প্রভাব, প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থাকবে গণমাধ্যম -মিডিয়া ভাবনা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার সম্প্রতি ঢাকায় ‘গণমাধ্যম’ বিষয়ে এক বক্তৃতায় বলেছেন: ‘গণমাধ্যমের ভূমিকা হওয়া উচিত সব ধরনের প্রভাব, প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থাকা। জনসেবায় ব্যর্থ সরকারের খোলাখুলি সমালোচনা করা। কখনোই দুষ্কর্মের সঙ্গে আপস করা উচিত নয়। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই যতটা পরিষ্কার হওয়া উচিত, বাস্তবে ততটা হয় না।’ (বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণের জন্য দেখুন ভোরের কাগজ, ২৭ জানুয়ারি ২০১০)।
কুলদীপ নায়ারের বক্তৃতায় এমন বহু দিক রয়েছে যা বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত নিবন্ধ লেখা যায়। আমি আজ এখানে শুধু একটি দিক নিয়ে আলোকপাত করব।
‘গণমাধ্যমের ভূমিকা হওয়া উচিত সব ধরনের প্রভাব, প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থাকা।’ এটা যে খুব নতুন একটা কথা তা নয়। তবে কথাটা আমাদের গণমাধ্যমের মালিক বা কর্মরত সাংবাদিকেরা সব সময় মনে রাখতে পারেন না। তাই কুলদীপ নায়ারের বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কথাটা আবার সবার সামনে তুলে ধরার তাগিদ অনুভব করছি।
সাংবাদিকতা পেশা, সংবাদপত্র প্রকাশনা বা টিভি চ্যানেল পরিচালনা করাকে আর দশটা ব্যবসা বা পেশার মতো দেখলে হবে না। এই পেশাকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সমাজ এই মর্যাদার প্রতিদানে গণমাধ্যম থেকে কিছু ব্যতিক্রমী ও সাহসী ভূমিকা আশা করে। বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু গণমাধ্যম রাজনৈতিক দলের মুখপত্রের মতো সংবাদ প্রকাশ করছে। কোনো দলকে সমর্থন করা বা কোনো দলের বিরোধিতা করা এখন কয়েকটি সংবাদপত্রের প্রাত্যহিক ভূমিকা হয়ে উঠেছে। সংবাদপত্রকে যে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ হতে হয় তা অনেক সংবাদপত্র ভুলেই গেছে। সংবাদপত্রটি যদি সরকার-ঘেঁষা হয় তাহলে সরকারের বা সরকারপ্রধানের গুণকীর্তনে তারা ব্যস্ত থাকে। ঘটনা যতটা বড় নয় ততটা বড় করে লেখা নিশ্চয় সাংবাদিকতা নয়। আবার সংবাদপত্রটি যদি বিরোধী দলের হয় তাহলে সরকারের একটি ভালো কাজও তাদের চোখে পড়ে না। সরকারের সবই খারাপ। সবই ব্যর্থতা।
এভাবে দলের মোসাহেবি করে কয়েকটি সংবাদপত্র আমাদের সংবাদিকতাকে দূষিত করে ফেলেছে। তারা যদি কোনো দলের ‘মুখপত্র’ হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দিত তাহলে আমার বলার কিছু থাকত না। কিন্তু তারা দাবি করে তারা জাতীয় দৈনিক। এখানেই যত বিপত্তি।
দলের মোসাহেবি করে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হলে তার পক্ষে সব ধরনের প্রভাব, প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থাকা কি সম্ভব?
কুলদীপ নায়ার বলেছেন: ‘গনমাধ্যমের ভূমিকা হওয়া উচিত জনসেবায় ব্যর্থ সরকারের খোলাখুলি সমালোচনা করা।’ এখন প্রশ্ন হলো: কোনো সংবাদপত্র বা সাংবাদিক বা কলাম লেখক যদি সরকারের আলিঙ্গনের মধ্যে থাকে, তার পক্ষে কি সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা করা সম্ভব? অথচ সবাই জানেন, ক্ষমতাসীন সরকারের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা যেকোনো স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রধান কর্তব্য। কোনো সরকারই ভুলত্রুটি বা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। আমাদের মতো দুর্নীতিকণ্টকিত দেশে সরকারের দুর্নীতি, ভুল বা ত্রুটি-বিচ্যুতি উদ্ঘাটন করতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ব্যর্থতার সামান্য অনুসন্ধান করতেও কোনো কোনো সংবাদপত্র বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। তারা ব্যস্ত বিরোধী দলের ছিদ্রান্বেষণে। বিরোধী দলের সমালোচনার বিষয় থাকলে সংবাদপত্রকে অবশ্যই তা করতে হবে। কিন্তু পত্রিকার প্রথম পাতাজুড়ে শুধু বিরোধী দলের সমালোচনা ও সরকারের গুণকীর্তন থাকলে তাকে কি সংবাদপত্র বলা চলে?
আমাদের ‘দলকানা’ সংবাদপত্র ও কলাম লেখকদের প্রভাব এত দূর বেড়েছে যে তারা নিরপেক্ষ সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা নিয়ে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করে। তাদের বক্তব্য এ রকম: ‘নিরপেক্ষতা হচ্ছে একরকম চক্রান্ত। কোনো দলের মোসাহেবি করাই হলো আদর্শ সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের দায়িত্ব।’ আমার ধারণা, সচেতন পাঠকসমাজ এসব ব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত হন না। দলকানা সংবাদপত্র ও নিরপেক্ষ সংবাদপত্রের মধ্যে পার্থক্য পাঠকেরা বুঝতে পারেন।
কুলদীপ নায়ার বলেছেন: ‘কখনোই দুষ্কর্মের সঙ্গে আপস করা উচিত নয়।’
বাংলাদেশে আমরা কী দেখি? পত্রিকাবিশেষ নানা কারণে নানা দুষ্কর্মকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, সমর্থন দিচ্ছে। অথচ একটি দায়িত্বশীল সংবাদপত্রের দায়িত্ব হলো দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করা। লেখালেখি তারা এখনো করছে। সেটা প্রধানত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্র মালিকের বিরুদ্ধে। কারও দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে লেখা আর কারও দুষ্কর্ম সম্পর্কে সাফাই গাওয়া কোনো ভালো সংবাদপত্রের ভূমিকা হতে পারে না।
আমাদের সংবাদপত্র জগত্টা এভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। দলকানা সংবাদপত্রের পক্ষে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করা সম্ভব হয় না। তাই তো দেখি বর্তমান শাসক দলের নানা সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন অনাচার সব সংবাদপত্র নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকাশ করে না। প্রকাশ না করে তারা সরকারি দলের কৃপা পাওয়ার আশা করছে। এভাবে কোনো সংবাদপত্রের ‘ব্যক্তিত্ব’ বিকশিত হয় না। সব সময় সরকার বা রাজনৈতিক দলের কৃপার ওপরই তাদের থাকতে হয়। পাঠকের শক্তিতে তারা বলীয়ান হতে পারে না।
আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এক ধরনের ‘করণিক সাংবাদিকতা’ করে ‘টিভি সাংবাদিকতা’র একটা দুর্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। টিভি চ্যানেলগুলো প্রধানত প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীর অনুষ্ঠান, প্রধান বিরোধী দল, বিভিন্ন উদ্বোধন, গোলটেবিল ও নানা দুর্ঘটনার ওপরই তাদের ক্যামেরা ব্যস্ত রেখেছে। নিজেদের উদ্যোগে কোনো সরকারি ব্যর্থতার রিপোর্ট তারা সহজে তুলে ধরে না। ব্যতিক্রম খুব কম। ফলে সরকারি কর্তাদের ধারণা হয়েছে, ‘টিভি চ্যানেলগুলো খুব দেশপ্রেমিক। তারা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে না।’ কিন্তু সরকারকে কে বোঝাবে, আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এখনো প্রকৃত টিভি সাংবাদিকতা শুরুই করেনি। ‘একুশে টিভি’র সাইমন যুগে কিছুটা চেষ্টা হয়েছিল।
কাজেই সংগত কারণে সংবাদপত্র নিয়েই সমালোচনা হচ্ছে বেশি। কুলদীপ নায়ার বাংলাদেশের সংবাদপত্র পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালো জেনেশুনে এ রকম বক্তব্য দিয়েছেন, নাকি সাধারণভাবে গণমাধ্যম সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন তা আমি জানি না। তবে তাঁর এই বক্তৃতা বাংলাদেশের বর্তমান সংবাদপত্র প্রকাশনার যুগে খুব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। বক্তৃতাটির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এ দেশের সব সাংবাদিক, সংবাদপত্র মালিক ও প্রকাশক মনোযোগ দিয়ে পড়লে গণমাধ্যমের অনেক কিছু সম্পর্কে চিন্তা করার খোরাক পাবেন। ভোরের কাগজকে ধন্যবাদ কুলদীপ নায়ারকে আমন্ত্রণ করার জন্য।
জ্যোতি বসু ও গণমাধ্যম
সম্প্রতি প্রয়াত ভারতের বামপন্থী নেতা কমরেড জ্যোতি বসুর নানা গুণাবলি উল্লেখ করে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বেশিরভাগ লেখাই চিন্তা উদ্দীপক। আমি শুধু একটা বিষয় যোগ করতে চাই।
অনেক রাজনীতিবিদের ধারণা, বড় নেতা, জনপ্রিয় নেতা বা জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী) হতে হলে গণমাধ্যমের বিরাট সহায়তার প্রয়োজন হয়। সেজন্য বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদ গণমাধ্যমকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেন। সাংবাদিকেরাও রাজনীতিবিদদের পেয়ে বসেছেন। কারণ, বেশিরভাগ রাজনীতিবিদের নানা দুর্বলতা রয়েছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গে কমরেড জ্যোতি বসু বা তাঁর দল সিপিএম তাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো কলকাতার বড় সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের (তখন শুধু দূরদর্শন) সহায়তা পাননি। কলকাতার দুই-তিনটি বড় ও অত্যন্ত প্রভাবশালী দৈনিক সব সময় সিপিএম, বামপন্থা ও জ্যোতি বসুবিরোধী ভূমিকা পালন করে গেছে। শত শত রিপোর্ট, কলাম, সম্পাদকীয় ও কার্টুন ছাপা হয়েছে বামফ্রন্ট সরকার তথা জ্যোতি বসুর বিপক্ষে। কিন্তু তাতে তেমন বড় ক্ষতি হয়নি বামফ্রন্টের। কিংবা জ্যোতি বসুর। একটানা ২৭ বছর বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায়। প্রায় ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। গণমাধ্যমের এত বিরূপ প্রচারণার প্রভাব কোথায় গেল? গণমাধ্যম নাকি খুব শক্তিশালী?
গণমাধ্যম অবশ্যই শক্তিশালী। তবে, তারচেয়েও শক্তিশালী হলো সাধারণ মানুষের সমর্থন। নেতা, রাজনৈতিক দল বা সরকার যদি তাদের কাজের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের মন জয় করতে পারে তাহলে গণমাধ্যমের বিরূপ প্রচারণা তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ও জ্যোতি বসু আমাদের সামনে এই দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এই দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের রাজনৈতিক দল বা নেতারা কি কিছু শিখবেন?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
কুলদীপ নায়ারের বক্তৃতায় এমন বহু দিক রয়েছে যা বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত নিবন্ধ লেখা যায়। আমি আজ এখানে শুধু একটি দিক নিয়ে আলোকপাত করব।
‘গণমাধ্যমের ভূমিকা হওয়া উচিত সব ধরনের প্রভাব, প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থাকা।’ এটা যে খুব নতুন একটা কথা তা নয়। তবে কথাটা আমাদের গণমাধ্যমের মালিক বা কর্মরত সাংবাদিকেরা সব সময় মনে রাখতে পারেন না। তাই কুলদীপ নায়ারের বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কথাটা আবার সবার সামনে তুলে ধরার তাগিদ অনুভব করছি।
সাংবাদিকতা পেশা, সংবাদপত্র প্রকাশনা বা টিভি চ্যানেল পরিচালনা করাকে আর দশটা ব্যবসা বা পেশার মতো দেখলে হবে না। এই পেশাকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সমাজ এই মর্যাদার প্রতিদানে গণমাধ্যম থেকে কিছু ব্যতিক্রমী ও সাহসী ভূমিকা আশা করে। বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু গণমাধ্যম রাজনৈতিক দলের মুখপত্রের মতো সংবাদ প্রকাশ করছে। কোনো দলকে সমর্থন করা বা কোনো দলের বিরোধিতা করা এখন কয়েকটি সংবাদপত্রের প্রাত্যহিক ভূমিকা হয়ে উঠেছে। সংবাদপত্রকে যে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ হতে হয় তা অনেক সংবাদপত্র ভুলেই গেছে। সংবাদপত্রটি যদি সরকার-ঘেঁষা হয় তাহলে সরকারের বা সরকারপ্রধানের গুণকীর্তনে তারা ব্যস্ত থাকে। ঘটনা যতটা বড় নয় ততটা বড় করে লেখা নিশ্চয় সাংবাদিকতা নয়। আবার সংবাদপত্রটি যদি বিরোধী দলের হয় তাহলে সরকারের একটি ভালো কাজও তাদের চোখে পড়ে না। সরকারের সবই খারাপ। সবই ব্যর্থতা।
এভাবে দলের মোসাহেবি করে কয়েকটি সংবাদপত্র আমাদের সংবাদিকতাকে দূষিত করে ফেলেছে। তারা যদি কোনো দলের ‘মুখপত্র’ হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দিত তাহলে আমার বলার কিছু থাকত না। কিন্তু তারা দাবি করে তারা জাতীয় দৈনিক। এখানেই যত বিপত্তি।
দলের মোসাহেবি করে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হলে তার পক্ষে সব ধরনের প্রভাব, প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থাকা কি সম্ভব?
কুলদীপ নায়ার বলেছেন: ‘গনমাধ্যমের ভূমিকা হওয়া উচিত জনসেবায় ব্যর্থ সরকারের খোলাখুলি সমালোচনা করা।’ এখন প্রশ্ন হলো: কোনো সংবাদপত্র বা সাংবাদিক বা কলাম লেখক যদি সরকারের আলিঙ্গনের মধ্যে থাকে, তার পক্ষে কি সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা করা সম্ভব? অথচ সবাই জানেন, ক্ষমতাসীন সরকারের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা যেকোনো স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রধান কর্তব্য। কোনো সরকারই ভুলত্রুটি বা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। আমাদের মতো দুর্নীতিকণ্টকিত দেশে সরকারের দুর্নীতি, ভুল বা ত্রুটি-বিচ্যুতি উদ্ঘাটন করতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ব্যর্থতার সামান্য অনুসন্ধান করতেও কোনো কোনো সংবাদপত্র বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। তারা ব্যস্ত বিরোধী দলের ছিদ্রান্বেষণে। বিরোধী দলের সমালোচনার বিষয় থাকলে সংবাদপত্রকে অবশ্যই তা করতে হবে। কিন্তু পত্রিকার প্রথম পাতাজুড়ে শুধু বিরোধী দলের সমালোচনা ও সরকারের গুণকীর্তন থাকলে তাকে কি সংবাদপত্র বলা চলে?
আমাদের ‘দলকানা’ সংবাদপত্র ও কলাম লেখকদের প্রভাব এত দূর বেড়েছে যে তারা নিরপেক্ষ সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা নিয়ে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করে। তাদের বক্তব্য এ রকম: ‘নিরপেক্ষতা হচ্ছে একরকম চক্রান্ত। কোনো দলের মোসাহেবি করাই হলো আদর্শ সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের দায়িত্ব।’ আমার ধারণা, সচেতন পাঠকসমাজ এসব ব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত হন না। দলকানা সংবাদপত্র ও নিরপেক্ষ সংবাদপত্রের মধ্যে পার্থক্য পাঠকেরা বুঝতে পারেন।
কুলদীপ নায়ার বলেছেন: ‘কখনোই দুষ্কর্মের সঙ্গে আপস করা উচিত নয়।’
বাংলাদেশে আমরা কী দেখি? পত্রিকাবিশেষ নানা কারণে নানা দুষ্কর্মকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, সমর্থন দিচ্ছে। অথচ একটি দায়িত্বশীল সংবাদপত্রের দায়িত্ব হলো দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করা। লেখালেখি তারা এখনো করছে। সেটা প্রধানত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্র মালিকের বিরুদ্ধে। কারও দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে লেখা আর কারও দুষ্কর্ম সম্পর্কে সাফাই গাওয়া কোনো ভালো সংবাদপত্রের ভূমিকা হতে পারে না।
আমাদের সংবাদপত্র জগত্টা এভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। দলকানা সংবাদপত্রের পক্ষে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করা সম্ভব হয় না। তাই তো দেখি বর্তমান শাসক দলের নানা সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন অনাচার সব সংবাদপত্র নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকাশ করে না। প্রকাশ না করে তারা সরকারি দলের কৃপা পাওয়ার আশা করছে। এভাবে কোনো সংবাদপত্রের ‘ব্যক্তিত্ব’ বিকশিত হয় না। সব সময় সরকার বা রাজনৈতিক দলের কৃপার ওপরই তাদের থাকতে হয়। পাঠকের শক্তিতে তারা বলীয়ান হতে পারে না।
আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এক ধরনের ‘করণিক সাংবাদিকতা’ করে ‘টিভি সাংবাদিকতা’র একটা দুর্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। টিভি চ্যানেলগুলো প্রধানত প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীর অনুষ্ঠান, প্রধান বিরোধী দল, বিভিন্ন উদ্বোধন, গোলটেবিল ও নানা দুর্ঘটনার ওপরই তাদের ক্যামেরা ব্যস্ত রেখেছে। নিজেদের উদ্যোগে কোনো সরকারি ব্যর্থতার রিপোর্ট তারা সহজে তুলে ধরে না। ব্যতিক্রম খুব কম। ফলে সরকারি কর্তাদের ধারণা হয়েছে, ‘টিভি চ্যানেলগুলো খুব দেশপ্রেমিক। তারা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে না।’ কিন্তু সরকারকে কে বোঝাবে, আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এখনো প্রকৃত টিভি সাংবাদিকতা শুরুই করেনি। ‘একুশে টিভি’র সাইমন যুগে কিছুটা চেষ্টা হয়েছিল।
কাজেই সংগত কারণে সংবাদপত্র নিয়েই সমালোচনা হচ্ছে বেশি। কুলদীপ নায়ার বাংলাদেশের সংবাদপত্র পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালো জেনেশুনে এ রকম বক্তব্য দিয়েছেন, নাকি সাধারণভাবে গণমাধ্যম সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন তা আমি জানি না। তবে তাঁর এই বক্তৃতা বাংলাদেশের বর্তমান সংবাদপত্র প্রকাশনার যুগে খুব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। বক্তৃতাটির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এ দেশের সব সাংবাদিক, সংবাদপত্র মালিক ও প্রকাশক মনোযোগ দিয়ে পড়লে গণমাধ্যমের অনেক কিছু সম্পর্কে চিন্তা করার খোরাক পাবেন। ভোরের কাগজকে ধন্যবাদ কুলদীপ নায়ারকে আমন্ত্রণ করার জন্য।
জ্যোতি বসু ও গণমাধ্যম
সম্প্রতি প্রয়াত ভারতের বামপন্থী নেতা কমরেড জ্যোতি বসুর নানা গুণাবলি উল্লেখ করে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বেশিরভাগ লেখাই চিন্তা উদ্দীপক। আমি শুধু একটা বিষয় যোগ করতে চাই।
অনেক রাজনীতিবিদের ধারণা, বড় নেতা, জনপ্রিয় নেতা বা জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী (প্রধানমন্ত্রী) হতে হলে গণমাধ্যমের বিরাট সহায়তার প্রয়োজন হয়। সেজন্য বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদ গণমাধ্যমকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেন। সাংবাদিকেরাও রাজনীতিবিদদের পেয়ে বসেছেন। কারণ, বেশিরভাগ রাজনীতিবিদের নানা দুর্বলতা রয়েছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গে কমরেড জ্যোতি বসু বা তাঁর দল সিপিএম তাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো কলকাতার বড় সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের (তখন শুধু দূরদর্শন) সহায়তা পাননি। কলকাতার দুই-তিনটি বড় ও অত্যন্ত প্রভাবশালী দৈনিক সব সময় সিপিএম, বামপন্থা ও জ্যোতি বসুবিরোধী ভূমিকা পালন করে গেছে। শত শত রিপোর্ট, কলাম, সম্পাদকীয় ও কার্টুন ছাপা হয়েছে বামফ্রন্ট সরকার তথা জ্যোতি বসুর বিপক্ষে। কিন্তু তাতে তেমন বড় ক্ষতি হয়নি বামফ্রন্টের। কিংবা জ্যোতি বসুর। একটানা ২৭ বছর বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায়। প্রায় ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। গণমাধ্যমের এত বিরূপ প্রচারণার প্রভাব কোথায় গেল? গণমাধ্যম নাকি খুব শক্তিশালী?
গণমাধ্যম অবশ্যই শক্তিশালী। তবে, তারচেয়েও শক্তিশালী হলো সাধারণ মানুষের সমর্থন। নেতা, রাজনৈতিক দল বা সরকার যদি তাদের কাজের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের মন জয় করতে পারে তাহলে গণমাধ্যমের বিরূপ প্রচারণা তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ও জ্যোতি বসু আমাদের সামনে এই দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এই দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের রাজনৈতিক দল বা নেতারা কি কিছু শিখবেন?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
No comments