হাত-পাওয়ালা ল্যাপটপ আমজাদ by এম আর আলম
মাথাটি যেন তাঁর হার্ডডিস্ক। একটা হাত-পাওয়ালা ল্যাপটপ মানুষটি। নাম আমজাদ হোসেন। কম্পিউটার-ল্যাপটপে কী থাকে না? ল্যাপটপ যেমন অজানা তথ্যের ভান্ডার, আর তেমনই দৈনন্দিন প্রতিটি কাজেরই অনুষঙ্গ। তারবিহীন ল্যাপটপ তো বহনযোগ্য। কিন্তু এর হাত-পা নেই। আমজাদ এর উল্টো। তাঁর সেই অঙ্গ দুটিও আছে। তবে চোখের আলো নিভতে বসেছে এখন।
প্রবল মেধাবী আমজাদের বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের দীঘলডাঙ্গী গ্রামে। গাঁয়ের ছেলে আমজাদ ১৯৭৩ সালে সৈয়দপুর কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে অর্থাভাবে আর পড়া হয়নি তাঁর। এ সময় পরিবারের চাপে বিয়ে করতে হয় আমজাদকে।
বিয়ে হলো, সংসার হলো। কিন্তু অনটনের সংসারে জীবন অতিবাহিত করা দায় হয়ে পড়ে আমজাদের। ফলে তিনি বাড়ির পাশের পোড়াহাট বাজারে ২০০ থেকে ৪০০ টাকার ওষুধ নিয়ে একটি ফার্মেসি খুলে বসেন। সেই থেকে মানুষ তাঁকে আমজাদ ডাক্তার নামেই চেনে। ফার্মেসি ব্যবসা চালাতে গিয়ে ছোটখাটো চিকিত্সক বনে যান আমজাদ। পরে পল্লি চিকিত্সকের প্রশিক্ষণ নিয়ে সত্যি সত্যিই চিকিত্সক হন তিনি। কিন্তু বিধিবাম! আশির দশকের শেষদিকে চোখে ঝাঁপসা দেখতে শুরু করেন আমজাদ। ধীরে ধীরে তাঁর একটি চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। অন্য চোখটিরও আলো নিভু নিভু।
চোখের আলো কমে যাওয়ায় আমজাদ প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়েন। আর বুঝি কিছুই হবে না তাঁকে দিয়ে। ঘরে তিন মেয়ে দুই ছেলে। তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আরও বেড়ে যায় উত্কণ্ঠা। নব্বই দশকের গোড়ার কথা। একদিন সকালে আমজাদ নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করলেন। স্মৃতি হাতড়ে তিনি পেয়ে যাচ্ছিলেন অতীতের অনেক কথা, যা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। নস্টালজিয়ার সেই সাগরে তিনি দিতে থাকলেন ডুবসাঁতার। বিষয়টি ভালো ঠেকলো তাঁর কাছে। স্কুল-কলেজ জীবনের অনেক স্মৃতিকে তিনি মাথার হার্ডডিস্কে ঠাঁই দিতে শুরু করলেন। সেখানে ভর করলেন আইনস্টাইন, মার্কনি, আর্কিমিডিসসহ অনেক বিজ্ঞানী। একইভাবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবকটি অঙ্গরাষ্ট্রের নাম আয়ত্তে আনলেন, এ যাবত্ সেখানকার সব প্রেসিডেন্টের নামও রপ্ত করলেন তিনি। গণচীনের প্রতিটি রাজ্যের নাম, সেখানকার জলবায়ু, ভৌগোলিক অবস্থা, চীনের প্রাচীর, ব্রিটিশ-কমনওয়েলথ, ভারতীয় উপমহাদেশ, এশিয়া, আফ্রিকার কী জানেন না আমজাদ? সারা বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র, তার মুদ্রা কিংবা সরকারপ্রধানের নাম, জটিল অঙ্কের সমাধান, বিজ্ঞানের নিত্য-নতুন আবিষ্কারের কথা সবই যেন আমজাদের মাথায় কিলবিল করছে।
গ্রামের কোনো ছেলেমেয়ে যদি সরকারি-বেসরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেন, সে ক্ষেত্রে আমজাদকে দরকার। চাকরিপ্রার্থীরা তাঁর কাছে জেনে নেন অনেক অজানা বিষয়। কেননা এ তল্লাটে নানা অজানাকে জানাতেই যেন আমজাদের জন্ম।
আমজাদের সঙ্গে কথা হলো। খোলা আকাশের নিচে একটি ভাঙা টেবিল-চেয়ার ও কিছু ওষুধপত্র নিয়ে বসেছিলেন তিনি। হাস্যোচ্ছ্বল আমজাদ বললেন, কেউ যদি মনে করে বিশ্বের অজানাকে আমি জানব, তাহলে সে তা পারবে। কম্পিউটার-ল্যাপটপ তো মানুষেরই আবিষ্কার। তিনি বলেন, আমি যেসব জিজ্ঞাসার সমাধান দিই, এসব কোন অলৌকিক ব্যাপার নয়। কারণ আমিও তো এসব শিখছি। যখন আমার চোখের শক্তি কমতে থাকল, তখন আমি মনের শক্তিকে বাড়ানোর চেষ্টা করলাম। মনকে প্রতিনিয়ত বিশ্বের নতুন নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক, বিজ্ঞান, অর্থনীতির ভান্ডারে পরিপূর্ণ করলাম, সব সময় আপডেট থাকার চেষ্টা শুরু করলাম। এসব সম্ভব হলো রেডিও শুনে। তিনি বললেন, আমি চোখে দেখি না, তবে টেলিভিশনের খরবগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করি। যা প্রতিনিয়ত মাথায় ধারণ করার চেষ্টা থাকে।
আমজাদের আরও গুণ রয়েছে বলে জানালেন বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাইদুর রহমান সরকার। তিনি জানান, আমজাদ এরই মধ্যে পাঁচ শতাধিক গান রচনা করেছেন। নিজের লেখা গানে নিজেই সুর তোলেন চারণ গীতিকার আমজাদ। সুরেলা কণ্ঠে তিনি গানও গাইতে পারেন। তাঁর লেখা ভাওয়াইয়া-পল্লিগীতি গেয়ে এ অঞ্চলের অনেক শিল্পী নাম করেছেন। আমজাদের মতে, ভাব থেকে তিনি ভাওয়াইয়া রচনা করেন। আর মেঠো সুরের মূর্ছনায় তিনি পল্লিগীতি লিখে ফেলেন।
একটি গান গাইতে বললে সপ্তমে সুর চড়িয়ে গেয়ে উঠলেন আমজাদ, ‘নানী তুই মোর সাথে থাক/তুই থাকিলে আন্ধিম এ্যালা, ভাত আর ন্যাপা শাক।’
গ্রামীণ প্রতিভা আমজাদের এখন দুঃসময়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রামের হাটের ফার্মেসিটা উচ্ছেদ করেছে। চোখ না থাকলেও রোগীদের তিনি চিকিত্সা দেন খোলা আকাশের নিচে বসে। কিন্তু এতে তাঁর রোগী কমে যাচ্ছে। পর্দার ব্যবস্থা নেই বলে মহিলা রোগীরা আসেন না।
মাত্র আড়াই লাখ টাকার জন্য আমজাদের চোখে কর্নিয়া সংযোজন হচ্ছে না। অথচ বিনয়ী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আমজাদ কারও সহযোগিতা চান না, চান না দয়া দক্ষিণাও।
গ্রামের হাত-পাওয়ালা ল্যাপটপটি সারা বিশ্বের খবর রাখেন, অথচ তাঁর খবর জানে না হয়তো পাশের গাঁয়ের মানুষটিও।
প্রবল মেধাবী আমজাদের বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের দীঘলডাঙ্গী গ্রামে। গাঁয়ের ছেলে আমজাদ ১৯৭৩ সালে সৈয়দপুর কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে অর্থাভাবে আর পড়া হয়নি তাঁর। এ সময় পরিবারের চাপে বিয়ে করতে হয় আমজাদকে।
বিয়ে হলো, সংসার হলো। কিন্তু অনটনের সংসারে জীবন অতিবাহিত করা দায় হয়ে পড়ে আমজাদের। ফলে তিনি বাড়ির পাশের পোড়াহাট বাজারে ২০০ থেকে ৪০০ টাকার ওষুধ নিয়ে একটি ফার্মেসি খুলে বসেন। সেই থেকে মানুষ তাঁকে আমজাদ ডাক্তার নামেই চেনে। ফার্মেসি ব্যবসা চালাতে গিয়ে ছোটখাটো চিকিত্সক বনে যান আমজাদ। পরে পল্লি চিকিত্সকের প্রশিক্ষণ নিয়ে সত্যি সত্যিই চিকিত্সক হন তিনি। কিন্তু বিধিবাম! আশির দশকের শেষদিকে চোখে ঝাঁপসা দেখতে শুরু করেন আমজাদ। ধীরে ধীরে তাঁর একটি চোখ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। অন্য চোখটিরও আলো নিভু নিভু।
চোখের আলো কমে যাওয়ায় আমজাদ প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়েন। আর বুঝি কিছুই হবে না তাঁকে দিয়ে। ঘরে তিন মেয়ে দুই ছেলে। তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আরও বেড়ে যায় উত্কণ্ঠা। নব্বই দশকের গোড়ার কথা। একদিন সকালে আমজাদ নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করলেন। স্মৃতি হাতড়ে তিনি পেয়ে যাচ্ছিলেন অতীতের অনেক কথা, যা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। নস্টালজিয়ার সেই সাগরে তিনি দিতে থাকলেন ডুবসাঁতার। বিষয়টি ভালো ঠেকলো তাঁর কাছে। স্কুল-কলেজ জীবনের অনেক স্মৃতিকে তিনি মাথার হার্ডডিস্কে ঠাঁই দিতে শুরু করলেন। সেখানে ভর করলেন আইনস্টাইন, মার্কনি, আর্কিমিডিসসহ অনেক বিজ্ঞানী। একইভাবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবকটি অঙ্গরাষ্ট্রের নাম আয়ত্তে আনলেন, এ যাবত্ সেখানকার সব প্রেসিডেন্টের নামও রপ্ত করলেন তিনি। গণচীনের প্রতিটি রাজ্যের নাম, সেখানকার জলবায়ু, ভৌগোলিক অবস্থা, চীনের প্রাচীর, ব্রিটিশ-কমনওয়েলথ, ভারতীয় উপমহাদেশ, এশিয়া, আফ্রিকার কী জানেন না আমজাদ? সারা বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র, তার মুদ্রা কিংবা সরকারপ্রধানের নাম, জটিল অঙ্কের সমাধান, বিজ্ঞানের নিত্য-নতুন আবিষ্কারের কথা সবই যেন আমজাদের মাথায় কিলবিল করছে।
গ্রামের কোনো ছেলেমেয়ে যদি সরকারি-বেসরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেন, সে ক্ষেত্রে আমজাদকে দরকার। চাকরিপ্রার্থীরা তাঁর কাছে জেনে নেন অনেক অজানা বিষয়। কেননা এ তল্লাটে নানা অজানাকে জানাতেই যেন আমজাদের জন্ম।
আমজাদের সঙ্গে কথা হলো। খোলা আকাশের নিচে একটি ভাঙা টেবিল-চেয়ার ও কিছু ওষুধপত্র নিয়ে বসেছিলেন তিনি। হাস্যোচ্ছ্বল আমজাদ বললেন, কেউ যদি মনে করে বিশ্বের অজানাকে আমি জানব, তাহলে সে তা পারবে। কম্পিউটার-ল্যাপটপ তো মানুষেরই আবিষ্কার। তিনি বলেন, আমি যেসব জিজ্ঞাসার সমাধান দিই, এসব কোন অলৌকিক ব্যাপার নয়। কারণ আমিও তো এসব শিখছি। যখন আমার চোখের শক্তি কমতে থাকল, তখন আমি মনের শক্তিকে বাড়ানোর চেষ্টা করলাম। মনকে প্রতিনিয়ত বিশ্বের নতুন নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক, বিজ্ঞান, অর্থনীতির ভান্ডারে পরিপূর্ণ করলাম, সব সময় আপডেট থাকার চেষ্টা শুরু করলাম। এসব সম্ভব হলো রেডিও শুনে। তিনি বললেন, আমি চোখে দেখি না, তবে টেলিভিশনের খরবগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করি। যা প্রতিনিয়ত মাথায় ধারণ করার চেষ্টা থাকে।
আমজাদের আরও গুণ রয়েছে বলে জানালেন বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাইদুর রহমান সরকার। তিনি জানান, আমজাদ এরই মধ্যে পাঁচ শতাধিক গান রচনা করেছেন। নিজের লেখা গানে নিজেই সুর তোলেন চারণ গীতিকার আমজাদ। সুরেলা কণ্ঠে তিনি গানও গাইতে পারেন। তাঁর লেখা ভাওয়াইয়া-পল্লিগীতি গেয়ে এ অঞ্চলের অনেক শিল্পী নাম করেছেন। আমজাদের মতে, ভাব থেকে তিনি ভাওয়াইয়া রচনা করেন। আর মেঠো সুরের মূর্ছনায় তিনি পল্লিগীতি লিখে ফেলেন।
একটি গান গাইতে বললে সপ্তমে সুর চড়িয়ে গেয়ে উঠলেন আমজাদ, ‘নানী তুই মোর সাথে থাক/তুই থাকিলে আন্ধিম এ্যালা, ভাত আর ন্যাপা শাক।’
গ্রামীণ প্রতিভা আমজাদের এখন দুঃসময়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রামের হাটের ফার্মেসিটা উচ্ছেদ করেছে। চোখ না থাকলেও রোগীদের তিনি চিকিত্সা দেন খোলা আকাশের নিচে বসে। কিন্তু এতে তাঁর রোগী কমে যাচ্ছে। পর্দার ব্যবস্থা নেই বলে মহিলা রোগীরা আসেন না।
মাত্র আড়াই লাখ টাকার জন্য আমজাদের চোখে কর্নিয়া সংযোজন হচ্ছে না। অথচ বিনয়ী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আমজাদ কারও সহযোগিতা চান না, চান না দয়া দক্ষিণাও।
গ্রামের হাত-পাওয়ালা ল্যাপটপটি সারা বিশ্বের খবর রাখেন, অথচ তাঁর খবর জানে না হয়তো পাশের গাঁয়ের মানুষটিও।
No comments