ঈদ সংস্কৃতির রূপান্তর by স্বকৃত নোমান
বাংলাদেশের
মুসলমান সমাজে ধর্মকেন্দ্রিক প্রধান প্রধান উৎসবগুলো হচ্ছে- ঈদুল ফিতর,
ঈদুল আজহা, আশুরা, শবেবরাত প্রভৃতি। দুইশ বছর আগে এসব উৎসবকেন্দ্রিক
সংস্কৃতির যে রূপ ছিল তার মৌলিক পরিবর্তন না ঘটলেও কিছু কিছু সংস্কৃতির
রূপান্তর ঘটেছে। ঈদসংস্কৃতির কথাই ধরা যাক। শত বছর আগের ঈদসংস্কৃতির সঙ্গে
বর্তমানের ঈদসংস্কৃতির ফারাক একেবারে কম নয়। উদাহরণ হিসেবে গত শতকের আশির
দশকের গ্রামীণ ঈদসংস্কৃতির একটা চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে।
রমজানের বিশ তারিখ রাতে যখন গ্রামের দু-একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মুসল্লি এতেকাফ আদায়ের লক্ষ্যে দশদিনের জন্য মসজিদে অন্তরীণ হতো, সেদিন থেকেই ঈদের দূরায়ত হাতছানি টের পাওয়া যেত। ঈদের আরো দশদিন বাকি থাকলেও একটা চাপা উত্তেজনা দেখা যেত ছোট-বড় সবার মধ্যে। আসন্ন ঈদের বিশেষ দিনটিকে উদযাপনের জন্য সবার ভেতর দেখা যেত এক ধরনের ব্যস্ততা। ছাব্বিশে রমজান রাতে তো শবেকদর। সাতাশে রমজান থেকে সেই ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠত। ঈদকে বরণ করে নেওয়ার জন্য সবাই চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করত। হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরেই তো ঈদ। শুরু হতো হাটেবাজারে কেনাবেচার ধুম। হাটের মুদি দোকানগুলো ভরে উঠত সেমাই-চিনি-নারিকেল-বাদাম-কিশমিশ ইত্যাদি জিনিসপত্রে। মা-বাবারা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দিতো এসব জিনিস। জামাতাকে উপহার দিত পায়জামা-পাঞ্চাবি-টুপি। ছেলেমেয়েদের কিনে দিত নতুন জামা-কাপড়। ঈদের আগের রাত পর্যন্ত চলত ধুম বেচাকেনা। শবেকদরের পরদিন থেকে গ্রামের ফকির-মিসকিনরা গেরস্তবাড়িগুলোতে ধরনা দেওয়া শুরু করত জাকাত-ফিতরার আশায়। ছেলেমেয়েরা পাঁচ-দশ টাকা দামের ঈদকার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা ও আমন্ত্রণ জানাতো বন্ধু-বান্ধবদের। ঈদের আগের দিন বিকেলে মেহেদি পাতা সংগ্রহের ধুম পড়ে যেত। ইফতারির সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে ইফতার খাওয়া ফেলে খোলা মাঠেঘাটে চলে যেত ঈদের নতুন বাঁকা চাঁদ দেখার জন্য। পশ্চিমের আকাশে সন্ধ্যাতারার আশপাশে নখাকৃতির বাঁকা চাঁদ দেখা গেলে হৈ-হৈ রৈ-রৈ পড়ে যেত দিকে দিকে। পড়ে যেত মেহেদি বাটার ধুম। গভীর রাত পর্যন্ত হাতে আর নখে নানা আলপনায় মেহেদি লাগাত ছেলেমেয়েরা। সারারাত কাটত উত্তুঙ্গ উত্তেজনায়। পরদিন যথারীতি খুব ভোরে সবার ঘুম ভেঙে যেত। মুয়াজ্জিনের আজানকে প্রতিদিনকার আজানের মতো মনে হতো না। এই বিশেষ দিনের প্রারম্ভের আজানটা দেওয়ার জন্য মুয়াজ্জিন যেন সারা বছর কণ্ঠটাকে প্রস্তুত করে রাখত। কী যে সুরের মূর্ছনা!
তারপর ভোর। গ্রীষ্মকাল হলে তো কথা নেই, পৌষ-মাঘ মাসের কড়া শীত হলেও গ্রামের পুকুর ঘাটে তিল ঠাঁই থাকত না। কসকো কোম্পানির সুগন্ধি সাবান, নতুন লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে সবাই ঘাটে হাজির হতো। পুকুরের পানি ঘোলা হয়ে উঠত অসংখ্য মানুষের গোসলের কারণে। কারো মুখে বিষাদের এতটুকু ছাপ থাকত না, সবাই কেমন প্রাণখোলা হাসিখুশি। বিষণ্ন বুড়োদেরও ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকত হাসির রেখা। গোসল করে বাড়ি ফিরে নতুন কিংবা ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখা পুরনো জামা-কাপড় গায়ে দেওয়ার পালা। ঈদ উপলক্ষে গ্রামের দোকান থেকে কেনা দু-চার টাকা দামের সুগন্ধী আতর পায়জামা-পাঞ্জাবিতে লাগাত সবাই। তারপর নকশাদার জায়নামাজ বা নলখাগড়ার তৈরি পাটিটা বগলদাবা করে ঈদগাঁহের দিকে রওনা হতো।
ঈদের আনন্দটা বড়দের চাইতে ছোটদেরই ছিল বেশি। ঈদগাঁহে গিয়ে নামাজ পড়ার চাইতে তারা বেশি ব্যস্ত থাকত বাঁশি, বেলুন আর হরেক রকমের খেলনা নিয়ে। দোকানিরা ঈদের দিন দোকানের বাইরে চাটাই বিছিয়ে নানা খেলনা সামগ্রী নিয়ে বসতো। সেসব খেলনার মধ্যে অন্যতম ছিল বিশেষভাবে তৈরি বাঁশের বাঁশি। এই বাঁশির পেছনের দিকটা রাজা কনডমের ভেতর ঢুকিয়ে সুতা দিয়ে ভালো করে বেঁধে নিতে হতো। তারপর ফুঁ দিয়ে কনডমটাকে ফুলিয়ে লাউ কি কুমড়ার মতো করে বহিরাংশের ছিদ্রটি ছেড়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতো স্টিমারের সাইরেনের মতো ভোঁ-ওঁয়া ভোঁ-ওঁয়া শব্দ। শিশু-কিশোরদের কাছে ঈদের দিনে এই বিশেষ খেলনাটি ছিল খুবই প্রিয়। খেলনার মধ্যে আরো ছিল রেফারি-বাঁশি, প্লাস্টিকের তৈরি প্রাইভেট কার ইত্যাদি। কারটির সামনের সরু ছিদ্রটাতে মোটা একটা সুতা বেঁধে টেনে টেনে চালাতে হতো। অনেকটা দুধের স্বাধ ঘোলে মেটানোর মতো। আর লাটিম তো ছিল খুবই জনপ্রিয় খেলনা। পুরনোটা ফেলে দিয়ে ঈদের দিন কেনা হতো নতুন লাটিম।
ঈদগাঁহে নামাজ শেষে শুরু হতো পারস্পরিক কোলাকুলি। তারপর মুসল্লিরা দলবেঁধে চলে যেত গ্রামের বড় গোরস্তানে। মৃত আত্মীয়-স্বজনদের রুহের মাগফেরাত কামনায় সার বেঁধে পশ্চিমমুখী দাঁড়িয়ে মোনাজাত করত। মোনাজাত শেষে আবার শুরু হতো কোলাকুলি। এরপর দলে দলে ভাগ হয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি সেমাই খেতে যেত। সেমাই বলতে তখন গ্রামের মানুষদের ভাষায় ‘বাংলা সেমাই’ বা ‘আলবা সেমাই’ ছিল প্রধান। চিনি-নারিকেল-বাদাম-কিশমিশ ও দুধ সহযোগে রান্না হতো এ সেমাই। চিনামাটির ছোট ছোট পিরিচে করে পরিবেশন করা হতো মেহমানদের। ছোটরা বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করে শ্রদ্ধা জানাতো। খুশি হয়ে বড়রা দু-চার টাকা বখশিশ না দিয়ে পারত না।
ঈদের দিন বিকেলবেলা কারো হাতে কোনো কাজ থাকত না। পার্থিব যাবতীয় কর্মযজ্ঞ থেকে আজ একেবারেই মুক্ত। অখ- অবসরতা কেবল। গ্রামের চা দোকানে ব্যাটারিচালিত টেলিভিশনে ঈদের সিনেমা দেখার ভিড় লেগে যেত। যাদের বাড়িতে ক্যাসেট প্লেয়ার থাকত তারা চড়া আওয়াজে গান বাজাতো। কিশোররা গ্রামের নির্জন রাস্তাঘাটে পয়সা আর মার্বেল খেলায় মেতে উঠত। মেয়েরা নতুন নতুন জামা-কাপড় পরে ঘুরে বেড়াত সারা গ্রাম। রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত লেগে থাকত এসব আনন্দ।
ঈদের পরের দিন শুরু হতো অন্য আয়োজন। তরুণ-যুবকরা দলবেঁধে চলে যেত জেলাশহর। ঈদ উপলক্ষে রাজ্জাক-ববিতা বা ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পার নতুন মারদাঙ্গা কি বিরহকাতর সিনেমা মুক্তি পেত। রেডিওতে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ভরাট কণ্ঠে সেসব সিনেমার বিজ্ঞাপন শুনতে শুনতে সিনেমাটি দেখার জন্য তীব্র আগ্রহ তৈরি হতো তাদের মধ্যে। তাই দলবেঁধে জেলাশহরের সিনেমা হলে সেটি দেখতে যাওয়া। সিনেমা দেখা শেষে চলে যেত দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি। মামা-মামি, খালা-খালু, ফুপা-ফুপিদের সঙ্গে দেখা না করলে তো ঈদ-আনন্দ অপূর্ণ থেকে যায়।
এবার আসা যাক সমকালীন ঈদসংস্কৃতি প্রসঙ্গে। কিছু কিছু ব্যাপার আগের মতো থাকলেও অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে গেছে। উপরে যেমন ঈদের দিন শিশু-কিশোরদের যেসব খেলনার কথা বলা হলো, বর্তমানে সেসব খেলনার গুণগত মান উন্নত হয়েছে। রাজা কনডমের বদলে এখন এসেছে বড় বড় মজবুত সব বাহারি বেলুন। এসেছে ব্যাটারিচালিত নানা খেলনা গাড়ি, প্লাস্টিকের পুতুল, পশু-পাখিসহ কত কি। এখন মেহেদি গাছ থেকে মেহেদি পাতা সংগ্রহ করে কষ্ট করে বেটে হাতে লাগাতে হয় না, বিভিন্ন কোম্পানি এনেছে নানা প্যাকেটজাত মেহেদি। নাগরিক জীবন তো বটেই, গ্রামীণ জীবনেও লেগেছে এই পরিবর্তনের ছোঁয়া। এখনও ঈদকার্ডের প্রচলন আছে বটে, কিন্তু তাতে লেগেছে প্রযুক্তির হাওয়া। এখন নানা ডিজাইনের ঈদকার্ড বাজারে পাওয়া যায়। আবার ঈদকার্ডের মধ্যে বাতিও জ্বলতে দেখা যায়। সুইস অন করলে বেজে ওঠে নানা মিউজিক। এখন ঈদের শুভেচ্ছা পাঠানো হয় মোবাইলে এসএমএস করে, ই-মেইল কিংবা ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসআপ বা ইমোর ইনবক্সে। বিশই রমজানের পর থেকে হাটে-বাজারে এমনকি নগরে টাঙানো হয় ‘ঈদ-শুভেচ্ছা’ লেখা বড় বড় ব্যানার। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বড় বড় তোরণ বানায় জনগণকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে।
ঈদসংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটেছে খাবার-দাবারের ক্ষেত্রেও। গত শতকের শেষের দিকে ‘লাচ্ছা সেমাই’ প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আগে এ সেমাই খোলা বিক্রি হতো। এখনো হয়। তবে এখন খোলা লাচ্ছা সেমাইর চাইতে বাহারি প্যাকেটজাত আধুনিক লাচ্ছা সেমাইর কদর বেশি। লাচ্ছা সেমাইয়ের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে নুডুলস। মাংস বা ডিম দিয়ে রান্না করা এ মুখরোচক খাবারটি ঈদের দিন সেমাইর সঙ্গে পরিবেশিত হয়। একটু অবস্থাসম্পন্ন গেরস্তরা আরো একধাপ এগিয়ে। তারা সেমাই বা নুডুলসের পরিবর্তে মাংসে পাকানো খিচুরি পরিবেশন করে থাকে। সকাল বেলায় সেমাই খাওয়া হলেও দুপুরে সামর্থ্য অনুযায়ী মুরগি, গরুর মাংস বা খাসির মাংসের ভোজ চলে। অবস্থাসম্পন্নদের ঘরে তৈরি হয় হালিম, কাবাব, বিরিয়ানি ইত্যাদি।
ঈদসংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রেও। ঈদকে সামনে রেখে নতুন নতুন আদরার কাপড়-চোপড় বাজার আনার প্রতিযোগিতায় নামে ব্যবসায়ীরা। এখন ঈদ উপলক্ষে জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ঈদ এলে যে যেভাবে পারে অন্যকে ঠকিয়ে দুই পয়সা আদায় করে নেওয়ার ধান্দায় থাকে অনেক ব্যবসায়ী। তিনশ টাকার শাড়ি ছয়শ টাকায়, এক হাজার টাকার জামা দুই হাজারে গিয়ে ঠেকে। বিপণি বিতানে গিয়ে কাপড়-চোপড়ের দাম দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না। ঈদ এলে বিক্রেতারা এতই ব্যস্ত থাকে যে, ক্রেতার সঙ্গে ভালোমতো কথা বলারও সময় পায় না। তাই কাপড়ের গায়ে দাম লিখে রাখে। দরাদরি করার কোনো সুযোগ নেই। এক দাম। যার ইচ্ছে হয় সে কিনবে। ঈদকে কেন্দ্র করে পরিবহন ভাড়া বেড়ে যায় দ্বিগুণ। পাড়ায়-মহল্লায় চাঁদাবাজিও কম চলে না। রাজধানী ঢাকা শহরে দ্বিগুণ বেড়ে যায় ছিনতাই। যদিও ঈদের তাৎপর্য এসব নয়। নিঃসন্দেহে এসব মানুষের ভেতর থেকে পারস্পরিক সহমর্মিতা বিনষ্টির ফল।
আজকের ঈদসংস্কৃতি অনেকটা প্রতিযোগিতামুখর। সমাজের সর্বস্তরে চলে এই প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, পরিবারের সঙ্গে পরিবারের এমনকি সমাজের গ-ি পেরিয়ে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। ছাত্র, শিক্ষক, আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাও এই প্রতিযোগিতার বাইরে নয়। প্রতিযোগিতার এই দৌড়ে টিকতে গিয়ে এখন কেউ আর সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের বাছ-বিচার করে না।
মিডিয়া জগতেও লক্ষ করা যায় এই প্রতিযোগিতা। ঈদসংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে। ঈদকে কেন্দ্র করে টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয় বিশেষ নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমাসহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। তাও এক-দুদিন নয়, টানা ছয়-সাত দিন ধরে প্রচারিত হয় এসব বিশেষ অনুষ্ঠান। ঈদের পনেরো দিন আগ থেকে শুরু হয় এসব অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার। কে কত ভালো অনুষ্ঠান বানাতে পারে তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। আবার বিজ্ঞাপন দাতারাও নির্মাণ করে ঈদ-কেন্দ্রিক বিশেষ বিজ্ঞাপন। দর্শকরাও এই আয়োজনের সঙ্গে এখন সম্পৃক্ত হয়ে গেছে অনেকটা। সারা বছর যারা টিভি দেখার মতো সময় পায় না, ঈদ এলে তারা প্রাণভরে এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করে।
প্রিন্ট মিডিয়াতেও এসেছে ঈদসংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন। দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে ঈদ বিশেষ সংখ্যা। সেসব সংখ্যা তিনশ থেকে ছয়শ পৃষ্ঠা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ছাপা হয় নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকদের নানা বিষয়ের লেখা, থাকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নানা বিজ্ঞাপন। এর মাধ্যমে তাদের ক্রেতা-গ্রাহকদের ঈদ শুভেচ্ছা জানানো হয়। এই বিশেষ সংখ্যাটি কার আগে কে বাজারে ছাড়বে থাকে সেই প্রতিযোগিতাও। হালে প্রিন্ট মিডিয়ায় ঈদ উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ফ্যাশন পাতা বা ফ্যাশন ক্যাটালগও। শহরের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজগুলো তাদের নতুন আদরার কাপড়গুলো জমা দেয় পত্রিকার অফিসে। মডেলদের সেসব পোশাক পরিয়ে ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ছবি তোলা হয়, আর সেই ছবি ছাপানো হয় পত্রিকার ফ্যাশন ক্যাটালগে। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে পত্রিকার বিশেষ রান্না পাতা বা রান্না সংখ্যাও প্রকাশিত হচ্ছে। রন্ধনশিল্পীরা ঈদের বিভিন্ন রেসিপি দিয়ে থাকে এসব সংখ্যায়। ঈদ বিশেষ সংখ্যা ছাড়াও ঈদের ছুটির আগে দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে পত্রিকার বর্ধিত পাতা। সেখানেও থাকে যথারীতি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি।
বিশ বছর আগের ঈদসংস্কৃতির সঙ্গে বর্তমানের ঈদসংস্কৃতির কত না ফারাক। ভবিষ্যতে যে এই ঈদসংস্কৃতির আরো রূপান্তর ঘটবে তাতে সন্দেহ নেই।
রমজানের বিশ তারিখ রাতে যখন গ্রামের দু-একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মুসল্লি এতেকাফ আদায়ের লক্ষ্যে দশদিনের জন্য মসজিদে অন্তরীণ হতো, সেদিন থেকেই ঈদের দূরায়ত হাতছানি টের পাওয়া যেত। ঈদের আরো দশদিন বাকি থাকলেও একটা চাপা উত্তেজনা দেখা যেত ছোট-বড় সবার মধ্যে। আসন্ন ঈদের বিশেষ দিনটিকে উদযাপনের জন্য সবার ভেতর দেখা যেত এক ধরনের ব্যস্ততা। ছাব্বিশে রমজান রাতে তো শবেকদর। সাতাশে রমজান থেকে সেই ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠত। ঈদকে বরণ করে নেওয়ার জন্য সবাই চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করত। হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরেই তো ঈদ। শুরু হতো হাটেবাজারে কেনাবেচার ধুম। হাটের মুদি দোকানগুলো ভরে উঠত সেমাই-চিনি-নারিকেল-বাদাম-কিশমিশ ইত্যাদি জিনিসপত্রে। মা-বাবারা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দিতো এসব জিনিস। জামাতাকে উপহার দিত পায়জামা-পাঞ্চাবি-টুপি। ছেলেমেয়েদের কিনে দিত নতুন জামা-কাপড়। ঈদের আগের রাত পর্যন্ত চলত ধুম বেচাকেনা। শবেকদরের পরদিন থেকে গ্রামের ফকির-মিসকিনরা গেরস্তবাড়িগুলোতে ধরনা দেওয়া শুরু করত জাকাত-ফিতরার আশায়। ছেলেমেয়েরা পাঁচ-দশ টাকা দামের ঈদকার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা ও আমন্ত্রণ জানাতো বন্ধু-বান্ধবদের। ঈদের আগের দিন বিকেলে মেহেদি পাতা সংগ্রহের ধুম পড়ে যেত। ইফতারির সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে ইফতার খাওয়া ফেলে খোলা মাঠেঘাটে চলে যেত ঈদের নতুন বাঁকা চাঁদ দেখার জন্য। পশ্চিমের আকাশে সন্ধ্যাতারার আশপাশে নখাকৃতির বাঁকা চাঁদ দেখা গেলে হৈ-হৈ রৈ-রৈ পড়ে যেত দিকে দিকে। পড়ে যেত মেহেদি বাটার ধুম। গভীর রাত পর্যন্ত হাতে আর নখে নানা আলপনায় মেহেদি লাগাত ছেলেমেয়েরা। সারারাত কাটত উত্তুঙ্গ উত্তেজনায়। পরদিন যথারীতি খুব ভোরে সবার ঘুম ভেঙে যেত। মুয়াজ্জিনের আজানকে প্রতিদিনকার আজানের মতো মনে হতো না। এই বিশেষ দিনের প্রারম্ভের আজানটা দেওয়ার জন্য মুয়াজ্জিন যেন সারা বছর কণ্ঠটাকে প্রস্তুত করে রাখত। কী যে সুরের মূর্ছনা!
তারপর ভোর। গ্রীষ্মকাল হলে তো কথা নেই, পৌষ-মাঘ মাসের কড়া শীত হলেও গ্রামের পুকুর ঘাটে তিল ঠাঁই থাকত না। কসকো কোম্পানির সুগন্ধি সাবান, নতুন লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে সবাই ঘাটে হাজির হতো। পুকুরের পানি ঘোলা হয়ে উঠত অসংখ্য মানুষের গোসলের কারণে। কারো মুখে বিষাদের এতটুকু ছাপ থাকত না, সবাই কেমন প্রাণখোলা হাসিখুশি। বিষণ্ন বুড়োদেরও ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকত হাসির রেখা। গোসল করে বাড়ি ফিরে নতুন কিংবা ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখা পুরনো জামা-কাপড় গায়ে দেওয়ার পালা। ঈদ উপলক্ষে গ্রামের দোকান থেকে কেনা দু-চার টাকা দামের সুগন্ধী আতর পায়জামা-পাঞ্জাবিতে লাগাত সবাই। তারপর নকশাদার জায়নামাজ বা নলখাগড়ার তৈরি পাটিটা বগলদাবা করে ঈদগাঁহের দিকে রওনা হতো।
ঈদের আনন্দটা বড়দের চাইতে ছোটদেরই ছিল বেশি। ঈদগাঁহে গিয়ে নামাজ পড়ার চাইতে তারা বেশি ব্যস্ত থাকত বাঁশি, বেলুন আর হরেক রকমের খেলনা নিয়ে। দোকানিরা ঈদের দিন দোকানের বাইরে চাটাই বিছিয়ে নানা খেলনা সামগ্রী নিয়ে বসতো। সেসব খেলনার মধ্যে অন্যতম ছিল বিশেষভাবে তৈরি বাঁশের বাঁশি। এই বাঁশির পেছনের দিকটা রাজা কনডমের ভেতর ঢুকিয়ে সুতা দিয়ে ভালো করে বেঁধে নিতে হতো। তারপর ফুঁ দিয়ে কনডমটাকে ফুলিয়ে লাউ কি কুমড়ার মতো করে বহিরাংশের ছিদ্রটি ছেড়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতো স্টিমারের সাইরেনের মতো ভোঁ-ওঁয়া ভোঁ-ওঁয়া শব্দ। শিশু-কিশোরদের কাছে ঈদের দিনে এই বিশেষ খেলনাটি ছিল খুবই প্রিয়। খেলনার মধ্যে আরো ছিল রেফারি-বাঁশি, প্লাস্টিকের তৈরি প্রাইভেট কার ইত্যাদি। কারটির সামনের সরু ছিদ্রটাতে মোটা একটা সুতা বেঁধে টেনে টেনে চালাতে হতো। অনেকটা দুধের স্বাধ ঘোলে মেটানোর মতো। আর লাটিম তো ছিল খুবই জনপ্রিয় খেলনা। পুরনোটা ফেলে দিয়ে ঈদের দিন কেনা হতো নতুন লাটিম।
ঈদগাঁহে নামাজ শেষে শুরু হতো পারস্পরিক কোলাকুলি। তারপর মুসল্লিরা দলবেঁধে চলে যেত গ্রামের বড় গোরস্তানে। মৃত আত্মীয়-স্বজনদের রুহের মাগফেরাত কামনায় সার বেঁধে পশ্চিমমুখী দাঁড়িয়ে মোনাজাত করত। মোনাজাত শেষে আবার শুরু হতো কোলাকুলি। এরপর দলে দলে ভাগ হয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি সেমাই খেতে যেত। সেমাই বলতে তখন গ্রামের মানুষদের ভাষায় ‘বাংলা সেমাই’ বা ‘আলবা সেমাই’ ছিল প্রধান। চিনি-নারিকেল-বাদাম-কিশমিশ ও দুধ সহযোগে রান্না হতো এ সেমাই। চিনামাটির ছোট ছোট পিরিচে করে পরিবেশন করা হতো মেহমানদের। ছোটরা বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করে শ্রদ্ধা জানাতো। খুশি হয়ে বড়রা দু-চার টাকা বখশিশ না দিয়ে পারত না।
ঈদের দিন বিকেলবেলা কারো হাতে কোনো কাজ থাকত না। পার্থিব যাবতীয় কর্মযজ্ঞ থেকে আজ একেবারেই মুক্ত। অখ- অবসরতা কেবল। গ্রামের চা দোকানে ব্যাটারিচালিত টেলিভিশনে ঈদের সিনেমা দেখার ভিড় লেগে যেত। যাদের বাড়িতে ক্যাসেট প্লেয়ার থাকত তারা চড়া আওয়াজে গান বাজাতো। কিশোররা গ্রামের নির্জন রাস্তাঘাটে পয়সা আর মার্বেল খেলায় মেতে উঠত। মেয়েরা নতুন নতুন জামা-কাপড় পরে ঘুরে বেড়াত সারা গ্রাম। রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত লেগে থাকত এসব আনন্দ।
ঈদের পরের দিন শুরু হতো অন্য আয়োজন। তরুণ-যুবকরা দলবেঁধে চলে যেত জেলাশহর। ঈদ উপলক্ষে রাজ্জাক-ববিতা বা ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পার নতুন মারদাঙ্গা কি বিরহকাতর সিনেমা মুক্তি পেত। রেডিওতে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ভরাট কণ্ঠে সেসব সিনেমার বিজ্ঞাপন শুনতে শুনতে সিনেমাটি দেখার জন্য তীব্র আগ্রহ তৈরি হতো তাদের মধ্যে। তাই দলবেঁধে জেলাশহরের সিনেমা হলে সেটি দেখতে যাওয়া। সিনেমা দেখা শেষে চলে যেত দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি। মামা-মামি, খালা-খালু, ফুপা-ফুপিদের সঙ্গে দেখা না করলে তো ঈদ-আনন্দ অপূর্ণ থেকে যায়।
এবার আসা যাক সমকালীন ঈদসংস্কৃতি প্রসঙ্গে। কিছু কিছু ব্যাপার আগের মতো থাকলেও অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে গেছে। উপরে যেমন ঈদের দিন শিশু-কিশোরদের যেসব খেলনার কথা বলা হলো, বর্তমানে সেসব খেলনার গুণগত মান উন্নত হয়েছে। রাজা কনডমের বদলে এখন এসেছে বড় বড় মজবুত সব বাহারি বেলুন। এসেছে ব্যাটারিচালিত নানা খেলনা গাড়ি, প্লাস্টিকের পুতুল, পশু-পাখিসহ কত কি। এখন মেহেদি গাছ থেকে মেহেদি পাতা সংগ্রহ করে কষ্ট করে বেটে হাতে লাগাতে হয় না, বিভিন্ন কোম্পানি এনেছে নানা প্যাকেটজাত মেহেদি। নাগরিক জীবন তো বটেই, গ্রামীণ জীবনেও লেগেছে এই পরিবর্তনের ছোঁয়া। এখনও ঈদকার্ডের প্রচলন আছে বটে, কিন্তু তাতে লেগেছে প্রযুক্তির হাওয়া। এখন নানা ডিজাইনের ঈদকার্ড বাজারে পাওয়া যায়। আবার ঈদকার্ডের মধ্যে বাতিও জ্বলতে দেখা যায়। সুইস অন করলে বেজে ওঠে নানা মিউজিক। এখন ঈদের শুভেচ্ছা পাঠানো হয় মোবাইলে এসএমএস করে, ই-মেইল কিংবা ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসআপ বা ইমোর ইনবক্সে। বিশই রমজানের পর থেকে হাটে-বাজারে এমনকি নগরে টাঙানো হয় ‘ঈদ-শুভেচ্ছা’ লেখা বড় বড় ব্যানার। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বড় বড় তোরণ বানায় জনগণকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে।
ঈদসংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটেছে খাবার-দাবারের ক্ষেত্রেও। গত শতকের শেষের দিকে ‘লাচ্ছা সেমাই’ প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আগে এ সেমাই খোলা বিক্রি হতো। এখনো হয়। তবে এখন খোলা লাচ্ছা সেমাইর চাইতে বাহারি প্যাকেটজাত আধুনিক লাচ্ছা সেমাইর কদর বেশি। লাচ্ছা সেমাইয়ের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে নুডুলস। মাংস বা ডিম দিয়ে রান্না করা এ মুখরোচক খাবারটি ঈদের দিন সেমাইর সঙ্গে পরিবেশিত হয়। একটু অবস্থাসম্পন্ন গেরস্তরা আরো একধাপ এগিয়ে। তারা সেমাই বা নুডুলসের পরিবর্তে মাংসে পাকানো খিচুরি পরিবেশন করে থাকে। সকাল বেলায় সেমাই খাওয়া হলেও দুপুরে সামর্থ্য অনুযায়ী মুরগি, গরুর মাংস বা খাসির মাংসের ভোজ চলে। অবস্থাসম্পন্নদের ঘরে তৈরি হয় হালিম, কাবাব, বিরিয়ানি ইত্যাদি।
ঈদসংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রেও। ঈদকে সামনে রেখে নতুন নতুন আদরার কাপড়-চোপড় বাজার আনার প্রতিযোগিতায় নামে ব্যবসায়ীরা। এখন ঈদ উপলক্ষে জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ঈদ এলে যে যেভাবে পারে অন্যকে ঠকিয়ে দুই পয়সা আদায় করে নেওয়ার ধান্দায় থাকে অনেক ব্যবসায়ী। তিনশ টাকার শাড়ি ছয়শ টাকায়, এক হাজার টাকার জামা দুই হাজারে গিয়ে ঠেকে। বিপণি বিতানে গিয়ে কাপড়-চোপড়ের দাম দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না। ঈদ এলে বিক্রেতারা এতই ব্যস্ত থাকে যে, ক্রেতার সঙ্গে ভালোমতো কথা বলারও সময় পায় না। তাই কাপড়ের গায়ে দাম লিখে রাখে। দরাদরি করার কোনো সুযোগ নেই। এক দাম। যার ইচ্ছে হয় সে কিনবে। ঈদকে কেন্দ্র করে পরিবহন ভাড়া বেড়ে যায় দ্বিগুণ। পাড়ায়-মহল্লায় চাঁদাবাজিও কম চলে না। রাজধানী ঢাকা শহরে দ্বিগুণ বেড়ে যায় ছিনতাই। যদিও ঈদের তাৎপর্য এসব নয়। নিঃসন্দেহে এসব মানুষের ভেতর থেকে পারস্পরিক সহমর্মিতা বিনষ্টির ফল।
আজকের ঈদসংস্কৃতি অনেকটা প্রতিযোগিতামুখর। সমাজের সর্বস্তরে চলে এই প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, পরিবারের সঙ্গে পরিবারের এমনকি সমাজের গ-ি পেরিয়ে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। ছাত্র, শিক্ষক, আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাও এই প্রতিযোগিতার বাইরে নয়। প্রতিযোগিতার এই দৌড়ে টিকতে গিয়ে এখন কেউ আর সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের বাছ-বিচার করে না।
মিডিয়া জগতেও লক্ষ করা যায় এই প্রতিযোগিতা। ঈদসংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে। ঈদকে কেন্দ্র করে টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয় বিশেষ নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমাসহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। তাও এক-দুদিন নয়, টানা ছয়-সাত দিন ধরে প্রচারিত হয় এসব বিশেষ অনুষ্ঠান। ঈদের পনেরো দিন আগ থেকে শুরু হয় এসব অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার। কে কত ভালো অনুষ্ঠান বানাতে পারে তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। আবার বিজ্ঞাপন দাতারাও নির্মাণ করে ঈদ-কেন্দ্রিক বিশেষ বিজ্ঞাপন। দর্শকরাও এই আয়োজনের সঙ্গে এখন সম্পৃক্ত হয়ে গেছে অনেকটা। সারা বছর যারা টিভি দেখার মতো সময় পায় না, ঈদ এলে তারা প্রাণভরে এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করে।
প্রিন্ট মিডিয়াতেও এসেছে ঈদসংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন। দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে ঈদ বিশেষ সংখ্যা। সেসব সংখ্যা তিনশ থেকে ছয়শ পৃষ্ঠা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ছাপা হয় নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকদের নানা বিষয়ের লেখা, থাকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নানা বিজ্ঞাপন। এর মাধ্যমে তাদের ক্রেতা-গ্রাহকদের ঈদ শুভেচ্ছা জানানো হয়। এই বিশেষ সংখ্যাটি কার আগে কে বাজারে ছাড়বে থাকে সেই প্রতিযোগিতাও। হালে প্রিন্ট মিডিয়ায় ঈদ উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ফ্যাশন পাতা বা ফ্যাশন ক্যাটালগও। শহরের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজগুলো তাদের নতুন আদরার কাপড়গুলো জমা দেয় পত্রিকার অফিসে। মডেলদের সেসব পোশাক পরিয়ে ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ছবি তোলা হয়, আর সেই ছবি ছাপানো হয় পত্রিকার ফ্যাশন ক্যাটালগে। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে পত্রিকার বিশেষ রান্না পাতা বা রান্না সংখ্যাও প্রকাশিত হচ্ছে। রন্ধনশিল্পীরা ঈদের বিভিন্ন রেসিপি দিয়ে থাকে এসব সংখ্যায়। ঈদ বিশেষ সংখ্যা ছাড়াও ঈদের ছুটির আগে দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে পত্রিকার বর্ধিত পাতা। সেখানেও থাকে যথারীতি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি।
বিশ বছর আগের ঈদসংস্কৃতির সঙ্গে বর্তমানের ঈদসংস্কৃতির কত না ফারাক। ভবিষ্যতে যে এই ঈদসংস্কৃতির আরো রূপান্তর ঘটবে তাতে সন্দেহ নেই।
No comments