আটটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিময়-দুর্নীতি সম্পর্কে বৃহস্পতিবারের প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মূলত সে কারণেই।ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর—এই চারটি ঐতিহ্যবাহী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে আরও প্রায় ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এই শুভচিন্তার সুফল ফলতে পারে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উন্নত মানের শিক্ষা-গবেষণা চলে, পঠন-পাঠন ও জ্ঞানচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ মোটেও সে রকম নয়। যাঁরা বিদ্যাপীঠকে জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত করবেন, সেই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেই যদি অনিয়ম-দুর্নীতি হয়, যোগ্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ভালো হতে পারে না। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতিও বিরাট সমস্যা। রাজনৈতিক কারণে, অর্থের বিনিময়ে শত শত কর্মচারী নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। নিয়োগ-বাণিজ্য শব্দটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও প্রচলিত হয়েছে—এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ও ক্ষতিকর বাস্তবতা আর কী হতে পারে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির থেকে বেশি প্রকট ছিল উপাচার্যদের আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি। জোট সরকারের পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে যখন তাঁদের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করে, তখন কয়েক দিনের ব্যবধানে চারজন উপাচার্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। আসলে উচিত ছিল দুর্নীতির দায়ে তাঁদের বিচার করা। মহাজোট সরকারের আমলে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ কমেছে, কিন্তু শিক্ষক ও অন্যান্য লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দলীয়করণের অভিযোগ মোটেও কমেনি। আসলে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম আর সরাসরি আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যে পার্থক্য করা ঠিক নয়; দুটিই ভীষণ অনৈতিক। বিশেষত, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মর্যাদাবান প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অনৈতিক চর্চাই অত্যন্ত ক্ষতিকর।
গুরুতর সমস্যা হলো, এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনাগুলোর যথাযথ প্রতিকার হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করে সরকারের কাছে যেসব সুপারিশ পাঠায়, সেগুলোর সবটা বাস্তবায়িত হয় না। কিছু বাস্তবায়িত হলেও সামান্য প্রশাসনিক রদবদল ছাড়া তেমন বড় আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। নিয়োগ-বাণিজ্য বা ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের দায়ে কারও চাকরি যায় না, জেল-জরিমানা হয় না। ফলে শাস্তির ভয় ব্যতিরেকে অনিয়ম-দুর্নীতিতে লিপ্ত থাকার প্রবণতা ক্রমাগত বেড়েছে।
কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি অবশ্যই দূর করতে হবে, নইলে জাতির ধ্বংস ঠেকানো যাবে না।
No comments