মুক্তিযোদ্ধারা যখন কেউই থাকবেন না, তখন...- অরণ্যে রোদন by আনিসুল হক
“মা, কৈশোরে একদিন আব্বা আমাকে সৈয়দপুরে নিয়ে গিয়েছিল, স্পেশাল ট্রেন দেখতে। সেখান থেকে আমি হারিয়ে যাই।...পরের দিন এসে সমস্ত কথা শুনতে না শুনতেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তুমি কাঁদছিলে। অথচ সেদিন তুমি তো কাঁদলে না মা! আমি রণাঙ্গণে চলে এলাম। গুলি, শেল, মর্টার নিয়ে আমার জীবন।...মাগো, সেদিনের সন্ধ্যাটাকে আমার বেশ মনে পড়ছে।...তুমি রান্নাঘরে বসে তরকারি কুটছিলে। আমি তোমাকে বললাম—মা, আমি চলে যাচ্ছি। তুমি মুখের দিকে তাকালে। আমি বলেছিলাম, ‘মা, আমি মুক্তিবাহিনীতে চলে যাচ্ছি।’ উনুনের আলোতে আমি তোমার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। তোমার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তুমি দাঁড়িয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তাকালে।...মা, সেদিন সন্ধ্যাতেই তুমি হাসিমুখে আমাকে বিদায় দিয়েছিলে।...মা, সেই দিনান্তের ক্লান্তিতে নিত্যকার মতো সেই সন্ধ্যাটি আবার আসবে তো? ইতি তোমার স্নেহের ববিন।”
একাত্তরের চিঠি (প্রকাশক প্রথমা) গ্রন্থে ঠাঁই পাওয়া একটা চিঠি। এই রকম অনেক মুক্তিযোদ্ধার চিঠি আছে এই বইয়ে, যেসব পড়লে চোখের পাতা আপনিই ভিজে আসে।
এই ছিল তখনকার বাংলাদেশ। এমন দুঃসময় এই দেশে আর কখনো আসেনি, এমন সুসময়ও আর কখনো দেখেনি কেউ। আমাদের মায়েরা হাসতে হাসতে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন রণাঙ্গণে, আমাদের কিশোর, যুবক, তরুণেরা নিজের জীবনমৃত্যুর চেয়েও বড় করে দেখেছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জনটাকে।
মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিলেন তখনকার তরুণেরা। যে কুড়ি বছর বয়সী তরুণটি সেদিন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, আজ তাঁর বয়স ৫৮ বছর। একাত্তরে যাঁর বয়স ছিল ৩০, আজ তিনি ৬৮ বছরের প্রবীণ। কাজেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা, বাস্তবতা এই যে, আজ প্রবীণের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। তখন যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৪০ বা ৫০ বছর বয়সে, তাঁদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই, এটাই স্বাভাবিক। আজ থেকে কুড়ি বছর পর, খুব সামান্যসংখ্যক মানুষই বেঁচে থাকবেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁদের বয়স ছিল কম, এঁদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই তখনো বেঁচে থাকবেন। ২০ বছর পর এই দেশে খুব কমসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাই বেঁচে থাকবেন, তেমনি রাজাকারদের মধ্যেও কাউকে জীবিত পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।
তাহলে কি তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবলুপ্ত হয়ে যাবে? এটা মোটেও কঠিন প্রশ্ন নয়। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই আজ বেঁচে নেই, তবুও যেমন একুশের চেতনা আজও আমাদের মধ্যে সজীব ও সক্রিয়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী শেষ মানুষটির জীবনাবসান ঘটলেও মুক্তিযুদ্ধ এই দেশে সব সময়ই উজ্জ্বল বাতিঘরের মতো থেকে যাবে, আমাদের দিয়ে যাবে পথনির্দেশ।
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের গৌরবটাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছে, তারা বিজয়ীর সঙ্গেই থাকতে চায়, পরাজিতের সঙ্গে নয়। এই কথা আজ উপলব্ধি করার এবং সেই অনুযায়ী আমাদের রাজনীতিকে সাজিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে।
যতই দিন যাবে, মুক্তিযুদ্ধ ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়ে উঠবে নতুন সময়ের মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধারা কেউ একসময় জীবিত থাকবেন না, কথাটা ভাবতেও খারাপ লাগছে। কিন্তু আমরা কেউই থাকব না, এই সত্য তো মেনে নিতেই হবে। কিন্তু থেকে যাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। থাকবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা গল্প-উপন্যাস-গান-কবিতা-নাটক-চলচ্চিত্র-স্মৃতিকথা।
কাজেই, একটা কাজ যতখানি পারা যায় করে যেতে হবে। তা হলো লিখে রাখা। আমরা চাই, প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা লিখে রাখুন। এমনকি যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীও হয়তো নিজেকে দাবি করেন না, কিন্তু একাত্তরে যাঁর বোঝার বয়স হয়েছিল, তাঁরই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের, তিনি তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথাটাই লিখে রাখতে পারেন। লিখে রাখা উচিত।
আর মুক্তিযুদ্ধ বলতে কেবল সশস্ত্র যুদ্ধের কথাই যেন আমরা না ভাবি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট অনেক ব্যাপক। ১৯৪৭ সাল থেকে প্রতিটা দিনই দেশ একটু একটু করে প্রস্তুত হয়েছে মুক্তির জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য। একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন কোনো জাদুমন্ত্রে এক লহমায় সশস্ত্র সংগ্রামে উন্নীত হয়নি, তার পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধ যেন এক বিশাল মহাকাব্য। কত যে তার চরিত্র। ওই সময়ের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রত্যেকেই একটা করে মহাকাব্য লিখতে পারবেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। কত রক্ত, কত অশ্রু, কত বীরত্ব, কত আত্মদান! এমন কোনো পরিবার আছে, মুক্তিযুদ্ধের ঢেউয়ে যা দোল খায়নি?
কিন্তু কেবল দেশে নয়, দেশের বাইরেও ঘটে গেছে কত ঘটনা। সারা পৃথিবী তত্পর হয়ে পড়েছিল এই যুদ্ধ নিয়ে। ভারত, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন—প্রত্যেকে কী ভীষণভাবে ব্যস্ত ছিল বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণে।
আমেরিকার অবমুক্ত সরকারি নথি থেকে এখন আমরা সেই সময়ে পরাশক্তিগুলোর তত্পরতার কিছু কিছু খবর জানতে পারছি। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বলেছিল ভারত আক্রমণ করতে। নিউইয়র্কে চীনের প্রতিনিধি আমেরিকাকে জানাবেন কবে তাঁরা ভারত আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। চীন যদি সত্যি সত্যি ভারত আক্রমণ করে বসে, রাশিয়ার তখন হস্তক্ষেপ করতেই হয়। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই বিষয়ে চুক্তি তখন স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বললেন, দরকার হলে অ্যাটম বোমা ব্যবহার করা হবে।
চীনের প্রতিনিধি নিউইয়র্কে বসলেন আমেরিকার প্রতিনিধির সঙ্গে, জানিয়ে দিলেন, তাঁরা ভারত আক্রমণ করছেন না। যুদ্ধের শেষ দিনগুলোয় এসব রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা গেছে আন্তর্জাতিক মহলে। অল্পের জন্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাত থেকে বেঁচে গেল পৃথিবীবাসী।
মুক্তিযুদ্ধের পরও যুদ্ধ হয়েছে। গোলাম আযমরা তত্পরতা চালিয়ে গেছেন একাত্তরের পরও, বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর।
কিন্তু এই দেশে প্রতিটা মানুষ, কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলকে বাদ দিলে, হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী একেকজন মুক্তিযোদ্ধা। এত ঐক্য আর কখনো দেখেনি কেউ! জাহানারা ইমাম, রুমীকে বলেছিলেন, যা, তোকে কোরবানি করে দিলাম। এভাবেই মা তাঁর সন্তানকে হাসিমুখে সাজিয়ে দিয়েছেন যোদ্ধার বেশে। সে ছিল সত্যিকারের আগুনের পরশমণি ছোঁয়া সময়। প্রতিটি বাঙালির অন্তর আগুন হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি বাঙালি সাহায্য করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের, কোনো না কোনো উপায়ে। কৃষকের বাড়িতে যখন আশ্রয় নিতেন মুক্তিযোদ্ধারা, দরিদ্র কৃষক তাঁদের গরম ভাত খাওয়ানোর জন্য নিজের শেষ সম্বলটুকু বিকিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। মানুষ কী যে আকুলতা দেখাত একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য বা জয়বাংলার জন্য একটা কিছু করতে।
ছোটবেলায় শিশু একাডেমীর পত্রিকা শিশুতে একটা গল্প পড়েছিলাম, গল্পের লেখকও একজন শিশুই। গল্পটা ছিল এ রকম—একটা পাতা আরেকটা মাটির ঢেলা গল্প করছে। পাতাটা বলছে, আমার জীবন ধন্য, কারণ, একাত্তর সালে এক মুক্তিযোদ্ধা আমার আড়ালে আত্মগোপন করেছিল। আর মাটির ঢেলা বলছে, আর এক মুক্তিযোদ্ধা আমাকে ছুড়ে মেরেছিল এক শত্রুসেনার দিকে। দুজনে এই গল্প করে আর হাসে।
একাত্তরের বাংলাদেশ ছিল এই রকমই। প্রতিটা মুক্তিকামী মানুষই তখন মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য কিছু না কিছু করার জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল। কিছু করতে না পারলে মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দোয়া করেছে, নফল নামাজ পড়েছে, রোজা রেখেছে বা উপোস করেছে। রাতে চুপি চুপি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনেছে। আমাদের নারীদের যে অসামান্য অবদান মুক্তিযুদ্ধে, তা লিখিত হওয়ার অপেক্ষায় পড়ে আছে। কেউ কেউ সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, প্রত্যেকেই ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কষ্ট ভোগ করেছেন। জাহানারা ইমামের মতো মহিলারা গাড়িতে করে এক বাসা থেকে আরেক বাসায় অস্ত্র নিয়ে গেছেন। পাকিস্তানি ক্যাম্পে আদিবাসী নারী প্রিনছা খাঁকে ধরে নিয়ে গেছে রান্নাবান্না করতে, তিনি কয়েক দিন ঠিকঠাক রান্না করলেন, একদিন খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন বিষ— এই ঘটনাও তো আমাদেরই যুদ্ধে ঘটেছে। আবার পলায়নরত বাবা-মা ক্রন্দনরত সন্তানের মুখ চেপে ধরেছেন—এই ঘটনাও তো আছে। পুরুষশূন্য গ্রামের মহিলারা দা-কুড়াল-বঁটি নিয়ে আক্রমণ করেছেন পাকিস্তানি সৈন্যদের, নিজেরা মরেছেন কিন্তু শেষতক পরাজিত করেছেন শত্রুদের। এসব কোনো গল্প নয়, এটা ইতিহাস। আবার পুরো গ্রামের সব পুরুষকে মেরে ফেলে একটা গ্রামকেই বানিয়ে তোলা হয়েছে বিধবাদের গ্রাম, এই গ্রামও তো এই দেশে আছে। কুখ্যাত ডাকাত হয়ে উঠেছেন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। ১০-১২ বছরের কিশোরেরা অস্ত্র বহন করছে, এই ছবি তো আমরা ছাপানো অবস্থাতেই পাই। যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ছিলেন টিনএজার।
বাঙালিদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে তেমন নিয়োগ দেওয়া হতো না, বলা হতো, বাঙালি যোদ্ধা-জাতি নয়। সেই অযোদ্ধা-জাতির মার খেয়েই পাকিস্তানিদের অবস্থা হয়ে পড়েছিল ত্রাহি ত্রাহি। নিরস্ত্র একটা জাতি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, আর জয়লাভ করেছে সেই যুদ্ধে। অবশেষে এল ১৬ ডিসেম্বর, যেদিন মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো ‘যোদ্ধা’ পাকিস্তানিরা।
এই যে বিজয়ীর গৌরব, নতুন প্রজন্ম সেই গৌরবকে ধারণ করে সামনে এগিয়ে চলেছে। পরাজিতের বেদনা বা কলঙ্কের সঙ্গে কেন তারা থাকবে? যত দিন যাবে, এই বোধ ততই তীব্র হবে। নতুন প্রজন্মের প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পক্ষ। তারা যুদ্ধাপরাধকে ঘৃণা করে, যুদ্ধাপরাধীর বিচায় চায়।
বর্তমানের রাজনীতিতে এটা একটা বড় নিয়ামক। ভবিষ্যতে এই দেশে থাকবে একটাই পক্ষ, তা হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ। এই কথাটা আমাদের রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে, হিসাবের মধ্যে নিতে হবে।
কথাটা আরও স্পষ্ট করে বলি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি—এটা বলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দাবিকে পাশ কাটানো যাবে না। তেমনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সহজ তো হবেই না, বরং ভরাডুবিই ডেকে আনা হবে। মুক্তিযুদ্ধ যত দূরবর্তী হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের মাহাত্ম্য তত বৃদ্ধি পাবে। মুক্তিযুদ্ধ যত অতীত হবে, ততই তা জীবন্ত ও জ্বলন্ত হয়ে উঠবে আমাদের জীবনে। মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলো রচিত হবে হয়তো তখন, যখন মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের কেউই বেঁচে থাকবে না।
আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা চিরঋণী এবং ঈর্ষান্বিতও, কারণ, তারা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুন্দর আর আলোকিত একটা দেশ গড়ে তুলে আমাদের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার আর মরার সুযোগ করে দেবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
একাত্তরের চিঠি (প্রকাশক প্রথমা) গ্রন্থে ঠাঁই পাওয়া একটা চিঠি। এই রকম অনেক মুক্তিযোদ্ধার চিঠি আছে এই বইয়ে, যেসব পড়লে চোখের পাতা আপনিই ভিজে আসে।
এই ছিল তখনকার বাংলাদেশ। এমন দুঃসময় এই দেশে আর কখনো আসেনি, এমন সুসময়ও আর কখনো দেখেনি কেউ। আমাদের মায়েরা হাসতে হাসতে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন রণাঙ্গণে, আমাদের কিশোর, যুবক, তরুণেরা নিজের জীবনমৃত্যুর চেয়েও বড় করে দেখেছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জনটাকে।
মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিলেন তখনকার তরুণেরা। যে কুড়ি বছর বয়সী তরুণটি সেদিন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, আজ তাঁর বয়স ৫৮ বছর। একাত্তরে যাঁর বয়স ছিল ৩০, আজ তিনি ৬৮ বছরের প্রবীণ। কাজেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা, বাস্তবতা এই যে, আজ প্রবীণের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। তখন যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৪০ বা ৫০ বছর বয়সে, তাঁদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই, এটাই স্বাভাবিক। আজ থেকে কুড়ি বছর পর, খুব সামান্যসংখ্যক মানুষই বেঁচে থাকবেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁদের বয়স ছিল কম, এঁদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই তখনো বেঁচে থাকবেন। ২০ বছর পর এই দেশে খুব কমসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাই বেঁচে থাকবেন, তেমনি রাজাকারদের মধ্যেও কাউকে জীবিত পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ।
তাহলে কি তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবলুপ্ত হয়ে যাবে? এটা মোটেও কঠিন প্রশ্ন নয়। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই আজ বেঁচে নেই, তবুও যেমন একুশের চেতনা আজও আমাদের মধ্যে সজীব ও সক্রিয়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী শেষ মানুষটির জীবনাবসান ঘটলেও মুক্তিযুদ্ধ এই দেশে সব সময়ই উজ্জ্বল বাতিঘরের মতো থেকে যাবে, আমাদের দিয়ে যাবে পথনির্দেশ।
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের গৌরবটাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছে, তারা বিজয়ীর সঙ্গেই থাকতে চায়, পরাজিতের সঙ্গে নয়। এই কথা আজ উপলব্ধি করার এবং সেই অনুযায়ী আমাদের রাজনীতিকে সাজিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে।
যতই দিন যাবে, মুক্তিযুদ্ধ ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়ে উঠবে নতুন সময়ের মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধারা কেউ একসময় জীবিত থাকবেন না, কথাটা ভাবতেও খারাপ লাগছে। কিন্তু আমরা কেউই থাকব না, এই সত্য তো মেনে নিতেই হবে। কিন্তু থেকে যাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। থাকবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা গল্প-উপন্যাস-গান-কবিতা-নাটক-চলচ্চিত্র-স্মৃতিকথা।
কাজেই, একটা কাজ যতখানি পারা যায় করে যেতে হবে। তা হলো লিখে রাখা। আমরা চাই, প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা লিখে রাখুন। এমনকি যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীও হয়তো নিজেকে দাবি করেন না, কিন্তু একাত্তরে যাঁর বোঝার বয়স হয়েছিল, তাঁরই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের, তিনি তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথাটাই লিখে রাখতে পারেন। লিখে রাখা উচিত।
আর মুক্তিযুদ্ধ বলতে কেবল সশস্ত্র যুদ্ধের কথাই যেন আমরা না ভাবি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট অনেক ব্যাপক। ১৯৪৭ সাল থেকে প্রতিটা দিনই দেশ একটু একটু করে প্রস্তুত হয়েছে মুক্তির জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য। একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন কোনো জাদুমন্ত্রে এক লহমায় সশস্ত্র সংগ্রামে উন্নীত হয়নি, তার পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধ যেন এক বিশাল মহাকাব্য। কত যে তার চরিত্র। ওই সময়ের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রত্যেকেই একটা করে মহাকাব্য লিখতে পারবেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। কত রক্ত, কত অশ্রু, কত বীরত্ব, কত আত্মদান! এমন কোনো পরিবার আছে, মুক্তিযুদ্ধের ঢেউয়ে যা দোল খায়নি?
কিন্তু কেবল দেশে নয়, দেশের বাইরেও ঘটে গেছে কত ঘটনা। সারা পৃথিবী তত্পর হয়ে পড়েছিল এই যুদ্ধ নিয়ে। ভারত, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন—প্রত্যেকে কী ভীষণভাবে ব্যস্ত ছিল বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণে।
আমেরিকার অবমুক্ত সরকারি নথি থেকে এখন আমরা সেই সময়ে পরাশক্তিগুলোর তত্পরতার কিছু কিছু খবর জানতে পারছি। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বলেছিল ভারত আক্রমণ করতে। নিউইয়র্কে চীনের প্রতিনিধি আমেরিকাকে জানাবেন কবে তাঁরা ভারত আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। চীন যদি সত্যি সত্যি ভারত আক্রমণ করে বসে, রাশিয়ার তখন হস্তক্ষেপ করতেই হয়। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের এই বিষয়ে চুক্তি তখন স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বললেন, দরকার হলে অ্যাটম বোমা ব্যবহার করা হবে।
চীনের প্রতিনিধি নিউইয়র্কে বসলেন আমেরিকার প্রতিনিধির সঙ্গে, জানিয়ে দিলেন, তাঁরা ভারত আক্রমণ করছেন না। যুদ্ধের শেষ দিনগুলোয় এসব রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা গেছে আন্তর্জাতিক মহলে। অল্পের জন্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাত থেকে বেঁচে গেল পৃথিবীবাসী।
মুক্তিযুদ্ধের পরও যুদ্ধ হয়েছে। গোলাম আযমরা তত্পরতা চালিয়ে গেছেন একাত্তরের পরও, বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর।
কিন্তু এই দেশে প্রতিটা মানুষ, কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলকে বাদ দিলে, হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী একেকজন মুক্তিযোদ্ধা। এত ঐক্য আর কখনো দেখেনি কেউ! জাহানারা ইমাম, রুমীকে বলেছিলেন, যা, তোকে কোরবানি করে দিলাম। এভাবেই মা তাঁর সন্তানকে হাসিমুখে সাজিয়ে দিয়েছেন যোদ্ধার বেশে। সে ছিল সত্যিকারের আগুনের পরশমণি ছোঁয়া সময়। প্রতিটি বাঙালির অন্তর আগুন হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি বাঙালি সাহায্য করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের, কোনো না কোনো উপায়ে। কৃষকের বাড়িতে যখন আশ্রয় নিতেন মুক্তিযোদ্ধারা, দরিদ্র কৃষক তাঁদের গরম ভাত খাওয়ানোর জন্য নিজের শেষ সম্বলটুকু বিকিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। মানুষ কী যে আকুলতা দেখাত একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য বা জয়বাংলার জন্য একটা কিছু করতে।
ছোটবেলায় শিশু একাডেমীর পত্রিকা শিশুতে একটা গল্প পড়েছিলাম, গল্পের লেখকও একজন শিশুই। গল্পটা ছিল এ রকম—একটা পাতা আরেকটা মাটির ঢেলা গল্প করছে। পাতাটা বলছে, আমার জীবন ধন্য, কারণ, একাত্তর সালে এক মুক্তিযোদ্ধা আমার আড়ালে আত্মগোপন করেছিল। আর মাটির ঢেলা বলছে, আর এক মুক্তিযোদ্ধা আমাকে ছুড়ে মেরেছিল এক শত্রুসেনার দিকে। দুজনে এই গল্প করে আর হাসে।
একাত্তরের বাংলাদেশ ছিল এই রকমই। প্রতিটা মুক্তিকামী মানুষই তখন মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য কিছু না কিছু করার জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল। কিছু করতে না পারলে মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দোয়া করেছে, নফল নামাজ পড়েছে, রোজা রেখেছে বা উপোস করেছে। রাতে চুপি চুপি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনেছে। আমাদের নারীদের যে অসামান্য অবদান মুক্তিযুদ্ধে, তা লিখিত হওয়ার অপেক্ষায় পড়ে আছে। কেউ কেউ সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, প্রত্যেকেই ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কষ্ট ভোগ করেছেন। জাহানারা ইমামের মতো মহিলারা গাড়িতে করে এক বাসা থেকে আরেক বাসায় অস্ত্র নিয়ে গেছেন। পাকিস্তানি ক্যাম্পে আদিবাসী নারী প্রিনছা খাঁকে ধরে নিয়ে গেছে রান্নাবান্না করতে, তিনি কয়েক দিন ঠিকঠাক রান্না করলেন, একদিন খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন বিষ— এই ঘটনাও তো আমাদেরই যুদ্ধে ঘটেছে। আবার পলায়নরত বাবা-মা ক্রন্দনরত সন্তানের মুখ চেপে ধরেছেন—এই ঘটনাও তো আছে। পুরুষশূন্য গ্রামের মহিলারা দা-কুড়াল-বঁটি নিয়ে আক্রমণ করেছেন পাকিস্তানি সৈন্যদের, নিজেরা মরেছেন কিন্তু শেষতক পরাজিত করেছেন শত্রুদের। এসব কোনো গল্প নয়, এটা ইতিহাস। আবার পুরো গ্রামের সব পুরুষকে মেরে ফেলে একটা গ্রামকেই বানিয়ে তোলা হয়েছে বিধবাদের গ্রাম, এই গ্রামও তো এই দেশে আছে। কুখ্যাত ডাকাত হয়ে উঠেছেন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। ১০-১২ বছরের কিশোরেরা অস্ত্র বহন করছে, এই ছবি তো আমরা ছাপানো অবস্থাতেই পাই। যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ছিলেন টিনএজার।
বাঙালিদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে তেমন নিয়োগ দেওয়া হতো না, বলা হতো, বাঙালি যোদ্ধা-জাতি নয়। সেই অযোদ্ধা-জাতির মার খেয়েই পাকিস্তানিদের অবস্থা হয়ে পড়েছিল ত্রাহি ত্রাহি। নিরস্ত্র একটা জাতি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, আর জয়লাভ করেছে সেই যুদ্ধে। অবশেষে এল ১৬ ডিসেম্বর, যেদিন মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো ‘যোদ্ধা’ পাকিস্তানিরা।
এই যে বিজয়ীর গৌরব, নতুন প্রজন্ম সেই গৌরবকে ধারণ করে সামনে এগিয়ে চলেছে। পরাজিতের বেদনা বা কলঙ্কের সঙ্গে কেন তারা থাকবে? যত দিন যাবে, এই বোধ ততই তীব্র হবে। নতুন প্রজন্মের প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পক্ষ। তারা যুদ্ধাপরাধকে ঘৃণা করে, যুদ্ধাপরাধীর বিচায় চায়।
বর্তমানের রাজনীতিতে এটা একটা বড় নিয়ামক। ভবিষ্যতে এই দেশে থাকবে একটাই পক্ষ, তা হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ। এই কথাটা আমাদের রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে, হিসাবের মধ্যে নিতে হবে।
কথাটা আরও স্পষ্ট করে বলি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি—এটা বলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দাবিকে পাশ কাটানো যাবে না। তেমনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সহজ তো হবেই না, বরং ভরাডুবিই ডেকে আনা হবে। মুক্তিযুদ্ধ যত দূরবর্তী হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের মাহাত্ম্য তত বৃদ্ধি পাবে। মুক্তিযুদ্ধ যত অতীত হবে, ততই তা জীবন্ত ও জ্বলন্ত হয়ে উঠবে আমাদের জীবনে। মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলো রচিত হবে হয়তো তখন, যখন মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের কেউই বেঁচে থাকবে না।
আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে আমরা চিরঋণী এবং ঈর্ষান্বিতও, কারণ, তারা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুন্দর আর আলোকিত একটা দেশ গড়ে তুলে আমাদের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার আর মরার সুযোগ করে দেবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
No comments