নবজাতকের কী দোষ? by মানসুরা হোসাইন
জন্মের
পরপর জীবন্ত নবজাতককে রাস্তায় বা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো
নবজাতক শিয়াল-কুকুরের খাবারে পরিণত হচ্ছে। কিছু নবজাতক অনাত্মীয় গুটি কয়েক
মানুষের দয়ায় পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জীবন্ত
নবজাতককে ফেলে দেওয়াই সব সমস্যার সমাধান কি না। নবজাতক ফেলে দেওয়ার পর,
তাকে মৃত বা জীবন্ত উদ্ধারের পর নবজাতকের অদৃশ্য জন্মদাত্রী মা নিজের বুকের
ধন কীভাবে রাস্তায় ফেলে দিলেন, তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়। বাংলাদেশ শিশু
অধিকার ফোরামের শিশু অধিকার পরিস্থিতি ২০১৭ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর
রাস্তা/ডাস্টবিন বা ঝোপ থেকে অজ্ঞাতপরিচয়ের ১৭টি নবজাতক কুড়িয়ে পাওয়া যায়।
২০১৬ সালে ফেলে দেওয়া বা কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতকের সংখ্যাটি ছিল ৯। অর্থাৎ এ
সময়ে এ ধরনের ঘটনা বাড়ে ৮৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এ ছাড়া গত বছর অজ্ঞাতপরিচয়ের
২৪ শিশুর লাশ পাওয়া যায়, যার ৯৯ শতাংশই ছিল নবজাতক (জন্মের পর ২৮ দিন বয়স
পর্যন্ত)। নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই
বিয়েবহির্ভূত অনেক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। ফলে এই
নবজাতকদের জন্ম যেমন বেড়ে গেছে, তেমনি বেড়ে গেছে জীবন্ত নবজাতককে ফেলে দিয়ে
সব দায় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ঘটনা। এতে করে নবজাতকের জন্মদাতা বাবা-মা
হয়তো নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, কিন্তু ফেলে দেওয়া নবজাতকের কপালে কী ঘটছে?
মাত্র এক দিন আগে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ
অনুযায়ী, ফরিদপুরে একটি কাগজের কার্টনের ভেতর থেকে এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার
করে পুলিশ। পরে লাশটি আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে শহরের আলীপুর পৌর
গোরস্থানে দাফন করা হয়। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারির রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট
থানা-পুলিশ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নে রাস্তার পাশ থেকে ওষুধের কাগজের কার্টন
থেকে এক মৃত নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে। তারও লাশ দাফন হয় বেওয়ারিশ লাশ
হিসেবে। এ ধরনের খবর দেখলেই মনে প্রশ্ন জাগে, কী দোষ ছিল এ নবজাতকের? আর
প্রথম আলো বা বিভিন্ন গণমাধ্যমে কয়টি ঘটনাই বা প্রকাশ পায়, তাও একটি
প্রশ্ন। চলতি বছরেরই ১০ ফেব্রুয়ারি। ঢাকার আশুলিয়ায় এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার
করে পুলিশ। নবীনগর-কালিয়াকৈর সড়কের পাশে পলাশবাড়ী এলাকায় একটি ডাস্টবিন
থেকে এই নবজাতকের লাশ তুলে নিয়ে তা কুকুরে খাচ্ছিল। চলতি বছরের গত ১৫
জানুয়ারির ঘটনাটি ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। গাড়ি থামিয়ে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের ফটকের অদূরে পলিথিনে মোড়ানো কিছু একটা
ফেলে যান এক তরুণী। পুলিশ ভাষ্য অনুযায়ী, ফেলে যাওয়া ভ্রূণটি চার-পাঁচ
মাসের হতে পারে। যাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন: কোনো কোনো নবজাতক সৌভাগ্য
নিয়ে পৃথিবীতে আসে। ফাইজা তেমনই একজন। ২০১৫ সালে কুকুরের কামড় থেকে বেঁচে
যাওয়া নবজাতকটির নাম ফাইজা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তার এ নাম দেয়।
যার অর্থ বিজয়িনী। হাসপাতাল থেকে ও যায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছোটমণি নিবাসে।
এখন আছে আইনগত বাবা-মায়ের কাছে। পূর্ব শেওড়াপাড়ার পুরোনো
বিমানবন্দরসংলগ্ন একটি মাঠে সিমেন্টের বস্তায় ভরে ফেলে গিয়েছিল ফাইজাকে।
কুকুরের দল বস্তার ভেতর থেকে বের করে ঠোঁট ও নাকের বেশ খানিকটা অংশ খেয়ে
ফেলে। বাঁ হাতের দুটি আঙুলের ডগাও চলে যায় কুকুরের পেটে। কয়েকজন নারী ওকে
কুকুরের হাত থেকে উদ্ধার করেন। রাজধানীতে সরকারের ছোটমণি নিবাসের
উপতত্ত্বাবধায়ক জুবলি বেগম রানু প্রথম আলোকে জানালেন, আদালতের মাধ্যমে
ফাইজা এখন নতুন বাবা-মায়ের বাড়িতে আছে। বর্তমানে নিবাসে পাঁচ মাস বয়সী
আরেকটি মেয়ে নবজাতক আছে। জন্মের পর তাকেও রাজধানীর খিলগাঁওয়ে কেউ ডাস্টবিনে
ফেলে যায়। বিড়াল ঘুরঘুর করে চারপাশে। কান্নার শব্দ পেয়ে এলাকাবাসী ওকে
উদ্ধার করে। গত নভেম্বরে জুবলি বেগম নিবাসটিতে উপতত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব
নেন। এ পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী ছয়জনকে (একসময় রাস্তায় ফেলে দেওয়া নবজাতক)
আদালতের মাধ্যমে আইনগত অভিভাবকের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন বলে জানালেন। গত
২৩ ফেব্রুয়ারি ঘটা করে উদ্যাপিত হলো কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায়
অহনা আমির নিঝুমের জন্মদিন। ময়লার স্তূপ থেকে উদ্ধার করতে আর একটু দেরি
হলেই ওর ছোট্ট দেহটি চলে যেত শিয়ালের পেটে। এখন ওর বাবা-মা নিঃসন্তান
দম্পতি মো. আমির উদ্দিন ও সাবরিনা আক্তার। মেয়ের জন্মদিনে তাঁরা নিমন্ত্রণ
করেছিলেন স্থানীয় সাংসদ (পাকুন্দিয়া-কটিয়াদী আসন) মো. সোহরাব উদ্দিনসহ
৭০০ অতিথিকে। গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাকে উদ্ধার করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি
পাকুন্দিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের
চিকিৎসক ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মিলে নিঃসন্তান দম্পতি আমির ও
সাবরিনার কাছে অহনাকে তুলে দিয়েছিলেন। ঘটনাটি ছিল ২০১০ সালের ৪
ফেব্রুয়ারির। ডাস্টবিনের পাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপের মধ্যে খবরের কাগজ
দিয়ে মোড়ানো নবজাতকটির সারা শরীরে ময়লা, দগদগে ঘা ছিল।
প্রস্রাব-পায়খানা দিয়ে শরীর মাখামাখি। ওই নবজাতকের বয়স এখন আট বছর। ওর
নাম ঐশ্বর্য। ঐশ্বর্য এখনো আলো ছড়াচ্ছে। অথচ পুলিশ প্রথমে জানিয়েছিল,
নেওয়া চলবে না। এ কথা শুনে শওকত আরা ফিরে যেতে চান। তখন সেই পুলিশই আবার
পেছন থেকে ডাকেন। বলেন, ‘আপনি নিলে তবু তো ও বাঁচবে।’ তারপর শওকত আরা
থানায় মুচলেকা দিয়ে নবজাতককে নেন। পালক পিতা ফজলুল বাসেত খান বললেন,
‘নবজাতক উদ্ধারের পর বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত খবরে আমরা আমাদের টেলিফোন
নম্বর দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত ফেলে যাওয়া নবজাতকের বাবা-মা পরিচয়
দিয়ে কেউ নিতে আসেনি। আমাদের মেয়ে ঐশ্বর্য এখন স্কুলে যাচ্ছে। ও ভালো
আছে। মেয়ে আর একটু বড় হলে আমরা ওকে জানাব ওর জীবনের ইতিহাস।’ ছোটমণি
নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক জুবলি বেগম রানু বলেন, ‘নিঃসন্তান দম্পতিরা আইনগত
অভিভাবকত্ব নিতে হন্যে হয়ে আমার প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিচ্ছেন প্রতিদিন।
অন্যদিকে, কেউ না কেউ সদ্য জন্ম নেওয়া নিজের সন্তানকে কুকুর-বিড়ালের
সামনে ফেলে যাচ্ছেন। প্রথমেই মনে হয়, আহা, নবজাতকটির তো কোনো দোষ ছিল
না।’
মানসুরা হুসাইন: সাংবাদিক।
মানসুরা হুসাইন: সাংবাদিক।
No comments