এ কী সমাপন by দ্বিজেন শর্মা
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ফ্লোরা ও ফ্যনা প্রকল্প, বাংলাদেশ জীব-ইতিহাস জ্ঞানকোষের প্রকাশনা অবশেষে সরকারি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার গাঁটে আটকা পড়ে গেল। সরকারি অনুদানে ইতিপূর্বে এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাপিডিয়া ও ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা’ অনেকটা নির্বিঘ্নেই প্রকাশ করেছে। বিপত্তি ঘটল এই প্রথম এবং তা ঘটল এমন একটি কর্মযজ্ঞে, যা এই উপমহাদেশে বিরল, হয়তো নজিরবিহীনও। ২৮ খণ্ডের (১৪ খণ্ড উদ্ভিদ-বিষয়ক ও ১৪ খণ্ড প্রাণিবিষয়ক) এই গ্রন্থমালায় আছে ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল থেকে অ্যামিবা এবং উল্লুক পর্যন্ত ১২ হাজার ২৬৯ প্রজাতির (উদ্ভিদ ছয় হাজার ৭৫২, প্রাণী পাঁচ হাজার ৫১৭) সচিত্র বর্ণনা অর্থাৎ বাংলাদেশের গোটা জীবকুলের ইতিবৃত্ত।
প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালের অক্টোবরে। শেষ হওয়ার কথা ২০০৯ সালের জুন মাসে। বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মীদের নিরলস শ্রমে ইংরেজি ২৮ খণ্ড ও বাংলা ২৮ খণ্ডের ৭ খণ্ড যথাসময়েই প্রকাশিত হয়েছিল। এটুকুই অসাধ্য সাধন। তাই বর্তমান সরকার বাংলা সংস্করণের কাজ সম্পন্ন করার জন্য সময় বাড়ায় ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যপ্ত। বাকি বাংলা সংস্করণের উপকরণ গ্রন্থনা শেষ হওয়ার মুখে হঠাৎ করেই ডিসেম্বরের শুরুতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পের অর্থপ্রদান বন্ধ করে দেয়। কারণ, সরকারের কিছু নতুন দাবি সোসাইটির কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের ওপর অযৌক্তিক সরকারি হস্তক্ষেপের অনেক ভোগান্তির অভিজ্ঞতা আমাদের আছে; কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রগতিশীল সরকারের কাছে তা বড়ই অপ্রত্যাশিত।
এই প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক গুরুত্বের ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। তবে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে পরিবেশ বিপর্যয় ও জীববৈচিত্র্য হ্রাসের পটভূমিতে জীববিদ্যা, বিশেষত টেক্সোনমি বা শ্রেণীকরণবিদ্যা আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ২৮ খণ্ডের ইংরেজি ও বাংলা জীব-ইতিহাস প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে গবেষণা, নীতিনির্ধারণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কতটা সহায়ক হতে পারে, তা বুঝতে পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন পড়ে না। কলমের এক খোঁচায় এমন একটি মহত্ উদ্যোগ দাবিয়ে দেওয়াকে কী বলে আখ্যায়িত করা যায়, জানি না।
প্রসঙ্গত, নিজের সামান্য অভিজ্ঞতার কথা বলি। মধ্য-পঞ্চাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যায় পড়ার সময় বাংলাদেশের গাছপালার একটি মাত্র বই-ই আমাদের ছিল—ডেভিড প্রেইনের দুই খণ্ডের ‘বেঙ্গল প্লান্টস’, বহুল ব্যবহারে অতি জরাজীর্ণ এবং ছাত্রছাত্রীদের ছুঁতে মানা। সেই সময় জন্মভূমির লাগোয়া পাথারিয়া পাহাড়ের উদ্ভিদকুল নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু তত্কালে এ ধরনের কাজ তত্ত্বাবধানের যতো যোগ্য বিশেষজ্ঞের প্রকট অভাব ছিল, বইপত্রেরও।
সেই পাহাড় আজ বনশূন্য। কাজটি এখনও সম্ভব, কিন্তু তা হবে সেকালের তুলনায় অসম্পূর্ণ। কেননা অনেক প্রজাতি ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে। আমার প্রথম চাকরি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। আমরাই সম্ভবত বেসরকারি কলেজে প্রথম উদ্ভিদবিদ্যার স্নাতক কোর্স চালু করি। লেগে যাই গাছপালা সংগ্রহের কাজে, কিন্তু অচেনা প্রজাতি শনাক্তকরণ নিয়ে বিপদে পড়ি। ‘বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ তখন প্রেইনের বইটির নতুন সংস্করণ ছাপিয়েছে জেনে তাদের একটা চিঠি লিখি। কয়েক মাস পর বরিশালের ডিসি অর্থাৎ জেলা প্রশাসক আমাকে ডেকে পাঠান এবং সরকারকে না জানিয়ে এই চিঠি লেখার জন্য ভর্ৎসনা করেন। এভাবেই শ্রেণীকরণবিদ্যা নিয়ে আমার গবেষণার জলাঞ্জলি। বলা বাহুল্য, এমনটি অন্যদের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকবে।
মার্কিন দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ হেনরি অ্যাডামস বলতেন, একজন শিক্ষকের প্রভাব কতটা দূরগামী, তিনি নিজেও তা জানেন না। বইয়ের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। একটি বই একজন মানুষের জীবনের গোটা ছকই পালটে দিতে পারে। প্রেইনের বইটির খণ্ড দুটি যথাসময়ে পেলে লেখক হওয়ার বদলে হয়তো আমি বিজ্ঞানী হতাম। পাথারিয়া পাহাড়ের উদ্ভিদকুলের অপেক্ষাকৃত সম্পূর্ণ একটি ইতিবৃত্ত লিখতে পারতাম। অন্যরা আরও বড় বড় কাজ করতে পারতেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ খণ্ডের ‘বাংলাদেশের জীবকুল জ্ঞানকোষ’ গ্রন্থমালার গুরুত্ব অনুধাবনীয়। উল্লেখ্য, শুধু জীবকুলের শ্রেণীকরণ গবেষণার সহায়তাই নয়, এই গ্রন্থমালার প্রভাব হবে বহুমাত্রিক ও সুদূরপ্রসারী। আশা করি, সরকার বিষয়টি সত্বর পুনর্বিবেচনা করবে এবং উদ্যোগটি অচিরেই বাধামুক্ত হবে।
দ্বিজেন শর্মা: উদ্ভিদবিদ, নিসর্গ বিষয়ক লেখক।
প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালের অক্টোবরে। শেষ হওয়ার কথা ২০০৯ সালের জুন মাসে। বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মীদের নিরলস শ্রমে ইংরেজি ২৮ খণ্ড ও বাংলা ২৮ খণ্ডের ৭ খণ্ড যথাসময়েই প্রকাশিত হয়েছিল। এটুকুই অসাধ্য সাধন। তাই বর্তমান সরকার বাংলা সংস্করণের কাজ সম্পন্ন করার জন্য সময় বাড়ায় ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যপ্ত। বাকি বাংলা সংস্করণের উপকরণ গ্রন্থনা শেষ হওয়ার মুখে হঠাৎ করেই ডিসেম্বরের শুরুতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পের অর্থপ্রদান বন্ধ করে দেয়। কারণ, সরকারের কিছু নতুন দাবি সোসাইটির কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের ওপর অযৌক্তিক সরকারি হস্তক্ষেপের অনেক ভোগান্তির অভিজ্ঞতা আমাদের আছে; কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রগতিশীল সরকারের কাছে তা বড়ই অপ্রত্যাশিত।
এই প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক গুরুত্বের ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। তবে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে পরিবেশ বিপর্যয় ও জীববৈচিত্র্য হ্রাসের পটভূমিতে জীববিদ্যা, বিশেষত টেক্সোনমি বা শ্রেণীকরণবিদ্যা আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ২৮ খণ্ডের ইংরেজি ও বাংলা জীব-ইতিহাস প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে গবেষণা, নীতিনির্ধারণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কতটা সহায়ক হতে পারে, তা বুঝতে পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন পড়ে না। কলমের এক খোঁচায় এমন একটি মহত্ উদ্যোগ দাবিয়ে দেওয়াকে কী বলে আখ্যায়িত করা যায়, জানি না।
প্রসঙ্গত, নিজের সামান্য অভিজ্ঞতার কথা বলি। মধ্য-পঞ্চাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যায় পড়ার সময় বাংলাদেশের গাছপালার একটি মাত্র বই-ই আমাদের ছিল—ডেভিড প্রেইনের দুই খণ্ডের ‘বেঙ্গল প্লান্টস’, বহুল ব্যবহারে অতি জরাজীর্ণ এবং ছাত্রছাত্রীদের ছুঁতে মানা। সেই সময় জন্মভূমির লাগোয়া পাথারিয়া পাহাড়ের উদ্ভিদকুল নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু তত্কালে এ ধরনের কাজ তত্ত্বাবধানের যতো যোগ্য বিশেষজ্ঞের প্রকট অভাব ছিল, বইপত্রেরও।
সেই পাহাড় আজ বনশূন্য। কাজটি এখনও সম্ভব, কিন্তু তা হবে সেকালের তুলনায় অসম্পূর্ণ। কেননা অনেক প্রজাতি ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে। আমার প্রথম চাকরি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। আমরাই সম্ভবত বেসরকারি কলেজে প্রথম উদ্ভিদবিদ্যার স্নাতক কোর্স চালু করি। লেগে যাই গাছপালা সংগ্রহের কাজে, কিন্তু অচেনা প্রজাতি শনাক্তকরণ নিয়ে বিপদে পড়ি। ‘বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ তখন প্রেইনের বইটির নতুন সংস্করণ ছাপিয়েছে জেনে তাদের একটা চিঠি লিখি। কয়েক মাস পর বরিশালের ডিসি অর্থাৎ জেলা প্রশাসক আমাকে ডেকে পাঠান এবং সরকারকে না জানিয়ে এই চিঠি লেখার জন্য ভর্ৎসনা করেন। এভাবেই শ্রেণীকরণবিদ্যা নিয়ে আমার গবেষণার জলাঞ্জলি। বলা বাহুল্য, এমনটি অন্যদের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকবে।
মার্কিন দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ হেনরি অ্যাডামস বলতেন, একজন শিক্ষকের প্রভাব কতটা দূরগামী, তিনি নিজেও তা জানেন না। বইয়ের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। একটি বই একজন মানুষের জীবনের গোটা ছকই পালটে দিতে পারে। প্রেইনের বইটির খণ্ড দুটি যথাসময়ে পেলে লেখক হওয়ার বদলে হয়তো আমি বিজ্ঞানী হতাম। পাথারিয়া পাহাড়ের উদ্ভিদকুলের অপেক্ষাকৃত সম্পূর্ণ একটি ইতিবৃত্ত লিখতে পারতাম। অন্যরা আরও বড় বড় কাজ করতে পারতেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ খণ্ডের ‘বাংলাদেশের জীবকুল জ্ঞানকোষ’ গ্রন্থমালার গুরুত্ব অনুধাবনীয়। উল্লেখ্য, শুধু জীবকুলের শ্রেণীকরণ গবেষণার সহায়তাই নয়, এই গ্রন্থমালার প্রভাব হবে বহুমাত্রিক ও সুদূরপ্রসারী। আশা করি, সরকার বিষয়টি সত্বর পুনর্বিবেচনা করবে এবং উদ্যোগটি অচিরেই বাধামুক্ত হবে।
দ্বিজেন শর্মা: উদ্ভিদবিদ, নিসর্গ বিষয়ক লেখক।
No comments