যৌনতা কমছে দেশে দেশে
যৌনতা
প্রাকৃতিক কিছু নয়, বরং মনুষ্য ডিসকোর্সের (আলাপ-আলোচনা) উপজাত। এমন
তত্ত্ব দিয়েছিলেন দার্শনিক মিশেল ফুকো। এক্ষেত্রে তার পর্যবেক্ষণ ছিল,
মানুষ যৌনতা নিয়ে প্রচুর কথা বলে। নিজের চার খণ্ডের গ্রন্থ ‘দ্য হিস্টরি অব
সেক্সুয়ালিটি’তে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা নিজেদের বুঝ দেই যে, যৌনতা নিয়ে
আমাদের যত আলোচনা, তা কখনোই যথেষ্ট নয়। এটি সম্ভব যে, যৌনতা বিষয়ে সবচেয়ে
বিরক্তিকর ও সবচেয়ে অধৈর্য সমাজ বোধ হয় আমাদেরই।’ মিশিগানের নর্থওয়েস্টার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে যৌনতা ও ডেটিং নিয়ে তিন
ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা শেষে, এই কলামিস্টের মনে হয়েছে যে, তিনি জানেন কেন
যৌনতা নিয়ে আমাদের আলাপ শেষই হচ্ছে না। ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের লেক্সিংটন
ব্লগের লেখক এভাবেই যৌনতা নিয়ে সাম্প্রতিক একটি নিবন্ধে আলোচনা করেছেন।
তিনি লিখেছেন, মানুষের এমন ...আর খুব আচরণই অবশিষ্ট আছে যা ব্যাখ্যা করা এত
কঠিন। আর এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তো নয়ই। নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে
ব্লগার লেক্সিংটনের সফরের একটি কারণ ছিল এই যে, জাপান ও কিছু ধনী দেশের মতো
আমেরিকায়ও তরুণ-তরুণীরা আগের তুলনায় অনেক কম যৌনক্রিয়ায় মিলিত হচ্ছে।
সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি গবেষণাও প্রকাশিত হয়েছে। ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী
আমেরিকানদের মধ্যে ১২ মাসে সেক্স করেন নি, এমন দাবি করা ব্যক্তিদের সংখ্যা
এক দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছর এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯
শতাংশে। যৌনতা নিয়ে বহু সামাজিক বিধিনিষেধ পশ্চিমা সমাজে এই এক দশকে গত
হয়েছে। তরুণ বয়সী আমেরিকানরা তাদের পূর্বসূরিদের চেয়ে ধর্মকর্ম করেন কম।
যৌন অভিগামিতা প্রকাশে তারা পূর্বসূরিদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা ও
স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করেন। এ ছাড়া স্মার্টফোনে বিনামূল্যে অবারিত পর্নো দেখার
কারণে তাদের মধ্যে যৌনতা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর প্রবণতাও
বেশি। কিন্তু তারপরও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার হার
কমেছে! নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ‘ম্যারেজ ১০১’ কোর্সের
পরিচালক ক্লিনিক্যাল মনোবিদ অ্যালেক্সান্দ্রা সলোমন অনেকটা বিস্ময়ের সুরে
বলেন, ‘আপনার হাতের মুঠোয় এখন পর্নোর ভাণ্ডার।’ কিন্তু তার এই পর্যবেক্ষণ
ক্লাসে খুব একটা মজার উদ্রেক করলো না। ফলে লেক্সিংটনের কাছে এই
শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে সবচেয়ে বিস্ময়কর যা মনে হলো তা হলো, তারা যৌনতা
নিয়ে অনেক বেশি স্পষ্টবাদী ও সংকোচহীন। নর্থওয়েস্টার্নের মতো একটি অভিজাত
বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌনতা নিয়ে পড়াশুনা করেন তারা। এই শিক্ষার্থীদের পরিচয়ে
অনেক বৈচিত্র্য আছে। কেউ সমকামী, কেউ বি-সমকামী। কেউ শ্বেতাঙ্গ, কেউ
কৃষ্ণাঙ্গ। এদের প্রায় অর্ধেকই এসেছেন ধর্মপরায়ণ পরিবার থেকে। কিছু এসেছে
অভিবাসী পরিবার থেকে। কিন্তু প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই যৌনতা বিষয়ে তাদের
পছন্দ, অপছন্দ, উদ্বেগ নিয়ে কথা বলতে বেশ আগ্রহী মনে হয়েছে। পর্নোর
ব্যবহার, শারীরিক লজ্জা এবং প্রকাশ্যে সৌন্দর্য্য চর্চা করার ক্ষেত্রে এই
মিলেনিয়াল প্রজন্মের মধ্যে যে অবসেশন তৈরি হয়েছে, তার নেপথ্যে এই দুয়ের
সম্পর্ক- এই সব নিয়ে তারা আলোচনা করেছে। এমন কি কিছু মাত্রায়, তারা যেন
তাদের প্রজন্মেরই প্রতিনিধিত্ব করেছে। যৌনতা নিয়ে কুণ্ঠা যেন কোনো সমস্যাই
নয়। তবে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যৌনতা নিয়ে আগ্রহ কমার সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত
খুবই সরল। সেটা হলো, সিঙ্গেলদের চেয়ে বিবাহিতরাই বেশি যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হন।
আর আমেরিকানরা বিয়ে করছে দেরি করে। এই হলো একটি ব্যাখ্যা। অর্থনৈতিক
টানাপড়েন আরেকটি কারণ। এটি কিন্তু কোনো কাকতালীয় বিষয় নয় যে, আমেরিকার
যুবক-যুবতীদের মধ্যে যৌনতায় কম জড়ানোর প্রবণতা দেখা দিয়েছে ২০০৮ সালের
অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকে। কিছুটা এই কারণেই অনেকে এখনো তাদের পিতামাতার
সঙ্গে থাকেন। ক্যারিয়ার নিয়ে সম্ভাবনা কম থাকলে আত্মবিশ্বাসে যে ঘাটতি দেখা
দেয়, যেমনটা অনেক জাপানির ক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে দেখা গেছে, সেটার কারণেও
গণ যৌন-অনাগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। আমেরিকার অর্থনীতিতে সম্প্রতি জোয়ার এলেও,
এখন তা অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে। এমন কি নর্থওয়েস্টার্নের শিক্ষার্থীদের মতো
সফলদের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। এটি ভীষণ বিস্ময়কর যে, প্রচুর
শিক্ষার্থী ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন যে, সেই
সময়কার করুণ স্মৃতিই তাদেরকে নিজ ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিতে প্ররোচিত
করেছে। এজন্য প্রয়োজনে অনেকে রোমান্টিক সম্পর্ক একেবারে এড়িয়ে চলতেও
কুণ্ঠাবোধ করছেন না। এক নারী সম্ভবত আবার এমন ধারণার সঙ্গে একমত নন। খোঁচা
দেয়ার সুরে প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা এখন আর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চাই না। তো আমরা
করছি কী তাহলে?’ কিন্তু তারপরেও আমেরিকার যৌন অনাগ্রহের যে তীব্রতা, তার
ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কেন এই অনাগ্রহ পুরুষদের মধ্যে বেশি কাজ করে, তারও
কোনো জবাব নেই। ২০০৮ সালের পর থেকে আজ অবধি, যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হচ্ছেন না,
৩০ বছরের কমবয়সী এমন পুরুষদের সংখ্যা প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে
এমন নারীদের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। এর নানা ধরনের কারণ অনেকে অনুমান
করেছেন। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য থেকে কয়েকটি কারণের স্বপক্ষে যুক্তিও পাওয়া
যায়। এদের অনেকেই মনে করেন, প্রযুক্তির ওপর অতি নির্ভরতার ফলে পুরুষদের
সামাজিক দক্ষতা মিইয়ে গেছে। অতিরিক্ত পর্নো দেখার ফলে তারা বাস্তবতা থেকে
পালানোর এক ধরনের পথও খুঁজে পেয়েছেন। তবে সবচেয়ে গ্রহণীয় উত্তর হতে পারে এই
যে, তরুণরা ক্রমান্বয়ে ডেট করতে বেশি অনাগ্রহী হয়ে উঠছেন। এর কারণ কী?
প্রায়ই এ জন্য দায়ী করা হয় কলেজ প্রাঙ্গণের কথিত ‘হুক আপ সংস্কৃতি’কে। হুক
আপ হলো, সম্পর্কের অঙ্গীকারে না জড়িয়েও কারও সঙ্গে শুধু যৌনতায় লিপ্ত হওয়া।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকেও আমেরিকায় সাধারণ সেক্স ও ডেটিং-এর অস্তিত্ব ছিল। এ
ছাড়া সঙ্গী না বানিয়েই একে অপরের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হচ্ছে এমন মানুষের
সংখ্যা বাড়িয়ে বলাও সহজ। নর্থওয়েস্টার্নের শিক্ষার্থীদের অর্ধেকই বলেছে,
তারা জীবনে এমনটা খুবই কম করেছে বা কখনই করেনি। তারা ডেট করার অনাগ্রহের
পেছনে যেসব কারণ বলেছে তার মধ্যে একটা হলো, ডেট কীভাবে এগিয়ে যাবে তা নিয়ে
পুরুষদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করা। অনেকের কাছেই পানশালায় কারও
সঙ্গে আলাপ করার দৃশ্যকল্প ভয়ঙ্কর না হলেও, আপত্তিকর মনে হয়েছে। একজন পুরুষ
শিক্ষার্থী বলেন, ‘কারও সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্য যে যৌনতা-প্ররোচিত, সেই
উদ্দেশ্য আবার প্রকাশ করা? এটা বেশ ভীতিজনক।’ সুতরাং, সমস্যাটা সম্ভবত হলো
এই যে, সম্ভাব্য সঙ্গীর প্রত্যাশা ও চাহিদা নিয়ে ভীষণ এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও
উদ্বেগ কাজ করে অনেকের মধ্যে। বিশেষ করে, কোনো সম্পর্কের ভিত্তি,
সম্পর্কের অগ্রগতির প্রত্যেক ধাপে উভয় পক্ষের সম্মত হওয়ার ওপর শিক্ষার্থীরা
অতিমাত্রায় যে গুরুত্ব আরোপ করেছে, সেখানেই হয়তো এই সমস্যার সূত্র লুকিয়ে
আছে। এটিই হয়তো এই সমস্যার কারণ, আবার প্রতিফলক। ডেটিং অ্যাপস, যেগুলো
প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীই ব্যবহার করে, সেগুলো হয়তো এই সমস্যা কিছুটা উপশম
করতে পারে। আবার এই অনাগ্রহের একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, নারীদের বর্ধিত
ক্ষমতায়ন, যৌন রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন, মি-টু ধারার হয়রানি করার
অভিযোগ ওঠার আশঙ্কা ইত্যাদি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগে
দুর্বল এমন তরুণ আমেরিকানরা সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এক গোলমেলে খেলায়
পড়েছে। ফলে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, তারা ভিডিও গেইম নিয়েই পড়ে আছে। কিন্তু
এই পরিস্থিতি এমন থাকবে না। অর্থনীতি এখন শক্তিশালী। পপুলার কালচারের
গতিধারা পরিবর্তিত হবে। আর যখন আমেরিকান তরুণ-তরুণীরা সমতা-ভিত্তিক
সম্পর্কে আরো অভ্যস্ত হয়ে উঠবে, তখন তারা রোমান্সের অস্পষ্টতা ও ঝুঁকি নিয়ে
আরো স্পষ্ট ধারণা পাবে। পরিস্থিতি আরো ভালো করার স্বার্থে, তারা হয়তো
তাদের ফোনটা একটু নামিয়ে, অন্যের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা, এমনকি একটু আধটু
মজা করার চেষ্টা করেও দেখতে পারে। (ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন)
No comments