অর্থনীতিতে কোরবানি ঈদের ইতিবাচক ভূমিকা by সাজ্জাদ আকবর
কোরবানিকৃত
পশুর সরবরাহ ও কেনাবেচার শুমারি ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-
চাঁদা, টোল, বখশিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, পশুর হাট ইজারা, চাদিয়া,
বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার, পশু কোরবানি ও বানানো এমনকি পশুর সাজগোজ
বাবদও এক বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতবদল হয়ে থাকে। কতটা বিপুল সে হাতবদল? অন্তত
কয়েক হাজার কোটি টাকা। সংক্ষেপ কথায় অর্থনীতিতে ফর্মাল-ইনফর্মাল ওয়েতে
আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ প্রচুর বেড়ে যায়। অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ
আবদুল মজিদ তার এক রচনায় ঈদে চাঙ্গা অর্থনীতির বর্ণনায় পাঁচটি পয়েন্ট
উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কোরবানির বহুমুখী অর্থনৈতিক
তাৎপর্য। হজ, কোরবানির পশু, পশুর চামড়াসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় কীভাবে
আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে শক্তিশালী অবদান রেখে চলে।
বছরঘুরে আমাদের মাথার ওপর ওঠে একফালি চাঁদ। ঈদের চাঁদ। আমাদের জীবনে নিয়ে আসে আনন্দ ও ত্যাগের মিশ্র অনুভূতি। সব আবিলতা, বিভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যের বন্ধনে আমাদের আবদ্ধ করে ঈদ। ত্যাগের মহিমায় করে ভাস্বর। ঈদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক আবেদন আমাদের ভেতরটাকে করে পরিশুদ্ধ। ঈদগাহ মানেই ধনী-গরিব, ইতর-ভদ্র শ্রেণিবিভেদের দেয়াল ভেঙে অসীম সাম্যের পতাকায় সমবেত হওয়া। ঈদ মানে ধনীর সম্পদে গরিবের ন্যায়সংগত অধিকার। বছরঘুরে ঈদ আসে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিশুদ্ধিকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান নিয়ে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা, শ্রেণিবিভেদের অবৈধ দেয়াল, অন্যায়, ধোঁকাবাজি, কালোবাজারি, গরিবের হক মেরে খাওয়া পুঁজির পাহাড় গুঁড়িয়ে দিয়ে অনাবিল সাম্য-সম্প্রীতিতে সমাজকে ভরিয়ে দেওয়ার আহ্বান নিয়ে ঈদের আগমন। ঈদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এ তাৎপর্যের বাইরে আছে বহুমুখী অর্থনৈতিক তাৎপর্য, যা ঈদকে করে তোলে আরও অর্থবহ, আরও সামাজিক, আরও সর্বজনীন।
বিশেষত ঈদুল আজহা উদযাপনে পশু কোরবানির মধ্যে রয়েছে বিশেষ আর্থসামাজিক তাৎপর্য। হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক পুত্র ইসমাইল (আ.) কে আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার ইচ্ছা প্রকাশের মহান স্মৃতি স্মরণ করে ইতিহাসের ধারাবাহিতায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে নিজের পাশব-প্রবৃত্তি, অসৎ উদ্দেশ্য ও হীনম্মন্যতারই কোরবানি করা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই বিশেষ ঈদ-উৎসবে নিজের চরিত্র ও কুপ্রবৃত্তির সংশোধন করার সুযোগ আসে। এজন্য জীবজন্তু কোরবানি করাকে নিছক জীবের জীবন-সংহার হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি আত্মশুদ্ধি ও নিজের পাশব-প্রবৃত্তি অবদমনের প্রয়াস প্রচেষ্টারই প্রতীকী প্রকাশ। সামাজিক কল্যাণ সাধনে সংশোধিত মানব চরিত্র বলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কোরবানির মাংস গরিব আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করার যে বিধান তার মধ্যে নিহিত রয়েছে সামাজিক সমতার মহান আদর্শ।
হজ পালন ঈদুল আজহা উৎসবের একটি বিশেষ অংশ। পবিত্র হজ অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশের মুসলমানরা সমবেত হন এক মহাসম্মিলনে। ভাষা ও বর্ণগত, দেশ ও আর্থিক অবস্থানগত সব ভেদাভেদ ভুলে সবার অভিন্ন মিলনক্ষেত্র কাবা শরিফে একই পোশাকে, একই ভাষায়, একই রীতি-রেওয়াজের মাধ্যমে যে ঐকতান ধ্বনিত হয় তার চেয়ে বড় ধরনের কোনো সাম্য-মৈত্রীর সম্মেলন বিশ্বের কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না। হজ পালনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন রং ও গোত্রের মানুষের মধ্যে এক অনির্বাচনীয় সখ্য সংস্থাপিত হয়। বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের যা অনুপম আদর্শ বলে বিবেচিত হতে পারে। এ হজকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির ব্যাপক তারল্য দেখা দেয়, যা সচল অর্থনীতির অনিবার্য প্রয়োজন। এ বছর প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ হজে যাচ্ছেন। প্রতিজনে গড়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা ব্যয় নির্বাহ করলে এ খাতে মোট অর্থব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে হজের ব্যবস্থাপনা ব্যয়েও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলাদেশি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা ব্যয়ের সংশ্লেষ থাকে। ফলে ব্যাংকিং সেক্টরে এ উপলক্ষে লেনদেন ও সেবা-সূত্রে ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়।
কোরবানির ঈদের মূল অর্থনৈতিক অনুষঙ্গ হলো পশু। পশু কোরবানি উপলক্ষে জাতীয় অর্থনীতিতে ঘটে মহাআয়োজন সমারোহ। গত বছর ঈদে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর মোট সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৫ লাখ এবং কোরবানি হয়েছিল ১ কোটি ৫ লাখের মতো। এ বছর সেটা আরও অনেক বেড়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ বছর দেশীয় কোরবানির পশুর সংখ্যা ১ কোটি ১৮ লাখ। এর মধ্যে রয়েছে ৪৫ লাখ ৮২ হাজার গরু-মহিষ, ৭২ লাখ ছাগল-ভেড়া এবং ৬ হাজার ৫৬৩টি অন্যান্য পশু। এখন গরুপ্রতি গড় মূল্য ৪০ হাজার টাকা দাম ধরলে ৪৬ লাখ গরু-মহিষের দাম দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং ৭২ লাখ খাসি-ভেড়ার দাম গড়ে ২ হাজার টাকা ধরলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। মোটকথা পশু কোরবানিতে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে।
এছাড়া কোরবানিকৃত পশুর সরবরাহ ও কেনাবেচার শুমারি ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়Ñ চাঁদা, টোল, বখশিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, পশুর হাট ইজারা, চাদিয়া, বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার, পশু কোরবানি ও বানানো এমনকি পশুর সাজগোজ বাবদও এক বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতবদল হয়ে থাকে। কতটা বিপুল সে হাতবদল? অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা। সংক্ষেপ কথায় অর্থনীতিতে ফর্মাল-ইনফর্মাল ওয়েতে আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ প্রচুর বেড়ে যায়।
অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ তার এক রচনায় ঈদে চাঙ্গা অর্থনীতির বর্ণনায় পাঁচটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কোরবানির বহুমুখী অর্থনৈতিক তাৎপর্য। হজ, কোরবানির পশু, পশুর চামড়াসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় কীভাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে শক্তিশালী অবদান রেখে চলে। চামড়া শিল্পের বার্ষিক সংগ্রহ ও বেচাকেনার অর্ধেকের বেশি জোগান আসে শুধু কোরবানির ঈদে। কোরবানিকৃত পশুর চামড়া রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্পে, পোশাক, হস্তশিল্পে এক অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের কর্মযোজনা সৃষ্টি হয়। এ চামড়া সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। এর বাইরে আছে কোরবানি উপলক্ষে দা, বটি, পশুর হাড়গোড়, মাংসের মশলাসহ নানা আসবাব ও পণ্যের জমজমাট ব্যবসা। তার মধ্যে শুধু মশলার ব্যবসা হয় তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকার। পশুর হাড়গোড়, শিং ও অন্যান্য অংশের ব্যবসায় হাতবদল হয় অন্যূন শতকোটি টাকা।
আর এসব লেনদেনে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে যায়। এসবের সঙ্গে যোগ হয় ঈদ উপলক্ষে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সারা বছরের তুলনায় আশাব্যঞ্জক হারে বেড়ে যায়। প্রবল হয় অর্থনীতির চাকা। অন্যদিকে ঈদের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সৃষ্টি হয় নানা কর্মসংস্থান। ফলে দেখা যায়, ঈদকে কেন্দ্র করে দোকানে দোকানে নতুন কর্মচারী নিয়োগ হয়।
ঈদকেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবস্থায় ঘটে আরও বড় এলাহি কা-। শহরের মানুষ আপনজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামে ছোটে। এক মাস আগে থেকে ট্রেন, বাস, লঞ্চের টিকিট বিক্রির তোড়জোড় দেখে বোঝা যায় এর প্রসার ও প্রকৃতি। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ দামে ফর্মাল টিকিট আর ইনফর্মাল টাউট, দালাল ও বিবিধ উপায়ে টিকিট বিক্রির সার্বিক ব্যবস্থা বোঝা যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পরিবহন খাতে সাকুল্যে ২ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা বা লেনদেন হয়ে থাকে। এটিও অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
মোদ্দাকথা, ঈদকেন্দ্রিক মুদ্রা লেনদেন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য গোটা দেশের অর্থনীতির উজ্জীবন ঘটায়। দুই ঈদে যত কেনাবেচা ও লেনদেন হয়, সারা বছরেও তা হয় না। বলা যায়, ঈদে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ। দারিদ্র্য মোচনে ঈদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কোরবানির পশুর গোশতের একটা অংশ দরিদ্রদের প্রাপ্য। সারা বছর যারা সামর্থ্যরে অভাবে গোশত কিনে খেতে পারে না, এ সময় তারাও অন্তত কয়েক দিন গোশত খেতে পারে। তাছাড়া কোরবানির পশুর চামড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থের হকদার দরিদ্র, এতিম ও অসহায় মানুষ। কোরবানির পশুর চামড়ার অর্থে দেশের বহু মাদ্রাসা ও এতিমখানার সারা বছরের খরচ চলে।
সামগ্রিক বিবেচনায়, অন্যান্য ধর্মীয় জাতি-সম্প্রদায়ের আনন্দ-উৎসবের তুলনায় মুসলমানদের আনন্দ-উৎসব যে আধ্যাত্মিক, সামাজিক, মানবিক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভিন্নতর তাৎপর্যে মহিমাময় ও কল্যাণবহ তাতে কোনো সন্দেহ আছে কি?
>>>তথ্যসূত্র : ১. প্রথম আলো ১৬ জুলাই ২০১৯; ২. নয়া দিগন্ত, ২৩ এপ্রিল ২০১৯; ৩. ইত্তেফাক ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫; ৪. বিবিসি বাংলা ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
>>>লেখক : রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট অ্যান্ড রিসার্চ, ঢাকা
বছরঘুরে আমাদের মাথার ওপর ওঠে একফালি চাঁদ। ঈদের চাঁদ। আমাদের জীবনে নিয়ে আসে আনন্দ ও ত্যাগের মিশ্র অনুভূতি। সব আবিলতা, বিভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যের বন্ধনে আমাদের আবদ্ধ করে ঈদ। ত্যাগের মহিমায় করে ভাস্বর। ঈদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক আবেদন আমাদের ভেতরটাকে করে পরিশুদ্ধ। ঈদগাহ মানেই ধনী-গরিব, ইতর-ভদ্র শ্রেণিবিভেদের দেয়াল ভেঙে অসীম সাম্যের পতাকায় সমবেত হওয়া। ঈদ মানে ধনীর সম্পদে গরিবের ন্যায়সংগত অধিকার। বছরঘুরে ঈদ আসে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিশুদ্ধিকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান নিয়ে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা, শ্রেণিবিভেদের অবৈধ দেয়াল, অন্যায়, ধোঁকাবাজি, কালোবাজারি, গরিবের হক মেরে খাওয়া পুঁজির পাহাড় গুঁড়িয়ে দিয়ে অনাবিল সাম্য-সম্প্রীতিতে সমাজকে ভরিয়ে দেওয়ার আহ্বান নিয়ে ঈদের আগমন। ঈদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এ তাৎপর্যের বাইরে আছে বহুমুখী অর্থনৈতিক তাৎপর্য, যা ঈদকে করে তোলে আরও অর্থবহ, আরও সামাজিক, আরও সর্বজনীন।
বিশেষত ঈদুল আজহা উদযাপনে পশু কোরবানির মধ্যে রয়েছে বিশেষ আর্থসামাজিক তাৎপর্য। হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক পুত্র ইসমাইল (আ.) কে আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার ইচ্ছা প্রকাশের মহান স্মৃতি স্মরণ করে ইতিহাসের ধারাবাহিতায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে নিজের পাশব-প্রবৃত্তি, অসৎ উদ্দেশ্য ও হীনম্মন্যতারই কোরবানি করা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই বিশেষ ঈদ-উৎসবে নিজের চরিত্র ও কুপ্রবৃত্তির সংশোধন করার সুযোগ আসে। এজন্য জীবজন্তু কোরবানি করাকে নিছক জীবের জীবন-সংহার হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি আত্মশুদ্ধি ও নিজের পাশব-প্রবৃত্তি অবদমনের প্রয়াস প্রচেষ্টারই প্রতীকী প্রকাশ। সামাজিক কল্যাণ সাধনে সংশোধিত মানব চরিত্র বলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কোরবানির মাংস গরিব আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করার যে বিধান তার মধ্যে নিহিত রয়েছে সামাজিক সমতার মহান আদর্শ।
হজ পালন ঈদুল আজহা উৎসবের একটি বিশেষ অংশ। পবিত্র হজ অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশের মুসলমানরা সমবেত হন এক মহাসম্মিলনে। ভাষা ও বর্ণগত, দেশ ও আর্থিক অবস্থানগত সব ভেদাভেদ ভুলে সবার অভিন্ন মিলনক্ষেত্র কাবা শরিফে একই পোশাকে, একই ভাষায়, একই রীতি-রেওয়াজের মাধ্যমে যে ঐকতান ধ্বনিত হয় তার চেয়ে বড় ধরনের কোনো সাম্য-মৈত্রীর সম্মেলন বিশ্বের কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না। হজ পালনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন রং ও গোত্রের মানুষের মধ্যে এক অনির্বাচনীয় সখ্য সংস্থাপিত হয়। বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের যা অনুপম আদর্শ বলে বিবেচিত হতে পারে। এ হজকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির ব্যাপক তারল্য দেখা দেয়, যা সচল অর্থনীতির অনিবার্য প্রয়োজন। এ বছর প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ হজে যাচ্ছেন। প্রতিজনে গড়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা ব্যয় নির্বাহ করলে এ খাতে মোট অর্থব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে হজের ব্যবস্থাপনা ব্যয়েও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলাদেশি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা ব্যয়ের সংশ্লেষ থাকে। ফলে ব্যাংকিং সেক্টরে এ উপলক্ষে লেনদেন ও সেবা-সূত্রে ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়।
কোরবানির ঈদের মূল অর্থনৈতিক অনুষঙ্গ হলো পশু। পশু কোরবানি উপলক্ষে জাতীয় অর্থনীতিতে ঘটে মহাআয়োজন সমারোহ। গত বছর ঈদে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর মোট সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৫ লাখ এবং কোরবানি হয়েছিল ১ কোটি ৫ লাখের মতো। এ বছর সেটা আরও অনেক বেড়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ বছর দেশীয় কোরবানির পশুর সংখ্যা ১ কোটি ১৮ লাখ। এর মধ্যে রয়েছে ৪৫ লাখ ৮২ হাজার গরু-মহিষ, ৭২ লাখ ছাগল-ভেড়া এবং ৬ হাজার ৫৬৩টি অন্যান্য পশু। এখন গরুপ্রতি গড় মূল্য ৪০ হাজার টাকা দাম ধরলে ৪৬ লাখ গরু-মহিষের দাম দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং ৭২ লাখ খাসি-ভেড়ার দাম গড়ে ২ হাজার টাকা ধরলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। মোটকথা পশু কোরবানিতে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে।
এছাড়া কোরবানিকৃত পশুর সরবরাহ ও কেনাবেচার শুমারি ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়Ñ চাঁদা, টোল, বখশিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, পশুর হাট ইজারা, চাদিয়া, বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার, পশু কোরবানি ও বানানো এমনকি পশুর সাজগোজ বাবদও এক বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতবদল হয়ে থাকে। কতটা বিপুল সে হাতবদল? অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা। সংক্ষেপ কথায় অর্থনীতিতে ফর্মাল-ইনফর্মাল ওয়েতে আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ প্রচুর বেড়ে যায়।
অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ তার এক রচনায় ঈদে চাঙ্গা অর্থনীতির বর্ণনায় পাঁচটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কোরবানির বহুমুখী অর্থনৈতিক তাৎপর্য। হজ, কোরবানির পশু, পশুর চামড়াসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় কীভাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে শক্তিশালী অবদান রেখে চলে। চামড়া শিল্পের বার্ষিক সংগ্রহ ও বেচাকেনার অর্ধেকের বেশি জোগান আসে শুধু কোরবানির ঈদে। কোরবানিকৃত পশুর চামড়া রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্পে, পোশাক, হস্তশিল্পে এক অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের কর্মযোজনা সৃষ্টি হয়। এ চামড়া সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। এর বাইরে আছে কোরবানি উপলক্ষে দা, বটি, পশুর হাড়গোড়, মাংসের মশলাসহ নানা আসবাব ও পণ্যের জমজমাট ব্যবসা। তার মধ্যে শুধু মশলার ব্যবসা হয় তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকার। পশুর হাড়গোড়, শিং ও অন্যান্য অংশের ব্যবসায় হাতবদল হয় অন্যূন শতকোটি টাকা।
আর এসব লেনদেনে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে যায়। এসবের সঙ্গে যোগ হয় ঈদ উপলক্ষে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সারা বছরের তুলনায় আশাব্যঞ্জক হারে বেড়ে যায়। প্রবল হয় অর্থনীতির চাকা। অন্যদিকে ঈদের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সৃষ্টি হয় নানা কর্মসংস্থান। ফলে দেখা যায়, ঈদকে কেন্দ্র করে দোকানে দোকানে নতুন কর্মচারী নিয়োগ হয়।
ঈদকেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবস্থায় ঘটে আরও বড় এলাহি কা-। শহরের মানুষ আপনজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামে ছোটে। এক মাস আগে থেকে ট্রেন, বাস, লঞ্চের টিকিট বিক্রির তোড়জোড় দেখে বোঝা যায় এর প্রসার ও প্রকৃতি। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ দামে ফর্মাল টিকিট আর ইনফর্মাল টাউট, দালাল ও বিবিধ উপায়ে টিকিট বিক্রির সার্বিক ব্যবস্থা বোঝা যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পরিবহন খাতে সাকুল্যে ২ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা বা লেনদেন হয়ে থাকে। এটিও অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
মোদ্দাকথা, ঈদকেন্দ্রিক মুদ্রা লেনদেন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য গোটা দেশের অর্থনীতির উজ্জীবন ঘটায়। দুই ঈদে যত কেনাবেচা ও লেনদেন হয়, সারা বছরেও তা হয় না। বলা যায়, ঈদে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ। দারিদ্র্য মোচনে ঈদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কোরবানির পশুর গোশতের একটা অংশ দরিদ্রদের প্রাপ্য। সারা বছর যারা সামর্থ্যরে অভাবে গোশত কিনে খেতে পারে না, এ সময় তারাও অন্তত কয়েক দিন গোশত খেতে পারে। তাছাড়া কোরবানির পশুর চামড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থের হকদার দরিদ্র, এতিম ও অসহায় মানুষ। কোরবানির পশুর চামড়ার অর্থে দেশের বহু মাদ্রাসা ও এতিমখানার সারা বছরের খরচ চলে।
সামগ্রিক বিবেচনায়, অন্যান্য ধর্মীয় জাতি-সম্প্রদায়ের আনন্দ-উৎসবের তুলনায় মুসলমানদের আনন্দ-উৎসব যে আধ্যাত্মিক, সামাজিক, মানবিক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভিন্নতর তাৎপর্যে মহিমাময় ও কল্যাণবহ তাতে কোনো সন্দেহ আছে কি?
>>>তথ্যসূত্র : ১. প্রথম আলো ১৬ জুলাই ২০১৯; ২. নয়া দিগন্ত, ২৩ এপ্রিল ২০১৯; ৩. ইত্তেফাক ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫; ৪. বিবিসি বাংলা ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
>>>লেখক : রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট অ্যান্ড রিসার্চ, ঢাকা
No comments