আচার-জুসে ফরমালিন, প্রাণের সাফাই!

ফরমালিন মেশানো আম দিয়ে তৈরি হয় আচার ও জুস। ফরমালিনযুক্ত আম দিয়ে প্রাণের আচার ও জুস তেরির রহস্য উদঘাটন করেছে মোবাইল কোর্ট। এ ঘটনায় প্রাণের দুই এক্সিকিউটিভকে দুই বছর করে কারাদণ্ড এবং
১ লাখ ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো ৬ মাসের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত।পুলিশ আটক করেছে স্থানীয় এজেন্টকেও।

প্রাণের আমে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন মেশানোর ঘটনার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।

গত বৃহস্পতিবার সংগঠনটি এক বিবৃতিতে জানায়, ফরমালিন আমদানি ও খাদ্যে ফরমালিনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের চেষ্টা চলছে। জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। তখন একটি প্রতিষ্ঠিত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের আমে ফরমালিন মেশানোর ঘটনা খুবই দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়।

এদিকে প্রাণের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাণ কখনও আমে ফরমালিন মেশায় না। তাদের পরিকল্পিত ভাবে ফাঁসানো হয়েছে। উপরন্তু, আম আটকের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, প্রাণের পণ্যে শতভাগ মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফরমালিন মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। খাদ্যের মাধ্যমে ফরমালিন শরীরে প্রবেশ করলে নানা জটিল ও কঠিন রোগে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। ফুসফুস ও কিডনি রোগ হতে পারে। এমন কী মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ও ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন ড. আবম ফারুক বাংলানিউজকে জানান, খাদ্যের সঙ্গে ফরমালিন পাকস্থলীতে প্রবেশ করলে বিপাক ক্রিয়াকে বাধাগস্ত করে। কোন খাদ্যই হজম হয় না। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গর্ভবতী নারী ও শিশু। গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক বিকাশ হয় না। এ ছাড়াও মানবদেহে ক্যান্সার হতে পারে।

প্রাণের আমে ফরমালিন মেশানোর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি জানান, এত বড় কোম্পানি যদি ফরমালিন মেশায়, তবে মানুষের ভরসার জায়গা কোথায়!

তিনি আরও জানান, এটি কোন ছোট ঘটনা নয়। এফবিসিসিআই একটি লোক দেখানো বিবৃতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। তাদের সদস্যপদ বাতিল করা উচিত। তবে আমরা বুঝবো এফবিসিসিআই খাদ্যে ভেজাল মুক্ত করণের পক্ষে। নইলে এই লোক দেখানো বিবৃতি দিয়ে কোনই লাভ নেই।

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজিরপাড়া গ্রামে মঙ্গলবার দুপুরে বিষাক্ত কেমিকেল ও ফরমালিন ব্যবহার করে আম প্রক্রিয়াজাত করার অভিযোগে প্রাণ কোম্পানির জুনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার ও স্থানীয় এজেন্টকে আটক করে।

এসময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আব্দুস সালাম ওই কোম্পানির দু’জনকে দুই বছর করে কারাদণ্ড এবং ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো ৬ মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন।

দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, প্রাণ কোম্পানির জুনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার মুরাদ হোসেন ও তাদের এজেন্ট কাজীপুর গ্রামের ইসাহাক আলীর ছেলে আব্দুল মজিদ মাস্টার।

এসময় প্রাণ কোম্পানির ক্রয়করা প্রায় আড়াই কোটি টাকা মূল্যের আম ধ্বংস ও আমে মেশানো কেমিক্যাল ও ফরমালিন জব্দ করা হয়।
pran
ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আব্দুস সালাম বাংলানিউজকে জানান, ১৯৬৯ সালের ও ২০০৫ সালের সংশোধনী বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ আইন এর ৬ (ক) ও ৭ ধারা মতে আটকদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে  উল্লেখিত রায় দেওয়া হয়েছে।

বিএসটিআই’র খুলনা বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাসুম বিল্লাহ ও মাঠ কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি পরীক্ষক দল পরীক্ষা করে প্রাণের আমে ১৮০ মিলিগ্রাম পরিমাণ ফরমালিনের উপস্থিতি পেয়েছেন।

মাসুম বিল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, মোট ৮৮৭টি ড্রামে মোট ৯০ মেট্রিক টন আম সংরক্ষণ করা হয়ে ছিলো।”

অভিযুক্ত এজেন্ট আবদুল মজিদ বাংলানিউজকে জানান, প্রাণ কোম্পানির সঙ্গে তাদের ২০০ টন আম দেওয়ার চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির পর বিভিন্ন স্থান থেকে আম সংগ্রহ করে তিনি স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে প্রসেসিং করেছেন মাত্র। এসব কিছুর তদারকি করেছে প্রাণ কোম্পানির নিয়োজিত কর্মকর্তা খলিলুর রহমান। আমে ফরমালিন মেশালে প্রাণের লোকেরা করেছেন বলে তিনি জানান।

অভিযুক্ত কারখানার মালিক আবদুল মজিদ দাবি করেন, তিনি গত ৫ মে ঢাকা গাবতলী সেন্ট্রাল মার্কেটের মামা গ্রুপ থেকে ২০০ টন সংরক্ষিত আম সরবরাহ করার জন্য চুক্তি করেন ও সে অনুযায়ী আম কেটে কেমিক্যাল মিশিয়ে সংরক্ষণ করেন। যার সার্বিক তত্বাবধানে ছিলেন প্রাণের নাটোরের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।”


কোম্পানির জুনিয়র এক্সিকিউটিভ মুরাদ হোসেন জানান, তারা এজেন্টদের কাছ থেকে শর্ত মোতাবেক আম কিনে থাকেন।

তাহলে ড্রামে ভরে কেমিক্যাল মিশিয়ে নিচ্ছেন কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকেন।

জেলা প্রশাসক মাহমুদ হাসান বাংলানিউজকে জানান, “ফরমালিনসহ নানা ধরনের বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে প্রাণ কোম্পনি যেটা করেছে আমরা প্রাথমিকভাবে তাদের আইনের আওতায় এনেছি। এটি খেয়ে আমাদের দেশের শিশুসহ নানা শ্রেণীর মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।”

গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার বাংলানিউজকে জানান, “মানবদেহে যেখানে শূন্য টলারেন্স পরিমাণ ফরমালিন সহনীয়। সেখানে প্রাণ কোম্পানি ওই প্রক্রিয়াজাত করা আমে ১৮০ মিলিগ্রাম ফরমালিনসহ ক্ষতিকারক বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে জন সাধারণের ক্ষতি করছে।

তিনি আরও জানান, “এখানে খোলা আকাশের নিচে অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে অদক্ষ লোক দিয়ে ফরমালিনসহ অন্যান্য কেমিক্যাল মেশানো আম দিয়ে প্রাণ কোম্পানি আমের আচারসহ জুস তৈরি করে।

স্থানীয়রা জানান, ভারত থেকে ঝড়ে পড়া আম এজেন্ট আবদুল মজিদের মাধ্যমে অত্যন্ত কম মূল্যে কিনে আনে প্রাণ। তাদের সম্পর্কে এলাকাবাসী খোঁজ নিতে গেলেই আবদুল মজিদের লোকেরা হুমকি দিত বলেও অভিযোগ করেন তারা।

No comments

Powered by Blogger.