এমন প্রেসিডেন্ট কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি by পবিত্র সরকার
আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাব দিয়েছেন, এই-যে
খ্যাপা লোকেরা এসে অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মেরে
ফেলছে, তার প্রতিবিধানের জন্য শিক্ষকদের হাতে রাইফেল তুলে দেয়া হোক। এ খবর
শুনে ‘পাগল, না পেটখারাপ’ না বলে হাততালি দিয়ে উঠতে ইচ্ছে হয়। আহা, কী
শুনিলাম! যাহা শুনিলাম তাহা জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না! এমন না হলে
প্রেসিডেন্ট! ভাগ্যিস বলেননি ছাত্রছাত্রীদের হাতে রাইফেল দাও! আর এর পরে
হয়তো বলবেন, হোটেলে গোলাগুলি চললে (লাস ভেগাসে যেমন চলল সেদিন) হোটেল
কর্মচারীদের হাতে রাইফেল দাও, গানের জলসায় গোলাগুলি চললে গায়ক-গায়িকা আর
শ্রোতাদের হাতে রাইফেল তুলে দাও। আরও অস্ত্র, আরও বেশি অস্ত্র, অস্ত্র দিয়ে
ভরে দাও দেশকে। তবে শান্তি আসবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের যেটা অস্ত্রের ‘লবি’,
এনআরএ বা ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন, তারা নিশ্চয়ই দু’হাত তুলে নাচছে।
এই তো চাই! অস্ত্র মাফিয়াদের পোয়াবারো হবে বলেই তো এই প্রেসিডেন্টকে তারা
ভোট দিয়ে পাঠিয়েছে। কারও কারও মনেই হতে পারে যে, এ লোকটা একটু খ্যাপাটে
আছে, সেই সঙ্গে বর্ণবিদ্বেষী, তবে সব আমেরিকান তার মতো নয়। সে কথা আমিও
মানি। কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা আমেরিকানরা বেশ অন্যরকম, হয়তো এর
বাইরেও বেশকিছু আমেরিকান অন্যরকম ভাবে। তারাই প্রতিবাদ করে, মিছিল করে,
হোয়াইট হাউসের সামনের লনে এসে ধরনায় বসে। নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর
ক্যালিফোর্নিয়ায় তারাই মিছিল করে বলে, ‘তুমি আমাদের প্রেসিডেন্ট নও!’ এদের
নিক্সনের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্পিরো অ্যাগ্নিয় বলেছিলেন, effete snobs! এর
মানে আপনারা ইংরেজি অভিধান খুলে দেখে নিন। অর্থাৎ একটা মানবিক, প্রগতিশীল
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রও আছে।
কিন্তু তারা বারেবারে হেরে যায়। আর না হারলেই
বা কী? রিপাবলিকানের বদলে ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট হলেও তার দুনিয়ার ওপরে
মস্তানি করার ইচ্ছে যায় না। হেরে যায় কাদের কাছে? হেরে যায় সেই এক উদ্ধত,
উগ্র, অন্ধ আমেরিকার কাছে, যার বাসিন্দারা মনে করে তাদের দেশের মতো আর কোনো
দেশ নেই, ফলে সবাইকে দেশের প্রভুত্ব মেনে নিতে হবে। তারা নিজেদের দেশের
নিজস্ব ‘ফুটবল’ খেলার প্রতিযোগিতাকে নাম দেয় ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ’, যেখানে
মুরগির উৎপাদন বেশি হয় তাকে বলে ‘চিকেন ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’,
ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানী স্যাক্রমেন্টোর নাম দেয় ‘ক্যামেলিয়া ক্যাপিটাল অব
দ্য ওয়ার্ল্ড’- কারণ সেখানে নাকি ক্যামেলিয়া ফুল বেশি ফোটে। এ রকম ‘পৃথিবীর
রাজধানী’তে পুরো দেশটা ভর্তি। অর্থাৎ নিজেদের দেশ সম্বন্ধে তাদের অহঙ্কার
প্রচুর। প্রায়ই শুনেছি, এমনকি সাধারণ লোকের মুখেও, We live in the best
country of the world! ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!’ দেশের জন্য
এই অহঙ্কার নিন্দনীয় নয়- আমি নিজে মাউন্ট রাশমোরে সেই পাহাড়ের চূড়োয় চার
প্রেসিডেন্টের মূর্তি দেখতে গিয়ে তাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘স্টার-স্প্যাংগলড
ব্যানার’ গানের সময় অনেক বৃদ্ধ আমেরিকানকে কাঁদতে দেখেছি, আমাদের বাংলাদেশে
যেমন ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনেও অনেকে কাঁদেন। তো অহঙ্কার করার বিষয়ও
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চয় অনেক আছে। তারা অর্থে, সম্পদে, বাহুবলে,
প্রযুক্তিতে, বাণিজ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি তো নিশ্চয়ই, তাদের বিদ্যা আর
সংস্কৃতিগত উপার্জনও কম নয়। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত, গবেষণায়
আবিষ্কারে তারা অনেক এগিয়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর বেশিরভাগ নোবেল
পুরস্কার তাদেরই ঝুলিতে গেছে এবং যায়। তাদের হলিউডের ছবি সারা পৃথিবী
দাপিয়ে বেড়ায় (তার মধ্যে চ্যাপলিন প্রমুখের অজস্র মহৎ ছবিও থাকে)। তাদের
সাহিত্য, নাটক-থিয়েটার অত্যন্ত উন্নত। তাদের সঙ্গীত সারা পৃথিবীর আদরের
বস্তু। একটা তুলনায় নতুন দেশের পক্ষে এই অর্জন সামান্য নয়। প্রকৃতিও তাদের
সহায়, কারণ ভারতের প্রায় তিনগুণ বিস্তার, অগাধ বৈচিত্র্য আর তেল, কয়লা আর
অন্যান্য ধাতু, আর অরণ্যের অপরিমিত প্রাকৃতিক সম্বল নিয়ে জনসংখ্যা ভারতের
মাত্র চারভাগের এক ভাগ (৩২ কোটির সামান্য বেশি)। ফলে এ দেশকে আর পায় কে?
তাই সারা পৃথিবী থেকে সেখানে পৌঁছে যাওয়ার ব্যাকুল স্বপ্ন, মানুষের
স্বর্গের আকাক্সক্ষার মতোই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলের
রাজ্যগুলো- যেগুলো উনিশ শতকের গৃহযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র চায়নি, যেখানে সাদারা
তেল আর অন্যান্য সম্পদে বেশি ধনী, তাদের মধ্যেই উগ্রতা আর হামবড়াই যেন
একটু বেশি। সাদাদের মধ্যে কালোদের অবস্থা সেখানে খুব ভালো নয়। আর লালমুখো
সাদা ট্রাম্প তো ওই অঞ্চলেরই লোক। সেখানেই আছে কু ক্লুক্স ক্লানের মতো চরম
দক্ষিণপন্থী দল- যাদের নেতা, নামটা ভুলে গেছি- নিক্সনের চীন যাত্রার সময়
বলেছিল, ‘আমার নিক্সনের চীনে যাওয়ায় কোনো আপত্তি নেই, আমার আপত্তি নিক্সনের
ফিরে আসায়।’
আমার মনে আছে বছর পঞ্চাশেক আগেকার কথা। টেক্সাসের ডালাস শহরে
একটি দীর্ঘ বাসযাত্রা থেকে থেমেছি। ভোরবেলায় সময় পেয়ে বাস টার্মিনালের
বাইরে হাত পা চালিয়ে একটু ঘুরে দেখছি বউ নিয়ে। দোকানপাট তখনও খোলেনি।
কিন্তু দোকানে বন্ধ শাটারের গায়ে, পাশের দেয়ালে দেখছি অদ্ভুত সব স্টিকার-
We're going to win the war in Vietnam- ‘ভিয়েতনামের যুদ্ধে আমরা জিতব’
(জেতেনি)। God is on our side- ‘ঈশ্বর আমাদের পক্ষে আছেন’ (অন্তত
ভিয়েতনামের যুদ্ধে ছিলেন না)। এবং সবচেয়ে যা মোক্ষম বার্তা- Register
communists, not guns. অর্থাৎ কার ঘরে ক’টা বন্দুক আছে তা হিসাব করতে যেও
না, বরং কোথায় ক’টা কমিউনিস্ট আছে তাদের মাথা গোনো। মনে রাখবেন, বন্দুক
বিক্রি নিষিদ্ধ বা সংকুচিত করার কথা হচ্ছে না, শুধু দেশের সরকার মিনমিন করে
এ কথা বলেছে যে, যার যত খুশি বন্দুক কেনো, আমাদের শুধু হিসাব রাখতে দাও
কার ঘরে ক’টা আছে। তাতেই আপত্তি। কমিউনিস্ট বা ওদের গালাগালের ভাষায় ‘কমি’
বা ‘রেড’দের নিয়ে তাদের প্রবল ঘৃণা, তখন সোভিয়েত আর চীন তাদের ভয়ানক শত্রু।
আশা করি সোভিয়েতের পতনের পর তাদের কমিউনিজমের ভূত দেখার ঘটনা একটু কমেছে।
কিন্তু বন্দুকের প্রতি গভীর আর ব্যাকুল প্রেম জেগেই আছে। তাতে যত নিরীহ
মানুষ বা ছেলেমেয়ে মরুক, ক্ষতি নেই। আরও বন্দুক নাও, যে বন্দুক চালায় তার
ওপরেও বন্দুক চালাও, খুন কর। এমন এক রাষ্ট্রপতি ধরাধামে অন্য কোথাও খোঁজো,
খুঁজেও পাবে নাকো তুমি। পবিত্র সরকার : লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র
ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
No comments