এখন সমুদ্রস্নান -চলতি পথে by দীপংকর চন্pr
রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে চেপে বসলাম বাসে। সমুদ্রের স্বপ্নে বিভোর হয়ে কত পথ, কত মাঠ, কত নদী, কত ঘাট পার হয়ে পৌঁছলাম পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার শেষপ্রান্ত লতাচাপলী ইউনিয়নে। বাস থেকে নেমে পা রাখলাম অনুন্নত এই ইউনিয়নের অপ্রশস্ত পাকা পথে। একটু হাঁটতেই লতাচাপলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চোখে পড়ল। বিদ্যালয়ের সামনেই একটি পাড় বাঁধানো জলাশয় থাকলেও আমাদের লক্ষ্য তো পাড়ের চিহ্নবিহীন সুবিশাল জলরাশি—কিন্তু কোথায়? কোথায় সেই জল? হ্যাঁ, অল্প দূরত্বেই, ওয়াপদা বাঁধের আশেপাশের হোটেল-মোটেলগুলো অতিক্রম করলেই সোনার বালুকাবেলা—কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এবং যেখানে সৈকত বিলীয়মান, সেখানেই উদ্ভাসিত আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। কী করব আমরা এখন? লোকলজ্জার ভয় বিপুলবিক্রমে জয় করে নেমে যাব সমুদ্রস্নানে? নাকি নির্জন সমুদ্র সৈকতে নগ্নপদে দীর্ঘক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করব পরিপাশের অপার্থিব সৌন্দর্য? স্নানে না নেমে শুরুতেই হাঁটা যাক বরং।
নথিপত্রে পটুয়াখালীর সদর উপজেলা থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরের এই কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থ প্রায় তিন কিলোমিটার হলেও সম্ভবত এই হিসাব পরিমার্জনার দাবি রাখে। সৈকতের কোল ঘেঁষে দুই একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ এক নারিকেলবীথি। অনেকটা পূর্বে পটুয়াখালী বনবিভাগের পরীক্ষামূলক ফোরসোর বাগান। ১৯৯৭-৯৮ সালে গড়ে ওঠা এই বাগানটির জমির পরিমাণ ছয় হেক্টর। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের দেখা মিললেও একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে সারিবদ্ধ ঝাউগাছের দল। সৈকতের মূল পয়েন্ট থেকে ঝাউবন অবধি পথটুকু একেবারে কম নয়। সূর্য তখন মধ্যগগনে। হাঁটতে হাঁটতে গলা শুকিয়ে কাঠ আমাদের। জল পান করা প্রয়োজন। কাছেই একটা দোকান দেখা গেল। মোহাম্মদ আলীর টং-দোকান। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত পর্যটকদের জন্য এই দোকানে রয়েছে হরেকরকম শুকনো খাবারের বন্দোবস্ত। আর ভিজে খাবারের আয়োজন কেমন এখানে? সকৌতুকে প্রশ্ন করতেই স্মিতহাস্যে দোকানি জানান, ‘চা আছে, স্প্রাইট আছে, বিশুদ্ধ জলের বোতল আছে, এ ছাড়াও আছে ভীষণ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ডাব’—সত্যিই! চোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো বিশালাকৃতির ডাবগুলো দেখে তৃষ্ণা নিবারণের অন্য কোনো বস্তুর কথা মাথায় আনা কঠিন! তাই ডাবই হাতে তুলে নিলাম আমরা। দোকানের ভাঙা বেঞ্চে বসে ডাব খেতে খেতে সাগর কবুতরের উড়ে বেড়ানো দেখলাম, দেখলাম কী নিপুণ দক্ষতায় নোনা জল থেকে ফ্যাসা মাছ তুলে নেয় তারা। তারপর সৈকতে অযত্নে জন্মানো কলমীলতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে সেরে নেয় ক্ষুধা নিবৃত্তির মতো নৈমিত্তিক জৈবিক কাজ।
ডাবের জলে তৃষ্ণা নিবারণ করে আবার উঠে দাঁড়াই আমরা। এবার উল্টোদিকে অর্থাত্ কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম অংশে অবস্থিত শুঁটকি পল্লীর দিকে পা বাড়াই ধীরে ধীরে। আমাদের মাথার ওপর মেঘমুক্ত নীল আকাশ। মুগ্ধ বিস্ময়ে সাগরের পাশাপাশি আকাশের বিশালত্বও অনুভবের প্রাণান্ত চেষ্টা করি। চেষ্টা করতে করতে ঢাকায় ফেলে আসা আকাশের কথা মনে হয়। একচিলতে সেই আকাশের সঙ্গে কুয়াকাটার সীমাহীন আকাশের প্রতি তুলনার বিষয়টি অযাচিতভাবেই উপস্থিত হয় ভাবনায়। অজান্তেই এক ধরনের দুঃখবোধ উড়ে এসে জুড়ে বসে। যদিও সেই দুঃখবোধ স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পায় না একেবারেই। কারণ, তুমুল বাতাসের দস্যিপনার কাছে ভীষণ অসহায় বোধ করে সে। প্রতিরোধের দেয়াল দৃঢ় করার পরিবর্তে লেজ গুটিয়ে পালায় সভয়ে।
শুঁটকি পল্লী দেখে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের শেষ ভাগ। এরপর আর স্নানবঞ্চিত থাকার কোনো মানে নেই। কিন্তু জামা-কাপড়? ব্যাগ? হাতে থাকা ক্যামেরা-ঘড়ি? এসব দেখেশুনে রাখার জন্য হঠাত্ই যেন শূন্য থেকে নেমে এল একজন প্রান্তশিশু। কী নাম তার? মনির। বয়স আনুমানিক আট বছর। কলাপাড়া ফেরিঘাটের কাছেই বাড়ি তার। ভাড়া ছিল না পকেটে, তবু বাসের কন্ডাক্টরকে অনুরোধ করে চলে এসেছে কুয়াকাটায়। সমুদ্রে স্নান করতে নেমে হারিয়েছে শেষ গাড়িতে বাড়ি ফেরার সুযোগ। এখন? কী করবে সে? প্রান্তশিশু মনিরের সমস্যাটি জটিল হলেও আমাদের তা ভাবায় না মোটেই। কারণ, আমাদের বর্তমান অবস্থাও মনিরের চেয়ে খুব একটা ভালো নয়। মনিরের মতোই কুয়াকাটায় আমাদের ভবিষ্যতও স্বচ্ছ নয়। রাতে থাকা কিংবা খাওয়ার কোনো জায়গা স্থির হয়নি এখনো। যদি তা হয়ই শেষঅবধি, তবে আমাদের সঙ্গে মনিরের ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই হবে! সে যাই হোক, আপাতত এসব আটপৌরে ভাবনা স্থগিত থাক। এখন সমুদ্রস্নান। প্রান্তশিশু মনির আমাদের সর্বস্ব নিয়ে বসে রইল নির্জন সৈকতে। আমরা নামলাম জলে—জোয়ার পেরিয়ে ভাটার সূচনা হয়েছে কেবল, তখনো অনেক স্রোত, অনেক ঢেউ—একের পর এক আছড়ে পড়ছে আমাদের অতি তুচ্ছ, অতি ক্ষুদ্র, অতি নগণ্য শরীরে—শরীর পেরিয়ে সেই ঢেউ গড়িয়ে যাচ্ছে সবেগে আবার বেলাভূমির দিকে—জল, জল আর জল—এ এক অবিশ্বাস্য লবণাক্ত পৃথিবী আমাদের চারপাশে!!!
নথিপত্রে পটুয়াখালীর সদর উপজেলা থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরের এই কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থ প্রায় তিন কিলোমিটার হলেও সম্ভবত এই হিসাব পরিমার্জনার দাবি রাখে। সৈকতের কোল ঘেঁষে দুই একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ এক নারিকেলবীথি। অনেকটা পূর্বে পটুয়াখালী বনবিভাগের পরীক্ষামূলক ফোরসোর বাগান। ১৯৯৭-৯৮ সালে গড়ে ওঠা এই বাগানটির জমির পরিমাণ ছয় হেক্টর। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের দেখা মিললেও একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে সারিবদ্ধ ঝাউগাছের দল। সৈকতের মূল পয়েন্ট থেকে ঝাউবন অবধি পথটুকু একেবারে কম নয়। সূর্য তখন মধ্যগগনে। হাঁটতে হাঁটতে গলা শুকিয়ে কাঠ আমাদের। জল পান করা প্রয়োজন। কাছেই একটা দোকান দেখা গেল। মোহাম্মদ আলীর টং-দোকান। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত পর্যটকদের জন্য এই দোকানে রয়েছে হরেকরকম শুকনো খাবারের বন্দোবস্ত। আর ভিজে খাবারের আয়োজন কেমন এখানে? সকৌতুকে প্রশ্ন করতেই স্মিতহাস্যে দোকানি জানান, ‘চা আছে, স্প্রাইট আছে, বিশুদ্ধ জলের বোতল আছে, এ ছাড়াও আছে ভীষণ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ডাব’—সত্যিই! চোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো বিশালাকৃতির ডাবগুলো দেখে তৃষ্ণা নিবারণের অন্য কোনো বস্তুর কথা মাথায় আনা কঠিন! তাই ডাবই হাতে তুলে নিলাম আমরা। দোকানের ভাঙা বেঞ্চে বসে ডাব খেতে খেতে সাগর কবুতরের উড়ে বেড়ানো দেখলাম, দেখলাম কী নিপুণ দক্ষতায় নোনা জল থেকে ফ্যাসা মাছ তুলে নেয় তারা। তারপর সৈকতে অযত্নে জন্মানো কলমীলতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে সেরে নেয় ক্ষুধা নিবৃত্তির মতো নৈমিত্তিক জৈবিক কাজ।
ডাবের জলে তৃষ্ণা নিবারণ করে আবার উঠে দাঁড়াই আমরা। এবার উল্টোদিকে অর্থাত্ কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম অংশে অবস্থিত শুঁটকি পল্লীর দিকে পা বাড়াই ধীরে ধীরে। আমাদের মাথার ওপর মেঘমুক্ত নীল আকাশ। মুগ্ধ বিস্ময়ে সাগরের পাশাপাশি আকাশের বিশালত্বও অনুভবের প্রাণান্ত চেষ্টা করি। চেষ্টা করতে করতে ঢাকায় ফেলে আসা আকাশের কথা মনে হয়। একচিলতে সেই আকাশের সঙ্গে কুয়াকাটার সীমাহীন আকাশের প্রতি তুলনার বিষয়টি অযাচিতভাবেই উপস্থিত হয় ভাবনায়। অজান্তেই এক ধরনের দুঃখবোধ উড়ে এসে জুড়ে বসে। যদিও সেই দুঃখবোধ স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পায় না একেবারেই। কারণ, তুমুল বাতাসের দস্যিপনার কাছে ভীষণ অসহায় বোধ করে সে। প্রতিরোধের দেয়াল দৃঢ় করার পরিবর্তে লেজ গুটিয়ে পালায় সভয়ে।
শুঁটকি পল্লী দেখে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের শেষ ভাগ। এরপর আর স্নানবঞ্চিত থাকার কোনো মানে নেই। কিন্তু জামা-কাপড়? ব্যাগ? হাতে থাকা ক্যামেরা-ঘড়ি? এসব দেখেশুনে রাখার জন্য হঠাত্ই যেন শূন্য থেকে নেমে এল একজন প্রান্তশিশু। কী নাম তার? মনির। বয়স আনুমানিক আট বছর। কলাপাড়া ফেরিঘাটের কাছেই বাড়ি তার। ভাড়া ছিল না পকেটে, তবু বাসের কন্ডাক্টরকে অনুরোধ করে চলে এসেছে কুয়াকাটায়। সমুদ্রে স্নান করতে নেমে হারিয়েছে শেষ গাড়িতে বাড়ি ফেরার সুযোগ। এখন? কী করবে সে? প্রান্তশিশু মনিরের সমস্যাটি জটিল হলেও আমাদের তা ভাবায় না মোটেই। কারণ, আমাদের বর্তমান অবস্থাও মনিরের চেয়ে খুব একটা ভালো নয়। মনিরের মতোই কুয়াকাটায় আমাদের ভবিষ্যতও স্বচ্ছ নয়। রাতে থাকা কিংবা খাওয়ার কোনো জায়গা স্থির হয়নি এখনো। যদি তা হয়ই শেষঅবধি, তবে আমাদের সঙ্গে মনিরের ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই হবে! সে যাই হোক, আপাতত এসব আটপৌরে ভাবনা স্থগিত থাক। এখন সমুদ্রস্নান। প্রান্তশিশু মনির আমাদের সর্বস্ব নিয়ে বসে রইল নির্জন সৈকতে। আমরা নামলাম জলে—জোয়ার পেরিয়ে ভাটার সূচনা হয়েছে কেবল, তখনো অনেক স্রোত, অনেক ঢেউ—একের পর এক আছড়ে পড়ছে আমাদের অতি তুচ্ছ, অতি ক্ষুদ্র, অতি নগণ্য শরীরে—শরীর পেরিয়ে সেই ঢেউ গড়িয়ে যাচ্ছে সবেগে আবার বেলাভূমির দিকে—জল, জল আর জল—এ এক অবিশ্বাস্য লবণাক্ত পৃথিবী আমাদের চারপাশে!!!
No comments