ঠিকানা শুধুই বৃদ্ধাশ্রম... by রুবেল হাবিব

‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার/ নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/ সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি/ ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/ আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’ নচিকেতার গানের মতোই জীবন এখানকার মানুষের। সব-হারানো বাবা-মায়ের সন্তান হয়ে তাঁদের আগলে রেখেছেন খতিব আবদুল জাহিদ। গড়ে তুলেছেন বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি পালিত হলো প্রবীণ দিবস। প্রবীণ দিবস উপলক্ষে এই বিশেষ প্রতিবেদন।

ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে বাড়ি আয়েশা বেগমের। ছেলের বাসা ঢাকার মিরপুর। আপনজন বলতে তাঁর রয়েছে ছেলের বউ আর নাতি। সেখানেই থাকার কথা আয়েশা বেগমের। একসময় কোলে-পিঠে করে ছেলেকে মানুষ করেছেন। নাতিকে আগলে রেখেছেন বুকে। স্বামী মারা যাওয়ার পর যখন শেষ সম্বল হিসেবে আঁকড়ে ধরবেন ছেলের হাত, তখনই সেই হাত ফসকে ছেলেও চলে যায় না ফেরার দেশে। তবে যাওয়ার আগে ঢাকার মিরপুরে বিশাল বাড়ি করে যায়। জীবনের শেষ কটা দিন নাতি আর নাতবউয়ের সঙ্গে সেখানেই থাকবেন, এমনটাই আশা ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধার। অত বড় বাড়িতে আয়েশা বেগমের জায়গা হবে না, তা তো নয়। হবেই। এমনটা আশা করেই সেই হরিণাকুণ্ডু থেকে রওনা হয়েছিলেন তিনি। একাই। মিরপুর পর্যন্ত এসেও ছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে ছেলের বাসার ঠিকানা হারিয়ে ফেলেন। সময়টা সবে সন্ধ্যা পার হয়েছে। মিরপুরের এক রাস্তায় কাঁদতে থাকেন পথ হারানো শিশুর মতো। বৃদ্ধ হলে মানুষ তো শিশুই হয়ে যায়। কান্না শুনে এগিয়ে আসে কিছু তরুণ। রাত ১১টার দিকে আয়েশা বেগমকে নিয়ে একটি সিএনজি এসে থামে গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের গেটে। তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন এখানকার কর্মীরা। তাঁর ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে ব্যাগ হাতড়ে বের হয় একটি বিয়ের কার্ড। বেশ কয়েক মাস আগে নাতির বিয়ে হয়েছে। সেই কার্ডের সূত্র ধরে ফোন করা হয় আয়েশা বেগমের ছেলের বউকে। সেখান থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, আয়েশা বেগমের থাকার জায়গা সেখানে নেই। তাঁকে যেন বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রেই রাখা হয়। সেই থেকে আয়েশা বেগমের ঠিকানা বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র, বিশিয়া, হোতাপাড়া, গাজীপুর।
কানে শোনেন না মণীন্দ্র চন্দ্র। একটা মেশিনের সাহায্যে তাঁর সঙ্গে বাক্য বিনিময় করতে হয়। যার এক প্রান্ত তাঁর কানের সঙ্গে লাগানো, আরেক প্রান্ত তাঁর শার্টের পকেটে। তিনি বই পড়ছিলেন। সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দিতেই সম্ভবত সেই মেশিনের শব্দতরঙ্গ বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর হাতে যে বই তার নাম স্বাস্থ্য ভালো রাখার আটটি সহজ উপায়। নিজের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতেই হাসলেন তিনি। জানালেন, স্ত্রী গত হয়েছে বেশ কয়েক বছর। তারপর স্বাস্থ্যর দিকে আর নজর দিতে পারেননি। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। তারা মানুষও হয়েছে। দুই ছেলে, এক মেয়ে তাঁর। মণীন্দ্রর কথায় জানা যায়, বড় ছেলে একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। ছোট ছেলে কানাডায় থাকেন। একমাত্র মেয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছোট ছেলে দেশে এলেই তাঁকে দেখতে আসেন। নিয়ে যেতে চান সেখানে। কিন্তু ওই দেশে গিয়ে থাকার ইচ্ছা নেই মণীন্দ্র চন্দ্রের। তিনি দেশেই কারও সঙ্গে থাকতে চান। বড় ছেলে একটু কম আসেন। মেয়েটা প্রায়ই খোঁজখবর নেন। আসেনও। কিন্তু দেশে ছেলেমেয়ে থাকলেও সেখানে থাকার জায়গা হয়নি মণীন্দ্রর। সরকারি তোলারাম কলেজের হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন তিনি। ছাত্রদের বুঝিয়েছেন রেওয়ামিল, জাবেদা, নগদান বহিসহ নানা রকম হিসাব-নিকাশ। গাজীপুর, হোতাপাড়ার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের সামনে বেঞ্চে বসে তিনি হয়তো অনেক দিন ধরেই নিজের জীবনের চূড়ান্ত হিসাব মেলাতে চান।

কিশোরের মনে বড় দাগ
ঘটনাটা হয়তো অনেকেই জানেন। আবারও বলা যায়। এটা এমনই এক ঘটনা যা কখনো পুরোনো হয় না। এই ঘটনার স্থান সবুজ শ্যামল এক গ্রাম। যেখানে মুকুল নামের দুরন্ত এক শিশু বেড়ে উঠছে। তাঁর বয়স যখন ১২-১৩ বছর, তখনই এ ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি। তাঁর বাড়ির পাশের এক বৃদ্ধাকে একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে কাঁদতে দেখেন। তাঁর কাছে গিয়ে জানতে চান কান্নার কারণ। বৃদ্ধা জানান, তাঁর সন্তানেরা আর তাঁকে বাড়িতে রাখতে চায় না। যাদের তিনি কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন, এই পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখিয়েছেন তাদের কাছেই ঠাঁই হচ্ছে না এই বৃদ্ধার। এখন কোলে যে শিশু আছে সে বৃদ্ধার নাতি। নাতিরা যেমন তাঁকে ছাড়তে চায় না, তেমনি বৃদ্ধাও তাদের ছেড়ে কোথায় গিয়ে থাকবেন, তা ভেবে পান না। এ ঘটনা দাগ কাটে ওই কিশোরের মনে। তখনই সিদ্ধান্ত নেন, এসব অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করবেন। যাঁদের পৃথিবীতে সন্তান থাকার পরও না থাকার অবস্থা হয়, তাঁদের সন্তান হয়ে আশ্রয় দেবেন তিনি। সেই চিন্তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটান মুকুল। এ বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। পুরো নাম খতিব আবদুল জাহিদ। মুকুল নামে সবার কাছে পরিচিত তিনি।

প্রতিদিনের জীবনযাপন
এখানে আছেন দুই শতাধিক প্রবীণ। এর মধ্যে শতাধিকই নারী। তবে এ সংখ্যা নিয়মিতই কমে-বাড়ে। এক কাপড়ে কোনো প্রবীণ যদি এখানে চলে আসেন তাঁকে আর বাকি জীবন নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না। তাঁর পোশাক, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ প্রয়োজনীয় ও নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এখানে এলে একটি নিয়মের মধ্যেই থাকতে হয়। খাবার গ্রহণ থেকে শুরু করে প্রতিদিনের দিনযাপন সবকিছুই নিয়মমতো। প্রবীণদের সকাল শুরু হয় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। সব ধর্মের মানুষের জন্য পৃথক প্রার্থনার ব্যবস্থা আছে। প্রার্থনা শেষে অনেকেই হাঁটতে বের হন। সকাল আটটার মধ্যে নাশতা তৈরি হয়ে যায়। সকালে খাবারের মধ্যে রয়েছে, আটার রুটি অথবা ভাত। সঙ্গে থাকে ডাল ও সবজি। যাঁর যেটা ভালো লাগে তিনি সেটাই খেতে পারেন। নাশতার পরপরই অনেকে নিজের কাজ করেন অথবা খেলাধুলা করেন। খেলাধুলার মধ্যে আছে—ক্যারম, লুডু, দাবাসহ সব ইনডোর আয়োজন। এরই মধ্যে দুপুর হয়ে যায়। গোসল সেরে প্রার্থনায় বসেন অনেকেই। তারপর দুপুরের খাবার খান। দুপুরের খাবারের তালিকায় আছে ভাত, মাছ, ডাল ও সবজি। খাবার শেষে বিশ্রাম। কেউ চাইলে এই সময় টিভি দেখেন এবং নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব সেরে নেন। আসরের আজানের পরপরই চা-নাশতা চলে আসে। নাশতা সেরে অনেকেই হাঁটতে বের হন। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ শেষে টিভি দেখতে যান অনেকে অথবা নিজেদের মধ্যে সময় কাটান। রাতের খাবারের তালিকায় আছে ভাত ও রুটি। এই হলো নিয়মিত রুটিন। যাঁদের চিকিৎসার জন্য আলাদা খাবার খেতে হয়, তাঁদের জন্যও ব্যবস্থা আছে। ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন খালেদ হাসান। বয়স ৬০ পেরিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি একজন স্ট্রোকের রোগী। এখানে নিয়মিত চিকিৎসা, ওষুধ ও ভালো খাবারদাবার পাই। তাই এখানেই আছি পাঁচ বছর হলো।’ খালেদ হাসান জানান, বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও এক ছেলে আছে। সেখানে নিয়মিত খাবার ও ওষুধ জোটে না বলে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে আছেন তিনি।

‘তিনি আমাদের বাবা’
‘বাসায় থাকলে বহুত ঝামেলা হয়, এই বাজার করো, বিদ্যুৎ বিল দিতে যাও, গ্যাস বিল দাও। এত ঝামেলা আর ভালো লাগে না বলে এখানে এসে থাকি। এখানে বাবা (মুকুল) আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সময়মতো খাওয়াদাওয়া এবং ইবাদত-বন্দেগি করতে পারি। এসব নিয়েই আছি। তিনি আমাদের বাবা, আমাদের সন্তান।’ এখানে থাকার কারণটা এভাবেই ব্যাখ্যা করলেন হাফেজ মো. আমিন শরীফ। তাঁর দুটি মেয়ে। চট্টগ্রামে তাঁর আলিশান বাড়ি আছে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর। তারপর থেকে এখানেই তিনি। মাঝখানে কিছুদিন ছিলেন না। তারপর আবার এসেছেন। এখন প্রতিদিন নিয়ম করে এখানকার কবরস্থানের পাশে দুই ঘণ্টা পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করেন। কবরস্থানের পাশে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে থাকলে বছরে দুবার ছুটি পাওয়া যায়। তখন মেয়েদের কাছে গিয়ে থেকে আসি। আমি বাবাকে বলে দিয়েছি আমার মৃত্যু হলে যেন এখানেই কবর দেওয়া হয়।’

ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়
৭২ বিঘা জমির ওপর যে পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে ঢুকলে যে কারও মন ভালো হয়ে যাবে। ঢুকতেই সারি সারি গাছ স্বাগত জানাবে। গাছগুলো যারা লাগিয়েছে, তাদের নামফলকও দেওয়া আছে। তারপরই মেডিকেল ক্যাম্প। পুরুষদের থাকার ইউনিট। সামনে এগিয়ে গেলে পুকুর ও অফিস কক্ষ। পাশেই মহিলাদের থাকার ইউনিট ও রান্নাঘর। সামনে-পেছনে বিশাল বাগান। প্রায় সব রকমের ফলদ ও ঔষধি গাছ। মহিলাদের ইউনিট থেকে সামনে এগোলে বিশ্রামখানা আর পুকুর। পুকুরে পদ্মফুল এবং নৌকা আছে। পুকুরের সামনে মসজিদ, অজুখানা ও লিচুবাগান। মসজিদ থেকে ৭২ বিঘার সীমানা দিয়ে হাঁটলে সামনে পড়বে কবরস্থান। পুরো কেন্দ্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বসার বেঞ্চ ও নিরাপত্তা বুথ। সবুজ ঘাসের কার্পেট ভেদ করে অলংকরণের মতো বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ইটের তৈরি পায়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তায় দুপাশে রয়েছে পানির লাইন ও লাইট। যেন অন্ধকারেও সহজেই চিনে নেওয়া যায় বৃদ্ধাশ্রমের পথঘাট। এখানকার প্রবীণ ব্যক্তিদের ঘুম ভাঙে অজস্র পাখির ডাকে।
পুরো বাগান পরিচর্যার জন্য কর্মীরাও রয়েছেন সদাতৎপর। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এ ৭২ বিঘা জমির অনেকটাই চাষযোগ্য। এখানে সবজি এবং ধান চাষ করা হয়। পুকুরে করা হয় মাছ চাষ, যা প্রবীণ ব্যক্তিদের নিত্য খাবারের চাহিদা পূরণ করে।

যেভাবে আসেন বৃদ্ধরা
আবদুল জাহিদ প্রায়ই গভীর রাতে ঢাকা শহরে ঘুরতে বের হন। রাস্তায় একা কোনো প্রবীণকে ঘুমাতে দেখলে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে আসেন পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এখানেই শেষ নয়, দেশের বিভিন্ন জেলখানায় খোঁজখবর রাখেন তিনি। কোনো অসহায় নিরপরাধ বৃদ্ধকে আটক অবস্থায় দেখলে তাঁর জামিনের ব্যবস্থা করেন। যোগাযোগ করলে ষাটোর্ধ্ব যে কেউ এসে বিনা পয়সায় এখানে থাকতে পারেন। পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে ০১৭১৪০৯৬৩২৫ নম্বরে।
‘এখানে না এলে বা চাকরি না করলে মানুষের জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা হতো না। মানুষ কতটা কষ্টে থাকলে নিজের সবকিছু ছেড়ে এখানে আসে তা জানা হতো না।’ কথাগুলো বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. আবু শরীফের।
প্রায় এক যুগ ধরে এখানে বয়স্কদের দেখাশোনা করছেন আবু শরীফ। ১৯৯৫ সালে এসে যোগ দেন হাবিবা খন্দকার। হোস্টেল সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এই মহিলা নিজের জীবনের দায়িত্ব পালনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এসব মানুষের সেবা করার ব্যাপারটাকে। তিনি বলেন, ‘মানুষের জন্য কাজ করার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই ছিল। আমার স্যার (খতিব আবদুল জাহিদ মুকুল) আমাকে এখানে নিয়ে এসে সে সুযোগ করে দিয়েছেন। এখানে অসহায় মানুষের সেবা করতে পারছি, এটাই আমার জীবনের বড় পাওয়া।’
aopurno@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.