সম্ভাবনার খাত হালকা প্রকৌশল শিল্প by জাহাঙ্গীর শাহ
পুরোনো ঢাকার আবদুল হাকিম মিয়া তাহেরবাগ লেনে দু-তিনজন কর্মচারী নিয়ে মেশিনের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির একটি ছোট্ট কারখানা স্থাপন করেন ১৯৮৫ সালে। সে সময় মাত্র কয়েক হাজার টাকা নিয়ে এই ব্যবসার যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয় এইচ টি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস। সেই থেকে আড়াই দশক ধরে এই কারখানাটি শুধু দেশেই নয়, শিল্পোন্নত ফ্রান্সেও শিল্পের খুচরা যন্ত্রাংশ রপ্তানি করে আসছে। এই কারখানায় এখন কাজ করেন ২০ থেকে ২৫ জন মেকানিক ও কর্মচারী। স্থানীয় বস্ত্র ও পাটকলের পাশাপাশি কৃষি খাতের মেশিনের যন্ত্রাংশও সরবরাহ করে থাকে এই হালকা প্রকৌশল শিল্পটি।
বিশেষজ্ঞদের মতো আবদুল হাকিম মিয়াও মনে করেন, একটি দেশের শ্রমঘন শিল্প খাতকে এগিয়ে নিতে হালকা প্রকৌশল শিল্পের বিকাশের কোনো বিকল্প নেই। আর এ কাজে পর্যাপ্ত সরকারি নীতি ও সহায়তা চান তিনি।
সাম্প্রতিক চীন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়া আরও পূর্বে ইউরোপ ও জাপান এই হালকা প্রকৌশল শিল্পকে ভিত্তি ধরেই আজ সারা বিশ্বে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া গেলে বাংলাদেশেও হালকা প্রকৌশল শিল্পের বড় বিকাশ ও বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার কথা সবার জানা। কিন্তু এ খাতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের তেমন মনোযোগ লক্ষ করা যায় না।
আবদুল হাকিম আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো ব্যবসা করতে ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন। কিন্তু দেশের ব্যাংকগুলো আমাদের গাড়ি কেনায় ঋণ দিতে যত আগ্রহী, ততটা এ ক্ষেত্রে নয়।’
এমন নানা সমস্যার পরও বাংলাদেশের হালকা প্রকৌশল শিল্প এক সম্ভাবনাময় খাত এবং এর বিকাশও হচ্ছে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি এসব যন্ত্রপাতির রপ্তানিও বাড়ছে। কয়েক বছর ধরেই বহির্বিশ্বে এর বাজারও তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে অবশ্য বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রপ্তানি কিছুটা ব্যাহত হয়, তবে আবার তা ঘুরেও দাঁড়িয়েছে।
সাধারণত, বাংলাদেশ থেকে এয়ারকন্ডিশন ও রেফ্রিজারেটরের যন্ত্রাংশ, ফ্যান, বৈদ্যুতিক তার, ব্যাটারি, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার, বাইসাইকেল, মোটরগাড়ির ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, সিরামিকস, ছোট মোটর যন্ত্র, পাইপ, টিউব, ব্রয়লার, ডাইসসহ নানা ধরনের হালকা যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানি হয়। নেদারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ভারত, চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানসহ বিভিন্ন দেশে এসব পণ্য রপ্তানি হয়।
আশির দশকের শুরু থেকে হালকা প্রকৌশলীর এসব যন্ত্রপাতি সীমিত পরিমাণে রপ্তানি শুরু হয়। এ ছাড়া স্থানীয় শিল্প, কৃষিসহ অন্যান্য খাতের কারখানায় প্রকৌশল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে এই খাতটি।
বিস্তৃতি: স্বাধীনতার পরপরই কিছু অবাঙালি উদ্যোক্তা পুরোনো ঢাকায় এই হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতির কারখানা করেন। সাধারণত গাড়ির যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, বাচ্চাদের খেলনার মাধ্যমেই সূত্রপাত হয় এই ব্যবসার। এখন এই ব্যবসা পুরোনো ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে বুড়িগঙ্গার ওপারেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, রংপুর, বগুড়া, যশোর, বরিশাল, সিলেট, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। বিদেশে চাহিদা থাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলছেন কোনো কোনো উদ্যোক্তা।
বর্তমানে সারা দেশে ৪০ হাজার হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় ছয় লাখ লোক কাজ করেন। আর এর মধ্যে মাত্র কমবেশি এক হাজার ২০০ প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে নিবন্ধিত রয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত সহযোগী শিল্পে আরও প্রায় ২০ লাখ কর্মরত।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পমালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, এই খাতটি দেশের অর্থনীতিতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি এবং সেবার জোগান দিয়ে যাচ্ছে।
ছোটখাটো একটি কারখানা তৈরি করতে কমপক্ষে চার-পাঁচ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। আর বড় আকারের একটি কারখানার জন্য কমবেশি ২০ কোটি টাকা পুঁজির প্রয়োজন পড়ে। তবে সক্ষমতা ও কারখানার যন্ত্রপাতি ব্যয় অনুযায়ী বিনিয়োগের পরিমাণ ওঠানামা করতে পারে।
রপ্তানি প্রবৃদ্ধি: চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সাড়ে পাঁচ কোটি ডলারের হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরের মোট ৩৫ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়। তবে এর আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩১ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৮ কোটি ১৩ লাখ ডলার, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৩১ কোটি ডলার ও ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সাড়ে ২৮ কোটি ডলারের প্রকৌশল যন্ত্রপাতি রপ্তানি হয়েছে।
২০০৬ সাল থেকেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের হালকা প্রকৌশল পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। সরকারও ২০০৭-০৯ সালের রপ্তানি নীতিতে হালকা প্রকৌশল খাতকে অগ্রাধিকার দেয়। এই খাতকে উৎসাহ দিতে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই রপ্তানি বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় দুই শতাংশই আসে হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি খাত থেকে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশেই এসব যন্ত্রপাতি বেশি রপ্তানি হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার পাশাপাশি অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশ সুবিধা (জিএসপি) পাওয়া যাচ্ছে।
উদ্যোক্তাদের দাবি: দেশের অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতের মতো হালকা প্রকৌশল শিল্প খাতের জন্য একটি পরিকল্পিত শিল্পপার্ক নির্মাণের দাবি করে আসছে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পমালিক সমিতি। শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া শিল্পপার্ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও এর কোনো অগ্রগতি নেই। এ ছাড়া শিল্পপতিরা এ খাতের জন্য একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্র নির্মাণের দাবিও করে আসছেন।
ব্যবসা শুরু করতে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, হালকা প্রকৌশল খাতটি এসএমই খাতে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ব্যাংক ঋণ দিতে গড়িমসি করে ব্যাংকগুলো।
সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক দাবি করেন, এ খাতের উন্নয়নে পুঁজির প্রাপ্যতা বা ব্যাংক ঋণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিভিন্ন সময়ে দাবিদাওয়াগুলো নিয়ে গেলে শুধু প্রতিশ্রুতি মেলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। প্রতিবছর প্রাক-বাজেট আলোচনায় এ শিল্পের সুরক্ষায় বিভিন্ন প্রস্তাব এলেও পরে তা আর আমলে নেওয়া হয় না।’
এ খাতের একটি বড় সমস্যা হলো হালকা প্রকৌশল শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করা মৌলিক লোহার (বেস মেটাল) ওপর শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক)। উদ্যোক্তারা এই শুল্ক ও মূসক প্রত্যাহারের দাবি জানান। বর্তমানে এই শুল্ক ও মূসক হার ৭ থেকে ১২ শতাংশ।
দেশের অভ্যন্তরে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি দেওয়া এবং এলপি গ্যাস সিলিন্ডার আমদানি পর্যায়ে সর্বোচ্চ শুল্ক নির্ধারণেরও দাবি জানান উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া দেশীয় ড্রাইসেল ব্যাটারি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর দাবিও রয়েছে উদ্যোক্তাদের। একই সঙ্গে তৈরি ফিল্টার আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর দাবিও রয়েছে তাঁদের।
বিআইডিএসের সমীক্ষা: ২০১০ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) হালকা প্রকৌশল শিল্প নিয়ে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত ও গবেষক নাজনীন আহমেদ এই সমীক্ষাটি পরিচালনা করেন।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সাধারণত ছয় থেকে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে এই ব্যবসা শুরু হয়। আর ১৪ থেকে ৫০ বছর বয়সী কর্মীরাই হালকা প্রকৌশল শিল্পে কাজ করে থাকেন। আর প্রতিদিন গড়ে ১১ ঘণ্টা কাজ করেন তাঁরা। তাঁদের মাসিক বেতন দুই থেকে ১৫ হাজার টাকা।
সরকারকে এই শিল্প খাতে সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করা হয় সমীক্ষায়। এতে বলা হয়, এই খাতটি বেশ সম্ভাবনাময়। পশ্চাৎসংযোগ শিল্প হিসেবে মূল শিল্পকে বেশ সহায়তা করছে হালকা প্রকৌশল শিল্প। এ ছাড়া দিন দিন এর রপ্তানি চাহিদাও বাড়ছে। সস্
তা শ্রমের জন্য এই শিল্পটি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতাসক্ষম বলেও মন্তব্য করা হয় সমীক্ষায়।
সাম্প্রতিক চীন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়া আরও পূর্বে ইউরোপ ও জাপান এই হালকা প্রকৌশল শিল্পকে ভিত্তি ধরেই আজ সারা বিশ্বে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া গেলে বাংলাদেশেও হালকা প্রকৌশল শিল্পের বড় বিকাশ ও বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার কথা সবার জানা। কিন্তু এ খাতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের তেমন মনোযোগ লক্ষ করা যায় না।
আবদুল হাকিম আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো ব্যবসা করতে ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন। কিন্তু দেশের ব্যাংকগুলো আমাদের গাড়ি কেনায় ঋণ দিতে যত আগ্রহী, ততটা এ ক্ষেত্রে নয়।’
এমন নানা সমস্যার পরও বাংলাদেশের হালকা প্রকৌশল শিল্প এক সম্ভাবনাময় খাত এবং এর বিকাশও হচ্ছে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি এসব যন্ত্রপাতির রপ্তানিও বাড়ছে। কয়েক বছর ধরেই বহির্বিশ্বে এর বাজারও তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে অবশ্য বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রপ্তানি কিছুটা ব্যাহত হয়, তবে আবার তা ঘুরেও দাঁড়িয়েছে।
সাধারণত, বাংলাদেশ থেকে এয়ারকন্ডিশন ও রেফ্রিজারেটরের যন্ত্রাংশ, ফ্যান, বৈদ্যুতিক তার, ব্যাটারি, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার, বাইসাইকেল, মোটরগাড়ির ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ, সিরামিকস, ছোট মোটর যন্ত্র, পাইপ, টিউব, ব্রয়লার, ডাইসসহ নানা ধরনের হালকা যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানি হয়। নেদারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ভারত, চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানসহ বিভিন্ন দেশে এসব পণ্য রপ্তানি হয়।
আশির দশকের শুরু থেকে হালকা প্রকৌশলীর এসব যন্ত্রপাতি সীমিত পরিমাণে রপ্তানি শুরু হয়। এ ছাড়া স্থানীয় শিল্প, কৃষিসহ অন্যান্য খাতের কারখানায় প্রকৌশল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে এই খাতটি।
বিস্তৃতি: স্বাধীনতার পরপরই কিছু অবাঙালি উদ্যোক্তা পুরোনো ঢাকায় এই হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতির কারখানা করেন। সাধারণত গাড়ির যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, বাচ্চাদের খেলনার মাধ্যমেই সূত্রপাত হয় এই ব্যবসার। এখন এই ব্যবসা পুরোনো ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে বুড়িগঙ্গার ওপারেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, রংপুর, বগুড়া, যশোর, বরিশাল, সিলেট, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। বিদেশে চাহিদা থাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলছেন কোনো কোনো উদ্যোক্তা।
বর্তমানে সারা দেশে ৪০ হাজার হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় ছয় লাখ লোক কাজ করেন। আর এর মধ্যে মাত্র কমবেশি এক হাজার ২০০ প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে নিবন্ধিত রয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত সহযোগী শিল্পে আরও প্রায় ২০ লাখ কর্মরত।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পমালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, এই খাতটি দেশের অর্থনীতিতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি এবং সেবার জোগান দিয়ে যাচ্ছে।
ছোটখাটো একটি কারখানা তৈরি করতে কমপক্ষে চার-পাঁচ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। আর বড় আকারের একটি কারখানার জন্য কমবেশি ২০ কোটি টাকা পুঁজির প্রয়োজন পড়ে। তবে সক্ষমতা ও কারখানার যন্ত্রপাতি ব্যয় অনুযায়ী বিনিয়োগের পরিমাণ ওঠানামা করতে পারে।
রপ্তানি প্রবৃদ্ধি: চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সাড়ে পাঁচ কোটি ডলারের হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরের মোট ৩৫ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়। তবে এর আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩১ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৮ কোটি ১৩ লাখ ডলার, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৩১ কোটি ডলার ও ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সাড়ে ২৮ কোটি ডলারের প্রকৌশল যন্ত্রপাতি রপ্তানি হয়েছে।
২০০৬ সাল থেকেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের হালকা প্রকৌশল পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। সরকারও ২০০৭-০৯ সালের রপ্তানি নীতিতে হালকা প্রকৌশল খাতকে অগ্রাধিকার দেয়। এই খাতকে উৎসাহ দিতে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই রপ্তানি বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় দুই শতাংশই আসে হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি খাত থেকে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশেই এসব যন্ত্রপাতি বেশি রপ্তানি হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার পাশাপাশি অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশ সুবিধা (জিএসপি) পাওয়া যাচ্ছে।
উদ্যোক্তাদের দাবি: দেশের অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতের মতো হালকা প্রকৌশল শিল্প খাতের জন্য একটি পরিকল্পিত শিল্পপার্ক নির্মাণের দাবি করে আসছে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পমালিক সমিতি। শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া শিল্পপার্ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও এর কোনো অগ্রগতি নেই। এ ছাড়া শিল্পপতিরা এ খাতের জন্য একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্র নির্মাণের দাবিও করে আসছেন।
ব্যবসা শুরু করতে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, হালকা প্রকৌশল খাতটি এসএমই খাতে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ব্যাংক ঋণ দিতে গড়িমসি করে ব্যাংকগুলো।
সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক দাবি করেন, এ খাতের উন্নয়নে পুঁজির প্রাপ্যতা বা ব্যাংক ঋণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিভিন্ন সময়ে দাবিদাওয়াগুলো নিয়ে গেলে শুধু প্রতিশ্রুতি মেলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। প্রতিবছর প্রাক-বাজেট আলোচনায় এ শিল্পের সুরক্ষায় বিভিন্ন প্রস্তাব এলেও পরে তা আর আমলে নেওয়া হয় না।’
এ খাতের একটি বড় সমস্যা হলো হালকা প্রকৌশল শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করা মৌলিক লোহার (বেস মেটাল) ওপর শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক)। উদ্যোক্তারা এই শুল্ক ও মূসক প্রত্যাহারের দাবি জানান। বর্তমানে এই শুল্ক ও মূসক হার ৭ থেকে ১২ শতাংশ।
দেশের অভ্যন্তরে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার উৎপাদন পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি দেওয়া এবং এলপি গ্যাস সিলিন্ডার আমদানি পর্যায়ে সর্বোচ্চ শুল্ক নির্ধারণেরও দাবি জানান উদ্যোক্তারা। এ ছাড়া দেশীয় ড্রাইসেল ব্যাটারি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর দাবিও রয়েছে উদ্যোক্তাদের। একই সঙ্গে তৈরি ফিল্টার আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর দাবিও রয়েছে তাঁদের।
বিআইডিএসের সমীক্ষা: ২০১০ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) হালকা প্রকৌশল শিল্প নিয়ে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত ও গবেষক নাজনীন আহমেদ এই সমীক্ষাটি পরিচালনা করেন।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সাধারণত ছয় থেকে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে এই ব্যবসা শুরু হয়। আর ১৪ থেকে ৫০ বছর বয়সী কর্মীরাই হালকা প্রকৌশল শিল্পে কাজ করে থাকেন। আর প্রতিদিন গড়ে ১১ ঘণ্টা কাজ করেন তাঁরা। তাঁদের মাসিক বেতন দুই থেকে ১৫ হাজার টাকা।
সরকারকে এই শিল্প খাতে সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করা হয় সমীক্ষায়। এতে বলা হয়, এই খাতটি বেশ সম্ভাবনাময়। পশ্চাৎসংযোগ শিল্প হিসেবে মূল শিল্পকে বেশ সহায়তা করছে হালকা প্রকৌশল শিল্প। এ ছাড়া দিন দিন এর রপ্তানি চাহিদাও বাড়ছে। সস্
তা শ্রমের জন্য এই শিল্পটি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতাসক্ষম বলেও মন্তব্য করা হয় সমীক্ষায়।
No comments