ইউজিসির পদক্ষেপ যেন ব্যর্থ না হয় by ড. মুহ. আমিনুল ইসলাম আকন্দ

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালন ব্যয়ের মঞ্জুরি প্রদানের কাজটি করে আসছিল। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে মঞ্জুরি না দিলেও সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ ভার ইউজিসির ওপর এসে পড়েছে। তবে অনিয়ম খুঁজে পেলেও নিজে শাস্তি প্রদান করতে পারে না, কেবল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে। প্রশাসনিক ক্ষমতা ঘাটতির কারণেই কি ইউজিসি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হয়েও অনেক পদক্ষেপ ও নীতিমালা কার্যকর করতে পারছে না? গত দশকে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদিত পদের বাইরে যথেচ্ছা শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের সংস্কৃতি দৃশ্যমান ছিল। কয়েক বছরে অবশ্য ইউজিসি সে প্রবণতা বেশ কমিয়ে আনতে পেরেছে। তার গৃহীত ও আশু পদক্ষেপগুলোতে যে অসঙ্গতি ও সমস্যা দূরীকরণ প্রাধান্য থাকছে, তা নিয়ে বিতর্ক নেই। ২০০৯ সালে প্রণীত প্রথম নিয়োগ ও পদোন্নতির অভিন্ন নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়নি, গত বছর নতুন করে অনুমোদিত নীতিমালাটিও প্রত্যাখ্যাত হলো। এখন চলছে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা, যেটা ব্যর্থ হলে গণমানুষের মধ্যে ইউজিসির সক্ষমতা নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে। ইউজিসির প্রশাসনিক সক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাড়ানো প্রশ্নে কারও আপত্তি থাকার কারণ নেই। তাই ২০১২ সালে সরকার এটাকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তর করার পদক্ষেপ নিয়েছিল। তারপর প্রস্তাবিত আইনে মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কৌশলগুলো বেশ সমালোচনা হয়েছে। সে পরিক্রমায় পাঁচ বছর আগে তৈরি খসড়া আজ পর্যন্ত আইনে পরিণত হয়নি। এখানে অবশ্যই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতিতে উচ্চশিক্ষা কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। আইনটি প্রণীত হলে কমিশন আকারে ইউজিসি হয়তো কার্যকরী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পাবে। তবে কমিশনের চেয়ারম্যানকে মন্ত্রী কিংবা সদস্যদের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়েই যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক হিসেবে দাঁড় করানো সম্ভব হবে, সেটা বলা যাবে না। ইতিপূর্বে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান কতটা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দেখাতে পেরেছেন? কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে প্রত্যেক উপাচার্যের অল্পবিস্তর স্বাতন্ত্রতা থাকে। জ্ঞান সৃজন ও রাজনৈতিক পুঁজি- এই দুই পরিবর্তনের সংমিশ্রণে ভিন্নতা থেকেই অনন্য প্রশাসনিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। গুণমানের উত্তরণকল্পে হলেও পরিবর্তনকালে ইউজিসিকে মনে রাখতে হবে যে, প্রায় নিয়ন্ত্রণ অনুপস্থিত সংস্কৃতি থেকে অতি দ্রুত পূর্ণ নিয়ন্ত্রক হওয়া সহজ হবে না।
ইউজিসি বর্তমানে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা চালু করতে কাজ করছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমসিকিউ পদ্ধতিতে আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। ভর্তি কার্যক্রম বিদেশেও আলাদা দেখেছি। নতুন পদ্ধতিতে মেডিকেল কলেজগুলোর মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাধারণ, কৃষি, প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি আলাদা গুচ্ছ ধরে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু করার লক্ষ্যে ইউজিসি চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠকে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি ও আচার্য মহোদয়ও আহ্বান করেছেন। আর্থিকভাবে অসচ্ছল ভর্তিচ্ছুদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণজনিত ব্যয় ও শ্রম হ্রাসের যুক্তিতে প্রক্রিয়াটি অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। তবে মেডিকেল কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল পার্থক্যটা হলো, মেডিকেলের বিষয় নয় শুধু কলেজ নির্বাচন করতে হয়। আর পঠিতব্য বিষয়ের গুরুত্ব ও বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে শিক্ষামানের বিষমসত্ততার মধ্যে নির্বাচনে সঠিক কারিগরি প্রক্রিয়া নির্ধারণে শঙ্কা থাকছে। বাজারে বিষমসত্ততার নানারূপ তথ্য থাকলেও নির্দেশনা দেওয়ার মতো আমাদের কোনো র‌্যাংকিং আছে কি? অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণে কারিগরি জটিলতার চেয়ে অধিক শঙ্কার জায়গা হবে প্রশ্ন ফাঁস। কয়েক বছরে সমালোচনার শীর্ষে আছে পাবলিক পরীক্ষার সব পর্যায়ে প্রশ্ন ফাঁস। এবার তো এসএসসি পরীক্ষার সব প্রশ্নই ফাঁস হয়েছে! তার সঙ্গে মেডিকেলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের খবরও আছে। ভর্তির প্রশ্ন ফাঁসে ব্যাপকতা কম হলেও এ কাজে আর্থিক প্রণোদনা অতি বেশি থাকায় প্রবণতা বাড়ছে। কোনো ছাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া মানে মাসসম্মত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য অতিরিক্ত আট-দশ লাখ টাকার খরচ বেঁচে যাওয়া। সেই সঙ্গে শিক্ষামানের পার্থক্যের প্রসঙ্গও যুক্ত হবে। তাই ফাঁস প্রশ্নের চাহিদা এতই বেশি যে, কেউ দু-চার লাখ খরচ করেও লাভ থাকে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন ফাঁস এখনও বিচ্ছিন্ন ঘটনার পর্যায়ে রয়েছে বলে আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ বহুলাংশে থাকছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বচ্ছভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণে সচেষ্ট আছে। কিন্তু গুচ্ছ পদ্ধতিতে প্রশ্ন ফাঁস হলে অসচ্ছল পরীক্ষার্থীদের সহজ অংশগ্রহণ ও খরচ বাঁচানোর লাভের চেয়ে ক্ষতিটা কি অতুলনীয় হবে না? দেশে সার্বিক প্রশ্ন ফাঁস দমনে কুচক্রী মহলের ওপর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না আসা পর্যন্ত গুচ্ছ পদ্ধতির প্রক্রিয়া থেকে সরে আসাটাই সমীচীন হবে বলে মনে হয়। ভাবতে হবে, স্থানীয়ভাবে প্রশ্ন পেয়ে বিত্তবান ও বখাটেদের নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সুযোগ বাড়বে কিনা? আর কুচক্রী মহল প্রশ্ন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাধারণ ব্রেন্ডিং কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? অন্যদিকে অভিন্ন পরীক্ষা গ্রহণ কার নেতৃত্বে কীভাবে হবে ঠিক করাটাও কঠিন হবে। ইউজিসির যেহেতু এমন পরীক্ষা গ্রহণে পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তাই নেতৃত্ব নিলেও সহজে বাস্তবায়ন করতে পারবে কি? ইউজিসির কার্যাবলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে গণমানুষ এখনও প্রতিষ্ঠানটির ব্যর্থতা সম্পর্কে অবহিত নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক্রমে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের মতো ইউজিসির অবস্থান তলানিতে নামুক, সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই ভর্তি কার্যক্রমে নয় বরং উচ্চশিক্ষায় গতিশীলতা আনয়নে ইউজিসির আশু সফলতা বেশি কাঙ্ক্ষিত। ইতিমধ্যে প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদে সেরা ফলাফল অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রচলন করে ইউজিসি প্রশংসিত হয়েছে। স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর প্রবণতা রোধকরণ হতে পারে আরেকটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এদিকে ইউজিসিকে কমিশন বানাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগে পদ সৃষ্টি, যোগ্যতা নির্ধারণ ও নিয়োগে মন্ত্রণালয় কর্তৃত্ব নিতে সচেষ্ট বলে অভিযোগ আছে। ইতিমধ্যে দেখা গেছে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি এবং শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতার পরও গ্রহণযোগ্য অভিন্ন নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি। সেটা যেভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, তাতে ইউজিসির নেতৃৃত্বের দুর্বলতা কি দৃশ্যমান হয়নি? ইউজিসি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে অসামঞ্জস্য দূর করতে চায়; তবে শুরুটা হতে পারে অভিন্ন ছুটির তালিকা প্রণয়ন দিয়ে। সেই সঙ্গে পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং করাটা অতি জরুরি বলে মনে হয়। খুশির খবর হলো, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালুর সময় প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে প্রেষণে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের আনার জন্য ইউজিসি তার বার্ষিক প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে। দেখার বিষয় হলো, সরকারি সাড়া কতটা মেলে। মুখে অনেকে উঁচুমানের গবেষণার কথা বললেও অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকল্পে উঁচুমানের প্রকাশনাধারীকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার তৎপরতা পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। তবু প্রত্যাশা করি, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্ঞানভিক্তিক সমাজ বিনির্মাণে ইউজিসি সফল হোক।
akanda_ai@hotmail.com
সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.