তৈরি পোশাকশিল্প ন্যূনতম মজুরির ফাঁদে মালিক, শ্রমিক আর এই দেশ by মোহাম্মদ হেলাল |
যুক্তরাষ্ট্রের গৃহায়ণ বাজারে ধস নামার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা অবস্থা তৈরি হয় ২০০৭-০৮ সালে। ২০০৯ সালে সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নেমে আসে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশে, যা ২০০৮ সালে ছিল ২ দশমিক ৮ শতাংশ।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হলেও ওই বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তার মানে বৈশ্বিক অর্থনীতির ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়েনি। প্রবৃদ্ধি যেটুকু কমেছিল, তা স্বাভাবিক কমা-বাড়ার মধ্যেই পড়ে। সাধারণত তেমনটি সচরাচর ঘটে না। বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি কমে যাওয়ার কথা। বাংলাদেশের মূল রপ্তানি পণ্য পোশাকের গন্তব্যস্থল আমেরিকা আর ইউরোপ। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক শূন্য শতাংশ থেকে নেমে এসেছিল মাইনাস ২ দশমিক ৬ শতাংশে আর ইউরোপের ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে মাইনাস ৪ দশমিক ১ শতাংশে। তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক অর্থাৎ তাদের আয় কমে যাওয়ায় তাদের চাহিদা কমার কথা। আর এই চাহিদার একটা অংশ আমরা রপ্তানির দ্বারা মিটিয়ে থাকি বলে আমাদের রপ্তানিও কমার কথা। কিন্তু তা কমেনি। ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতে বৈদেশিক মুদ্রার অর্জন ভালো অবস্থায় ছিল। পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রবাসী আয়েও টান পড়েনি। বৈশ্বিক অর্থনীতির শক বা নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে ঢুকে মূলত অর্থনীতির দুটি জানালা দিয়ে—পোশাক রপ্তানি আর প্রবাসী আয়। এই দুয়ে টান পড়েনি বলেই আমাদের অর্থনীতি ওই চাপের মুখেও অক্ষত ছিল।প্রশ্ন হলো, আমাদের পোশাক রপ্তানি কেন বৈশ্বিক মন্দার সময়েও কমেনি? আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের বৃহৎ অংশীদার দেশগুলোর মন্দার সময়েও কমেনি? কারণ একটাই—আমাদের পোশাকের ক্ষেত্রে খরচ অনেক কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকার নিম্ন আয়ের মানুষদের অনেকেই কেনে এসব। অন্যদিকে আমাদের খরচ, প্রতিযোগী দেশ চীন, ভারত, কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েতনামের তুলনায় অনেকটা কম হওয়ায় কিংবা তাদের খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় অনেক বিদেশি ক্রেতার বাংলাদেশের প্রতি ঝুঁকে পড়া। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, প্রতিযোগীদের খরচ বাড়লে আমাদের বাড়বে না কেন? মূল উপকরণ ফেব্রিকস তো প্রায় একই উৎস থেকে, একই দামে আসার কথা। আমাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পরিবহন খরচ—সবকিছুই মূল্যস্ফীতির জন্য বেড়েছে। তার মানে সার্বিকভাবে আমাদের মজুরির ঊর্ধ্বমুখী সমন্বয় হয়নি। আর যদি প্রতিযোগীদের খরচ বাড়ার কারণে আমাদের পোশাকের চাহিদা বাড়ে, তবে পোশাকের দামও অনেক বাড়ার কথা। সেই রকম দাম বাড়লে আমাদের পোশাকের চাহিদা কমে আবার আগের জায়গায় চলে আসার কথা। কোনো তথ্য হাজির না করে শুধু বিদেশি ক্রেতাদের ক্রমবর্ধমান হারে বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকে পড়ার ওপর ভিত্তি করেই বলা যায়, আমাদের পোশাকের দাম তুলনামূলকভাবে কম বাড়ছে, ক্ষেত্রবিশেষে একই রকম থাকছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাকি আবার কমছেও। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, আমাদের খরচ কম বুঝলাম। তাই বলে দাম তো প্রতিযোগী দেশের দামের সমান বা তার চেয়ে একটু কম হতে পারে, এত কম হবে কেন যার ফলে ক্রেতারা অনেক বেশি এদিকে ছুটে আসবেন? সেটা কী করে সম্ভব হচ্ছে? সম্ভব হচ্ছে একটাই কারণে—আমাদের পোশাকমালিকদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা। বাজার অর্থনীতিতে এটা অস্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক হলো প্রতিযোগিতার নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। যার ফলে দাম কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার মূলে রয়েছে কম ন্যূনতম মজুরি আর খারাপ কর্মপরিবেশ।
দেশের সব পোশাকমালিকই কিন্তু শ্রমিকদের বঞ্চিত করছেন না। এই পোশাকশিল্পের মধ্যে এমন অনেক মালিক আছেন, যাঁরা অনেক ভালো মজুরি দিচ্ছেন—সর্বনিম্ন মজুরির থেকে বেশি মজুরি। তাঁরা দিতে পারছেন কারণ তাঁরা দক্ষ। তাঁদের উৎপাদনশীলতা ভালো কিংবা তাঁরা উচ্চ দামে পোশাক বিক্রি করতে পারেন। তাঁদের ব্যবস্থাপনা ভালো। আবার মালিকদের মধ্যে একটা বিরাট অংশ আছে, যারা অদক্ষ। যারা শ্রমিকদের ঠকাচ্ছে, সর্বনিম্ন মজুরি বা সম্ভব হলে তার চেয়েও কম মজুরি দিচ্ছে, অত্যন্ত খারাপ কর্মপরিবেশে শ্রমিকদের রাখছে। আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশের কম হবে না তাদের সংখ্যা। এই নিম্ন মানের অদক্ষ মালিকেরা যাঁরা দক্ষ তাঁদের আন্ডারকাট করছে। যেখানে দক্ষ মালিকেরা ভালো দাম ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি করছেন, অদক্ষ মালিকেরা এজেন্টের মাধ্যমে ওই ক্রেতার কাছে আরও কম দামে বিক্রির প্রস্তাব দিচ্ছেন। যেমন, কোনো একটা জামা যেখানে তিন ডলারে একজন দক্ষ মালিক বিক্রি করছেন, সেখানে অদক্ষ একজন ২ দশমিক ৯০ ডলারে কিংবা তারও কমে বিক্রির প্রস্তাব দিচ্ছেন। এজেন্টের মাধ্যমে যখন এই প্রস্তাব ক্রেতার কাছে যাচ্ছে, ক্রেতা তখন দক্ষ মালিককে ১০ সেন্ট দাম কমাতে বলছেন। ফলে দক্ষ মালিক হয়তো দাম কমিয়ে আনছেন। অথবা দক্ষ মালিক হয়তো আরও বেশি দামে বিক্রি করতে পারতেন, যা এখন আর পারছেন না। এসব সুবিধা নেওয়ার জন্য ক্রেতারা দামের ব্রেকডাউন চাচ্ছেন। এসব কারণে আমাদের মধ্যে যে তীব্র প্রতিযোগিতা, সেই প্রতিযোগিতাই কিন্তু আমাদের দামটাকে নিচে ধরে রাখছে বা কমিয়ে দিচ্ছে। যদি ন্যূনতম মজুরি সঠিক হতো, কর্মপরিবেশের একটা মান বজায় রাখতে হতো, তবে অদক্ষরা এই শিল্প থেকে বেরিয়ে যেত কিংবা দক্ষতা বাড়িয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করত। সুযোগ পেত না অসুস্থ প্রতিযোগিতার—যার কারণে ঠকছে সরকার, ঠকছেন শ্রমিক আর ঠকছেন দক্ষ মালিকেরা।
পৃথিবীর কোনো শিল্পেই অদক্ষতা টিকে থাকে না। অদক্ষরা বের হয়ে যায় আর দক্ষদের প্রসার ঘটে। এ দেশে তারা টিকে আছে ভুল নীতি আর বেকারত্বে অভিশপ্ত নিয়ন্ত্রণহীন এক শ্রমবাজারের কারণে। এই নিম্ন মানের মালিকদের বের করে দিতে হবে পোশাকশিল্পের স্বার্থে। বাজার অর্থনীতিতে কোনো কোম্পানিকে জোর করে বন্ধ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা করে দিলে একটা অংশ বের হয়ে যেতে পারে। কর্মপরিবেশ নিয়ে চাপ দিলে আরেকটা অংশ বের হয়ে যাবে। যে দেশে শ্রমিকের বিকল্প কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ নেই, দর-কষাকষির জন্য শ্রমিক ইউনিয়ন নেই; সেই দেশে সরকারকেই এ কাজ করতে হবে। সরকারের নানাবিধ প্রণোদনা এই নিম্ন মানের মালিকদের টিকে থাকতে সাহায্য করছে। কর্মপরিবেশ মানা না-মানার সঙ্গে প্রণোদনার শর্ত জুড়ে দিলে এই নীতি ভালো কাজ করবে। পাশাপাশি সাব-কন্ট্রাক্ট নামের কমিশন এজেন্ট ধরনের আচরণ নিরুৎসাহিত করতে হবে। সাব-কন্ট্রাক্টই সাব-স্ট্যান্ডার্ড মালিকদের টিকিয়ে রাখে অনেক ক্ষেত্রে। ক্রেতার পরিশোধিত দামের পুরোটা সাব-কন্ট্রাক্ট মালিকেরা পান না বলে অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা শ্রমিককে ঠকাতে বাধ্য হন। তবে এসব পলিসির কারণে সাময়িক বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু শিগগিরই দক্ষ কোম্পানি প্রসারতা লাভ করে বর্তমানের চেয়ে বেশি মজুরিতে তাদের অনেকের কর্মসংস্থান করতে পারবে। এসব নীতির কারণে পোশাকশিল্পের সবার খরচ বেড়ে যাবে। প্রতিযোগী দেশগুলোর খরচ অনেক বাড়ার কারণে ক্রেতারা আরও বেশি দাম দিয়ে আমাদের পোশাক কিনতে বাধ্য হবেন। তাই মজুরি বাড়িয়ে দিয়ে হাতে নেওয়া আমাদের এই ‘কাট দ্য বটম’ নীতি সার্বিকভাবে এই শিল্পের জন্য কোনো ঝুঁকি বয়ে আনবে না।
আরেকটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। তীব্র প্রতিযোগিতার ফলে সরকারের নানাবিধ প্রণোদনার সুবিধা কিন্তু অনেকটাই চলে যাচ্ছে বিদেশি ভোক্তার কাছে। আমরা যখন সারে কিংবা বীজে ভর্তুকি দেই, তখন কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে যায়। ফলে কৃষকেরা উৎপাদন বাড়ান। বেশি উৎপাদনের কারণে বাজারে সরবরাহ বেড়ে গিয়ে দাম কমে যায়। কম দামে চাল কেনে ভোক্তারা। তার মানে যে ভর্তুকি আমরা কৃষককে দিই তার ফল ভোগ করে ভোক্তারা। একইভাবে, বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের মালিকদের যে প্রণোদনা দিচ্ছি, সে প্রণোদনা আসলে চলে যাচ্ছে বিদেশি ক্রেতা কিংবা ভোক্তার কাছে। আমাদের বিশ্বের এক নম্বর রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার দরকার নেই, বরং আমাদের দেখতে হবে রপ্তানি করে আমরা কতটুকু মূল্য সংযোজন করছি। আজকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ প্রবাসী আয় উপার্জিত হচ্ছে, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক বাইরে পাঠিয়েই ফিলিপাইন আমাদের প্রায় সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। ফলে আমরা কতটা পোশাক রপ্তানি করছি, তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা কী পরিমাণ মূল্য সংযোজন করছি সেটা। তাই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে এক নম্বর হওয়ার চিন্তা না করে যারা অদক্ষ, শ্রমিকদের শোষণ করছে এবং দক্ষদের আন্ডারকাট করছে, তাদের বের করে দিয়ে দেশের সামগ্রিক কল্যাণ বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রসারতা সব সময় কল্যাণ বাড়ায় না।
মোহাম্মদ হেলাল: অর্থনীতির শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)।
No comments