বিএনপি কোন পথে -সপ্তাহের হালচাল by আব্দুল কাইয়ুম
অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিএনপিকে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আগামী ৮ ডিসেম্বর তাদের জাতীয় কাউন্সিলের সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করবে জ্বলন্ত এসব প্রশ্নে কাউন্সিল কী অবস্থান নেয় তার ওপর। এর প্রথমটি হলো দলের ভেতরে গণতন্ত্রের প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, দলকে দুর্নীতি থেকে দূরে রাখার বিষয়ে অবস্থান। আর তৃতীয়ত, যেটি আসলে প্রথম প্রশ্ন হওয়া উচিত, তা হলো দল কি আবার কখনো ‘হাওয়া ভবন’নির্ভর হয়ে পড়বে? এ তিনটি বিষয়ে কাউন্সিল ইতিবাচক অবস্থান নিতে না পারলে রাজনীতিসচেতন মানুষ তো বটেই, এমনকি বিএনপির সমর্থকেরাও কিছুটা আশাহত হবেন। আসলে বিষয়গুলো এতই পরিষ্কার যে এর কোনোটাই কোনো দায়িত্বশীল দল এড়িয়ে যেতে পারে না।
ধরা যাক দলের ভেতরের গণতন্ত্রের কথা। বিএনপির মতো একটি দলের কাছে নিশ্চয়ই এমন আশা করা যায় না যে তারা যৌথ নেতৃত্ব চালু করবে। বাস্তবতা হলো চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াই দলের মূল কেন্দ্র। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্তে নিশ্চয়ই তাঁর মতামত প্রাধান্য পাবে। এটাই স্বাভাবিক এবং মানুষও তাই মনে করে। কিন্তু এর মধ্যেও তো দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের আরও কিছু বিষয় থাকে। যেমন, চৌদ্দ বছর ধরে কেন জাতীয় কাউন্সিল হয়নি? এর মানে কি এই দাঁড়ায় না যে দলে কাউন্সিল মূল্যহীন, শুধু চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর নেতৃত্বই যথেষ্ট? দলের বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মাসে একবার স্থায়ী কমিটির সভা ও প্রতি তিন মাসে একবার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভা হওয়ার কথা। কিন্তু এই বিধানগুলোও মানা হয় না। নির্বাহী কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে। সেটাও প্রায় ছয় বছর পর। আর স্থায়ী কমিটির সভা সম্প্রতি মাঝেমধ্যে হচ্ছে বটে, কিন্তু আগে বৈঠক তেমন হতোই না।
অনেক দলে এ রকম হয়ে থাকে। গঠনতন্ত্রে লেখা থাকলেও বাস্তবায়ন হয় না। কিন্তু যেসব দল বড় ও গুরুত্বপূর্ণ, যারা সরকার গঠন করে, তাদের বেলায় এ রকম হলে চলবে কেন? দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বের নিয়মিত বৈঠক, আলাপ-আলোচনা না হলে দলাদলি উত্সাহিত হয়। তা ছাড়া দলে যদি অনিয়ম প্রশ্রয় পায় তাহলে সেই দল ক্ষমতায় গেলে নিশ্চয়ই সেখানেও নানা অনিয়ম হবে। হয়েছেও তাই। কাউন্সিলে যদি এসব বিষয় আলোচনায় আসে এবং সে অনুযায়ী দল পরিচালনায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণের বিধান গৃহীত হয়, তাহলে সেটা কিছুটা হলেও অগ্রগতি বলে বিবেচিত হবে। এ জন্য হয়তো গঠনতন্ত্রে কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। তবে গঠনতন্ত্রের বিধানগুলো যেন দল পরিচালনায় মেনে চলা নিশ্চিত করা হয়, সেটাই মূল কথা।
এসব বিষয়ে বিএনপির সহসভাপতি ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী এম কে আনোয়ারের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, বর্তমানে বিএনপিতে বিভিন্ন রূপে এই চর্চা অব্যাহত আছে। যেমন, উচ্চতর পর্যায়ে স্থায়ী কমিটির সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন তাঁর গুলশান কার্যালয়ে সব সময় আলাপ-আলোচনা করেন। তাঁর মতে, চেয়ারপারসন একজন ‘মহত্ শ্রোতা’। সুতরাং তিনি সবার কথা শুনেই সিদ্ধান্ত নেন।
এম কে আনোয়ার বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা। তিনি যদি দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতান্ত্রিক রীতি অনুসরণের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন, তাহলে কিছু বলার থাকে না। সে ক্ষেত্রে ধরে নিতে হয় যে কাউন্সিলে হয়তো বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব পাবে না। তাহলে তো কাউন্সিলের সাফল্য অনেকাংশে ম্লান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কারণ এই কাউন্সিল শুধু নির্বাচন কমিশনের শর্ত অনুযায়ী গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনেই যদি দায়িত্ব শেষ করে তাহলে তা যথেষ্ট হবে না। সেটা তো করতেই হবে, এবং সে ব্যাপারে বিএনপি আগেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রশ্ন হলো আনুষ্ঠানিক সংশোধনীর অতিরিক্ত আরও কিছু পাওয়া যাবে কি না। অন্তত আগে দল যেভাবে চলেছে, তার থেকে কী পরিবর্তন হলো, সেটা তো মানুষ দেখতে চাইবে। সেখানে যদি বলা হয়, বিএনপির মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা ঠিকই আছে, তাহলে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা মার খাবে।
বিএনপির জেলা পর্যায়ে সম্মেলন শুরু হলে প্রথমেই চট্টগ্রামে দুই পক্ষের মারপিটে সম্মেলন পণ্ড হয়ে যায়। এম কে আনোয়ারের ব্যাখ্যা হলো, দলে গণতন্ত্র তথা বহুমতের অস্তিত্ব আছে বলেই এই মারামারি। যদি তা না থাকত, যদি উপর থেকে চেয়ারপারসন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন, তাহলে কোথাও কোনো গণ্ডগোল হতো না। এই ব্যাখ্যা মেনে নেওয়া কঠিন। এটা ঠিক যে চট্টগ্রাম বা অন্যান্য জেলার সম্মেলনে যে অন্তর্দলীয় সংঘর্ষ হচ্ছে, তার বেশির ভাগই স্রেফ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। একে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অস্তিত্বের প্রকাশ বলে দেখানো চলে না। বরং এসব ঘটনা দলের মধ্যে আরও খোলামেলা আলোচনার অপরিহার্যতাকেই বড় করে সামনে আনে।
দলের মধ্যে যখন রাখঢাক চলে তখনই অবাধ দুর্নীতির রাস্তা খুলে যায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনার সময় অকল্পনীয় দুর্নীতি হয়েছে, এবং এই দুর্নীতির জন্যই বিএনপির আজ এমন দুর্দশা। সুতরাং আসন্ন কাউন্সিলে এ ব্যাপারে ভালোভাবে আলোচনা দরকার। বিএনপিকে উঠে দাঁড়াতে হলে এর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকা দরকার। কোনো অজুহাত চলবে না। কার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দুর্নীতির মামলা হয়েছে, সেটা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। মানুষের ধারণায় এটা এসে গেছে যে বিএনপির বিগত সরকারের আমলে মন্ত্রী ও নেতারা চরম দুর্নীতি করেছেন। এখন তাঁরা সেই ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখেন? তারা কি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর সব দায় চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের পাক-পবিত্র বলে প্রমাণ করতে চাইবে, নাকি পুরো বিষয়টি কাউন্সিলের আলোচনাতেই আনবে না? আসলে দুর্নীতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে এর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অঙ্গীকার দরকার। বিএনপি কি সেটা পারবে?
এম কে আনোয়ার খুব দামি একটা কথা বলেছেন। তাঁর মন্তব্য হলো, ‘যত দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্নীতিমুক্ত না হবে, তাদের ছত্রচ্ছায়ায় দুর্নীতি বন্ধ না হবে’, তত দিন পর্যন্ত দুর্নীতি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এই পর্যবেক্ষণ খুবই সঠিক এবং সব দলের জন্য প্রযোজ্য। বিশেষভাবে বিএনপি এবারের কাউন্সিলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করুক। তারা বলুক যে মন্ত্রী ও নেতারা দুর্নীতি করলে দল থেকে বের করে দেওয়া হবে, অথবা অন্তত দৃষ্টান্তস্থানীয় শাস্তি পাবে। জানি এসব কথা মানুষ অনেক শুনেছে, তাতে অবস্থার খুব বেশি হেরফের হয়নি। সেটা না হোক, তার পরও এ ধরনের আলোচনা ও সিদ্ধান্তের মূল্য আছে। অন্তত দলকে ভাবায়, দলকে আরও একটু উঁচুতে নিয়ে যায়।
কিন্তু মুশকিল হলো যখন বলা হয় নিজের জন্য তো চাঁদাবাজি বা দুর্নীতি করি না, করি দলের জন্য। কেউ বলেন, নির্বাচনে জিততে হলে, দলকে জিতিয়ে আনতে হলে, টাকার দরকার। এটা আজকের কথা নয়। সেই রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমলেও এই প্রথা ছিল। বিএনপির নেতা ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘এই চাঁদা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। মাসে তিন লাখ টাকা করে দশজন মন্ত্রীকে দলের জন্য চাঁদা দিতে বলা হয়েছিল। আমার নামও দেয়া হয়েছিল তাতে। কিন্তু আমি এভাবে চাঁদা দেওয়ার পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তর্ক করেছি। রাজনীতিতে অর্থের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তাই নিজের ফর্মুলাও দিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা গৃহীত হয়নি। যাক আমি আর শেষ পর্যন্ত চাঁদা দেইনি। জাহাজমন্ত্রী নূরুল হকও চাঁদা দিতে অস্বীকার করেন। এই অবাধ্যতা প্রেসিডেন্ট জিয়ার পছন্দ হয়নি’ (চলমান ইতিহাস, মওদুদ আহমদ, ইউপিএল, ২০০৯, পৃ.১৭৮-১৭৯)।
প্রায় ৩০ বছর আগে তিন লাখ টাকার দাম এখন কম করে হলেও তো ৩০ লাখ হবে! তাহলে যদি একজন মন্ত্রীকে মাসে ৩০ লাখ টাকা করে দিতে হয়, আর সেই ৩০ লাখ তুলতে গিয়ে যদি তাঁকে নিজের জন্য আরও ৩০ লাখ বাগাতে হয়, তাহলে দুর্নীতি বন্ধ হবে কীভাবে?
বিগত বিএনপির সরকারের সময় দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছিল বিশেষভাবে হাওয়া ভবনের কল্যাণে। সেখানে কার্যত সমান্তরাল সরকার চলত। অভিযোগ যে দেশের যেকোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সেখানে সেলামি দিতে হতো। ওই সময় হাওয়া ভবন আসলে দেশে দুর্নীতির প্রতীক হয়ে ওঠে। বিএনপি এর দায় এড়াতে পারে না। এবারের কাউন্সিলে যদি বিএনপি এই স্পর্শকাতর হাওয়া ভবনের ইস্যুটি আলোচনায় এনে এ ধরনের সমান্তরাল সরকার ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়, তাহলে তা বিএনপিকে শক্তি জোগাবে।
বিএনপির বিভিন্ন জেলা সম্মেলনে দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও নেতাদের অনেকে ওসব ঢেকে রাখতে চাইছেন। তবে এটাও ঠিক যে বেশ কিছু জেলায় শান্তিপূর্ণভাবে সম্মেলন হয়েছে। এটা তাদের শক্তির দিক। বিএনপি সরকারের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক এ ব্যাপারে বলেন, তিনি যে কয়টা এলাকায় সম্মেলন করেছেন, সবখানে উত্সাহ-উদ্দীপনা ছিল, কমিটি নিয়ে প্রথমে দ্বন্দ্ব থাকলেও পরে সমঝোতার মাধ্যমে সম্মেলন সুসম্পন্ন হয়। এমনকি করিমগঞ্জ পৌরসভাসহ তিনটি উপজেলায় গোপন ব্যালটে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে। এটা নিশ্চয়ই বিএনপির জন্য শুভ ইঙ্গিত। নেতৃত্ব নির্বাচনের এই ধারাটি নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত হোক, এটা সব দিক থেকেই ভালো হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
ধরা যাক দলের ভেতরের গণতন্ত্রের কথা। বিএনপির মতো একটি দলের কাছে নিশ্চয়ই এমন আশা করা যায় না যে তারা যৌথ নেতৃত্ব চালু করবে। বাস্তবতা হলো চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াই দলের মূল কেন্দ্র। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্তে নিশ্চয়ই তাঁর মতামত প্রাধান্য পাবে। এটাই স্বাভাবিক এবং মানুষও তাই মনে করে। কিন্তু এর মধ্যেও তো দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের আরও কিছু বিষয় থাকে। যেমন, চৌদ্দ বছর ধরে কেন জাতীয় কাউন্সিল হয়নি? এর মানে কি এই দাঁড়ায় না যে দলে কাউন্সিল মূল্যহীন, শুধু চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর নেতৃত্বই যথেষ্ট? দলের বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মাসে একবার স্থায়ী কমিটির সভা ও প্রতি তিন মাসে একবার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভা হওয়ার কথা। কিন্তু এই বিধানগুলোও মানা হয় না। নির্বাহী কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয়েছে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে। সেটাও প্রায় ছয় বছর পর। আর স্থায়ী কমিটির সভা সম্প্রতি মাঝেমধ্যে হচ্ছে বটে, কিন্তু আগে বৈঠক তেমন হতোই না।
অনেক দলে এ রকম হয়ে থাকে। গঠনতন্ত্রে লেখা থাকলেও বাস্তবায়ন হয় না। কিন্তু যেসব দল বড় ও গুরুত্বপূর্ণ, যারা সরকার গঠন করে, তাদের বেলায় এ রকম হলে চলবে কেন? দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বের নিয়মিত বৈঠক, আলাপ-আলোচনা না হলে দলাদলি উত্সাহিত হয়। তা ছাড়া দলে যদি অনিয়ম প্রশ্রয় পায় তাহলে সেই দল ক্ষমতায় গেলে নিশ্চয়ই সেখানেও নানা অনিয়ম হবে। হয়েছেও তাই। কাউন্সিলে যদি এসব বিষয় আলোচনায় আসে এবং সে অনুযায়ী দল পরিচালনায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণের বিধান গৃহীত হয়, তাহলে সেটা কিছুটা হলেও অগ্রগতি বলে বিবেচিত হবে। এ জন্য হয়তো গঠনতন্ত্রে কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। তবে গঠনতন্ত্রের বিধানগুলো যেন দল পরিচালনায় মেনে চলা নিশ্চিত করা হয়, সেটাই মূল কথা।
এসব বিষয়ে বিএনপির সহসভাপতি ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী এম কে আনোয়ারের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, বর্তমানে বিএনপিতে বিভিন্ন রূপে এই চর্চা অব্যাহত আছে। যেমন, উচ্চতর পর্যায়ে স্থায়ী কমিটির সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন তাঁর গুলশান কার্যালয়ে সব সময় আলাপ-আলোচনা করেন। তাঁর মতে, চেয়ারপারসন একজন ‘মহত্ শ্রোতা’। সুতরাং তিনি সবার কথা শুনেই সিদ্ধান্ত নেন।
এম কে আনোয়ার বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা। তিনি যদি দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতান্ত্রিক রীতি অনুসরণের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন, তাহলে কিছু বলার থাকে না। সে ক্ষেত্রে ধরে নিতে হয় যে কাউন্সিলে হয়তো বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব পাবে না। তাহলে তো কাউন্সিলের সাফল্য অনেকাংশে ম্লান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কারণ এই কাউন্সিল শুধু নির্বাচন কমিশনের শর্ত অনুযায়ী গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনেই যদি দায়িত্ব শেষ করে তাহলে তা যথেষ্ট হবে না। সেটা তো করতেই হবে, এবং সে ব্যাপারে বিএনপি আগেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রশ্ন হলো আনুষ্ঠানিক সংশোধনীর অতিরিক্ত আরও কিছু পাওয়া যাবে কি না। অন্তত আগে দল যেভাবে চলেছে, তার থেকে কী পরিবর্তন হলো, সেটা তো মানুষ দেখতে চাইবে। সেখানে যদি বলা হয়, বিএনপির মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা ঠিকই আছে, তাহলে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা মার খাবে।
বিএনপির জেলা পর্যায়ে সম্মেলন শুরু হলে প্রথমেই চট্টগ্রামে দুই পক্ষের মারপিটে সম্মেলন পণ্ড হয়ে যায়। এম কে আনোয়ারের ব্যাখ্যা হলো, দলে গণতন্ত্র তথা বহুমতের অস্তিত্ব আছে বলেই এই মারামারি। যদি তা না থাকত, যদি উপর থেকে চেয়ারপারসন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন, তাহলে কোথাও কোনো গণ্ডগোল হতো না। এই ব্যাখ্যা মেনে নেওয়া কঠিন। এটা ঠিক যে চট্টগ্রাম বা অন্যান্য জেলার সম্মেলনে যে অন্তর্দলীয় সংঘর্ষ হচ্ছে, তার বেশির ভাগই স্রেফ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। একে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অস্তিত্বের প্রকাশ বলে দেখানো চলে না। বরং এসব ঘটনা দলের মধ্যে আরও খোলামেলা আলোচনার অপরিহার্যতাকেই বড় করে সামনে আনে।
দলের মধ্যে যখন রাখঢাক চলে তখনই অবাধ দুর্নীতির রাস্তা খুলে যায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনার সময় অকল্পনীয় দুর্নীতি হয়েছে, এবং এই দুর্নীতির জন্যই বিএনপির আজ এমন দুর্দশা। সুতরাং আসন্ন কাউন্সিলে এ ব্যাপারে ভালোভাবে আলোচনা দরকার। বিএনপিকে উঠে দাঁড়াতে হলে এর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকা দরকার। কোনো অজুহাত চলবে না। কার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দুর্নীতির মামলা হয়েছে, সেটা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। মানুষের ধারণায় এটা এসে গেছে যে বিএনপির বিগত সরকারের আমলে মন্ত্রী ও নেতারা চরম দুর্নীতি করেছেন। এখন তাঁরা সেই ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখেন? তারা কি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর সব দায় চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের পাক-পবিত্র বলে প্রমাণ করতে চাইবে, নাকি পুরো বিষয়টি কাউন্সিলের আলোচনাতেই আনবে না? আসলে দুর্নীতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে এর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অঙ্গীকার দরকার। বিএনপি কি সেটা পারবে?
এম কে আনোয়ার খুব দামি একটা কথা বলেছেন। তাঁর মন্তব্য হলো, ‘যত দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্নীতিমুক্ত না হবে, তাদের ছত্রচ্ছায়ায় দুর্নীতি বন্ধ না হবে’, তত দিন পর্যন্ত দুর্নীতি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এই পর্যবেক্ষণ খুবই সঠিক এবং সব দলের জন্য প্রযোজ্য। বিশেষভাবে বিএনপি এবারের কাউন্সিলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করুক। তারা বলুক যে মন্ত্রী ও নেতারা দুর্নীতি করলে দল থেকে বের করে দেওয়া হবে, অথবা অন্তত দৃষ্টান্তস্থানীয় শাস্তি পাবে। জানি এসব কথা মানুষ অনেক শুনেছে, তাতে অবস্থার খুব বেশি হেরফের হয়নি। সেটা না হোক, তার পরও এ ধরনের আলোচনা ও সিদ্ধান্তের মূল্য আছে। অন্তত দলকে ভাবায়, দলকে আরও একটু উঁচুতে নিয়ে যায়।
কিন্তু মুশকিল হলো যখন বলা হয় নিজের জন্য তো চাঁদাবাজি বা দুর্নীতি করি না, করি দলের জন্য। কেউ বলেন, নির্বাচনে জিততে হলে, দলকে জিতিয়ে আনতে হলে, টাকার দরকার। এটা আজকের কথা নয়। সেই রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমলেও এই প্রথা ছিল। বিএনপির নেতা ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘এই চাঁদা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। মাসে তিন লাখ টাকা করে দশজন মন্ত্রীকে দলের জন্য চাঁদা দিতে বলা হয়েছিল। আমার নামও দেয়া হয়েছিল তাতে। কিন্তু আমি এভাবে চাঁদা দেওয়ার পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তর্ক করেছি। রাজনীতিতে অর্থের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তাই নিজের ফর্মুলাও দিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা গৃহীত হয়নি। যাক আমি আর শেষ পর্যন্ত চাঁদা দেইনি। জাহাজমন্ত্রী নূরুল হকও চাঁদা দিতে অস্বীকার করেন। এই অবাধ্যতা প্রেসিডেন্ট জিয়ার পছন্দ হয়নি’ (চলমান ইতিহাস, মওদুদ আহমদ, ইউপিএল, ২০০৯, পৃ.১৭৮-১৭৯)।
প্রায় ৩০ বছর আগে তিন লাখ টাকার দাম এখন কম করে হলেও তো ৩০ লাখ হবে! তাহলে যদি একজন মন্ত্রীকে মাসে ৩০ লাখ টাকা করে দিতে হয়, আর সেই ৩০ লাখ তুলতে গিয়ে যদি তাঁকে নিজের জন্য আরও ৩০ লাখ বাগাতে হয়, তাহলে দুর্নীতি বন্ধ হবে কীভাবে?
বিগত বিএনপির সরকারের সময় দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছিল বিশেষভাবে হাওয়া ভবনের কল্যাণে। সেখানে কার্যত সমান্তরাল সরকার চলত। অভিযোগ যে দেশের যেকোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সেখানে সেলামি দিতে হতো। ওই সময় হাওয়া ভবন আসলে দেশে দুর্নীতির প্রতীক হয়ে ওঠে। বিএনপি এর দায় এড়াতে পারে না। এবারের কাউন্সিলে যদি বিএনপি এই স্পর্শকাতর হাওয়া ভবনের ইস্যুটি আলোচনায় এনে এ ধরনের সমান্তরাল সরকার ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়, তাহলে তা বিএনপিকে শক্তি জোগাবে।
বিএনপির বিভিন্ন জেলা সম্মেলনে দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও নেতাদের অনেকে ওসব ঢেকে রাখতে চাইছেন। তবে এটাও ঠিক যে বেশ কিছু জেলায় শান্তিপূর্ণভাবে সম্মেলন হয়েছে। এটা তাদের শক্তির দিক। বিএনপি সরকারের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক এ ব্যাপারে বলেন, তিনি যে কয়টা এলাকায় সম্মেলন করেছেন, সবখানে উত্সাহ-উদ্দীপনা ছিল, কমিটি নিয়ে প্রথমে দ্বন্দ্ব থাকলেও পরে সমঝোতার মাধ্যমে সম্মেলন সুসম্পন্ন হয়। এমনকি করিমগঞ্জ পৌরসভাসহ তিনটি উপজেলায় গোপন ব্যালটে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে। এটা নিশ্চয়ই বিএনপির জন্য শুভ ইঙ্গিত। নেতৃত্ব নির্বাচনের এই ধারাটি নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত হোক, এটা সব দিক থেকেই ভালো হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
No comments