জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার স্থির, বছরে যোগ হচ্ছে ২২ লাখ মানুষ by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
৩৫
বছর বয়সী নাজমা ছয় সন্তান নিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছেন। স্বামী ইউসুফ
দিনমজুরি করে সংসার চালান। এত বড় পরিবার নিয়ে তার স্বামীও সন্তুষ্ট নন।
ইউসুফ বলেন, আগে বুঝতে পারিনি। এখন চেষ্টা করছি জনসংখ্যা যাতে আর না বাড়ে।
রাজধানীর পলাশী মোড়ে ইডেন কলেজের দেয়ালের সঙ্গে ঝুপড়ি ঘর পেতে থাকেন
হাজেরা। ২৩ বছর বয়সী এই মহিলা জানান, তার বাল্যবিবাহ হয়েছে। এই মুহূর্তে
তিনি তিন সন্তানের জননী। তার স্বামী রিকশা চালান। কষ্টে দিন কাটে তাদের।
তিনি জানান, সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের লোকজন বছরেও একবার আসেন না। প্রশ্ন করে বলেন, আমরা গরিব মানুষ, ওষুধ কিনার টাকা পাবো কোথায়। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা কম। তাই সন্তান নিয়েছি। এখন বাচ্চা লালন-পালনে কষ্ট হচ্ছে। নদী ভাঙার কারণে জামালপুর জেলা থেকে এই শহরে আসা তাদের। শুধু নাজমা দম্পতিই নন, দেশে প্রতিদিন জনসংখ্যা বাড়ছে ৫ হাজার ২০৫ জন। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭-এর ১লা জুলাই পর্যন্ত ১৯ লাখ লোক বৃদ্ধি পেয়েছে দেশে। ২০১৬ সালে লোক ছিল ১৬ কোটি ৮ লাখ। ২০১৭-এর ১লা জুলাই এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটি ২৭ লাখ জনসংখ্যা। এটাকে প্রাক্কলিত জনসংখ্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
বিবিএস আরো বলছে, গত পাঁচ (২০১৩ থেকে ২০১৭) বছরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার বাড়েনি। প্রায় একই রকম রয়েছে। স্থবির হয়ে আছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যাও আর বাড়ছে না। দেশের জনসংখ্যার ওপর পড়ছে এর বিরূপ প্রভাব। ১লা জানুয়ারি ২০১৮ সালে প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩৬ লাখ। টিএফআর ২ দশমিক শূন্য ৫। বিবিএস চলতি বছরের ৩০শে জুন ‘বাংলাদেশ স্যাম্পেল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৭’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি প্রাক্কলিত (ইস্টিমিটেড) জনসংখ্যা।
১০ই জুলাই পরিবার কল্যাণ অধিদপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রতি বছরে দেশে নতুন করে ২২ লাখ লোক যোগ হচ্ছে। যা একটি জেলার লোকের সমান। তিনি বলেন, বর্তমানে টিএফআর ২ দশমিক ৩। অর্থাৎ গড়ে একজন নারী দুজনের উপরে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। টিএফআর দুই থাকলে ভালো হতো বলে তিনি উল্লেখ করেন। রিমোট বা দুর্গম এলাকায় পরিবার পরিকল্পনা দুর্বল স্বীকার করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, চেষ্টা চলছে দুর্বলতা দূর করার।
জাতিসংঘ ২০১৫ সালের জনসংখ্যা বিষয়ক প্রজেকশন বলেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা আগামী ২০৫০ সালে ২০২ মিলিয়ন হবে। অর্থাৎ ২০ কোটি ২০ লাখে দাঁড়াবে। দেশে পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচির সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ করছেন বহু দম্পতি। কালেভদ্রে যেটুকু পান তা আবার এনজিও কর্মীদের কাছ থেকে। অনেকে আবার টাকার অভাবেও এনজিওদের পন্থায় পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচি নিতে পারেন না। ফলে থমকে যেতে বসছে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি, এমনই মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দম্পতিদের কাছে পৌঁছায় না বলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
অনেককে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সরকারি কোনো ধরনের সুবিধা না পেয়ে তারা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারছে না বলে অভিযোগ আসছে।
বাংলাদেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখাতে পেরেছিল জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ব্যবহার (কন্ট্রাসেপটিভ প্রিভিলেন্স রেট-সিপিআর) বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে সক্ষম দম্পতি প্রায় ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। প্রতি দশকে এর ব্যবহার বেড়েছে। ২০০০ সালে এই হার বেড়ে ৫৪ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপরের ১০ বছরে গতি অনেকটা শ্লথ হয়ে পড়ে। ২০১১ সালে এর হার ছিল ৬১ দশমিক ২ শতাংশ।
২০১২ সালে ছিল ৬২ দশমিক ২ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ছিল ৬২ দশমিক ৩। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার তেমন বাড়েনি। প্রায় একই রকম রয়েছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী শহর অঞ্চলের (৬৬ দশমিক ৩ শতাংশ) মহিলারা গ্রামাঞ্চলের (৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ) মহিলার চেয়ে বেশি হারে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের সঙ্গে মোট প্রজনন হারের (টোটাল ফার্টিলিটি রেট-টিএফআর) সম্পর্ক সরাসরি। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারী যত সন্তানের জন্ম দেন, সেটাই টিএফআর।
১৯৭৫ সালে নারীরা মোট ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন (টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৩)। ২০০১ সালের দিকে এই সংখ্যা ছিল ৩। ২০১৪ সালের হিসাব অনুসারে বর্তমানে টিএফআর ২ দশমিক ৩। অর্থাৎ গড়ে একজন নারী দুজন করে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। ২০১৬ সালের মোট প্রজনন হার ২০১১ সালের মোট প্রজনন হারের (২ দশমিক ১১) থেকে সামান্য কম। প্রজননের সব পরিমাপ তুলনা করলে দেখা গেছে, সমপ্রতি বছরগুলোতে বাংলাদেশের জন্মের হার ২ দশমিক ১ এর কাছাকাছি। অনেকটা স্থির অবস্থায় আছে। অন্যদিকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় মরণশীলতা ৫ দশমিক ১ জন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার এ প্রসঙ্গে বলেন, পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদার হার পূরণের চেষ্টা চলছে। যারা পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান কিন্তু সেখানে পৌঁছানো যাচ্ছে না। যোগাযোগ গ্যাপ রয়েছে। তাদের কাছে যাওয়ার কর্মসূচি নিচ্ছে সরকার। তিনি বিবিএসএস’র সূত্র ধরে বলেন, এখন টিএফআর ২ দশমিক ১। ভালো অবস্থানে আছে। এখন থেকে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ও পরামর্শ দেয়ার জন্য একটি কল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। যার নম্বর ১৬৭৬৭ (সুখী পরিবার)।
পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারীর সংখ্যা হার সন্তোষজনক নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ দম্পতির মধ্যে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এখাতে জনবলও বাড়াতে হবে। অনেক মাঠকর্মী আছেন যারা মাঠে সঠিকভাবে কাজ করেন না। অনেকে মাঠেই যান না। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার প্রবণতা বেশি। ফলে নারী সন্তান ধারণে দীর্ঘ প্রজননকাল পাচ্ছে। বেশি সন্তান জন্মদানের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। আঠারো বছরের আগেই ৭৩ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশে। যা পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বেশি। সমাজের প্রচলিত প্রথা ও ধারণার কারণে অনেক মেয়ে শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বলে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের গবেষণায় উঠে এসেছে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা গবেষণার এই ফলাফল তুলে ধরেন। গবেষণার প্রতিবেদনের ফলাফল উল্লেখ করে তারা বলেন, এশিয়ার তিনটি দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার গ্রামাঞ্চলের বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের হার বেশ উদ্বেগজনক।
পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অফিসিয়াল টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে পরিবার-পরিকল্পনা পরিদর্শকরা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারী দম্পতির সংখ্যা তাদের নিবন্ধন (রেজিস্ট্রার) খাতায় বাড়িয়ে লিখে থাকেন। একই সঙ্গে অফিসিয়াল টার্গেট পূরণ করতে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকরা ষাটোর্ধ্ব নারী ও পুরুষদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ করাচ্ছেন। এক হাজার টাকা ভাতা ও শাড়ি এবং লুঙ্গির লোভ দেখিয়ে তাদের এ বন্ধ্যাকরণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছরের নারীর আর সন্তান ধারণ ক্ষমতা থাকে না। কর্মসূচির চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে, বাল্যবিবাহ এখনও একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান।
১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে মেয়েদের বিয়ে না দেয়ার আইন থাকলেও ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে (বিডিএইচএস-২০১৪); ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরীদের ৩১ শতাংশ প্রথম বা দ্বিতীয় বারের মতো গর্ভবতী হন; ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের হার অনেক কম (মাত্র ৪৭ শতাংশ); পরিবার পরিকল্পনার আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণের হার মাত্র ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ, পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদার হার এখনও ১২ শতাংশ; পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিতে ড্রপ আউটের হার এখনও ১২ শতাংশ; সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ মায়ের প্রসব এখনও বাড়িতে সংগঠিত হয়; সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে মোট প্রজনন হার অন্যান্য বিভাগের চেয়ে এখনও বেশি; সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধনী-গরিব, শহর, গ্রাম, শিক্ষিত-অশিক্ষিত এর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে; দুর্গম এলাকার (হাওর, বাঁওড়, বিল, চর, পার্বত্য ও উপকূলীয় এলাকা) জনগণের নিকট এখনও পরিবার পরিকল্পনা সেবা যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়া বড় চ্যালেঞ্জ।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর-উন-নবী মানবজমিনকে এ প্রসঙ্গে বলেন, এনালগ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে হবে না। অর্থাৎ পুরানো ধাঁচের কর্মসূচি দিয়ে পরিবার পরিকল্পনা চলবে না। ইনোভেটিব এপ্রোচ লাগবে পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে। এখন চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। মানুষকে আর্কষণ করে এমন কর্মসূচি দিতে হবে। মানুষের মূল্যবোধ হুড়হুড় করে পরিবর্তন হয় না। সম্পদের সঙ্গে জনসংখ্যার ব্যালেন্স দেখতে হবে। জনসম্পদ কাজে লাগাতে পারলে পরিবার পরিকল্পনা অটোমেটিক কাজে আসবে।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আজ ১১ই জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করা হবে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-‘পরিকল্পিত পরিবার সুরক্ষিত মানবাধিকার।’
তিনি জানান, সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের লোকজন বছরেও একবার আসেন না। প্রশ্ন করে বলেন, আমরা গরিব মানুষ, ওষুধ কিনার টাকা পাবো কোথায়। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা কম। তাই সন্তান নিয়েছি। এখন বাচ্চা লালন-পালনে কষ্ট হচ্ছে। নদী ভাঙার কারণে জামালপুর জেলা থেকে এই শহরে আসা তাদের। শুধু নাজমা দম্পতিই নন, দেশে প্রতিদিন জনসংখ্যা বাড়ছে ৫ হাজার ২০৫ জন। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭-এর ১লা জুলাই পর্যন্ত ১৯ লাখ লোক বৃদ্ধি পেয়েছে দেশে। ২০১৬ সালে লোক ছিল ১৬ কোটি ৮ লাখ। ২০১৭-এর ১লা জুলাই এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটি ২৭ লাখ জনসংখ্যা। এটাকে প্রাক্কলিত জনসংখ্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
বিবিএস আরো বলছে, গত পাঁচ (২০১৩ থেকে ২০১৭) বছরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার বাড়েনি। প্রায় একই রকম রয়েছে। স্থবির হয়ে আছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যাও আর বাড়ছে না। দেশের জনসংখ্যার ওপর পড়ছে এর বিরূপ প্রভাব। ১লা জানুয়ারি ২০১৮ সালে প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩৬ লাখ। টিএফআর ২ দশমিক শূন্য ৫। বিবিএস চলতি বছরের ৩০শে জুন ‘বাংলাদেশ স্যাম্পেল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৭’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি প্রাক্কলিত (ইস্টিমিটেড) জনসংখ্যা।
১০ই জুলাই পরিবার কল্যাণ অধিদপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রতি বছরে দেশে নতুন করে ২২ লাখ লোক যোগ হচ্ছে। যা একটি জেলার লোকের সমান। তিনি বলেন, বর্তমানে টিএফআর ২ দশমিক ৩। অর্থাৎ গড়ে একজন নারী দুজনের উপরে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। টিএফআর দুই থাকলে ভালো হতো বলে তিনি উল্লেখ করেন। রিমোট বা দুর্গম এলাকায় পরিবার পরিকল্পনা দুর্বল স্বীকার করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, চেষ্টা চলছে দুর্বলতা দূর করার।
জাতিসংঘ ২০১৫ সালের জনসংখ্যা বিষয়ক প্রজেকশন বলেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা আগামী ২০৫০ সালে ২০২ মিলিয়ন হবে। অর্থাৎ ২০ কোটি ২০ লাখে দাঁড়াবে। দেশে পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচির সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ করছেন বহু দম্পতি। কালেভদ্রে যেটুকু পান তা আবার এনজিও কর্মীদের কাছ থেকে। অনেকে আবার টাকার অভাবেও এনজিওদের পন্থায় পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচি নিতে পারেন না। ফলে থমকে যেতে বসছে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি, এমনই মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। প্রয়োজনীয় পরামর্শ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দম্পতিদের কাছে পৌঁছায় না বলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
অনেককে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সরকারি কোনো ধরনের সুবিধা না পেয়ে তারা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারছে না বলে অভিযোগ আসছে।
বাংলাদেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখাতে পেরেছিল জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ব্যবহার (কন্ট্রাসেপটিভ প্রিভিলেন্স রেট-সিপিআর) বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে সক্ষম দম্পতি প্রায় ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। প্রতি দশকে এর ব্যবহার বেড়েছে। ২০০০ সালে এই হার বেড়ে ৫৪ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপরের ১০ বছরে গতি অনেকটা শ্লথ হয়ে পড়ে। ২০১১ সালে এর হার ছিল ৬১ দশমিক ২ শতাংশ।
২০১২ সালে ছিল ৬২ দশমিক ২ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ছিল ৬২ দশমিক ৩। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার তেমন বাড়েনি। প্রায় একই রকম রয়েছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী শহর অঞ্চলের (৬৬ দশমিক ৩ শতাংশ) মহিলারা গ্রামাঞ্চলের (৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ) মহিলার চেয়ে বেশি হারে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের সঙ্গে মোট প্রজনন হারের (টোটাল ফার্টিলিটি রেট-টিএফআর) সম্পর্ক সরাসরি। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারী যত সন্তানের জন্ম দেন, সেটাই টিএফআর।
১৯৭৫ সালে নারীরা মোট ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন (টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৩)। ২০০১ সালের দিকে এই সংখ্যা ছিল ৩। ২০১৪ সালের হিসাব অনুসারে বর্তমানে টিএফআর ২ দশমিক ৩। অর্থাৎ গড়ে একজন নারী দুজন করে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। ২০১৬ সালের মোট প্রজনন হার ২০১১ সালের মোট প্রজনন হারের (২ দশমিক ১১) থেকে সামান্য কম। প্রজননের সব পরিমাপ তুলনা করলে দেখা গেছে, সমপ্রতি বছরগুলোতে বাংলাদেশের জন্মের হার ২ দশমিক ১ এর কাছাকাছি। অনেকটা স্থির অবস্থায় আছে। অন্যদিকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় মরণশীলতা ৫ দশমিক ১ জন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার এ প্রসঙ্গে বলেন, পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদার হার পূরণের চেষ্টা চলছে। যারা পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান কিন্তু সেখানে পৌঁছানো যাচ্ছে না। যোগাযোগ গ্যাপ রয়েছে। তাদের কাছে যাওয়ার কর্মসূচি নিচ্ছে সরকার। তিনি বিবিএসএস’র সূত্র ধরে বলেন, এখন টিএফআর ২ দশমিক ১। ভালো অবস্থানে আছে। এখন থেকে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ও পরামর্শ দেয়ার জন্য একটি কল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। যার নম্বর ১৬৭৬৭ (সুখী পরিবার)।
পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারীর সংখ্যা হার সন্তোষজনক নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ দম্পতির মধ্যে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এখাতে জনবলও বাড়াতে হবে। অনেক মাঠকর্মী আছেন যারা মাঠে সঠিকভাবে কাজ করেন না। অনেকে মাঠেই যান না। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার প্রবণতা বেশি। ফলে নারী সন্তান ধারণে দীর্ঘ প্রজননকাল পাচ্ছে। বেশি সন্তান জন্মদানের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। আঠারো বছরের আগেই ৭৩ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশে। যা পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বেশি। সমাজের প্রচলিত প্রথা ও ধারণার কারণে অনেক মেয়ে শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে বলে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের গবেষণায় উঠে এসেছে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা গবেষণার এই ফলাফল তুলে ধরেন। গবেষণার প্রতিবেদনের ফলাফল উল্লেখ করে তারা বলেন, এশিয়ার তিনটি দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার গ্রামাঞ্চলের বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের হার বেশ উদ্বেগজনক।
পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অফিসিয়াল টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে পরিবার-পরিকল্পনা পরিদর্শকরা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারী দম্পতির সংখ্যা তাদের নিবন্ধন (রেজিস্ট্রার) খাতায় বাড়িয়ে লিখে থাকেন। একই সঙ্গে অফিসিয়াল টার্গেট পূরণ করতে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকরা ষাটোর্ধ্ব নারী ও পুরুষদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ করাচ্ছেন। এক হাজার টাকা ভাতা ও শাড়ি এবং লুঙ্গির লোভ দেখিয়ে তাদের এ বন্ধ্যাকরণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছরের নারীর আর সন্তান ধারণ ক্ষমতা থাকে না। কর্মসূচির চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বলছে, বাল্যবিবাহ এখনও একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান।
১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে মেয়েদের বিয়ে না দেয়ার আইন থাকলেও ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে (বিডিএইচএস-২০১৪); ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরীদের ৩১ শতাংশ প্রথম বা দ্বিতীয় বারের মতো গর্ভবতী হন; ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের হার অনেক কম (মাত্র ৪৭ শতাংশ); পরিবার পরিকল্পনার আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণের হার মাত্র ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ, পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদার হার এখনও ১২ শতাংশ; পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিতে ড্রপ আউটের হার এখনও ১২ শতাংশ; সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ মায়ের প্রসব এখনও বাড়িতে সংগঠিত হয়; সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে মোট প্রজনন হার অন্যান্য বিভাগের চেয়ে এখনও বেশি; সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধনী-গরিব, শহর, গ্রাম, শিক্ষিত-অশিক্ষিত এর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে; দুর্গম এলাকার (হাওর, বাঁওড়, বিল, চর, পার্বত্য ও উপকূলীয় এলাকা) জনগণের নিকট এখনও পরিবার পরিকল্পনা সেবা যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়া বড় চ্যালেঞ্জ।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর-উন-নবী মানবজমিনকে এ প্রসঙ্গে বলেন, এনালগ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে হবে না। অর্থাৎ পুরানো ধাঁচের কর্মসূচি দিয়ে পরিবার পরিকল্পনা চলবে না। ইনোভেটিব এপ্রোচ লাগবে পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে। এখন চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। মানুষকে আর্কষণ করে এমন কর্মসূচি দিতে হবে। মানুষের মূল্যবোধ হুড়হুড় করে পরিবর্তন হয় না। সম্পদের সঙ্গে জনসংখ্যার ব্যালেন্স দেখতে হবে। জনসম্পদ কাজে লাগাতে পারলে পরিবার পরিকল্পনা অটোমেটিক কাজে আসবে।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আজ ১১ই জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করা হবে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-‘পরিকল্পিত পরিবার সুরক্ষিত মানবাধিকার।’
No comments