এশিয়া এসিএম প্রতিযোগিতা -তথ্যপ্রযুক্তি by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
এবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চমত্কার প্রাঙ্গণে অ্যাসোসিয়েশন ফর কম্পিউটিং মেশিনারির (এসিএম) ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কন্টেস্টের এশিয়া অঞ্চলের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হলো গত অক্টোবর মাসে। এ বছর উত্তর অমেরিকার ১১টি, দক্ষিণ আমেরিকার চারটি, ইউরোপের পাঁচটি, আফ্রিকার দুটি, অস্ট্রেলিয়ার একটি এবং এশিয়ার ১৪টি সাইটে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এশিয়ার ১৪টির মধ্যে চীনের চারটি, ভারতের দুটি, বাংলাদেশ, ইরান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, কোরিয়া এবং জাপানের একটি করে সাইট আছে। প্রতি সাইটের বিজয়ী এবার চীনের হারবিন শহরে ১-৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০-এ অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে যোগদান করবে। ১০০ দলের মধ্যে থাকবে প্রতি সাইট থেকে আরও বিজয়ী দল।
চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৯টি দল এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের মধ্যে প্রথম স্থানের জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। কখনো বুয়েট, কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর কখনো বা ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষে আগত ৪০-৫০ জন কোচসহ আগ্রহী সবাই এই লড়াই উপভোগ করেছেন। একপর্যায়ে ১৮৯ মিনিটে ছয়টি সমস্যা সমাধান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুরানস দল প্রথম, সমসংখ্যক সমাধান করে ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয়, পাঁচটি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকোলাইটস তৃতীয়, বুয়েট র্যান্ড এক্লিপটিকস চারটি করে চতুর্থ স্থান দখল করেছিল। পরে বুয়েটের তানায়েম, সানি এবং মাসুকের দল সাতটি সমস্যা সমাধান করে প্রতিযোগিতার শেষমুহূর্ত পর্যন্ত শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিল। সাতবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের সম্মানিত বিচারক শাহরিয়ার মঞ্জুর এবং তাঁর সুদক্ষ বিচারক দলের নজর এড়ায়নি ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সাবমিশন, যা কিউতে ছিল এবং যার একটি সমাধান শুদ্ধ হওয়ায় ফুদানেরও সমাধান ৭-এ দাঁড়াল শ্রেয়তর পেনাল্টি সময়ে। ফলে বরাবরের মতোই ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হলো। শাহরিয়ার মঞ্জুর ঢাকা সাইটের জাজিং ডাইরেক্টর হওয়ার পর থেকে আমাদের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার সমস্যার গুণগতমান বেড়েছে।
যা হোক, ৮৯টি দলের মধ্যে ৭৮টি দল কমপক্ষে একটি করে সমস্যা সমাধান করেছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানী থেকে দূরে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত হাজী দানেশ এবং ইউএসটিসি। দুটি ও তিনটি করে সমস্যার সমাধান করে নয়টি করে দল। তিনটি করে দল চারটি, দুটি দল পাঁচটি করে, একটি দল ছয়টি এবং দুটি দল সাতটি করে সমস্যার সমাধান করে। ফুদান হ্যাপিহেভেন সাতটি সমস্যা সমাধান করে প্রথম স্থান অর্জন করে চীনের হারবিন শহরে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে। সমানসংখ্যক সমস্যা সমাধান করে বুয়েট র্যান্ড এক্লিপটিক দ্বিতীয় স্থানে। ছয়টি সমস্যা সমাধান করে ডিইউ কুরানস তৃতীয়, ডিইউ অ্যাকোলাইট পাঁচটি করে চতুর্থ, বুয়েট ইনটেগ্রিটি পাঁচটি করে পঞ্চম, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ চারটি করে ষষ্ঠ, সাইথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এসইইউ আকাতসুকি চারটি করে সপ্তম এবং ডিইউ অ্যারেস চারটি করে অষ্টম স্থান দখল করে।
এটা অত্যন্ত উত্সাহব্যঞ্জক যে স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির দলগুলো অধিকতর প্রতিষ্ঠিত বলে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দলকে পেছনে ফেলে পুরস্কার পেয়েছে। এসিএমের মতো একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার সূচনার ফলে পাবলিক পরীক্ষায় সাফল্য না পেয়েও মেধাবী ছাত্ররা তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারছে, নিজেদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলগুলোর নৈপুণ্য অসাধারণ। প্রথম দশে বুয়েটের চারটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে তিনটি। এ ছাড়া আইইউটি, শাহজালাল, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ও ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির দলগুলো তিনটি করে সমস্যার সমাধান করে তাদের প্রোগ্রামিং মেটার স্বাক্ষর রেখেছে।
এসিএম প্রোগ্রামিংয়ের মতো একটি ধারার সূচনার ফলেই তুলনামূলকভাবে দুর্বল ভৌত অবকাঠামো, পরীক্ষাগার সর্বোপরি অভিজ্ঞ ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকের অভাবেও আমাদের ছাত্ররা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মর্যাদাকর আসরে ভারতীয় ছাত্রদের থেকে ভালো করছে। এ বছর এপ্রিল মাসে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৩৪টি দেশ থেকে ১০০টি দল অংশ নেয়। এর মধ্যে ভারত থেকে ছিল দুটি দল আর বাংলাদেশ থেকে তিনটি। শুধু তাই-ই নয়, উপমহাদেশের যে দুটি দল এই প্রতিযোগিতায় র্যাংক পেয়েছিল, তাও বাংলাদেশের। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দল চারটি সমস্যার সমাধান করে ৩৪তম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দল তিনটি সমস্যার সমাধান করে ৪৯তম স্থান দখল করে।
যেকোনো প্রতিযোগিতায় আমাদের সাফল্যের এমন ধারাবাহিকতা পাওয়া ভার, কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে এসিএম প্রতিযোগিতায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দল ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতিবছরই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। অংশগ্রহণের এমন ধারাবাহিকতা নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে বিশ্বের মাত্র চার-পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। এবার প্রতিযোগিতার আরেকটি আকর্ষণ ছিল আইসিপিসি চ্যালেঞ্জ। এই প্রতিযোগিতায় বুয়েটের দল রানার্সআপ হয়েছে, তাও আবার এবারের প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে। অনেক দিন ধরে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেনি। সুখের বিষয়, এখন তারা অংশগ্রহণ শুরু করেছে। এবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পঞ্চম স্থান দখল করেছে। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সেন্ট পিটার্সবার্গ ইউনিভার্সিটি অব আইটি মেকানিক্স অ্যান্ড অপটিক্স। দ্বিতীয় হয়েছে সিনহুয়া, তৃতীয় সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট, চতুর্থ আরস্টড স্টেট, চোজিয়াং সপ্তম, এমআইটি অষ্টম। প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা আয়োজনে, সমস্যা রচনায়, সমাধানের বিচারে বাংলাদেশের এখন বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি। তাই তো এশিয়ার বিভিন্ন সাইটের আয়োজকদের দেশের বিচারকদের, সমস্যা রচয়িতাদের শরণাপন্ন হতে হয়। বেলল্যাব, মাইক্রোসফট কিংবা আইবিএমের মতো নামকরা কোম্পানি এর অর্থায়ন করে থাকে সুতরাং আমাদের এসিএমে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত না হলেও চলবে। এসিএম প্রোগ্রামিংয়ের অসাধারণ সংস্কৃতির ফলেও আমাদের দেশের প্রোগ্রামারদের এখন কত সুখ্যাতি। acm.uva.es/problemset অথবা অন্যান্য অলনাইন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার সাইটে গেলে বাংলাদেশের ছাত্রদের প্রোগ্রামিং দক্ষতা এবং আগ্রহে অভিভূত হতে হয়। ভ্যালাদলিদের কান্ট্রি র্যাংকিংয়ে এখনো বাংলাদেশ শীর্ষস্থান দখল করে আছে।
গত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ থেকে তিনটি দল ছিল। আশা করব আগামী বছর হারবিনে অনুষ্ঠিতব্য প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে একটি দল থাকবে এবং তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি সম্মান নিয়ে আসবে।
২.
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে যত তুলকালাম কাণ্ড ঘটে তা তো অন্য কোনো দেশেই হয় না। তথ্যপ্রযুক্তির নামে মন্ত্রণালয় এবং আইসিটি টাস্কফোর্স তার মধ্যে অন্যতম। তবে আমাদের অর্জন এত সাদামাটা যে তা কল্পনা করাও যায় না। একাধারে যথেষ্ট কম বিনিয়োগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তুলনামূলকভাবে নবীন, অনভিজ্ঞ অল্পসংখ্যক শিক্ষক নিয়ে দুর্বল ভৌত অবকাঠামো এবং ল্যাব ফ্যাসিলিটিজের মধ্যেও বিশ্বমানের যে শিক্ষা দিচ্ছে তার বড় প্রমাণ আমাদের এসিএমের সাফল্য। একই সঙ্গে আমাদের ছাত্ররা তাদের গবেষণা-দক্ষতা দেখাচ্ছে নামীদামি জার্নালগুলোয় তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করে। অন্যপক্ষে আইসিটি ব্যবহারের নামে কত উদ্যোগই না নেওয়া হলো। তথ্যপ্রযুক্তির যন্ত্রাংশ থেকে কর রহিত করা, ইইএফ ফান্ড, ট্যাক্স হলিডে, তথ্যপ্রযুক্তি নানা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ, ইনকিউবেটর স্থাপন, সিলিকন ভ্যালিতে শেয়ারড অফিস। সবকিছু করে আইসিটি থেকে রপ্তানি আয় ভারতের এক হাজার ভাগের এক ভাগও নয়। আর প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের তরুণ ছাত্ররা গত ১০-১১ বছর শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের বিগত ২০-২৫ বছরের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। আমাদের মেধাবী কম্পিউটারের স্নাতকদের হাতে তথ্যপ্রযুক্তির দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে, যদি এই প্রযুক্তি দিয়ে আমরা সত্যিই একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চাই। আমাদের নেতাদের এই সুমতি ঘটবে—এই প্রত্যাশায়।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ বুয়েট। ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৯টি দল এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের মধ্যে প্রথম স্থানের জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। কখনো বুয়েট, কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর কখনো বা ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষে আগত ৪০-৫০ জন কোচসহ আগ্রহী সবাই এই লড়াই উপভোগ করেছেন। একপর্যায়ে ১৮৯ মিনিটে ছয়টি সমস্যা সমাধান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুরানস দল প্রথম, সমসংখ্যক সমাধান করে ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয়, পাঁচটি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকোলাইটস তৃতীয়, বুয়েট র্যান্ড এক্লিপটিকস চারটি করে চতুর্থ স্থান দখল করেছিল। পরে বুয়েটের তানায়েম, সানি এবং মাসুকের দল সাতটি সমস্যা সমাধান করে প্রতিযোগিতার শেষমুহূর্ত পর্যন্ত শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিল। সাতবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের সম্মানিত বিচারক শাহরিয়ার মঞ্জুর এবং তাঁর সুদক্ষ বিচারক দলের নজর এড়ায়নি ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সাবমিশন, যা কিউতে ছিল এবং যার একটি সমাধান শুদ্ধ হওয়ায় ফুদানেরও সমাধান ৭-এ দাঁড়াল শ্রেয়তর পেনাল্টি সময়ে। ফলে বরাবরের মতোই ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হলো। শাহরিয়ার মঞ্জুর ঢাকা সাইটের জাজিং ডাইরেক্টর হওয়ার পর থেকে আমাদের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার সমস্যার গুণগতমান বেড়েছে।
যা হোক, ৮৯টি দলের মধ্যে ৭৮টি দল কমপক্ষে একটি করে সমস্যা সমাধান করেছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানী থেকে দূরে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত হাজী দানেশ এবং ইউএসটিসি। দুটি ও তিনটি করে সমস্যার সমাধান করে নয়টি করে দল। তিনটি করে দল চারটি, দুটি দল পাঁচটি করে, একটি দল ছয়টি এবং দুটি দল সাতটি করে সমস্যার সমাধান করে। ফুদান হ্যাপিহেভেন সাতটি সমস্যা সমাধান করে প্রথম স্থান অর্জন করে চীনের হারবিন শহরে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে। সমানসংখ্যক সমস্যা সমাধান করে বুয়েট র্যান্ড এক্লিপটিক দ্বিতীয় স্থানে। ছয়টি সমস্যা সমাধান করে ডিইউ কুরানস তৃতীয়, ডিইউ অ্যাকোলাইট পাঁচটি করে চতুর্থ, বুয়েট ইনটেগ্রিটি পাঁচটি করে পঞ্চম, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ চারটি করে ষষ্ঠ, সাইথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এসইইউ আকাতসুকি চারটি করে সপ্তম এবং ডিইউ অ্যারেস চারটি করে অষ্টম স্থান দখল করে।
এটা অত্যন্ত উত্সাহব্যঞ্জক যে স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির দলগুলো অধিকতর প্রতিষ্ঠিত বলে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দলকে পেছনে ফেলে পুরস্কার পেয়েছে। এসিএমের মতো একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার সূচনার ফলে পাবলিক পরীক্ষায় সাফল্য না পেয়েও মেধাবী ছাত্ররা তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারছে, নিজেদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলগুলোর নৈপুণ্য অসাধারণ। প্রথম দশে বুয়েটের চারটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে তিনটি। এ ছাড়া আইইউটি, শাহজালাল, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ও ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির দলগুলো তিনটি করে সমস্যার সমাধান করে তাদের প্রোগ্রামিং মেটার স্বাক্ষর রেখেছে।
এসিএম প্রোগ্রামিংয়ের মতো একটি ধারার সূচনার ফলেই তুলনামূলকভাবে দুর্বল ভৌত অবকাঠামো, পরীক্ষাগার সর্বোপরি অভিজ্ঞ ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষকের অভাবেও আমাদের ছাত্ররা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মর্যাদাকর আসরে ভারতীয় ছাত্রদের থেকে ভালো করছে। এ বছর এপ্রিল মাসে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৩৪টি দেশ থেকে ১০০টি দল অংশ নেয়। এর মধ্যে ভারত থেকে ছিল দুটি দল আর বাংলাদেশ থেকে তিনটি। শুধু তাই-ই নয়, উপমহাদেশের যে দুটি দল এই প্রতিযোগিতায় র্যাংক পেয়েছিল, তাও বাংলাদেশের। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দল চারটি সমস্যার সমাধান করে ৩৪তম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দল তিনটি সমস্যার সমাধান করে ৪৯তম স্থান দখল করে।
যেকোনো প্রতিযোগিতায় আমাদের সাফল্যের এমন ধারাবাহিকতা পাওয়া ভার, কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে এসিএম প্রতিযোগিতায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দল ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতিবছরই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। অংশগ্রহণের এমন ধারাবাহিকতা নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে বিশ্বের মাত্র চার-পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। এবার প্রতিযোগিতার আরেকটি আকর্ষণ ছিল আইসিপিসি চ্যালেঞ্জ। এই প্রতিযোগিতায় বুয়েটের দল রানার্সআপ হয়েছে, তাও আবার এবারের প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে। অনেক দিন ধরে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেনি। সুখের বিষয়, এখন তারা অংশগ্রহণ শুরু করেছে। এবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পঞ্চম স্থান দখল করেছে। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সেন্ট পিটার্সবার্গ ইউনিভার্সিটি অব আইটি মেকানিক্স অ্যান্ড অপটিক্স। দ্বিতীয় হয়েছে সিনহুয়া, তৃতীয় সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট, চতুর্থ আরস্টড স্টেট, চোজিয়াং সপ্তম, এমআইটি অষ্টম। প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা আয়োজনে, সমস্যা রচনায়, সমাধানের বিচারে বাংলাদেশের এখন বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি। তাই তো এশিয়ার বিভিন্ন সাইটের আয়োজকদের দেশের বিচারকদের, সমস্যা রচয়িতাদের শরণাপন্ন হতে হয়। বেলল্যাব, মাইক্রোসফট কিংবা আইবিএমের মতো নামকরা কোম্পানি এর অর্থায়ন করে থাকে সুতরাং আমাদের এসিএমে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত না হলেও চলবে। এসিএম প্রোগ্রামিংয়ের অসাধারণ সংস্কৃতির ফলেও আমাদের দেশের প্রোগ্রামারদের এখন কত সুখ্যাতি। acm.uva.es/problemset অথবা অন্যান্য অলনাইন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার সাইটে গেলে বাংলাদেশের ছাত্রদের প্রোগ্রামিং দক্ষতা এবং আগ্রহে অভিভূত হতে হয়। ভ্যালাদলিদের কান্ট্রি র্যাংকিংয়ে এখনো বাংলাদেশ শীর্ষস্থান দখল করে আছে।
গত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ থেকে তিনটি দল ছিল। আশা করব আগামী বছর হারবিনে অনুষ্ঠিতব্য প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে একটি দল থাকবে এবং তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি সম্মান নিয়ে আসবে।
২.
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে যত তুলকালাম কাণ্ড ঘটে তা তো অন্য কোনো দেশেই হয় না। তথ্যপ্রযুক্তির নামে মন্ত্রণালয় এবং আইসিটি টাস্কফোর্স তার মধ্যে অন্যতম। তবে আমাদের অর্জন এত সাদামাটা যে তা কল্পনা করাও যায় না। একাধারে যথেষ্ট কম বিনিয়োগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তুলনামূলকভাবে নবীন, অনভিজ্ঞ অল্পসংখ্যক শিক্ষক নিয়ে দুর্বল ভৌত অবকাঠামো এবং ল্যাব ফ্যাসিলিটিজের মধ্যেও বিশ্বমানের যে শিক্ষা দিচ্ছে তার বড় প্রমাণ আমাদের এসিএমের সাফল্য। একই সঙ্গে আমাদের ছাত্ররা তাদের গবেষণা-দক্ষতা দেখাচ্ছে নামীদামি জার্নালগুলোয় তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করে। অন্যপক্ষে আইসিটি ব্যবহারের নামে কত উদ্যোগই না নেওয়া হলো। তথ্যপ্রযুক্তির যন্ত্রাংশ থেকে কর রহিত করা, ইইএফ ফান্ড, ট্যাক্স হলিডে, তথ্যপ্রযুক্তি নানা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ, ইনকিউবেটর স্থাপন, সিলিকন ভ্যালিতে শেয়ারড অফিস। সবকিছু করে আইসিটি থেকে রপ্তানি আয় ভারতের এক হাজার ভাগের এক ভাগও নয়। আর প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের তরুণ ছাত্ররা গত ১০-১১ বছর শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের বিগত ২০-২৫ বছরের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। আমাদের মেধাবী কম্পিউটারের স্নাতকদের হাতে তথ্যপ্রযুক্তির দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে, যদি এই প্রযুক্তি দিয়ে আমরা সত্যিই একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চাই। আমাদের নেতাদের এই সুমতি ঘটবে—এই প্রত্যাশায়।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ বুয়েট। ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments