সবুজ বিপ্লব কি থেমে যাবে by এ এম এম শওকত আলী
অধিকতর কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে ষাট দশকে সবুজ বিপ্লবের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ওই সময় বাংলাদেশে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বর্তমানের চেয়ে কম ছিল। একমাত্র কারণ জনসংখ্যা। সবুজ বিপ্লব মূলত তিনটি কৃষি উপকরণের ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে সূচিত হয়। এক. উচ্চফলনশীল বীজ (উফশী)। দুই. রাসায়নিক সার এবং তিন. সেচ। এর সঙ্গে যোগ করা যায় উপকরণ ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ।
এ উদ্যোগের আওতায় যে দুটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হয় তা হলো—ক. পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্তৃপক্ষ (১৯৫৯) এবং খ. পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (১৯৬১) অর্থাৎ যথাক্রমে বর্তমানের পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিএডিসি। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত করা হয় উল্লিখিত তিনটি কৃষি উপকরণ স্বল্পমূল্যে কৃষকের দোরগোড়ায় সরবরাহের দায়িত্ব। স্বল্পমূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন ছিল কৃষি খাতে ভর্তুকি। একই সঙ্গে প্রয়োজন ছিল কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যাতে করে খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য শস্যের উফশী বীজ উদ্ভাবন ও সরবরাহ করা সম্ভব হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করা হয়।
আশির দশকের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ভর্তুকি হ্রাসের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানে সচেষ্ট হয়। তাদের যুক্তি ছিল, ভর্তুকিতে অপচয় হয় প্রচুর এবং ভর্তুকি বন্ধ করে ওই উদ্বৃত্ত অর্থ অন্যান্য খাতে ব্যবহার করা সম্ভব। আশির দশকের শেষ পর্যায়ে এবং নব্বই দশকের প্রথমার্ধে সরকার দাতা সংস্থার পরামর্শে কৃষি উপকরণ বিপণনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নেয়। বিএডিসির সেচ ও সার বিতরণ কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। দাতাদের তরফ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয় বিএডিসিকে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সমাপ্ত করা হলেও এ সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকার ও দাতা সংস্থারা ভুলে যায়।
১৯৯৬-পরবর্তী সময়ে সরকার কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে। তার পর থেকেই এ ব্যবস্থাকে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এ দৃষ্টিভঙ্গির মূল ভিত্তি ছিল দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ১৯৯৬-পরবর্তী সময়ে সরকার বিএডিসিকে পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পুনর্গঠিত বিএডিসির রূপরেখা ১৯৯৯ সালে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়। সাম্প্রতিক কালে এ বিষয়টিকে অধিকতর মজবুত করার লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করে। কমিটি বর্তমানে কাজ করছে।
কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টি এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সবুজ বিপ্লবকে অধিকতর সুসংহত ও টেকসই করার জন্যই ভর্তুকির প্রয়োজন। উন্নত দেশে এ খাতে যে পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া হয় তার তুলনায় বাংলাদেশের ভর্তুকির পরিমাণ নিতান্তই নগণ্য। কারণ সম্পদের অপ্রতুলতা। এ জন্য প্রয়োজন কৃষি উৎপাদনসংক্রান্ত কোন উপখাতে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দেওয়া হবে তা চিন্তাভাবনা করে নির্ণয় করা। বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে তিনটি উপকরণের জন্যই ভর্তুকি দিচ্ছে। ভর্তুকির সুফল কী?
সম্প্রতি ভারতে সারের ওপর যে ভর্তুকি দেওয়া হয় তা সেদেশের সরকার পুনর্বিবেচনা করার অঙ্গীকার করেছে মর্মে বিদেশি এক পত্রিকায় ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্লেষণধর্মী এ সংবাদে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে আগামী এপ্রিল মাসে ভারত সরকার ভর্তুকি কর্মসূচি নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজাবে। উদ্দেশ্য এর ফলে কৃষক সুষম সার ব্যবহারে উৎসাহিত হবে। সুষম সার ব্যবহারের সুফল প্রধানত দুটি। এক. এর মাধ্যমে জমির উর্বরতা স্থায়িত্ব লাভ করে। দুই. অধিক ফলনও নিশ্চিত হয়। আলোচ্য সংবাদের প্রতিবেদনটি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে যথোপযুক্ত ভর্তুকির মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবকে স্থায়িত্ব দানের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। কারণ, ভারতে তিন দশক ধরেই সারে ভর্তুকির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ফসফরাস ও পটাশ সারের তুলনায় ইউরিয়া সারে অধিকতর ভর্তুকি প্রদান, যা তিন প্রকারের সারের সুষম ব্যবহারের পরিপন্থী।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা নতুন আঙ্গিকে ভর্তুকি কর্মসূচির অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও ইউরিয়ার জন্য প্রদত্ত ভর্তুকি অপরিবর্তিত রয়েছে। এর ফলে সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না মর্মে প্রতিবেদক মন্তব্য করেছেন। অপরিবর্তিত পরিস্থিতির বিশ্লেষণে দেখা যায় যে কারণটি রাজনৈতিক। ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধি করলে দেখা যায় কৃষকেরা প্রতিবাদমুখী হবে। এটাই হলো আশঙ্কা। এ জন্য ইউরিয়া সারের ভর্তুকির পরিমাণ অপরিবর্তিত রেখে অন্যান্য সারের ভর্তুকি হ্রাস করা হয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের অন্য কারণটি হলো, ভারতে ইউরিয়া সার উৎপাদনকারীদের একটি শক্তিশালী লবি বিদ্যমান। সবুজ বিপ্লবের ভবিষ্যত্ নিয়ে এ জন্য কৃষক ও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কামুক্ত নন। একজন কৃষক আরেকটি আশঙ্কার বিষয় উত্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, ১৯৬০ সালে যখন তাঁর পিতা প্রথম একটি নলকূপ স্থাপন করেছিলেন তখন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল মাত্র পাঁচ ফুট। বর্তমানে ৫৫ ফুটও পানি উত্তোলনের জন্য যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশের ভর্তুকি নীতি ভারতের অনুরূপ। এ দেশের বিশেষজ্ঞসহ নীতি-নির্ধারকেরা সুষম সার ব্যবহারের সুফল সমন্ধে মোটেই অজ্ঞ নন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ইউরিয়ার ওপর ভর্তুকির পরিমাণ অন্যান্য সারের তুলনায় অধিকতর। এ বিষয়ে ভারত যে ভ্রান্ত নীতি কয়েক দশক ধরে অনুসরণ করেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ একই নীতি অনুসরণে আগ্রহী। তবে বাংলাদেশে ২০০৯-১০ সালে কিছুটা পার্থক্যের ধারা বিদ্যমান। বর্তমানে ইউরিয়ার মূল্য কেজি প্রতি মাত্র ১০ টাকা। কৃষক পর্যায়ে ১২ টাকা। ভারতে এ সারের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় কেজি প্রতি আড়াই থেকে সাড়ে চার টাকা কম। ডিএপির মূল্য বাংলাদেশে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা। ভারতে ১৪.৫১ টাকা। পটাশ সারের কেজিপ্রতি মূল্য বাংলাদেশে ২৫ টাকা। ভারতে মাত্র ৬.৯১ টাকা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে ডিএপি, টিএসপি ও পটাশ সারের তুলনায় ভর্তুকি অধিকতর। কৃষি মন্ত্রণালয় সাহসের সঙ্গে আগের তুলনায় টিএসপি ও পটাশ সারের তুলনায় অর্ধেক হ্রাস করা সত্ত্বেও ইউরিয়ার মূল্য অপরিবর্তিত রয়েছে। ইউরিয়ার মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকার এ বিষয়ে কিছুটা হলেও উদাসীন। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিন প্রকার সারের মূল্যের মধ্যে পার্থক্যের পরিমাণ ভারতে অপেক্ষাকৃত কম। বাংলাদেশে বেশি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত ভর্তুকি নীতি প্রয়োজনীয় হলেও তা যথেষ্ট নয়। অন্য প্রয়োজনীয় বিষয়টি হলো এ বিষয়ে কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির অব্যাহত প্রচেষ্টা। সাধারণত এ কাজটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর করে থাকে। তবে মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা সংস্থাও এ বিষয়ে কারিগরি তথ্য দিতে সক্ষম। বর্তমানে যে বিষয়টি দৃশ্যমান তা হলো এ দুটি সংস্থাই বিক্ষিপ্তভাবে এ বিষয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করছে। প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা। এ ছাড়া মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল সারসংক্রান্ত যে নির্দেশিকা প্রকাশ করে, নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে প্রদত্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। যা করা হয়েছে তা হলো দুটি-একটি প্রকল্প। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্য প্রয়োজন প্রতিবছর নির্ধারিত কর্মসূচির। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা সংস্থা কয়েক বছর অন্তর মাটির উর্বরতাভিত্তিক মানচিত্র প্রকাশ করে থাকে। এসব মানচিত্রে শস্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের মাত্রার হার অনুযায়ী সংকটজনক এলাকাগুলো চিহ্নিত করা। বিএআরসি কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যে প্রতীয়মান হয় যে ১৯৮১-২০০৩ সময়কালে মাটির উর্বরতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উপাদান ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে, মাটিতে উপাদানভিত্তিক চাহিদার হার অপেক্ষাকৃত অধিক। আশঙ্কা এখানেই।
মাটির উর্বরতা হ্রাসের মাত্রা রোধের জন্যই সুষম সার ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সাম্প্রতিককালে টিএসপি ও পটাশ সারের মূল্য আগের তুলনায় অর্ধেক পর্যায়ে নিয়ে আসার ফলে কৃষকেরা এখন এ দুটি সার ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছেন। এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে জরিপের মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। মাটির উর্বরতার ভিত্তিতে উল্লিখিত মানচিত্রে যেসব উপজেলা সংকটময় মর্মে চিহ্নিত করা হয়েছে সেসব স্থানে অচিরেই সুষম সার ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশেও সবুজ বিপ্লবের অব্যাহত ধারা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এর ফলে খাদ্যনিরাপত্তা অধিকতর সংকটে আবদ্ধ হবে।
বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের মাত্রা লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরওয়ারি বৃদ্ধির হার এখনো অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে জাতীয় কৃষি এবং জাতীয় পানি নীতিতে ভূ-উপরিস্থ পানি সেচকার্যে অধিকতর ব্যবহারের স্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করা হয়। এ সত্ত্বেও তা আশানুরূপভাবে অর্জন সম্ভব হয়নি। বিএডিসির এক জরিপমতে, মোট ৫১ লাখ ২৬ হাজার ৮৫১ হেক্টর জমি ২০০৮-০৯ সালে সেচের আওতায় ছিল। এর মধ্যে শতকরা ৭৯ ভাগ জমি ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে সেচকার্য করা হয়েছিল। ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচকৃত এলাকার হার ছিল মাত্র শতকরা ২১ ভাগ।
জানা গেছে যে কৃষি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ভূ-উপরিস্থ পানির অধিকতর ব্যবহারের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং অন্তরায়ও প্রচুর। সম্পদের অপ্রতুলতা ব্যতীত, ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতাও কম। সবুজ বিপ্লব থেমে যাওয়ার আশঙ্কা এখানেই।
এ এম এম শওকত আলী: সাবেক কৃষি সচিব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
এ উদ্যোগের আওতায় যে দুটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হয় তা হলো—ক. পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্তৃপক্ষ (১৯৫৯) এবং খ. পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (১৯৬১) অর্থাৎ যথাক্রমে বর্তমানের পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিএডিসি। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত করা হয় উল্লিখিত তিনটি কৃষি উপকরণ স্বল্পমূল্যে কৃষকের দোরগোড়ায় সরবরাহের দায়িত্ব। স্বল্পমূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন ছিল কৃষি খাতে ভর্তুকি। একই সঙ্গে প্রয়োজন ছিল কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যাতে করে খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য শস্যের উফশী বীজ উদ্ভাবন ও সরবরাহ করা সম্ভব হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করা হয়।
আশির দশকের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ভর্তুকি হ্রাসের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানে সচেষ্ট হয়। তাদের যুক্তি ছিল, ভর্তুকিতে অপচয় হয় প্রচুর এবং ভর্তুকি বন্ধ করে ওই উদ্বৃত্ত অর্থ অন্যান্য খাতে ব্যবহার করা সম্ভব। আশির দশকের শেষ পর্যায়ে এবং নব্বই দশকের প্রথমার্ধে সরকার দাতা সংস্থার পরামর্শে কৃষি উপকরণ বিপণনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নেয়। বিএডিসির সেচ ও সার বিতরণ কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। দাতাদের তরফ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয় বিএডিসিকে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সমাপ্ত করা হলেও এ সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকার ও দাতা সংস্থারা ভুলে যায়।
১৯৯৬-পরবর্তী সময়ে সরকার কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে। তার পর থেকেই এ ব্যবস্থাকে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এ দৃষ্টিভঙ্গির মূল ভিত্তি ছিল দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ১৯৯৬-পরবর্তী সময়ে সরকার বিএডিসিকে পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পুনর্গঠিত বিএডিসির রূপরেখা ১৯৯৯ সালে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়। সাম্প্রতিক কালে এ বিষয়টিকে অধিকতর মজবুত করার লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করে। কমিটি বর্তমানে কাজ করছে।
কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টি এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সবুজ বিপ্লবকে অধিকতর সুসংহত ও টেকসই করার জন্যই ভর্তুকির প্রয়োজন। উন্নত দেশে এ খাতে যে পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া হয় তার তুলনায় বাংলাদেশের ভর্তুকির পরিমাণ নিতান্তই নগণ্য। কারণ সম্পদের অপ্রতুলতা। এ জন্য প্রয়োজন কৃষি উৎপাদনসংক্রান্ত কোন উপখাতে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দেওয়া হবে তা চিন্তাভাবনা করে নির্ণয় করা। বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে তিনটি উপকরণের জন্যই ভর্তুকি দিচ্ছে। ভর্তুকির সুফল কী?
সম্প্রতি ভারতে সারের ওপর যে ভর্তুকি দেওয়া হয় তা সেদেশের সরকার পুনর্বিবেচনা করার অঙ্গীকার করেছে মর্মে বিদেশি এক পত্রিকায় ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্লেষণধর্মী এ সংবাদে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে আগামী এপ্রিল মাসে ভারত সরকার ভর্তুকি কর্মসূচি নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজাবে। উদ্দেশ্য এর ফলে কৃষক সুষম সার ব্যবহারে উৎসাহিত হবে। সুষম সার ব্যবহারের সুফল প্রধানত দুটি। এক. এর মাধ্যমে জমির উর্বরতা স্থায়িত্ব লাভ করে। দুই. অধিক ফলনও নিশ্চিত হয়। আলোচ্য সংবাদের প্রতিবেদনটি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে যথোপযুক্ত ভর্তুকির মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবকে স্থায়িত্ব দানের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। কারণ, ভারতে তিন দশক ধরেই সারে ভর্তুকির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ফসফরাস ও পটাশ সারের তুলনায় ইউরিয়া সারে অধিকতর ভর্তুকি প্রদান, যা তিন প্রকারের সারের সুষম ব্যবহারের পরিপন্থী।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা নতুন আঙ্গিকে ভর্তুকি কর্মসূচির অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও ইউরিয়ার জন্য প্রদত্ত ভর্তুকি অপরিবর্তিত রয়েছে। এর ফলে সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না মর্মে প্রতিবেদক মন্তব্য করেছেন। অপরিবর্তিত পরিস্থিতির বিশ্লেষণে দেখা যায় যে কারণটি রাজনৈতিক। ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধি করলে দেখা যায় কৃষকেরা প্রতিবাদমুখী হবে। এটাই হলো আশঙ্কা। এ জন্য ইউরিয়া সারের ভর্তুকির পরিমাণ অপরিবর্তিত রেখে অন্যান্য সারের ভর্তুকি হ্রাস করা হয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের অন্য কারণটি হলো, ভারতে ইউরিয়া সার উৎপাদনকারীদের একটি শক্তিশালী লবি বিদ্যমান। সবুজ বিপ্লবের ভবিষ্যত্ নিয়ে এ জন্য কৃষক ও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কামুক্ত নন। একজন কৃষক আরেকটি আশঙ্কার বিষয় উত্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, ১৯৬০ সালে যখন তাঁর পিতা প্রথম একটি নলকূপ স্থাপন করেছিলেন তখন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল মাত্র পাঁচ ফুট। বর্তমানে ৫৫ ফুটও পানি উত্তোলনের জন্য যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশের ভর্তুকি নীতি ভারতের অনুরূপ। এ দেশের বিশেষজ্ঞসহ নীতি-নির্ধারকেরা সুষম সার ব্যবহারের সুফল সমন্ধে মোটেই অজ্ঞ নন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ইউরিয়ার ওপর ভর্তুকির পরিমাণ অন্যান্য সারের তুলনায় অধিকতর। এ বিষয়ে ভারত যে ভ্রান্ত নীতি কয়েক দশক ধরে অনুসরণ করেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ একই নীতি অনুসরণে আগ্রহী। তবে বাংলাদেশে ২০০৯-১০ সালে কিছুটা পার্থক্যের ধারা বিদ্যমান। বর্তমানে ইউরিয়ার মূল্য কেজি প্রতি মাত্র ১০ টাকা। কৃষক পর্যায়ে ১২ টাকা। ভারতে এ সারের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় কেজি প্রতি আড়াই থেকে সাড়ে চার টাকা কম। ডিএপির মূল্য বাংলাদেশে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা। ভারতে ১৪.৫১ টাকা। পটাশ সারের কেজিপ্রতি মূল্য বাংলাদেশে ২৫ টাকা। ভারতে মাত্র ৬.৯১ টাকা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে ডিএপি, টিএসপি ও পটাশ সারের তুলনায় ভর্তুকি অধিকতর। কৃষি মন্ত্রণালয় সাহসের সঙ্গে আগের তুলনায় টিএসপি ও পটাশ সারের তুলনায় অর্ধেক হ্রাস করা সত্ত্বেও ইউরিয়ার মূল্য অপরিবর্তিত রয়েছে। ইউরিয়ার মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকার এ বিষয়ে কিছুটা হলেও উদাসীন। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিন প্রকার সারের মূল্যের মধ্যে পার্থক্যের পরিমাণ ভারতে অপেক্ষাকৃত কম। বাংলাদেশে বেশি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত ভর্তুকি নীতি প্রয়োজনীয় হলেও তা যথেষ্ট নয়। অন্য প্রয়োজনীয় বিষয়টি হলো এ বিষয়ে কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির অব্যাহত প্রচেষ্টা। সাধারণত এ কাজটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর করে থাকে। তবে মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা সংস্থাও এ বিষয়ে কারিগরি তথ্য দিতে সক্ষম। বর্তমানে যে বিষয়টি দৃশ্যমান তা হলো এ দুটি সংস্থাই বিক্ষিপ্তভাবে এ বিষয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করছে। প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা। এ ছাড়া মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল সারসংক্রান্ত যে নির্দেশিকা প্রকাশ করে, নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে প্রদত্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। যা করা হয়েছে তা হলো দুটি-একটি প্রকল্প। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্য প্রয়োজন প্রতিবছর নির্ধারিত কর্মসূচির। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা সংস্থা কয়েক বছর অন্তর মাটির উর্বরতাভিত্তিক মানচিত্র প্রকাশ করে থাকে। এসব মানচিত্রে শস্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের মাত্রার হার অনুযায়ী সংকটজনক এলাকাগুলো চিহ্নিত করা। বিএআরসি কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যে প্রতীয়মান হয় যে ১৯৮১-২০০৩ সময়কালে মাটির উর্বরতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উপাদান ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে, মাটিতে উপাদানভিত্তিক চাহিদার হার অপেক্ষাকৃত অধিক। আশঙ্কা এখানেই।
মাটির উর্বরতা হ্রাসের মাত্রা রোধের জন্যই সুষম সার ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সাম্প্রতিককালে টিএসপি ও পটাশ সারের মূল্য আগের তুলনায় অর্ধেক পর্যায়ে নিয়ে আসার ফলে কৃষকেরা এখন এ দুটি সার ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছেন। এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে জরিপের মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। মাটির উর্বরতার ভিত্তিতে উল্লিখিত মানচিত্রে যেসব উপজেলা সংকটময় মর্মে চিহ্নিত করা হয়েছে সেসব স্থানে অচিরেই সুষম সার ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশেও সবুজ বিপ্লবের অব্যাহত ধারা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এর ফলে খাদ্যনিরাপত্তা অধিকতর সংকটে আবদ্ধ হবে।
বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের মাত্রা লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরওয়ারি বৃদ্ধির হার এখনো অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯০ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে জাতীয় কৃষি এবং জাতীয় পানি নীতিতে ভূ-উপরিস্থ পানি সেচকার্যে অধিকতর ব্যবহারের স্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করা হয়। এ সত্ত্বেও তা আশানুরূপভাবে অর্জন সম্ভব হয়নি। বিএডিসির এক জরিপমতে, মোট ৫১ লাখ ২৬ হাজার ৮৫১ হেক্টর জমি ২০০৮-০৯ সালে সেচের আওতায় ছিল। এর মধ্যে শতকরা ৭৯ ভাগ জমি ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে সেচকার্য করা হয়েছিল। ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচকৃত এলাকার হার ছিল মাত্র শতকরা ২১ ভাগ।
জানা গেছে যে কৃষি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ভূ-উপরিস্থ পানির অধিকতর ব্যবহারের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ এবং অন্তরায়ও প্রচুর। সম্পদের অপ্রতুলতা ব্যতীত, ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতাও কম। সবুজ বিপ্লব থেমে যাওয়ার আশঙ্কা এখানেই।
এ এম এম শওকত আলী: সাবেক কৃষি সচিব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments