ঝিমিয়ে পড়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় by কাদের গনি চৌধুরী
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজই ঠিকমত চলছে না। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শাসকদল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঘুমিয়ে এবং বিদেশ ভ্রমণ করে তিন বছর পার করে দিতে যাচ্ছেন। প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ব্যক্তিগত ও দলীয় কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন। মন্ত্রণালয়ে এলে থাকেন দলীয় কর্মীবেষ্টিত হয়ে। দলীয় লোকজনের সঙ্গে আড্ডা আর ফাইল দেখতে দেখতে তার সময় কেটে যায়। মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাড়তি সময় দেয়ার কোনো সুযোগই নেই তার। ফলে যাচ্ছেতাইভাবে চলছে মন্ত্রণালয়টি।
এলজিআরডি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মাসে তিন থেকে চার দিন অফিস করেন সৈয়দ আশরাফুল। তা-ও থাকেন এক থেকে দুই ঘণ্টা। এ আসাও মন্ত্রণালয়ে কাজ করার জন্য নয়। প্রতি সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে যোগ দিতে সপ্তাহে একদিন সচিবালয়ে আসতে হয় তাকে। বৈঠক শেষে যাওয়ার পথে কিংবা বৈঠক শুরুর আগে কিছু সময় কাটান তিনি নিজ দফতরে। তার ওপর ঘনঘন বিদেশ সফরের কারণে মন্ত্রিসভার অনেক বৈঠকেও তিনি থাকেন না। এখনও তিনি বিদেশ সফরে আছেন। গত মঙ্গলবার দুই সপ্তাহের জন্য লন্ডন গেছেন তিনি। শুধু মন্ত্রণালয়ই নয়, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তিনি
সভানেত্রীর ধানমন্ডির অফিসেও যান না। আশরাফুলের ঘনিষ্ঠরা জানান, তিনি অনেক রাত করে ঘুমান, তাই দুপুরের আগে ঘুম থেকে উঠতে পারেন না। মন্ত্রিসভার বৈঠক এবং জরুরি প্রোগ্রাম থাকলে তার পিএস অশোক মাধব রায় ফোন করে ঘুম থেকে জাগান। জরুরি কোনো ফাইল থাকলে এপিএস সেলিম খান মন্ত্রীর হেয়ার রোডের বাসায় দৌড়ান। কখনও হাতে হাতে ফাইল স্বাক্ষর করিয়ে নেন আবার কখনও এক সপ্তাহ লেগে যায়। যার কারণে মন্ত্রীর অফিস ও সরকারি বাসায় ফাইলের স্তূপ জমেছে। ফাইল স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে তিনি বড় খুঁতখুঁতে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। পুরো ফাইল পড়ে তবেই সই করেন তিনি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর অফিস না করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীও জানেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কাজে মনোযোগী হতে নির্দেশ দিয়েছেন। সে নির্দেশও মানছেন না তিনি। মন্ত্রীর ঘনঘন বিদেশ সফর আর অনুপস্থিতির কারণে স্থবির হয়ে পড়ছে স্থানীয় সরকার প্রশাসন।
এলজিআরডি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার কারণে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ মাসের পর মাস ফাইলবন্দি হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সরকারের অবহেলায় সারাদেশের স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নের গতি থমকে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর আদেশ-নির্দেশও কার্যকর হচ্ছে না। জানা গেছে, মন্ত্রীর বিদেশ সফরের সময় মন্ত্রণালয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। সরকারের পৌনে তিন বছরে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মাত্র তিন মাস অফিস করেছেন। বাসাকেই অফিস বানিয়েছেন তিনি। ফলে সারাদেশ থেকে আসা বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তারা অফিসে না পেয়ে এলাকায় ফিরে যান। আবার বাসায় সব মানুষের প্রবেশাধিকার না থাকায় মন্ত্রীর পরিচিত নেতা বা আত্মীয়স্বজন ছাড়া অন্য কেউ সহজে তাকে পান না। এছাড়া মন্ত্রী ঘনঘন বিদেশ সফর করায় তার মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তারা অলস সময় কাটাতে হাজিরা দেন মাত্র। তবে মন্ত্রীর এপিএস থাকেন বেশ দাপটে। এপিএস সেলিম খান নানা কাজের তদবির করে বেড়ান বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি অর্ধকোটি টাকা মূল্যের গাড়ি দাবড়ে বেড়ান। মন্ত্রীর ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, তিনি কারও ব্যাপারে তদবির নেন না।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ শুধু মন্ত্রী নন, তিনি শাসকদল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। সারাদেশের দলীয় নেতারা তার সঙ্গে দেখা করতে এলে দেখা পান না। ফলে নেতাকর্মীরা তার কাছ থেকে কোনো দিকনির্দেশনাও পান না। অভিযোগ রয়েছে, এ কারণে অনেক জেলা কমিটি অনুমোদন পাচ্ছে না। ফলে সাংগঠনিকভাবে দল বিভিন্ন জেলায় স্থবির হয়ে আছে। এমনকি সিটি করপোরেশনের মেয়ররাও সাক্ষাত্ পান না তার। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনও রিসিভ করেন না তিনি। পারতপক্ষে দলীয় কার্যালয়মুখো হন না। নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এ নিয়ে দলের নেতারা আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছেন। এলজিআরডি মন্ত্রীর খামখেয়ালিপনার কারণে অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীও বিব্রত হন বলে জানা গেছে। তবে এ নিয়ে সৈয়দ আশরাফুলকে তিনি তেমন কিছু বলেনও না। সৈয়দ আশরাফ কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য। তার নির্বাচনী এলাকায় যান কালেভদ্রে অথচ সুযোগ পেলেই লন্ডন সফরে যান।
এলজিআরডি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের মাসিক বৈঠকেও তিনি প্রায়ই অনুপস্থিত থাকছেন। এ কারণে তার হেয়ার রোডের সরকারি বাসায় গুরুত্বপূর্ণ ফাইল অনুমোদনের জন্য নিয়ে যান সচিবসহ পদস্থ কর্মকর্তারা। তারপরও ফাইলে স্বাক্ষর করতে আগ্রহ কমই দেখান মন্ত্রী। তিনি পারতপক্ষে এক সপ্তাহের আগে কোনো ফাইলের অনুমোদন দেন না। ব্যস্ততার কথা বলে কর্মকর্তাদের অনেক সময় ফিরিয়ে দেন।
মন্ত্রীর নিয়মিত অনুপস্থিতি ও দাফতরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সঠিক নির্দেশনা না থাকায় কর্মকর্তারা অনেক সময় জরুরি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কর্মকর্তারা অনেক সময় মন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করতেও ব্যর্থ হন। ফলে পিএস, এপিএসের কথামতই তাদের কাজ করতে হচ্ছে।
মন্ত্রীর উদাসীনতার কারণে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সূত্র জানায়, মন্ত্রীর মতো এপিএসও অনেক সময় পদস্থ কর্মকর্তাদের টেলিফোন রিসিভ করেন না। এ অবস্থায় অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে মন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়াই দাফতরিক আদেশ জারি করতে হচ্ছে। আদেশ জারির পর ফাইলে পুরনো তারিখে মন্ত্রীর স্বাক্ষর নেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনাররা কিছুদিন আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আসেন। একটি মামলার বিষয়ে দেখা করতে যান মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। কিন্তু মন্ত্রী নেই। এরপর তারা যান একই মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের দফতরে। সেখানেও সাক্ষাত্ পেলেন না, কারণ তিনিও নেই। অতঃপর সচিবের দফতরে। সচিব আবু আলম মো. শহিদ খানও বিদেশে। সর্বশেষ তারা সাক্ষাত্ করতে যান যুগ্ম সচিব আবদুুল মালেকের সঙ্গে। তাকেও পাওয়া যায়নি। তিনিও গেছেন বিদেশে। এভাবেই চলছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর খামখেয়ালিপনার কারণে এখনও কার্যকর হয়নি উপজেলা ব্যবস্থা। এমনকি অনেক চেয়ারম্যান অফিস পর্যন্ত পাননি। এ নিয়ে কথা বলার জন্য বার বার চেষ্টা করেও মন্ত্রীকে পাচ্ছেন না তারা।
সম্প্রতি উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের তোপের মুখে পড়তে হয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের এক সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। এক বছরেও উপজেলা পরিষদকে কার্যকর না করায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা মন্ত্রীর সামনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ব্যাপক হট্টগোল করেন। কয়েক দফা সমাবেশ বয়কটও করেন তারা। এ সময় আয়োজকরা তো বটেই, মন্ত্রী নিজেই বারবার ধৈর্য ধরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার অনুরোধ জানিয়েও বিক্ষোভ সামাল দিতে পারেননি। একপর্যায়ে বক্তৃতা সংক্ষেপ করে দ্রুত অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। তখন সমাবেশস্থলে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক বন্ধ রাখতে হয় অনুষ্ঠানের কার্যক্রম। এ সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ সভামঞ্চে ছিলেন। উপজেলা জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, সরকার গত এক বছর উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি আজও। এ নিয়ে চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানরা বেশ কয়েকবার ঢাকায় এলজিআরডি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন; কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
এলজিআরডি মন্ত্রীর অতিকথন : আশরাফুল ছিলেন আওয়ামী লীগের মধ্যে একজন ফ্রেশ ইমেজসম্পন্ন ব্যক্তি। কিন্তু ইদানীং তিনি অনেক আপত্তিকর কথা বলে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন : ‘জিয়া ও এরশাদের সময় গড়ে ওঠা প্রজন্ম নষ্ট প্রজন্ম। তাদের ঠিক করা সম্ভব নয়।’ একটি দেশের মন্ত্রী এবং সেই দেশের একটি বড় দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কথা কতটা দুর্ভাগ্যজনক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সম্মানে আয়োজিত ভোজ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি মুসলমানও নই, হিন্দুও নই। সম্প্রতি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক স্মরণসভায় তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য নতুন করে ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিছু কিছু পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল এ লক্ষ্যে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। গত জুলাই মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, তারেক রহমানই গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, জামায়াতপন্থী দৈনিক পত্রিকার একজন সম্পাদকের পীড়াপীড়িতে বেগম খালেদা জিয়া হরতাল আহ্বান করেছিলেন।
সভানেত্রীর ধানমন্ডির অফিসেও যান না। আশরাফুলের ঘনিষ্ঠরা জানান, তিনি অনেক রাত করে ঘুমান, তাই দুপুরের আগে ঘুম থেকে উঠতে পারেন না। মন্ত্রিসভার বৈঠক এবং জরুরি প্রোগ্রাম থাকলে তার পিএস অশোক মাধব রায় ফোন করে ঘুম থেকে জাগান। জরুরি কোনো ফাইল থাকলে এপিএস সেলিম খান মন্ত্রীর হেয়ার রোডের বাসায় দৌড়ান। কখনও হাতে হাতে ফাইল স্বাক্ষর করিয়ে নেন আবার কখনও এক সপ্তাহ লেগে যায়। যার কারণে মন্ত্রীর অফিস ও সরকারি বাসায় ফাইলের স্তূপ জমেছে। ফাইল স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে তিনি বড় খুঁতখুঁতে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। পুরো ফাইল পড়ে তবেই সই করেন তিনি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর অফিস না করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীও জানেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কাজে মনোযোগী হতে নির্দেশ দিয়েছেন। সে নির্দেশও মানছেন না তিনি। মন্ত্রীর ঘনঘন বিদেশ সফর আর অনুপস্থিতির কারণে স্থবির হয়ে পড়ছে স্থানীয় সরকার প্রশাসন।
এলজিআরডি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার কারণে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ মাসের পর মাস ফাইলবন্দি হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সরকারের অবহেলায় সারাদেশের স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নের গতি থমকে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর আদেশ-নির্দেশও কার্যকর হচ্ছে না। জানা গেছে, মন্ত্রীর বিদেশ সফরের সময় মন্ত্রণালয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। সরকারের পৌনে তিন বছরে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মাত্র তিন মাস অফিস করেছেন। বাসাকেই অফিস বানিয়েছেন তিনি। ফলে সারাদেশ থেকে আসা বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তারা অফিসে না পেয়ে এলাকায় ফিরে যান। আবার বাসায় সব মানুষের প্রবেশাধিকার না থাকায় মন্ত্রীর পরিচিত নেতা বা আত্মীয়স্বজন ছাড়া অন্য কেউ সহজে তাকে পান না। এছাড়া মন্ত্রী ঘনঘন বিদেশ সফর করায় তার মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তারা অলস সময় কাটাতে হাজিরা দেন মাত্র। তবে মন্ত্রীর এপিএস থাকেন বেশ দাপটে। এপিএস সেলিম খান নানা কাজের তদবির করে বেড়ান বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি অর্ধকোটি টাকা মূল্যের গাড়ি দাবড়ে বেড়ান। মন্ত্রীর ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, তিনি কারও ব্যাপারে তদবির নেন না।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ শুধু মন্ত্রী নন, তিনি শাসকদল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। সারাদেশের দলীয় নেতারা তার সঙ্গে দেখা করতে এলে দেখা পান না। ফলে নেতাকর্মীরা তার কাছ থেকে কোনো দিকনির্দেশনাও পান না। অভিযোগ রয়েছে, এ কারণে অনেক জেলা কমিটি অনুমোদন পাচ্ছে না। ফলে সাংগঠনিকভাবে দল বিভিন্ন জেলায় স্থবির হয়ে আছে। এমনকি সিটি করপোরেশনের মেয়ররাও সাক্ষাত্ পান না তার। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনও রিসিভ করেন না তিনি। পারতপক্ষে দলীয় কার্যালয়মুখো হন না। নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এ নিয়ে দলের নেতারা আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছেন। এলজিআরডি মন্ত্রীর খামখেয়ালিপনার কারণে অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীও বিব্রত হন বলে জানা গেছে। তবে এ নিয়ে সৈয়দ আশরাফুলকে তিনি তেমন কিছু বলেনও না। সৈয়দ আশরাফ কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য। তার নির্বাচনী এলাকায় যান কালেভদ্রে অথচ সুযোগ পেলেই লন্ডন সফরে যান।
এলজিআরডি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের মাসিক বৈঠকেও তিনি প্রায়ই অনুপস্থিত থাকছেন। এ কারণে তার হেয়ার রোডের সরকারি বাসায় গুরুত্বপূর্ণ ফাইল অনুমোদনের জন্য নিয়ে যান সচিবসহ পদস্থ কর্মকর্তারা। তারপরও ফাইলে স্বাক্ষর করতে আগ্রহ কমই দেখান মন্ত্রী। তিনি পারতপক্ষে এক সপ্তাহের আগে কোনো ফাইলের অনুমোদন দেন না। ব্যস্ততার কথা বলে কর্মকর্তাদের অনেক সময় ফিরিয়ে দেন।
মন্ত্রীর নিয়মিত অনুপস্থিতি ও দাফতরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সঠিক নির্দেশনা না থাকায় কর্মকর্তারা অনেক সময় জরুরি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কর্মকর্তারা অনেক সময় মন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করতেও ব্যর্থ হন। ফলে পিএস, এপিএসের কথামতই তাদের কাজ করতে হচ্ছে।
মন্ত্রীর উদাসীনতার কারণে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সূত্র জানায়, মন্ত্রীর মতো এপিএসও অনেক সময় পদস্থ কর্মকর্তাদের টেলিফোন রিসিভ করেন না। এ অবস্থায় অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে মন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়াই দাফতরিক আদেশ জারি করতে হচ্ছে। আদেশ জারির পর ফাইলে পুরনো তারিখে মন্ত্রীর স্বাক্ষর নেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনাররা কিছুদিন আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আসেন। একটি মামলার বিষয়ে দেখা করতে যান মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। কিন্তু মন্ত্রী নেই। এরপর তারা যান একই মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের দফতরে। সেখানেও সাক্ষাত্ পেলেন না, কারণ তিনিও নেই। অতঃপর সচিবের দফতরে। সচিব আবু আলম মো. শহিদ খানও বিদেশে। সর্বশেষ তারা সাক্ষাত্ করতে যান যুগ্ম সচিব আবদুুল মালেকের সঙ্গে। তাকেও পাওয়া যায়নি। তিনিও গেছেন বিদেশে। এভাবেই চলছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর খামখেয়ালিপনার কারণে এখনও কার্যকর হয়নি উপজেলা ব্যবস্থা। এমনকি অনেক চেয়ারম্যান অফিস পর্যন্ত পাননি। এ নিয়ে কথা বলার জন্য বার বার চেষ্টা করেও মন্ত্রীকে পাচ্ছেন না তারা।
সম্প্রতি উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের তোপের মুখে পড়তে হয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের এক সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। এক বছরেও উপজেলা পরিষদকে কার্যকর না করায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা মন্ত্রীর সামনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ব্যাপক হট্টগোল করেন। কয়েক দফা সমাবেশ বয়কটও করেন তারা। এ সময় আয়োজকরা তো বটেই, মন্ত্রী নিজেই বারবার ধৈর্য ধরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার অনুরোধ জানিয়েও বিক্ষোভ সামাল দিতে পারেননি। একপর্যায়ে বক্তৃতা সংক্ষেপ করে দ্রুত অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। তখন সমাবেশস্থলে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক বন্ধ রাখতে হয় অনুষ্ঠানের কার্যক্রম। এ সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ সভামঞ্চে ছিলেন। উপজেলা জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, সরকার গত এক বছর উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি আজও। এ নিয়ে চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানরা বেশ কয়েকবার ঢাকায় এলজিআরডি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন; কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
এলজিআরডি মন্ত্রীর অতিকথন : আশরাফুল ছিলেন আওয়ামী লীগের মধ্যে একজন ফ্রেশ ইমেজসম্পন্ন ব্যক্তি। কিন্তু ইদানীং তিনি অনেক আপত্তিকর কথা বলে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন : ‘জিয়া ও এরশাদের সময় গড়ে ওঠা প্রজন্ম নষ্ট প্রজন্ম। তাদের ঠিক করা সম্ভব নয়।’ একটি দেশের মন্ত্রী এবং সেই দেশের একটি বড় দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কথা কতটা দুর্ভাগ্যজনক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সম্মানে আয়োজিত ভোজ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি মুসলমানও নই, হিন্দুও নই। সম্প্রতি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক স্মরণসভায় তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য নতুন করে ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিছু কিছু পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল এ লক্ষ্যে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। গত জুলাই মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, তারেক রহমানই গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, জামায়াতপন্থী দৈনিক পত্রিকার একজন সম্পাদকের পীড়াপীড়িতে বেগম খালেদা জিয়া হরতাল আহ্বান করেছিলেন।
No comments