বিশ্বকে যেভাবে বদলে দিয়েছে ইসলাম by আবদুল মাননান আসযাদ
বিশ্ব
নেতৃত্বের আসনে ইসলামি সভ্যতা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশ্বে তার এক
সুদূরপ্রসারী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আগেই উল্লেখ করেছি যে, প্রাক ইসলামি
যুগে বিশ্বে বিরাজমান ছিল এক নৈরাজ্যকর ও ভয়ানক পরিস্থিতি। মানবজাতি আল্লাহ
বিস্মৃতি হয়ে নিমগ্ন ছিল পৌত্তলিকতার মোহে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য
থেকে তারা ছিল অনেকটাই দূরে। কুসংস্কার আর অপসংস্কৃতিতে সয়লাব ছিল তাবৎ
দুনিয়া।
ইসলাম আবির্ভূত হওয়া এবং বিশ্বনেতৃত্বের আসনে তার সমাসীন হওয়ার পর বিশ্বে দেখা দেয় এক আমূল পরিবর্তন। পরিলক্ষিত হয় তার এক সুমহান প্রভাব প্রতিপত্তি। যে খ্রিস্টান জাতি ইসলামকে দেখত চরম অবজ্ঞার চোখে, এর প্রতি তারা তাদের হৃদয়ে লালন করতো হিংসা-বিদ্বেষ আর শত্রুতা; সে খ্রিস্টান জাতিই ইসলামের সোনালী শাসন, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা সর্বোপরি মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলকে সুরক্ষা প্রদান দেখে তারা ইসলামকে শুধু স্বাগতই জানান নাই, মুসলিম শাসকদের বিয়োগান্তে তারা চরম ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন হতেন।
বিশ্ব নেতৃত্বে ইসলামি সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপি তা এক সংস্কারমূলক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ধর্ম, সাহিত্য, আত্মিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিশ্বের সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয় তার বহুমুখী প্রভাব ও প্রতিপত্তি। সবকিছুতেই সাধন করে এক নবসংস্কার।
যে ক্ষেত্রে ইসলামি সভ্যতার প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয় তা হলো তাওহীদ তথা একত্ববাদের ক্ষেত্রে। আগেই উল্লেখ করেছি যে, প্রাক ইসলামি যুগে আরবসহ গোটা পৃথিবীই নিমজ্জিত ছিল মূর্তিপূজার রমরমা ব্যবসায়। আল্লাহ প্রদত্ত দুটি ধর্ম ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মেও প্রবিস্ট হয়েছিল মূর্র্তির পূজা-অর্চনা। ফলশ্রুতিতে দুটি ধর্ম থেকে তার নিজস্ব সত্তা ও স্বকীয়তার বিচ্যুতি ঘটেছিল। ইসলামি সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ওই ধর্ম দুটি যেভাবে মূর্র্তিসত্তার সাথে একীভূত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল তা থেকে কিছুটা হলেও আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।
৮ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের ফলে মুসলমানরা যখন সেখানে তাওহীদ তথা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের আহ্বান জানালেন এবং মূর্র্তি পূজা-অর্চনা পরিহারের আহ্বান জানালেন এর প্রভাব শুধু স্পেনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি পুরো ইউরোপে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সেখানে সূচীত হয় এক মূর্র্তিবিরোধী আন্দোলন। পুরো ইউরোপেই মূর্র্তিকে ধর্মবিরোধী কাজ বলে আখ্যায়িত করে মূর্র্তিবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ওই আন্দোলন সম্পর্কে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রা:) বলেন :
“এই আন্দোলন এত প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে যে, তৃতীয় লুই, কনস্টান্টাইন ৫ম ও ৪র্থ লুই এর মত প্রবল প্রতাপান্বিত রোমক সম্রাটরা পর্যন্ত একে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। প্রথমোল্লিখিত সম্রাট ৭২৬ খ্রিস্টাব্দে এক রাজকীয় ফরমান জারি করে সরকারীভাবে চিত্র ও মূর্র্তির পবিত্রতার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ৭৩০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ফরমানে একে তিনি মূর্তিপূজা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। খ্রিস্টান ও মূর্র্তি পূজক ইউরোপ এবং রোমক ও গ্রীক সভ্যতায় (যার চিত্রশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা ও মূর্তি নির্মাণ পৃথিবী বিখ্যাত) চিত্র ও মূর্র্তির বিরুদ্ধে এই অনীহা ও জিহাদ নিশ্চিতই ইসলামের মূর্তিভাঙ্গা ও তৌহিদী ঘোষণার উচ্চকিত নাদই ছিল যা পাশ্চাত্যে মুসলিম স্পেনের মাধ্যমে ইসলামের প্রচারÑপ্রসার ও প্রভাবাধীনে পৌছে। এর সমর্থন এ থেকেও পাওয়া যাবে, তুরিযানের প্রধান পাদ্রী পুরোহিত এবং এই আন্দোলন ও দাওয়াতের বিরাট এক উৎসাহী সমর্থক ও পতাকাবাহী ক্লডিয়াস (যিনি তার প্রভাবাধীন এলাকাতে চিত্র ও ক্রুশ কাষ্ঠ পুড়িয়ে ফেলতেন) সম্পর্কে ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, তাঁর জন্ম ও লালন-পালন স্পেনে হয়েছিল এবং এটা হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর কথা যখন সেখানে মুসলিম শাসন ও মুসলিম সভ্যতা উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছিল।”
শুধু ইউরোপেই নয় এশিয়ার ভারত উপমহাদেশেও মূর্র্তির ক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। পৃথিবীর মধ্যে ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে প্রাচীন কাল থেকেই মূর্র্তির আধিক্যতা প্রচুর ছিল। পৌরাণিক যুগে সেখানে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সংখ্যা ছিল। সেখানে ৭ম শতাব্দীতে সাহাবী ও তৎপরবর্তীতে আরব বণিকদের আগমনের ফলে সেক্ষেত্রে তা অনেকটাই হ্রাস পায়। সাহাবীদের ইসলামের প্রতি দাওয়াত ও আরববণিকদের ব্যবসার পাশাপাশি তাওহীদের প্রতি আহ্বানের ফলে ভারত অনেকটাই মূর্র্তির আধিক্য থেকে মুক্তি পায়। শেষ পর্যন্ত সেখানেও মূর্র্তিকে ধর্মবিরোধী কাজ বলে সেখানকার অনেক বুদ্ধিজীবী দার্শনিকগণ মত প্রকাশ করেন।
আজ ভারতে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সংখ্যা কমে যে স্বল্প পরিমাণে এসে পৌছেছে এর পেছনেও মূলত ইসলামি সভ্যতারই সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান।
বিশ্বব্যাপি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায়ও ইসলামের সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। প্রাক ইসলামিক যুগে আরব, ইউরোপ ও এশিয়ার কোথাও ঐক্য-সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ফলশ্রুতিতে ভূলুন্ঠিত ছিল মানবতা, মানবিকতা ও মানবাধিকার। পারস্পরিক অনৈক্য, দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে সমাজ ও রাষ্ট্র প্রবল বিশৃঙ্খল প্রবণ হয়ে উঠার কারণে শান্তি ও শৃঙ্খলা ছিল সুদূরপরাহত। ফলে শান্তির বাণী কাঁদছিল নিরবে-নিভৃতে। ইসলামি সভ্যতাই মানবজাতি থেকে জাহিলিয়্যাতের এই অপকর্মকে দূরীভূত করে তাদের মাঝে ঐক্য ও শৃঙ্খলা সুপ্রতিষ্ঠিত করে সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং গোটা মানবজাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَاذكُرُوْا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ اِذْ كُنْتُمْ اَعْدَاءً فَالفَ بَيْنَ قُلُوْبِكُمْ فَاَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِه اِخْوَانًا .
তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে তোমরা এখন তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছে।
প্রাক ইসলামিক যুগে মানবজাতির মাঝে যে অধঃপতন নেমে এসেছিল, ওই সময় ইসলামি সভ্যতা যদি দিগি¦জুড়ে আলো না ছড়াতো, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে ঐক্য ও সংহতির বাণী প্রচার না করতো, তাহলে এটা অতি সুস্পষ্ট যে মানবজাতির ধ্বংসের জন্য কোনো অদৃশ্য শক্তির প্রয়োজন হতো না। বরং তারা নিজেরাই পরস্পর মারামারি, ও হানিনাহিতে লিপ্ত থেকে দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাতে জড়িয়ে নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যেত। মানবজাতিকে এই অনিবার্য ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছে একমাত্র ইসলামি সভ্যতাই।
জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যে আজ ইউরোপ যে উন্নতির শিখরে পৌছেছে সেখানেও রয়েছে একমাত্র ইসলামি সভ্যতারই প্রভাব। আজ ইউরোপসহ তাবৎ পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যের যে উন্নতির সোপান পরিলক্ষিত হচ্ছে, আধুনিক বিশ্বসভ্যতার যে অগ্রগতি ও উন্নতি অবলোকন করা যাচ্ছে এর পেছনে মূলত অবদানই হলো ইসলামি সভ্যতার। মুসলিম স্পেনের পথ ধরে ও ক্রসেডের মাধ্যমে ইসলামের অমূল্য রত্নভাণ্ডার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও স্থাপত্য শিল্পের কলা কৌশল ইউরোপের কাছে পাচারের ফলেই আধুনিক বিশ্ব সভ্যতার অস্তিত্ব তৈরী হয়েছে। একারণে আধুনিক বিশ্বসভ্যতা অবশ্যই ইসলামি সভ্যতার কাছে ঋণী।
আধুনিক বিশ্ব সভ্যতার সমাজ গঠন, রাষ্ট্র গঠন, আইন বিজ্ঞান ও দর্শনেও রয়েছে ইসলামি সভ্যতার অভূতপূর্ব প্রভাব। এরিষ্টটলকে যদিও সমাজ ও রাষ্ট্রের জনক বলা হয়, কিন্তু পাশ্চাত্যরা আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের যে ধারণা ও তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছে তার পেছনেও রয়েছে মুসলিম প্রথিতযশা জ্ঞানী-বিজ্ঞানী ইমাম গাজ্জালী, ইবনে খালদুন ও আবু নাছের আল ফারাবীর প্রত্যক্ষ অবদান। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া এসব কালজয়ী মুসলিম মনীষীগণই সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার পথ উন্মোচন করে দিয়েছেন। রচনা করেছেন এতদ্বসংক্রান্ত মূল্যবান গ্রন্থ। আদৌ তাদের বহু গ্রন্থ পাশ্চাত্যে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বেশ সমাদৃত এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যের অর্ন্তভুক্ত হয়ে আছে।
আধুনিক আইন ও দর্শন শাস্ত্রেও ইসলামি সভ্যতার সুস্পষ্ট প্রভাব দৃশ্যমান। আজ পাশ্চাত্যে আইন শাস্ত্রে ও দর্শনে উন্নতির যে ছোঁয়া প্রতীয়মান হচ্ছে এবং আইন তৈরীতে তারা যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে তা মূলত মুসলিম মনীষীদেরই অবদান। নবম ও দশত শতাব্দীতে এমন কতিপয় মুসলিম মনীষীর আবির্ভাব ঘটে যারাই প্রথমে বিশ্বে আইন শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটান। ইমাম আবুহানিফা, শাফেঈ, মালেক, হাম্বলী, মুহামম্মদ ও আবু ইউসুফ প্রমুখ মনীষীগণই মুসলিম আইনের ভিত রচনা করেন এবং পশ্চিমারা তাদের গ্রন্থাবলী থেকেই আইন শাস্ত্রের জ্ঞান আহরণ করে আইন বিজ্ঞানের জন্ম দেন। মুসলিমদের কালজয়ী আইন গ্রন্থ “হিদায়া” আজো পাশ্চাত্যে সমান সমাদৃত এবং তাদের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সংরক্ষিত। দর্শন শাস্ত্রের জ্ঞানও তারা আহরণ করেছেন মুসলিম মনীষীদের প্রতীকৃৎ ইবনে রুশদ থেকে। পাশ্চাত্যে রয়েছে তাঁর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা।
মোদ্দাকথা, বিশ্ব সভ্যতায় রয়েছে ইসলামি সভ্যতার ব্যাপক প্রভাব ও প্রতিপত্তি। বিশ্বে ইসলামি সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলেই আধুনিক বিশ্ব সভ্যতার জন্ম হয়েছে। মানুষ আল্লাহকে চিনতে পেরেছে। মানবতা, নৈতিকতা ও মানবাধিকারের ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বব্যাপি ইসলামি সভ্যতার প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও গবেষক স্যার টমাস আর্নল্ড তার ঞযব ঞবধপযরহম ড়ভ ওংষধস” নামক গ্রন্থে বলেন, “ইসলাম একটি রাজনৈতিক শক্তি, যার প্রভাব দুনিয়া ব্যাপৃত, যতই নিকট থেকে নিকটতর হবে, ততই অনুভব করবে পৃথিবী। জগতের সকল অমঙ্গলের একমাত্র সমাধানই হচ্ছে ইসলাম”।
লেখকের সভ্যতার দ্বন্দ্ব ও আগামী দিনের পৃথিবীতে ইসলাম গ্রন্থ থেকে
ইসলাম আবির্ভূত হওয়া এবং বিশ্বনেতৃত্বের আসনে তার সমাসীন হওয়ার পর বিশ্বে দেখা দেয় এক আমূল পরিবর্তন। পরিলক্ষিত হয় তার এক সুমহান প্রভাব প্রতিপত্তি। যে খ্রিস্টান জাতি ইসলামকে দেখত চরম অবজ্ঞার চোখে, এর প্রতি তারা তাদের হৃদয়ে লালন করতো হিংসা-বিদ্বেষ আর শত্রুতা; সে খ্রিস্টান জাতিই ইসলামের সোনালী শাসন, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা সর্বোপরি মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলকে সুরক্ষা প্রদান দেখে তারা ইসলামকে শুধু স্বাগতই জানান নাই, মুসলিম শাসকদের বিয়োগান্তে তারা চরম ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন হতেন।
বিশ্ব নেতৃত্বে ইসলামি সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপি তা এক সংস্কারমূলক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ধর্ম, সাহিত্য, আত্মিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিশ্বের সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয় তার বহুমুখী প্রভাব ও প্রতিপত্তি। সবকিছুতেই সাধন করে এক নবসংস্কার।
যে ক্ষেত্রে ইসলামি সভ্যতার প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয় তা হলো তাওহীদ তথা একত্ববাদের ক্ষেত্রে। আগেই উল্লেখ করেছি যে, প্রাক ইসলামি যুগে আরবসহ গোটা পৃথিবীই নিমজ্জিত ছিল মূর্তিপূজার রমরমা ব্যবসায়। আল্লাহ প্রদত্ত দুটি ধর্ম ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মেও প্রবিস্ট হয়েছিল মূর্র্তির পূজা-অর্চনা। ফলশ্রুতিতে দুটি ধর্ম থেকে তার নিজস্ব সত্তা ও স্বকীয়তার বিচ্যুতি ঘটেছিল। ইসলামি সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ওই ধর্ম দুটি যেভাবে মূর্র্তিসত্তার সাথে একীভূত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল তা থেকে কিছুটা হলেও আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।
৮ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের ফলে মুসলমানরা যখন সেখানে তাওহীদ তথা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের আহ্বান জানালেন এবং মূর্র্তি পূজা-অর্চনা পরিহারের আহ্বান জানালেন এর প্রভাব শুধু স্পেনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি পুরো ইউরোপে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সেখানে সূচীত হয় এক মূর্র্তিবিরোধী আন্দোলন। পুরো ইউরোপেই মূর্র্তিকে ধর্মবিরোধী কাজ বলে আখ্যায়িত করে মূর্র্তিবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ওই আন্দোলন সম্পর্কে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রা:) বলেন :
“এই আন্দোলন এত প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে যে, তৃতীয় লুই, কনস্টান্টাইন ৫ম ও ৪র্থ লুই এর মত প্রবল প্রতাপান্বিত রোমক সম্রাটরা পর্যন্ত একে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। প্রথমোল্লিখিত সম্রাট ৭২৬ খ্রিস্টাব্দে এক রাজকীয় ফরমান জারি করে সরকারীভাবে চিত্র ও মূর্র্তির পবিত্রতার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ৭৩০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ফরমানে একে তিনি মূর্তিপূজা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। খ্রিস্টান ও মূর্র্তি পূজক ইউরোপ এবং রোমক ও গ্রীক সভ্যতায় (যার চিত্রশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা ও মূর্তি নির্মাণ পৃথিবী বিখ্যাত) চিত্র ও মূর্র্তির বিরুদ্ধে এই অনীহা ও জিহাদ নিশ্চিতই ইসলামের মূর্তিভাঙ্গা ও তৌহিদী ঘোষণার উচ্চকিত নাদই ছিল যা পাশ্চাত্যে মুসলিম স্পেনের মাধ্যমে ইসলামের প্রচারÑপ্রসার ও প্রভাবাধীনে পৌছে। এর সমর্থন এ থেকেও পাওয়া যাবে, তুরিযানের প্রধান পাদ্রী পুরোহিত এবং এই আন্দোলন ও দাওয়াতের বিরাট এক উৎসাহী সমর্থক ও পতাকাবাহী ক্লডিয়াস (যিনি তার প্রভাবাধীন এলাকাতে চিত্র ও ক্রুশ কাষ্ঠ পুড়িয়ে ফেলতেন) সম্পর্কে ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, তাঁর জন্ম ও লালন-পালন স্পেনে হয়েছিল এবং এটা হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর কথা যখন সেখানে মুসলিম শাসন ও মুসলিম সভ্যতা উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছিল।”
শুধু ইউরোপেই নয় এশিয়ার ভারত উপমহাদেশেও মূর্র্তির ক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। পৃথিবীর মধ্যে ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে প্রাচীন কাল থেকেই মূর্র্তির আধিক্যতা প্রচুর ছিল। পৌরাণিক যুগে সেখানে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সংখ্যা ছিল। সেখানে ৭ম শতাব্দীতে সাহাবী ও তৎপরবর্তীতে আরব বণিকদের আগমনের ফলে সেক্ষেত্রে তা অনেকটাই হ্রাস পায়। সাহাবীদের ইসলামের প্রতি দাওয়াত ও আরববণিকদের ব্যবসার পাশাপাশি তাওহীদের প্রতি আহ্বানের ফলে ভারত অনেকটাই মূর্র্তির আধিক্য থেকে মুক্তি পায়। শেষ পর্যন্ত সেখানেও মূর্র্তিকে ধর্মবিরোধী কাজ বলে সেখানকার অনেক বুদ্ধিজীবী দার্শনিকগণ মত প্রকাশ করেন।
আজ ভারতে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সংখ্যা কমে যে স্বল্প পরিমাণে এসে পৌছেছে এর পেছনেও মূলত ইসলামি সভ্যতারই সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান।
বিশ্বব্যাপি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায়ও ইসলামের সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। প্রাক ইসলামিক যুগে আরব, ইউরোপ ও এশিয়ার কোথাও ঐক্য-সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ফলশ্রুতিতে ভূলুন্ঠিত ছিল মানবতা, মানবিকতা ও মানবাধিকার। পারস্পরিক অনৈক্য, দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে সমাজ ও রাষ্ট্র প্রবল বিশৃঙ্খল প্রবণ হয়ে উঠার কারণে শান্তি ও শৃঙ্খলা ছিল সুদূরপরাহত। ফলে শান্তির বাণী কাঁদছিল নিরবে-নিভৃতে। ইসলামি সভ্যতাই মানবজাতি থেকে জাহিলিয়্যাতের এই অপকর্মকে দূরীভূত করে তাদের মাঝে ঐক্য ও শৃঙ্খলা সুপ্রতিষ্ঠিত করে সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং গোটা মানবজাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَاذكُرُوْا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ اِذْ كُنْتُمْ اَعْدَاءً فَالفَ بَيْنَ قُلُوْبِكُمْ فَاَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِه اِخْوَانًا .
তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে তোমরা এখন তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছে।
প্রাক ইসলামিক যুগে মানবজাতির মাঝে যে অধঃপতন নেমে এসেছিল, ওই সময় ইসলামি সভ্যতা যদি দিগি¦জুড়ে আলো না ছড়াতো, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে ঐক্য ও সংহতির বাণী প্রচার না করতো, তাহলে এটা অতি সুস্পষ্ট যে মানবজাতির ধ্বংসের জন্য কোনো অদৃশ্য শক্তির প্রয়োজন হতো না। বরং তারা নিজেরাই পরস্পর মারামারি, ও হানিনাহিতে লিপ্ত থেকে দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাতে জড়িয়ে নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যেত। মানবজাতিকে এই অনিবার্য ধ্বংস থেকে রক্ষা করেছে একমাত্র ইসলামি সভ্যতাই।
জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যে আজ ইউরোপ যে উন্নতির শিখরে পৌছেছে সেখানেও রয়েছে একমাত্র ইসলামি সভ্যতারই প্রভাব। আজ ইউরোপসহ তাবৎ পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যের যে উন্নতির সোপান পরিলক্ষিত হচ্ছে, আধুনিক বিশ্বসভ্যতার যে অগ্রগতি ও উন্নতি অবলোকন করা যাচ্ছে এর পেছনে মূলত অবদানই হলো ইসলামি সভ্যতার। মুসলিম স্পেনের পথ ধরে ও ক্রসেডের মাধ্যমে ইসলামের অমূল্য রত্নভাণ্ডার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও স্থাপত্য শিল্পের কলা কৌশল ইউরোপের কাছে পাচারের ফলেই আধুনিক বিশ্ব সভ্যতার অস্তিত্ব তৈরী হয়েছে। একারণে আধুনিক বিশ্বসভ্যতা অবশ্যই ইসলামি সভ্যতার কাছে ঋণী।
আধুনিক বিশ্ব সভ্যতার সমাজ গঠন, রাষ্ট্র গঠন, আইন বিজ্ঞান ও দর্শনেও রয়েছে ইসলামি সভ্যতার অভূতপূর্ব প্রভাব। এরিষ্টটলকে যদিও সমাজ ও রাষ্ট্রের জনক বলা হয়, কিন্তু পাশ্চাত্যরা আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের যে ধারণা ও তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছে তার পেছনেও রয়েছে মুসলিম প্রথিতযশা জ্ঞানী-বিজ্ঞানী ইমাম গাজ্জালী, ইবনে খালদুন ও আবু নাছের আল ফারাবীর প্রত্যক্ষ অবদান। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে জন্ম নেয়া এসব কালজয়ী মুসলিম মনীষীগণই সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার পথ উন্মোচন করে দিয়েছেন। রচনা করেছেন এতদ্বসংক্রান্ত মূল্যবান গ্রন্থ। আদৌ তাদের বহু গ্রন্থ পাশ্চাত্যে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বেশ সমাদৃত এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যের অর্ন্তভুক্ত হয়ে আছে।
আধুনিক আইন ও দর্শন শাস্ত্রেও ইসলামি সভ্যতার সুস্পষ্ট প্রভাব দৃশ্যমান। আজ পাশ্চাত্যে আইন শাস্ত্রে ও দর্শনে উন্নতির যে ছোঁয়া প্রতীয়মান হচ্ছে এবং আইন তৈরীতে তারা যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে তা মূলত মুসলিম মনীষীদেরই অবদান। নবম ও দশত শতাব্দীতে এমন কতিপয় মুসলিম মনীষীর আবির্ভাব ঘটে যারাই প্রথমে বিশ্বে আইন শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটান। ইমাম আবুহানিফা, শাফেঈ, মালেক, হাম্বলী, মুহামম্মদ ও আবু ইউসুফ প্রমুখ মনীষীগণই মুসলিম আইনের ভিত রচনা করেন এবং পশ্চিমারা তাদের গ্রন্থাবলী থেকেই আইন শাস্ত্রের জ্ঞান আহরণ করে আইন বিজ্ঞানের জন্ম দেন। মুসলিমদের কালজয়ী আইন গ্রন্থ “হিদায়া” আজো পাশ্চাত্যে সমান সমাদৃত এবং তাদের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সংরক্ষিত। দর্শন শাস্ত্রের জ্ঞানও তারা আহরণ করেছেন মুসলিম মনীষীদের প্রতীকৃৎ ইবনে রুশদ থেকে। পাশ্চাত্যে রয়েছে তাঁর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা।
মোদ্দাকথা, বিশ্ব সভ্যতায় রয়েছে ইসলামি সভ্যতার ব্যাপক প্রভাব ও প্রতিপত্তি। বিশ্বে ইসলামি সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলেই আধুনিক বিশ্ব সভ্যতার জন্ম হয়েছে। মানুষ আল্লাহকে চিনতে পেরেছে। মানবতা, নৈতিকতা ও মানবাধিকারের ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বব্যাপি ইসলামি সভ্যতার প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও গবেষক স্যার টমাস আর্নল্ড তার ঞযব ঞবধপযরহম ড়ভ ওংষধস” নামক গ্রন্থে বলেন, “ইসলাম একটি রাজনৈতিক শক্তি, যার প্রভাব দুনিয়া ব্যাপৃত, যতই নিকট থেকে নিকটতর হবে, ততই অনুভব করবে পৃথিবী। জগতের সকল অমঙ্গলের একমাত্র সমাধানই হচ্ছে ইসলাম”।
লেখকের সভ্যতার দ্বন্দ্ব ও আগামী দিনের পৃথিবীতে ইসলাম গ্রন্থ থেকে
No comments